জ্বলদর্চি

বাগদি চরিত (৩ য় পর্ব) /শ্রীজিৎ জানা

বাগদি চরিত (৩ য় পর্ব)

শ্রীজিৎ জানা


বটু গুনীনের এভাবে মৃত্যু  সকলকে আশ্চর্য করে। কত কথা চারদিকে ঘুরপাক খেতে থাকে,
---বটু গুনীনের নিশ্চই কুথাও খুঁট হইছিল। নইলে সপ্পাঘাত হয়? তাও আবার মনসার থানে!ভরখর পূজার সময়!
---উসব লোক ঠকানা দু'নম্বরী বিদ্দা! বেশি দিন চলবেননি বুজলু। মা যা দেখানার দেখাবেই
---লোক ঠকানা আবার কি? সাপে কাটা মরা রুগীকে পজ্যন্ত বাঁচি দিছে। অমন নেমখারামি কথা বলিসিনি।
----তা বাঁচিছে মিথ্যা লয়। তবে অনেকের কাছ থেকে ভুজুংভাজুং দিয়ে কম টাকাকড়ি হাতায নি,বজলু!
----যাক, এবার ম্যানেজারের কপাল খুলে গেল।
----বটু গুনীনের নামটা যদি খুদা ধরে রাখতে পারে ত আর কথা নাই। অকে ত বটু গুনীন সব বিদ্যাই শিখি দিয়ে গ্যাছে।
সেই শুরু। ক্ষুদিরামকে তার নিজের নামে কেউ চেনে না।খুদা মাল বলেও ডাকা সব ভুলে যায়। সবার কাছে তখন থেকেই সে ম্যানেজার। দূর দূরান্তের লোক ঢোলের ম্যানেজারের কাছে আসে। সাপে কাটা হোক আর ভূতে ধরা সব বটু গুনীনের সাগরেদ খুদা ম্যানেজারের কাছে হাজির হয়। প্রথম দিকে খুদা বটু গুনীনের মনসার থানে বসে ঝাড়ফুঁক করত। জড়িবুটি দিত। মাদুলি বাঁধত। ভূত ছাড়াত। ওস্তাদের রীতিনীতি প্রথম দিকে ভাঙতে চায় না সে । কোন টাকাকড়ি নেয় না। যেটুকু প্রণামী মা'র থানে পড়ে তার অর্ধেক ওস্তাদের পরিবারকে দেয়। বাকিটা ঘরে আনে।
বেঁকে বসে খুদার বউ সাগরী। ষাঁড়া হাঁসের মতো সাগরীর ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলা। রেগে গেলে তার গলার সব শিরা ফুলে ওঠে। খুদা সাগরীকে ভয় পায়। ভয়ের অনেক কারণ আছে। খুদা আর সব ভাইদের মতোই বাঁটকুল। সাগরী তারচে হাত খানেক লম্বা। ভারী পাছা দুলিয়ে সাগরী হাঁসের মতোই হাঁটে। রঙ তার মাগুরমাছের মতো।মুখের গড়ন খারাপ বলা যাবে না। শুধু চোখের চাউনির জন্য মনে হয় সাগরী সবসময় রেগে আছে। পাড়ায় ছোঁকছোঁকানি স্বভাব অনেকেরই । সাগরীকেও লোভ করে অনেকে। বুকের উপরে,পাছার উপরে অনেকের চোখ গুয়া মাছির মতো চিটে বসে থাকে। তবে সাগরীর সামনে দাঁড়াতে সাহস হয় না কারো। 
খুদাকে অনেক বেগ পেতে হয়। ওস্তাদের কাছে খুদা সব শুনেছে। হাতেনাতে শিখেছে। বটু গুনীন স্বামী-স্ত্রীর বনিবনা না হলে শিকড় বাঁধত। কখনো স্বামীকে আলাদা ডাকত। স্ত্রীকে আলাদা। কতরকম জ্ঞানের কথা বলত তার ওস্তাদ।
---মেইয়ারা হল পকিতির জাত। পকিতিকে কেউ আজ ওব্দি হারাতে  পারে নি। অদেরকে কায়দা করে বশ কত্তে হয়।
খুদা শিকড় কাটতে কাটতে শুনত সব। অবাক হোত মনে মনে।
--- তেমন ত পড়া লিখা জানে নি ওস্তাদ! কেমন করে যে এতসব শিখল কে জানে?
কখনো স্ত্রীকে বোঝাত কিভাবে স্বামীকে নিয়ে চলতে হয়।
---বুইলি বেটি,ছ্যানারা হল ঢ্যামনা সাপের জাত। সহজে বগ্গ মানবেনি। কিন্তু যেদি কায়দা জানু ত একেবারে কেঁচা হয়ে তোর গায়ে লেপ্টি থাকবে। অরা বেশি বাইর চোথা। কথায় বলে শুনুনু? ঘরের পিঠা বড্ড তিতা/পরের পিঠা বড্ড মিঠা। শুদু চোখের লেলচামি। তুও ছাড়বিনি বেটি। অরো যা তোরো তা আছে। আনাজপাতি  ঝালমশলা সব এক। শুদু রাঁদার কায়দা জানতে হবে। থাইলেই দেখবি তোর জিনিস তোর হাতের মুঠায়।
সাগরীর সঙ্গে খুদার বিয়ে হয় হঠাৎ করেই। ডগরা পাড়ার পুনির মা সমন্ধ নিযে আসে খুদার বাপের কাছে। খুদা তখন বটু গুনীনের ঘরেই থাকে। সাগরেদি করার ফাঁকে বাপের জল-কালা জমিতে খাটাখাটি করে। পুনির মায়ের মুখে কথা শুনেই খুদার বাপ কথা দিয়ে দ্যায়। খুদার গুনীনী করা তার বাপ পছন্দ করত না কিছুতেই। দিন দুবেলা বাপে বেটায় খিটিচিমটি লেগেই থাকত। খুদার বাপের যত রাগ গিয়ে পড়ত খুদার মায়ের উপর।
---তোর লাই পেয়ে উটা অমন হইছে। কি খ্যানে জন্ম দিইলম। হারামিটা জালের ছেঁড়া, পোলের গড়া। আগে কাঁধে জুয়াল দিই,তাপরে বুজবি কত ধানে কত চাল।
সুয়োগটা তাই হাতছাড়া করতে চায় না কিছুতেই। যেদিন কথা হল,তার পরের দিনই খুদাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। ধরা চটকার বিয়ে। খুদা বাপের মুখের উপর কিছু বলতে পারে না। সাগরীকে ছাদনা তলায় প্রথম দেখে মনে মনে খুশিই হয়।


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



পরদিন বটু গুনীন খুদাকে তলব করে। বেশ কয়েকটা মাদুলি বানাতে হবে। খুদা মনে মনে গরগর করে। তবে মুখে কিছু না বলে ঘাড় নুইয়ে মাদুলিতে শিকড় ভরে। তারপর একমুখ মোম দিয়ে আটকে দেয়। সামনেই বসে বেলপাতায় সিঁদুর দিয়ে মা মনসার নাম লিখছিল বটু গুনীন। একইসাথে খুদাকে যে কথাগুলো বলেছিল তার মধ্যে রসিকতা ছিল। শিক্ষাও ছিল যথেষ্ট।
---- তোর ত সাপে বর হোলো রে খুদা। বাপ তোর ঘাড়ে জুয়াল চাপাতে চেয়েছিল কিন্তু সেই জুয়াল তোকে হযত খাটাবে বেশি,তবে সুখও দিবে।
কথা শুনে খুদার মুখ লজ্জায ঢলঢল করে। চোখে মুখে পিটপিটানি হাসি উথলায়। ওস্তাদ তাকে আরো শিক্ষা দেয়।
-----মেইয়ারা লদী। ছ্যানারা লৌকা। বাগে পেলে  ওই লদী লৌকাকে পুরা পেটে পুরে লিবে। মেইয়া -লদীর স্রোত সারাখন উজান দিকে বয়। হাল শক্ত করে ধরে রাখবি। আর দাঁড় বাইবি। দাঁড় যেদি দুব্বল হয় তবে তোর ডুবে মরা নিশ্চিত। লদী তখন বাঁধ ভেঙে যার তার লৌকা তলায় ঢেউ খেলবে ,বুইলু?
কথা গুলো খুদার মনে গেঁথে যায়। প্রথম রাতেই খুদা বুঝিয়ে দ্যায় গ্যাড়া বলে সাগরী যেন বেশি না লাফায়। তার ভিতরে একটা ময়ালসাপ পিড়ি পাকিয়ে বসে আছে। খিদা পেলে মেড়েমুড়ে সব গিলে নিবে। রাতবিরেতে যখন খিদাটা চাগাড় দেয়। সাগরী যখন গিলে খেতে আসে,খুদা ময়ালসাপের মতো দুহাতের ফাঁসে তাকে দুমড়ে মুচড়ে দেয়। ঘোর যুদ্ধ বাঁধে। ওস্তাদের কথাটা খুদার মাথায় ঘা মারে। হাল শক্ত করে ধরে রাখতে হবে। দাঁড় বাইতে হবে হরদম। লগি ঠেলে উজান ভেঙে এগোতে পারলেই সাগরী জব্দ। সাগরী চরম তৃপ্তি পেয়ে নিঃসাড়ে ঘুমিয়ে পড়ে। দুটো বাচ্চার মা সাগরী। চেহারা দেখে আন্দাজ করা মুশকিল। বাগ্দীর ঘরের পান্তাভাত আর গেঁড়ি কাঁকড়ার গুনে এমন শরীর হয়েছে যে সাগরীকে দেখলে অনেক পুরুষের মনে কত রকম ইচ্ছে হতে পারে। খুদা বড় ভাগ্যবান বলে পাড়ার অনেকেই আপশোস করে। বাগ্দী বউয়ের গতর। শিলাইয়ের বানের মতো কামের তোড়। খুদাকে প্রচণ্ড বেগ পেতে হয়। তবে যেদিন খুদার ময়ালসাপটা জলকেঁচার মতো লেপ্টি পড়ে থাকে,সেদিন সাগরী একটু কথায় খরিশ সাপের মতো গর্জন করে। ছেলেমেয়ে দুটার উপর তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে। খুদাও টিপনি ছাড়ে না। তেড়ে যায়, খজরা শালী, সব সময় খাইখাই। শরীরটাকে আর কত চুষবি? লাজলজ্জা কি তোর সব শিলাইয়ের জলে ধুয়া হয়ে গেছে?
সাগরী এবার যাবে কোথায়? ঘরে লঙ্কাকাণ্ড বাঁধিয়ে দেয়।
----তোর মুরাদ ত শুদু  বোটা গুনীনের ল্যাজ ধরে ঘুরা। সারাদিন অই শিকড় ছিঁড়েঠে না বাল ছিঁড়েঠে কে জানে?
খুদার মাথায় রক্ত উঠে যায়। হাতের কাছে যা পায় তা নিযে ছুটেকুঁদে আসে  সাগরী কাপড়ের আঁচলটাকে কোমরে বেচ দিয়ে গুঁজে নেয়। বঁটি হোক কাটারি হোক হাতে নিয়ে সেও তেড়ে আসে। দুজনের মুখের খিস্তির কাছে দুজনের হাতে ধরা হাতিয়ারও তখন লজ্জা পায়। মনে হয় বঁটি-কাটারির ধারের চেয়ে খুদা-সাগরীর গালিগালাজের ধার অনেক বেশি।

Post a Comment

0 Comments