জ্বলদর্চি

আমি আমার মতো /পর্ব -১৯ /সুকন্যা সাহা

আমি আমার মতো
পর্ব -১৯

সুকন্যা  সাহা 

মেসবাড়ি

উত্তর কলকাতার পুরোনো মেস বাড়ি গুলোর একটা আলাদা texture আছে , আছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য । ঘিঞ্জি অপরিসর সরু গলি তার মধ্যে উঠে গেছে চারতলা বাড়ি নীচের তলায় গাড়ি বারান্দা , বড় বড় থাম , থামের মাথায় আবার কারুকাজ করা ; কোনো এক সময় এগুলির রং ই দুধ সাদা ছিল , এখন বিবর্ণ পলেস্তারা ওঠা , রং প্রায় বোঝাই যায় না ।গাড়ি বারান্দায় একসময় কত গাড়ি থাকত , অস্টিন , হেরাল্ড স্ট্যন্ডার্ড এখন শুধুই পুরু ধূলোর স্তর । গাড়ি বারান্দার পাশ দিয়ে উঠে গেছে কাঠের সিঁড়ি । দোতালা তিনতলা চারতলা , দুপাশে কারুকাজ করা রেলিং, জায়গায় জায়গায় ভেঙে পড়েছে সেই রেলিং , চারিদিকে পুরু ধূলোর আস্তরণ ... ঝুল, মাকড়সার জাল , কে পরিস্কার করবে ? বারোয়ারি ব্যাপার ... চোখ বন্ধ করলেই দেখা যায় উনবিংশ শতাব্দী ... যখন কলকেতায় পড়তে আসা বাবুদের গলার আওয়াজে গমগম করত এই মেসবাড়ি , কোঁচকানো ধুতি, গিলে করা পাঞ্জাবী ,তাস আড্ডা আর ফূর্তির বন্যা বইত ... অনেকে আবার ছা-পোষা কেরানীগিরিও করতেন , নানা রকমের নানা কিসিমের মানুষজন ; ঘর গুলো বড় বড় , প্রতিটা ঘরে বেশ কয়েকটা কাঠের তক্তপোশ বা চৌকি , অবশ্যই সিংগল বেডেড , চৌকির ওপর ফুলছাপ বেডশীট, শহুরে কত্তার সুটকেসে যত্ন করে ভরে দেন গিন্নি ।খাটের ওপরেই চলত তাসের আড্ডা, পেশেন্স রামি আরো কত কি ! ছুটির দিনে তেলচিটে তলা পুড়ে যাওয়া বড় কড়াইতে রান্না হত পাঁঠার মাংস , সঙ্গে বন্ধু বান্ধব পানাহার । বেশ জমাটি ব্যাপার । এজমালি চাকর ভজনের ফাই ফরমায়েশ জোগান দিতে দিতে প্রাণান্ত । কখনও হুকুম নীচে থেকে চারমিনারের প্যাকেট নিয়ে আসার , তো কখনও সোডার বোতল , কোনো কোনো ঘরে ছিল গ্রামোফোন ,ভাঙা রেকর্ড প্লেয়ার , ছু্টির দিনে ভেসে আসত আঙ্গুরবালা কি বেগম আখতার । ঘরগুলোর সঙ্গে ঝুল বারান্দা , ওপর থেকে প্রায় গোটা কলকাতাই নজরে আসে । চলমান জীবন, ধাবমান গাড়ি ঘোড়া । মেস বাড়ি বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে এজমালি কলতলা, একটা চাতাল,টাইম কলের জল, লাইফ বয় বা margo সাবান ঘষে ঘষে স্নান আর সেই স্নানের মময় পাশের বাড়ির বৌ মেয়েদের সঙ্গে চোখা চোখি,আলগোছে  কাঁধে গামছা ফেলে তার দ্রুত চলে যাওয়া ...অকারণে হৃদয় ধুকপুক ধুকপুক ... ব্যাক গ্রাউণ্ডে মিউজিক ...চোখে চোখে কথা বল/মুখে কিছু বল না... সপ্তাহে রোজ বাজার করার রুটিন মেসে ঠিক করাই থাকত...ঠাকুরের দেওয়া ফর্দ মিলিয়ে দুই ঢাউস ব্যাগ ভর্তি বাজার করা মুখের কথা ছিল না...মেসে দু বেলা তিরিশ, তিরিশ ষাট জনের পাত পড়বে । বাজার করা নিয়ে লেগ পুলিং কথা কাটা কাটি এমনকি হাতাহাতিও হামেশাই হত ।ফি ছুটিতে মেস বাবুরা বাড়ি যেতেন, বাড়ি বলতে দেশের বাড়ি , তখন জমজমে মেস বাড়ি একেবারে শুনশান , খোলা বারান্দায় পায়রা গম খেত খুঁটে খুঁটে ... ভজনের ও ছুটি মিলত এই কটা দিন, উপরি রোজগার আর বকশিসের টাকায় লখানির জন্য কিনত লাল রঙের চুলের ফিতে, আয়না , চিরুণি , সস্তা ডুরে শাড়ি ...বড় বড় তালা পড়ে যেত মেসের ঘরগুলোয় ... এখনও ঘর গুলো তালা দেওয়া , শুধু তালাগুলোয় জং পড়ে গেছে অব্যবহারে ...


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



পুনশ্চ –{ মেস বাড়ি বাংলা সাহিত্যকে  সমৃদ্ধ করেছে । শিবরাম চক্কোত্তি থেকে বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়  অনেকেই থাকতেন মেসবাড়িতে ; আর  তাদের  লেখার  মধ্যে উঠে   এসেছে মেস  জীবনের ইতিবৃত্ত। সাড়েচুয়াত্তর , পড়শন, বসন্ত বিলাপ মেস জীবনকে নিয়ে চলচিত্রায়িত হয়েছে একাধিক যুগান্তকারী সিনেমা। কবে যে মেস বাড়ির চল আস্তে আস্তে  উঠে গেল কলকাতা থেকে আর সেখানে  জায়গা করে নিল পি জি , বা পেয়িং গেস্ট সিস্টেম , সে আবার অন্য ইতিহাস ।}
(ক্রমশঃ}

Post a Comment

0 Comments