জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে -৬৬/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে

রোশেনারা খান

পর্ব ৬৬

আজ বেশ কয়েকদিন হল এদেশে এসেছি। একদিন মাঝরাতে ল্যান্ডফোনটা বেজে ওঠাতে ঘুম ভেঙ্গে যায়। ওদের ও আমাদের দুটি রুমে দুটি রিসিভার আছে। রিং  থেমে  যেতে বুঝলাম মেয়ে তুলেছে। তক্ষুনি ও আমাদের রুমে এসে বলল, মা  রাস্তার ওপাশের টার্কিশ ফ্যামিলির ভদ্রলোক খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। তাই ওনার মিসেস জানতে চাইছেন, আমরা বাচ্চা দুটিকে কিছু  সময় রাখি কি না। আমি দিয়ে যেতে বললাম। এদেশে বাইরে থেকে যারা এসেছেন তাঁরা সবসময়ই প্রয়োজনে পরস্পরের প্রতি হাত বাড়িয়ে দেন। বাচ্চা দুটি এসেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। ভোর ৫ টায় ওদের মা এসে নিয়ে যায়।
সেক্সপিয়রের রান্নাঘর


    গতকাল(৯জুলাই) বাবলিদের  এক বন্ধু দম্পতির বিবাহ বার্ষিকী ছিল।  দুজনেই কনসাল্টেন্ট। বিশাল আয়োজন। দেশ থেকে দুজনেরই বাবা মা এসেছেন। ভাই এসেছে আমেরিকা থেকে। আমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল দুজনেই। দেখে  ভাল লাগল। প্রচুর মানুষ এসেছেন। তার মধ্যে অর্ধেক ব্রিটিশ। বেশ কিছু ব্রিটিশ মহিলা শাড়ি, চুড়ি পরেছেন দেখে বেশ মজা লাগল। দেশি বিদেশি মিলে হিন্দি গানের সঙ্গে কী নাচটাই না নাচল সবাই। আমরা বুড়োবুড়িরা এক টেবিলে ছিলাম। এঁরা বেশির ভাগই আমার পরিচিত। ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেছল।

     নিনাদি ফোন করে নিজের অসহায়তার কথা বলছিলেন। সেদিনের পার্টির ব্যপারেও বলছিলেন। সামনের শুক্রবার ওনার চোখ অপারেশন হবে। কিন্তু দেখতে যাওয়ার উপায় নেই। তাই বললাম, তুমি প্রয়োজন মনে করলে  ফোন করবে, আমি যাব। এদেশে এই বয়সটাতে মানুষ খুব অসহায় হয়ে পড়েন।দেখে কষ্ট হয়।  


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



    বাবলিদের প্রতিবেশী অঞ্জুর ছেলে বার্থডে পার্টি  ছিল। আমাকে অনেক করে যেতে বলে গেলেও যাওয়া হয়নি।

আজ(২৩/০৬/১৬) বাবলি আর দীপ ভোট দিতে গেছল। এই ভোটের রেজাল্ট এক ঐতিহাসিক পরিবর্তন নিয়ে এল। গ্রেট ব্রিটেন ৫২% ভোটে জিতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে গেল। এবিষয়ে যেটুকু জানলাম, তা হল গ্রেট ব্রিটেন নিজেদের দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। আরও ভাল নাগরিক পরিসেবা দিতে চায়।
সেক্সপিয়রের লনের এক কোনে রবীন্দ্রনাথের মূর্তি।


    ২৪ জুন গন ভোটের রেজাল্ট প্রকাশিত হওয়ার পরেই প্রেসিডেন্ট ক্যামরুন পদত্যাগ করেন। ফলে তাঁর মন্ত্রীসভা ভেঙ্গে যায়। নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের জন্য আবার ভোট হবে। ক্যামরুন অক্টোবর পর্যন্ত তাঁর দায়িত্ব পালন করবেন। ক্যামরুনের এত তাড়াতাড়ি পদত্যাগ করার কারণ উনি ইউরপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিপক্ষে ছিলেন। এই পরিস্থিতিতে উনি ক্ষমতায় থাকলে ওনার সততা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। অপর দিকে লেবার পার্টির নেতার ওপর তাঁর দল পদত্যাগ করার জন্য চাপ দিচ্ছে। কারণ তাঁর অতি বামপন্থা মনোভাব। তিনি লেবার পার্টির ভোটে নেতা হলেও এম পি রা তাঁকে চাইছেন না। গ্রেট ব্রিটেনের, মানে ইংল্যান্ডের এই সিদ্ধান্ত ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন সহজভাবে নিতে পারছে না। তাই তারা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাওয়ার জন্য তাড়া দিচ্ছে। কিন্তু এই বেরিয়ে আসার জন্য নিয়ম অনুযায়ী আটিক্যাল ৫০ রুল চালু করতে হবে। এই রুল চালু করতে অন্তত তিনমাস সময় লাগবে। নতুন প্রধানমন্ত্রী হবেন যিনি তিনি এসে এই রুল চালু করবেন। তার পরেও এই বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ করতে বছর দুই সময় লাগবে।

      এদিকে ইংল্যান্ডে প্রতি মুহূর্তে  রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটছে। অর্থনৈতিক অবস্থাও টালমাটাল হয়ে উঠেছে। পাউণ্ডের মূল্য গত তিরিশ বছরের ইতিহাসে এতখানি কমেনি। বড় বড় কোম্পানি, ব্যাঙ্ক, ইংল্যান্ড ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবছে। ছোটখাটো অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটছে। পোল্যান্ডের এক মিলিয়ন লোক ইংল্যান্ডে বাস করেন। তাদের দোকানগুলিতে আক্রমণের চেষ্টা চালানো হয়েছে। জোর করে একটি বাচ্চার হাতে প্ল্যাকেট ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাতে ইংল্যান্ড ছেড়ে যাওয়ার কথা লেখা রয়েছে। ইংল্যান্ড বাসীদের একটি অংশ এই ভেবে চিন্তিত, ইংল্যান্ডের গুরুত্ব ও ক্ষমতা দুইই হ্রাস পাবে। দেশের নিরাপত্যা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়বে। ইংল্যান্ড একা হয়ে যাবে। এর আগে স্কটল্যান্ডে একবার গণভোট হয়াছিল গ্রেট ব্রিটেন থেকে বেরিয়ে আসার পক্ষে ও বিপক্ষে মতামত জানার জন্য। ইংল্যান্ডের সঙ্গে থাকার পক্ষে বেশি ভোট পড়ায় স্কটল্যান্ড বেরিয়ে আসতে পারেনি। এবার স্কটল্যান্ড ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পক্ষে ভোট দিয়ে হেরে গেছে। তাই ওরা আবার গণভোট চাইছে গ্রেট ব্রিটেন থেকে বেরিয়ে আসার জন্য।

      এবারের ভোটের রেজাল্টের ফলে, ইউরোপের রাজনীতিতে যে ঝড় উঠেছিল, তাতে গ্রেট ব্রিটেন ভেঙ্গে টুকরো হয়ে যাবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল।  সাউথ আয়ারল্যান্ড স্বাধীন। তারা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দলভুক্ত। এখন তাই অনেকে  ইংল্যান্ডে থেকে তাঁদের আইরিশ শিকড়ের সন্ধান করে আয়ারল্যান্ডের পাসপোর্টের জন্য লাইন দিয়েছে। যাতে গ্রেট ব্রিটেনে থেকেও আয়ারল্যান্ডের পাসপোর্ট থাকায় ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গেও সম্পর্ক রাখা যায়।এই সময় সাময়িকভাবে  সেয়ার বাজারেও ধস নেমেছিল। তবে যা যা ভেবে মানুষ আতঙ্কিত হয়েছিল, তেমনটা কিছুই ঘটেনি।

     ভোটের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেন টেরেসা মে। ওনার স্বামীর নাম ফিলিপ। অক্সফোর্ডে পড়ার সময় এঁদের দুজনের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন বেনজির  ভুট্টাো। ফিলিপ পেশায় একজন ব্যাঙ্কার। টেরেসা মের ১০০ টি রান্নার বই আছে। চিতার ছাপ দেওয়া জুতো তার খুব পছন্দ। বিভিন্ন ডিজাইনের জুতো তিনি পছন্দ করেন। টেরেসা মে পূর্বে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন।

            এখানকার মানুষ খুবই ভদ্র, সুসভ্য। পথেঘাটে দেখা হলে অপরিচিত হলেও হাই-হ্যালো করেন। সবসময় তা না হলেও হাসি বিনিময় করেন। আমাদের দেশে নিজের লোককেও সময় বিশেষে অনেকে চিনতে চান না। আজ সন্ধ্যায় হ্যানির  মেয়ে আলাপ করতে এসেছিলেন হাতে একগোছা ল্যাভেন্ডার নিয়ে। আমার যতটুকু দৌড় সেটুকু শেষ করে মেয়েকে ডেকে দিলাম।

     হঠাৎ করে এখানে খুব গরম পড়েছে। বাড়ির ভিতরে তাপমাত্রা ২৮ ডিগ্রি, বাইরে ৩৬ ডিগ্রি। সবকিছু এখন ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। ঠিক আমার জীবনটার মত। এই কয়েকদিন আগের ঘটনা সকালে একটু ব্যস্ততা থাকে, ওদের বেরনোর সময়।জারার কোনো কারণে ছুটি ছিল। দীপ আর বাবলি বের হবে। উনি সোফায়  বসে  ছানামুড়ি খাচ্ছিলেন, আমি অন্য দিকে বসে উল বুনছি। হঠাৎ দেখি উনি  অজ্ঞান হয়ে গেছেন। দীপ হাসপাতালে ফোন করতে, ওঁরা ঠিকানা জেনে নিয়ে  বাড়ির দরজা খুলে রাখতে বললেন। এ্যাম্বুলেন্সে যন্ত্রপাতি নিয়ে দুজন এসে প্রেসার মাপলেন, ইসিজি করলেন। তারপর বলেন, আমরা একবার নিয়ে যাব। দীপ আর বাবলি সঙ্গে গেল। দুপুরের পর ফিরল। এখন ঠিক আছেন। পরে জানলাম এটার কারন ওনার বুকে সামান্য ব্যথা হচ্ছিল। উনি কাউকে কিছু না জানিয়ে ‘সরবিট্রেট ৫’ জিভের তলায় রেখেছিলেন। সেটা মুড়ির সঙ্গে খাওয়া হয়ে গেছল।
এভন নদী

    এখানে অফিস, স্কুল শনি রবি দুদিন বন্ধ থাকে। ডাক্তারদের সবসময় তা থাকে না। অনেক সময় সারা সপ্তাহ ডিউটি থাকে। আজ শনিবার দীপের ছুটি আছে, তাই সবাই মিলে সেক্সপিয়রের জন্মস্থান স্ত্রাটফোরড(Stratford)যাওয়া হয়েছিল। প্রথমে দোতলা বাসে করে শহরটা ঘুরে দেখা হল। সেক্সপিয়রের মামাবাড়ি, শ্বশুরবাড়ি, জামাইবাড়ি, থিয়েটার হল, ওনার সমাধিস্থল আরও অনেক কিছু। এরপর আমরা টিকিট কেটে সেক্সপিয়রের বাড়ি দেখতে ঢুকলাম। বাড়িটি এখন মিউজিয়ম। ভিতরে ঢুকে সিঁড়ি দিয়ে উঠেই বেডরুমে পৌঁছে গেলাম।  পরিপাটি করে বিছানা পাতা রয়েছে। ভিতরে আরও একটি রুমে খাটের পাশে বেবিকট রয়েছে। খাট গুলো খুব বেঁটে। গাইড জানালেন, তখন হাঁটুমুড়ে শোওয়া হত। এখানে সেই রুমটিও দেখলাম, যেখানে সেক্সপিয়রের বাবা দস্তানা বানাতেন। সেখানেও সবকিছু সাজানো রয়েছে, রান্নাঘরে তৈজসপাতির সঙ্গে নকল মাছ, ডিম, মাংস রয়েছে, রয়েছে সেক্সপিয়রের চেয়ার টেবিল, আরও অনেক কিছু। বাড়িটি বহু পুরনো এবং কাঠের মেঝে হওয়ার কারনে কোথাও কোথাও মেঝে নষ্ট হয়ে গেছে। সেখানে পা রাখা বারণ। নিচে নেমে এসে দেখলাম লনের এক কোনে  রবীন্দ্রনাথের আবক্ষ একটি মূর্তি রয়েছে। এ সবকিছুরি ছবি তোলা হয়েছে। এরপর গিফটসপে টুকটাক কেনাকাটা করে চলে এলাম এভনের পাড়ে সেক্সপিয়রের বিশাল মূর্তির পাদদেশে। এখানে বসে সঙ্গে নিয়ে আসা খাবার খেয়ে, কফির কাপ হাতে নিয়ে মূর্তির চারপাশটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। চার কোনে চারটি মূর্তি রয়েছে, এগুলি সেক্সপিয়রের লেখা মহাকাব্যের চারটি চরিত্র। শেষে আমরা লঞ্চে চড়ে নানান দৃশ্য দেখতে দেখতে এভনের বুকে বেশ  কিছুক্ষণ ভেসে বেড়ালাম।

                              ক্রমশ

Post a Comment

1 Comments

  1. সুন্দর! খুব ভালো লাগছে।

    ReplyDelete