জ্বলদর্চি

কবিতা লেখার আরেকরকম বিপদ /মলয় রায়চৌধুরী


আমার জীবনের ঘটনা-৫

কবিতা লেখার আরেকরকম বিপদ

মলয় রায়চৌধুরী


—আপনিই তো ওকে বলেছিলেন, ধ্যাড়ানির সময়ে করলে বিপদ নেই । বলেননি ? এই চিঠিটা দেখুন, শুধু দেখুন, ছোঁবেন না । এটা আপনার হাতের লেখা তো ?

.

ভাগ্যিস ধ্যাড়ানি শব্দটা ব্যবহার করেছে । মাসিক বা মেন্স বললে বিহারি কর্মচারীগুলো টের পেয়ে যেতো। 

.

অরিন্দম অবশ্য টের পেয়েছে ; মাথা নামিয়ে কলম হাতে ব্যস্ত থাকার অভিনয় করছে । পাগল হয়ে কয়েকমাস লুম্বিনী পার্কে ভর্তি ছিল । পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশি ট্যুরে গেলে তার বউকে চটকাবার জন্য লাঞ্চের সময়ে বাড়ি যাচ্ছি বলে কেটে পড়ত অরিন্দম । ওকেও ধ্যাড়ানির আইডিয়াটা দিয়েছিলুম, কিন্তু বউটা অতোটা এগোতে দেয়নি ; বলেছিল, “শুধু ওপর-ওপর বোলাও” । ব্যাস পাগল হয়ে গেল। অফিসের নারী-নারকোটিক গ্যাঙ ওকে বলেছিল, “আরে অন্যের বউকে ছেড়ে আমাদের দলে এসো, ফি-হপ্তায় নতুন মাল।” 

যায়নি । প্রেমে ফেঁসে হালুয়া টাইট ।

.

চিঠিটা ছোঁ মেরে কেড়ে নেবার তালে ছিলুম, বুঝতে পেরে ভাঁজ করে বাঁ হাতে পাট করে রাখলো আলেয়া। বলল, “এটা আপনার মা-বাবাকে দেখাবো, ওনারা বিশ্বাস করবেন যে চিঠিটা আপনি আমাকে লিখেছেন, কেননা আপনার বিখ্যাত কবিতায় আমার নামও আছে । আপনার কবিতা ফটোকপি করে আপনার বন্ধু বিলি করেছিল অফিসে । সবাই পড়েছে।”

.

বাঞ্চোৎ নিশীথ ! আমি কলকাতায় মামলা লড়ছি, রাস্তায় ফ্যা ফ্যা করছি । রাতে মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজছি আর ও ব্যাটা আমার কবিতাটা যোগাড় করে ফটোকপি করে বিলিয়েছে । অফিসেই ফটোকপির মেশিন রয়েছে, তাই যতো ইচ্ছে কপি করে বাঙালি কর্মচারীদের মধ্যে বিলি করেছে । আর আমি ফিরে কাজে যোগ দিতেই আমাকে দিয়ে প্রেমিকাকে প্রেমপত্র লিখিয়েছে । আলেয়ার চিঠিটা আট পাতার ; একই সঙ্গে আত্মহত্যার হুমকি আর বিয়ে করার কাঁদো-কাঁদো প্রস্তাব ।

.

নিজের নিঃশব্দ সংলাপ গিলে ফেলি : “ইডিয়টটা আমার চিঠিটা কপি করার বদলে অরিজিনালটায় সই করে পাঠিয়ে দিয়েছে ; হিন্দি স্কুলে পড়ে দু’পাতা বাংলা লেখাও কপি করতে পারেনি । বলেছিলুম, কপি করে আমার চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলে দিও ।”

.

—আপনি আমাকে বিয়ে করুন । সক্কোলে বিশ্বাস করবে এই প্রেমপত্রটা আপনিই আমাকে লিখেছেন। আপনার বাবা-মা পাত্রী খুঁজছেন তো ? আমিই পাত্রী ।

.

বলে কী মেয়েটা !

.

—আপনি নিশীথের চেয়ে হাজারগুণ ভালো পাত্র । নিজেদের বাড়ি আছে । মাইনেও অনেক পান। আমাদের পরিবারের মতন আপনিও ঘটি । শুনেছি সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের বংশধর ।

.

কন্ঠস্বরে ভারিক্কি অফিসারগিরি এনে বললুম, “দ্যাখো আলেয়া, এটা তোমার আর নিশীথের ব্যাপার, আমাকে অযথা টেনে আনছো এর মধ্যে । হাতের লেখা আমার, স্বীকার করছি, কিন্তু চিঠিটা নিশীথ লিখেছে তোমাকে, তোমার আটপাতা চিঠির উত্তরে । ও তো বলেইছে যে তোমাকে বিয়ে করবে। তোমাদের বাড়িতে যাবেন ওর বাবা-মা।”

.

নিশীথ ব্যাটা সত্যিই কালো । বাংলা-হিন্দি মিশিয়ে কথা বলে । ভাড়া বাড়িতে থাকে ।

.

—-না, আমি আপনাকেই বিয়ে করব । আপনার কবিতায় আমার নাম আছে । সেই আলেয়া কে তা আমার জানার দরকার নেই । আমি শিয়োর, আপনার বাবা-মা সেই আলেয়াকে চেনেন না, কিন্তু আমাকে চিনবেন । আমি আপনার অধস্তন কর্মচারী । ওনারা মেনে নেবেন যে আপনি আমাকে এক্সপ্লয়েট করেছেন ।

.

ওফ, ভাগ্যিস সেক্সুয়ালি এক্সপ্লয়েট করেছেন বলেনি । সবকটা বিহারী কর্মচারী আমাদের কথাবার্তা টের পেতে চাইছে ।

.

—আপনিই তো লিখেছেন, “অথচ আমি চেয়েছিলুম আলেয়ার নতুন জবার মতো যোনির সুস্থতা” । কী ? লেখেননি ? আপনার পুরো কবিতাটা আমার মুখস্হ । শুধু আমার কেন, অনেকেরই মুখস্হ । এখন আপনিই ঠিক করুন কী করবেন ।

.

অরিন্দম উঠে বাইরে চলে গেল । ভালো হলো । 

.

একটু পরে ফিরে এলো অরিন্দম ; সঙ্গে নিশীথ ।

.

আলেয়ার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো নিশীথ, “আরে কী করছ কি ! মলয়দাকে ভড়কি দিচ্ছ কেন ? তুমি তো জানো আমি ভালোভাবে বাংলা লিখতে পারি না । 

মলয়দাকে দিয়ে তোমার চিঠির উত্তর লিখিয়েছিলুম ।

.

আলেয়ার হাত থেকে চিঠিটা কেড়ে নিয়ে আমাকে দিয়ে নিশীথ বলল, “নাও, নাও, আবার কোন বিপদে পড়বে।”

.

চিঠিটা নিয়ে ছিঁড়ে ফেলে দিলুম ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে ।

.

আলেয়ার হাত ধরে ডিপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে গেল নিশীথ ।

.

পেছন ফিরে আলেয়ার হাসি মনে আছে আজও ।

.

নারীর হাসিও আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারে । 

.

একটা কবিতা লেখার কতোরকমের যে প্রতিক্রিয়া হতে পারে তা কবিরা নিজেরাই জানে না !



জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇




Post a Comment

0 Comments