জ্বলদর্চি

বাগদিচরিত (দ্বিতীয় পর্ব) /শ্রীজিৎ জানা

বাগদিচরিত (দ্বিতীয় পর্ব)

শ্রীজিৎ জানা


লোখার বড়দা খুদা।ক্ষুদিরাম মাল। বটু ডগরার সাগরেদি করত। নামকরা গুনীন ছিল বটকৃষ্ণ ডগরা। দূরদূরান্ত থেকে লোক আসত তার কাছে। খেজুরনালার পাশে ডগরাদের উঁচু ভিটা। তা প্রায় পঁচিশটার মত পৈঠা ভেঙে উঠতে হয়  ভিটায়। বটু গুনীনের মনসা মন্দির ভিটার মুখেই। চারচালা মাটির মনসার থান। পাশে এক পদিকার মত জায়গা জুড়ে সিজ মনসার গাছ। পাতায়,ডালে,গোড়ায় সিঁদুর মাখিয়ে রাঙিয়ে দিয়েছে ভক্তরা। আশ্বিনের সংক্রান্তিতে বটু গুনীনের মনসার থানে জমাটি পুজো হয়। গুণীনের পুজো বলে কথা। ভাল হওয়া সাপকাটি রুগীর ঘরের লোক,  ভাল হওয়া জন্ডিস রুগীর ঘরের লোক,আশেপাশের গ্রাম থেকে আসা মা মনসার ব্রতী  সবেমিলে সারারাত দেবীর থান গিজগিজ করে লোকে।বটু গুনীন সেদিন তান্ত্রিকের মত বেশ ধারণ করে। লাল রঙের ধূতি,গেঞ্জি আর উড়নায় যেন রক্তজবার মতো লালে দাউদাউ করে। কপালে লাল তিলক।গলায় কাঁচপুঁতি ও রুদ্রাক্ষমালা। আর মাঝে মাঝেই চিৎকার করে বলে উঠে
--জয় মা মনসা!জয় মা কালনাগিনী ! অধম ব্যাটাকে তুই ক্ষমা করবি মা গো। তোর ভক্তদের একটু যেন দেখু, মা।
বটু গুনীনের সাপে কাটা রুগী বেশি। দিন হোক আর গভীর রাত, রুগী একবার বটু গুনীনের হাতে পড়লেই সবাই জানে যমকেও ফিরে যেতে হবে যমালয়ে। মুখে মুখে এমন কথাই ফেরি হয়। সব সাপের স্বভাব চরিত্তি বটু গুনীনের নখ দর্পণে। দাঁতের দাগ দেখেই সে বলে দিতে পারে, কোন সাপে রুগীকে কেটেছে। তারপর শুরু তার চিকিৎসা। প্রথমে মন্দিরে মাথা ঠুকিয়ে দুয়ারে বসাবে রুগীকে। সেদিকে খুদা লালগঁদ আর তুলসীপাতা তুলে শিলে বাটা শুরু করে দেবে। সাথে দু'চার ধরণের শিকড়বাকড়। রুগীকে কিছুক্ষণ ছাড়া ছাড়াই গঁদ-তুলসীর রস খাওয়ানো চলবে। রুগীর বাড়ির লোকের কাছে বটু গুনীনের এই বখাল এক্কেবারে অব্যর্থ। যাকে বলে বিশল্যকরণী। আর সেইসাথে বটু গুনীন চালু করবে তার চাপড়সার ওঝাগিরি। দ্রুত লয়ে  আউড়াতে থাকবে সাপের বিষ নামানোর মন্ত্র। থুরু বুরু বিষ/থুরু বুরু খাস/থুরু বুরু খাইয়া বিষ/ বশ্য হইয়া যাস/ দোহাই মা পদ্যা/দোহাই মা পদ্যা/দোহাই ঈশ্বরী করণী/ দোহাই মোনাইশা দেবী। এই এক কলি মন্ত্র বলেই চটাস্ করে এক চাপড় বসিয়ে দেবে সাপে কাটার স্থানে। মন্ত্র আর এই চাপড়ের জোরেই সাপের বিষের বিষক্রিয়া নষ্ট হয়।খুদা পাশে দাঁড়িয়ে বটুর হুকুম তামিল করে। কোনকিছু চাইবার মাত্রই চরকির মতো চোঁচা মেরে দৌড় লাগায়। এই সময় দরকারি সব কথা খুদাকে বলা-ই নিয়ম। রুগীর বাড়ির লোকজন খুদাকে বলে ম্যানেজার। সেই শুরু। খুদাকে সকলে ম্যানেজার নামেই চেনে। তারপর একদিন হঠাৎ মারা যায় বটু গুনীন। সেদিনের কথা মনে হলে খুদা ভয়ে ভক্তিতে শিউরে উঠে।

বটকৃষ্ণ ডগরা ঢোলের নামকরা গুনীন। ক্ষুদিরাম তার সাগরেদ। আশ্বিনের সংক্রান্তিতে হয় ওস্তাদি পূজা। পয়লাতে হয় গুনীনী পূজা। বটু ডগরার পূজা কার্তিকের পয়লাতে। বটুর মনসার থানে প্রতিবছরের মতো সেবার ভিড়ে ভিড়াক্কার। বটু ডগরা নামকরা ওঝা বলে নয়,তার মা মনসার থান খু্বই জাগ্রত। কামরূপ -কামাখ্যা ফেরত ঢোলে একবার এক গুনীন আসে। বটু তখন সবে বিয়ে করেছে। ডগরা পাড়ার মধ্যে কেন কে জানে তার বটুকে মনে ধরে। বটুকে তার সাগরেদ করে। সব বিদ্যাই একে একে শেখায় সে। তবে থেকেই গুনীনের কাজ করে বটু। প্রথম বিদ্যা শেখানোর দিনই বটুর গুরুদেব তাদের ভিটার মনসাতলায় মায়ের ঘট প্রতিষ্ঠা করে। বটু পরে ঝিটাবেড়ার মন্দির বানায়। ফিবছর ধূমধাম করে পূজা হয়। কতজন মানত শোধ করতে আসে। কারো মানত বিফলে যায় না। সব থেকে আশ্চর্যের বিষয় মায়ের মাথায় ফুল চাপানোর আগেই কোথা থেকে একটা গোখরো সাপ সেখানে হাজির হয় কেউ জানে না। বটু জানে সে হল সর্প রূপধারিণী  সাক্ষাৎ  মা মনসা।  ভক্তদের কাছে এই দৃশ্য দেখা পরম সৌভাগ্যের বলে মনে হয়। ভীড় ক্রমে বাড়তে থাকে বছর বছর। আগে এসব নিয়ে বটু গুনীনকে কম টিটকারি শুনতে হয় নি। বটু বলে,
----সাদে কী বলে বাগ্দী।  অদের জাত হিংসা বেশি। নিজের জাতের কারো ভাল অরা দেখবেনি কুনুদিন।
শুধু পাড়া প্রতিবেশি নয়, রথতলার মাহিষ্যরা আগে কত কথা শুনাত বটুকে।
----কী দিন এল কলির কালে। মা মনসা আর জাত পেলনি!শেষে বাগ্দীর হাতে ফুল-জল লিতে এল।
বটু কথাটা সহজে গায়ে মাখে না। 
----অমন করে বলনি, বুজেছ। পেটে মোরও দু'কলম বিদ্যা আছে। দেবদেবীরা জাত দেখেনি,মন দেখে। তমাদের মত জাল-জোচ্চুরির মন নয় বটু ডগরার।


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



সেবার পূজা চলছিল সাড়ম্বরে। বটু জোড় হাত করে মায়ের কাছে বসে। বামুন ঠাকুর জানায় এবার মায়ের মাথায় ফুল চাপানো হবে। সবাই গলবস্ত্র হয়ে মাথা ঠুকে প্রণাম সারে। প্রতিবারের মতো হিসহিস শব্দ করে সেই গোখরো সাপের আবির্ভাব হতেই শাঁখ,ঘন্টা,ঢাক,ঝাঁজ বাজতে থাকে। ব্রতীরা মা মা বলে জয়ধ্বনি দিতে শুরু করে। বটুর চোখ ছলছল করতে থাকে। সাষ্টাঙ্গে প্রণাম সেরে যেই না উঠবে,অম্নি গোখরো বটুর মাথায় ছোবল মারে। বামুন তড়াক করে লাফ দিয়ে সরে যায়। বটুর স্ত্রী  তক্ষুনি মূর্ছা যায়। খুদা পাশেই ছিল।  নিমিষে গুরু বটুকে ধরে বসাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু বটু বাধা দেয়। ব্রতীদের মধ্যে চিৎকার চেঁচামিচি শুরু হয়ে যায়। ভিড় থেকে কান্নার রোল ভেসে আসে। বটু ওই অবস্থায় সবাইকে স্বান্তনা দিয়ে বলে,
---তমরা ভয় পেওনি। ঠাকুর মশাই পূজা শুরু কর। খেপি আমার মাথায় তার আশীব্বাদ দিয়েছি। আমি মাথা পেতে লিলম।
----সে কি বোলছো গুরুদেব। আমি মন্ত্র পোড়বো। বখাল বেটে খাওয়াবো। তুমি অনুমতি দাও।
---না রে খুদা। দোষ করি আর নাই করি মায়ের ইচ্ছা পূর্ণ হোক, আমি চাই। তরা পূজা বন্ধ করিসিনি।
বলেই ঘরের দিকে হাঁটা দ্যায়। সকলে কত অনুনয় বিনয় করে। বটুর স্ত্রী ততক্ষণ উঠে পায়ে মাথা কুড়তে থাকে। কিন্তু বটুকে টলানো যায় না। ঘরের ভিতরে গিয়ে শুয়ে পড়ে। মাথার দিকে বসে থাকে তার স্ত্রী।  পা তলে বটুর দুই ছেলে,খুদা এবং আরো কয়েকজন। ভোরের দিকে মুখ দিয়ে গাঁজ উঠতে থাকে। কঁকিয়ে উঠে বটুর স্ত্রী, ছেলে,খুদা সকলে।  গোঙানির মতো একটা শব্দ করে হঠাৎ চুপ করে যায় বটু গুনীন। আর নড়েচড়ে না। কান্নার রোল আরো দ্বিগুণ হয়ে ভোরের বাতাসকে ভারী করে দ্যায়। সেদিকে পূজাও তখন শেষ।  অন্যবারের চেয়ে এবার যেন তক্ষুনি মা ফুল দিয়ে দ্যান। ব্রতীরা সকলে অবাক হয়। তারচেয়েও বিস্ময়ের হল সেই গোখরো ছোবল মারার পর থেকেই অদৃশ্য।    (ক্রমশ)

Post a Comment

1 Comments

  1. জাত লিখিয়ে, শুরুতেই কৌতুহল এর ছোবল ,বিষে জরজর পাঠককুল

    ReplyDelete