জ্বলদর্চি

প্রতিবেশী দেশ নেপালের লোক‌উৎসবের কিছু কথা /মৌমিতা চ্যাটার্জী

প্রতিবেশী দেশ নেপালের লোক‌উৎসবের কিছু কথা

মৌমিতা চ্যাটার্জী


হিন্দুধর্মের পূজাপার্বণ, উৎসব-ব্যসন বৈচিত্র্যময়। পৃথিবীর কোনায় কোনায় ছড়িয়ে থাকা হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ রীতিনীতি মেনে, অত্যন্ত আনন্দ ও নিষ্ঠার সঙ্গে উৎসব পালন করে থাকেন। বাংলাদেশের বারোমাসের তেরো পার্বণ সম্পর্কে তো আমরা সকলেই মোটামুটি জানি। আজ আমাদের প্রতিবেশী দেশ সম্পর্কে বরং কিছু জানা যাক। 
জানা যাক ধর্মের প্রতি তাদের নিষ্ঠার কথা।
আজ জানব নেপালের মানুষের পবিত্র আচার-‌উৎসব সম্পর্কে। 
নেপাল হিমালয় দ্বারা পরিবেষ্টিত দেশ যার প্রায় ৮১ শতাংশ মানুষ‌ই হিন্দু। এখানে গোর্খা ও  নেওয়ার  সম্প্রদায় ভুক্ত মানুষের প্রাধান্য বেশী। গোর্খারা মূলতঃ হিন্দু এবং নেওয়াররা বৌদ্ধ। সুতরাং হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মিলনে নেপালী উৎসব বিশেষ মাহাত্ম্য লাভ করেছে। 
নেওয়াররা নেপালের উপত্যকা অধ্যুষিত এলাকার এক অতি প্রাচীন জাতি। এদের সম্পর্কে সঠিকভাবে কিছু বলা যায়না। আর্য, মোঙ্গল এবং দ্রাবিড় সব ধারার মানুষ মিলেমিশে নেপাল উপত্যকায় যে জনগোষ্ঠী তৈরি হয়েছিলো তারই সাধারণ নাম ছিলো নেওয়ার। আর গোর্খারা মূলতঃ নেপালের ধর্মগুরু গোরক্ষনাথের অনুগামী।
আসন্ন ১লা বৈশাখ। এই দিন থেকেই নেপালীদের লোকাচার ও উৎসবের সূচনা। এই দিন নেপালের ভোগমতী গ্রামে নেপালের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা মৎসেন্দ্রনাথের অভিষেকক্রিয়া সম্পন্ন হয়। অভিষেকক্রিয়ার পর  উচ্চ বিচিত্র বর্ণের, পতাকাশোভিত কাঠের রথে বসিয়ে তাঁকে পাটনে (নগরীতে) আনা হয়। পাটনে এক মাস অবস্থানের পর পুনরায় মৎসেন্দ্রনাথ ভোগমতিতে প্রত্যাবর্ত্তন করেন। এই যাত্রা বৌদ্ধ নেওয়ারদের উৎসব। তবে সকলেই এই উৎসবে অংশগ্রহন করেন।
মৎসেন্দ্রনাথ সম্পর্কে কিছু কথা বলি। তিনি মীননাথ, মীনাপ্পা নামেও পরিচিত। তিনি নাথ সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা। এই নাথ সম্প্রদায় হল শৈব সম্প্রদায়। যদিও এ ব্যাপারে যথেষ্ট মতভেদ আছে। নাথ সম্প্রদায়কে কৌল বা যুগী সম্প্রদায়‌ও বলা যায়। শিবকে নাথ সম্প্রদায় আদিগুরু হিসেবে মানেন, এই আদিদেব এর শিষ্য‌ই হলেন মৎসেন্দ্রনাথ। তাঁর জন্মস্থান চন্দ্রদ্বীপ যা বর্তমানে বাংলাদেশের বরিশালের অন্তর্গত। কথিত আছে, মৎস্যের উদরে থেকে তিনি শিব শক্তির রহস্যের কথা শুনে সিদ্ধিলাভ করেন। তাই তাঁর নাম হয় মৎসেন্দ্রনাথ। তাঁর প্রধান শিষ্যদ্বয় হলেন গোরক্ষনাথ ও চৌরঙ্গীনাথ।
 মৎসেন্দ্রনাথ সম্পর্কে আর‌ও অনেক কাহিনী প্রচলিত, কিন্তু এখানে সেসব আলোচনা নিষ্প্রয়োজন।

বৈশাখ মাসের অপর লৌকিক উৎসব হল বজ্রযোগিনী মন্দির যাত্রা। এটি নেপালীদের নেওয়ার জাতির কাছে এটি অত্যন্ত পবিত্র উৎসব। ষোড়শ শতকে কাঠমান্ডুর মল্লবংশীয় রাজা মহারাজ প্রতাপমল্ল এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে মূলতঃ তান্ত্রিকমতে পূজার্চ্চনা হয়ে থাকে। এখানে দেবী উগ্রতারা রূপে পূজিতা হন। বৈশাখ মাসের ৩ তারিখে মন্দির যাত্রা শুরু হয়। দেবীর ক্ষুদ্র মূর্তি কাঁধে চড়িয়ে পুরো শহর ঘোরানো হয় । প্রায় একসপ্তাহ এই উৎসব চলে। এই বজ্রযোগিনী মন্দির গুহ্যেশ্বরী মন্দির নামেও পরিচিত। এটি একান্ন পীঠের অন্যতম। কথিত আছে এখানে দেবী সতীর দুই হাঁটু পতিত হয়।


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



জৈষ্ঠ্য মাসে সিবি যাত্রা উৎসব পালিত হয় বিষ্ণুমতী নদীর ধারে। অদ্ভুত এই উৎসবে 
ছেলেরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে নদীর উভয় পার থেকে পরস্পরকে পাথর ছুঁড়ে মারে। বিষ্ণুমতী নদী শিবপুরী পর্বতের কাছে অবস্থিত। আগে এই উৎসবে গুরুতর দুর্ঘটনা ঘটত। এখন এই উৎসব এর উন্মত্ততাকে সরকার থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। 
 
নেপালে নেওয়ার জাতির একটি পবিত্র লোক উৎসব হল বাঁহরযাত্রা । বছরে দুবার এই উৎসব সম্পন্ন হয়। শ্রাবণ এবং ভাদ্র মাসে। নেওয়ারদের মধ্যে পুরোহিতরা বাঁহরা নামে পরিচিত। এই দুই বিশেষ দিনে নেওয়ার সম্প্রদায় তাদের ঘরবাড়ী সুন্দর করে সাজিয়ে তোলে। বাড়ীর মেয়েরা বাড়ীর সদর দরজায় চালপূর্ণ পাত্র বা ভান্ড  নিয়ে বসে থাকে। বাঁহরা -রা পূর্ব্বপুরুষদের রীতি অনুয়ায়ী ভিক্ষার উদ্দেশ্যে দরজায় দরজায় উপস্থিত হয়। মেয়েরা সকলকে ভিক্ষা দেন। বৌদ্ধধর্মের ভিক্ষুক কর্তৃক
ভিক্ষাগ্রহনের পূর্বরীতি স্মরণ করাই এই উৎসবের ভিত্তি।

গাধিমাই উৎসব হলো নেপালের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে প্রায় ১৬০ কিলোমিটার দক্ষিণে বারা জেলার বারিয়ারপুরের গাধিমাই মন্দিরে অনুষ্ঠিত হয় এই উৎসব। মূলত মাধেসি জনগোষ্ঠী (নেপালের দক্ষিণভাগে ও বিহারের উত্তরাংশের সমতলে বসবাসকারি মানুষদেরকে বলাহয়) এটি উদযাপন করে। শক্তির দেবী গাধিমাইকে সন্তুষ্ট করার লক্ষ্যে এই উৎসবে মহিষ, শুকর, ছাগল, মুরগি ও কবুতর সহ অন্যান্য অনেক পশু বলি দেওয়া হয়। লোকেরা নারকেল, মিষ্টি, লাল রঙের জামাকাপড় ইত্যাদিও দেয়। উৎসবটিকে বিশ্বের বৃহত্তম পশুবলি অনুষ্ঠান হিসেবে বর্ণনা করা হয়।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হল গাইযাত্রা উৎসব। এটি মূলত নেপালের নেওয়ার সম্প্রদায়ের উৎসব। এই উৎসব ভাদ্র মাসে হয় ৮ থেকে ১০ দিন ধরে এই উৎসব চলতে থাকে। মূলত বিগত বছরের মৃত ব্যক্তিদের স্মরণে কাঠমান্ডু উপত্যকায় নেওয়ার সম্প্রদায় গাই পূজা করে থাকে। তবে নেওয়াররা ছাড়াও এ উৎসবে অন্যান্য সম্প্রদায়ের সবাই অংশগ্রহণ করে থাকে। 

নেপালে ইন্দ্র যাত্রা কাঠমান্ডুর সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। এটি ইয়েনিয়া নামেও পরিচিত। এই উদযাপন দুটি অনুষ্ঠান নিয়ে গঠিত ইন্দ্রযাত্রা এবং কুমারী যাত্রা। ভাদ্র মাসে নেওয়ারদের মধ্যে এই মহোৎসব হয়। এই দিন একটি উঁচু কাঠের স্তম্ভ রাজার বাড়ীর সামনে রোপণ করা হয়। তখন সকলে নানারকম মুখোশ পরে স্তম্ভটির চারিদিকে নৃত্য করে। তৃতীয় দিবসে কয়েকজন কুমারীকে রাজার সামনে পূজা করা হয়। কুমারী মেয়েদের পূজার পর রথে বসিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করানো হয়। অত্যন্ত সমারোহের সঙ্গে এই উৎসব পালিত হয়।

নেপালে সারমেয় দের সম্মানিত করাও বেশ সুন্দর একটি উৎসবের মধ্যে পড়ে। কার্তিক মাসে এই উৎসব টি হয়ে থাকে। এই দিন রাস্তায় বিচরণকারী সমস্ত সারমেয় দের মাথায় চন্দনের টিপ এবং গলায় মালা পরিয়ে তাদের সমাদর করা হয়। বৌদ্ধ ধর্মে অহিংসা ও জীবের প্রতি প্রেমের নিদর্শন হিসেবে এই উৎসব পালিত হয়।

কার্তিক পূর্ণিমায় সধবা মেয়েরা তীজব্রত পালন করে থাকে। এইদিন তারা উপবাস করেন এবং সকলে পশুপতিনাথ দর্শন করেন। পরদিন সকালে স্বামীকে প্রণাম করে জলগ্রহণ করেন। স্বামীর কল্যাণ ও দীর্ঘজীবন কামনা করে এই ব্রত রাখা হয়। এই ব্রতের সাথে আমাদের হিন্দু অবাঙালীদের করবাচৌথের মিল পাওয়া যায়।

ভারতীয় বাঙালীদের দূর্গাপূজার মতো নেপালেও উদ্দীপনার সাথে দূর্গাপূজা পালিত হয়। এখানে মা ভবানী রূপে আরাধিতা হন। বাংলার বিজয়া দশমী উৎসবের মত এখানে পালিত হয় দশাইন।
এই দিন দই, সিঁদুর এবং চাল দিয়ে বিশেষ টিকা প্রস্তুত করা হয়। বাড়ির বড়রা পরিবারের ছোট সদস্যদের কপালে এই টিকা লাগান।বিশ্বাস করা হয় যে লাল টিকা ঐক্যের প্রতীক। এদিন বড়রা ছোটদের আশীর্বাদ, উপহার দিয়ে থাকেন। পরিবারের সকলে একত্রিত হয়ে পালন করে এই আচার।

এই বিশেষ উৎসব ব্যতীত রাখীপূর্ণিমা, জন্মাষ্টমী, নাগপঞ্চমী,শ্যামাপূজা, ভাইফোঁটা, মাঘীপূর্ণিমা, শ্রী পঞ্চমীতে বাগদেবীর আরাধনা, হোলি ইত্যাদি সকল উৎসব অত্যন্ত আনন্দের সাথে এখান পালিত হয়ে থাকে।
ভারতের সঙ্গে নেপালের সংস্কৃতির মিল অনেকাংশেই । পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত লাগোয়া হওয়ায় খাদ্যাভ্যাস থেকে সংস্কৃতির অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মিল দেখতে পাওয়া যায়। ভারতের মতো নেপালেও জাঁকজমকভাবে প্রত্যেকটি উৎসব পালিত হয়। উৎসব একপ্রকার মিলনস্থল। নেপালের সমগ্র উৎসব সমারোহে ভারতীয় এবং অন্যান্য দেশের বহু মানুষ অংশ নেন।
এই উৎসবের মধ্যে দিয়েই মানসিক উদারতা, সাংস্কৃতিক চিন্তন বিনিময়, মননশীলতা,ঐক্যবোধ গড়ে ওঠে। আমরা সকলে এক পৃথিবী মায়ের সন্তান এই বোধ থেকেই পরস্পরের প্রতি ভ্রাতৃভাব গড়ে ওঠে। তাই পৃথিবীর সকল দেশের ছোটো বড়ো সমস্ত উৎসব সফল হোক ও তাকে কেন্দ্র করে মানুষ অনাবিল আনন্দে মেতে উঠুক। তবেই উৎসবের সার্থকতা।

Post a Comment

0 Comments