জ্বলদর্চি

নাটকের নেশায়/ মিলি ঘোষ

নাটকের নেশায় 
মিলি ঘোষ 


তখন স্কুল জীবন। সিনেমা দেখার অনুমতি ছিল না বললেই চলে। হাতে গোনা দু'একটা হয়তো দেখার সুযোগ হতো। অবশ্যই তা বড়োদের সঙ্গে। বড়োদের ইচ্ছাতেই। এরকম কঠোর নিয়ম নীতির মধ্যে হঠাৎ একটা নাটক দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম।
চেতনা গোষ্ঠীর 'মারীচ সংবাদ'। 
তখন সিস্টেমটা এমন ছিল, কোনও জামা পছন্দ না হলেও বলতে হবে পছন্দ হয়েছে। 
   সিনেমা দেখার পরও একই প্রশ্ন, "কেমন লাগল ?"
  "ভালো।"
  "কোন্ চরিত্র সবচেয়ে ভালো লাগল ?"
এই উত্তরটা মাথা খাটিয়ে দিতে হতো। প্রশ্ন কর্তার মতের সঙ্গে না মিললেই, আমি কতটা ভুল তা প্রমাণ হয়ে যেত। কাজেই প্রশ্ন কর্তার পছন্দকেই নিজের পছন্দ বলে রেহাই পাওয়ার একটা চেষ্টা ছিল। 
এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে 'মারীচ সংবাদ' দেখে আমি রীতিমত নিজের মত প্রকাশ করতে শুরু করলাম। 

মারীচ সংবাদ মানেই যেন 'মেরি বাবা'। এই মেরি বাবার চরিত্রে ছিলেন বিপ্লব কেতন চক্রবর্তী। সেই প্রথম তাঁকে দেখি একেবারে সামনে থেকে। তখন জানতাম না তিনি কে। কিন্তু নাটক দেখে বুঝেছিলাম, তিনি এমন একজন, যার অভিনয় একবার দেখলে ভোলা সম্ভব নয়। নাচে, গানে, অভিনয়ে একেবারে মাতিয়ে দিলেন। কোথাও কোনও ফাঁক নেই। মনে হচ্ছিল, ঠিক এমনটিই হওয়ার কথা।
শুধু মেরিবাবাকে দেখব বলে, আমি মারীচ সংবাদ আরও একবার দেখলাম। অবশ্যই সুযোগ এল, তাই। তারমানে এই নয়, বাকিদের অভিনয় ভালো লাগেনি। চেতনা গোষ্ঠীর কলাকুশলীদের সম্পর্কে আলাদা করে বলার তো কিছু নেই। প্রত্যেকেই সুঅভিনেতা। যেহেতু মেরিবাবা আমাকে বিশেষ ভাবে আকর্ষণ করেছে, তাই বিপ্লব কেতন চক্রবর্তীর কথা উল্লেখ করতেই হলো। 
 
এরপর দেখলাম গিরিশ মঞ্চে শাঁওলি মিত্র'র 'নাথবতী অনাথবৎ'। একাঙ্ক নাটক। গোটা মঞ্চ একা দাপিয়ে গেলেন। কখনও তিনি যুধিষ্ঠির, কখনও ভীম কখনও বা দ্রৌপদী। এরকমও হতে পারে! প্রত্যেকের গলার স্বর, হাঁটা, কথাবলা, উপহাস করা, অপমানিত হওয়া সমস্ত অভিব্যক্তি একা করে দেখালেন। দর্শক কখনও স্তব্ধ, কখনও বিস্মিত। কখনও বা হেসে কুটিপাটি।
ভীমকেই সত্যিকারের মানুষ হিসেবে দেখানো হয়েছে। 
   ভীম বলছে— পাঞ্চালী, তোমার কি খুউউব কষ্ট হচ্ছে ?
পাঞ্চালীর শরীর চলছে না। জীবনযুদ্ধে সে বিধ্বস্ত। তার কণ্ঠ দিয়ে শুধুই ঘরঘরে আওয়াজ। 
   নিঃশেষ হতে হতেও জানিয়ে গেল পাঞ্চালী--ভীম, পরের জন্মে আমি যেন শুধু তোমাকেই পাই। 

শাঁওলি মিত্র'র শিল্পী জীবনে এ এক অসামান্য সৃষ্টি। এই ধরনের নাটক, হাজারো নাটকের ভীড়ে কখনও হারিয়ে যেতে পারে না।
শাঁওলি মিত্র আর আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু 'নাথবতী অনাথবৎ' থেকেই গেল। বাংলা নাটক যতদিন থাকবে, এই নাটকটিও মানুষের মনে ততদিন থাকবে, আশা করা যায়।
এটাও একাধিকবার দেখা। 

নাটক দেখা চলতেই লাগল। যখন তখন নয়। তবে সুযোগ হতো। 
অনেক নাটকের নামও ঠিকমতো মনে নেই। তবে এরই মধ্যে কিছু আছে, যা স্মৃতিতে থেকে গেছে। সেগুলির অন্যতম হলো নাট্যরঙ্গ আয়োজিত 'শ্রী মধুসূদন'।  
আবার গিরিশ মঞ্চ।
মাইকেলের ভূমিকায় শ্রী সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। রঙিন পর্দার জনপ্রিয় মুখ। কমেডি চরিত্রে দক্ষ বলে টিভি সিরিয়াল বা সিনেমাতে তাঁর উপস্থিতি দর্শকদের কাছে সব সময়ই আকর্ষণীয়। সেই সুরজিৎবাবু মাইকেলের মতো একটা অসামান্য সিরিয়াস চরিত্রে কী সাংঘাতিক অভিনয় করলেন! মাইকেলের অসহনীয় কষ্টের দিনগুলির মধ্যেও তাঁর সৃষ্টি থেমে থাকেনি। চরম দুর্দিনে বিদ্যাসাগরকে পাশে পাওয়া, সবই পেয়েছি ওই নাটকে।
সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাঁটা, বাচনভঙ্গি, দাপুটে অভিনয় মুগ্ধ হয়ে দেখলাম। প্রতিটি স্টেপ ফেলছেন, আগে হিল পরে টো। চোখে যেন আগুন জ্বলছে। সহ অভিনেতা অভিনেত্রীরা প্রত্যেকেই অনবদ্য। 
  একটা দিনও কি আমরা মধুসূদন দত্তের কথা ভাবি ? তাঁর লেখা পড়ি ? এই নাটকটা দেখার পর আবার নতুন করে ভেবেছি। পড়েছি। এটাই নাটকের বৈশিষ্ট্য। মানুষকে ভাবতে বাধ্য করে। 
 
যা আমার মনে গভীর ভাবে রেখাপাত করে, তা সহজে যেতে চায় না। এ ক্ষেত্রেও তা'ই হলো। পুরো নাটকটাই চোখের সামনে ভাসতে লাগল। সুরজিৎবাবুকে ফোন করে আমার প্রতিক্রিয়া জানালাম। খুব খুশি হলেন। অনেক্ষণ কথা হলো। ধৈর্য্য ধরে পুরো ফিডব্যাকটা নিলেন। নাট্যকার, অভিনেতাদের পরিশ্রম, অধ্যাবসায়, প্রতিভা তো আছেই। তার সঙ্গে দর্শকদের প্রতিক্রিয়া জানাটাও জরুরী। নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সব কিছুরই প্রয়োজন। এরপরেও মাঝেমাঝে শিল্পীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। 

অনেক সময়ই নাটক দেখতে গিয়ে চেনা পরিচিতদের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। কিছু ভালো লাগা মিশে থাকে তাতে। যতক্ষণ নাটক শুরু না হচ্ছে, ঠিক আছে। কিন্তু নাটক চলাকালীন কানের পাশে অনবরত বকবক শুধু নিজের কাছে পীড়াদায়ক নয়। নাটকের পক্ষেও তা অনভিপ্রেত। তারপর থেকে একা যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নিলাম। আর রিভিউ লেখার অনুরোধ থাকলে, একা যাওয়াই শ্রেয়। 

অ্যাকাডেমিতে গেলাম নাট্যরঙ্গ আয়োজিত একটি নতুন নাটক 'কুকুর হইতে সাবধান' দেখতে। একাই। এই নাটকটির কথা আলাদা করে একটু বলতেই হয়।

নাটকটি হাস্যরসাত্মক, যার আড়াল থেকে উঁকি দেয় চেতনা। নাটকের প্রথম দৃশ্যই নজর কাড়ে। ব্রহ্মা  একটি বৃহদাকার টেস্ট টিউবে ওষুধ তৈরী করছেন, যে ওষুধ তিনি পৃথিবীতে কোন এক চূড়ান্ত সৎ ব্যক্তির ওপর প্রয়োগ করবেন এবং ব্যক্তিটি ধীরে ধীরে কুকুরের মতো আচরণ করতে শুরু করবে ( পাঠক এখানে কুকুরের আচরণের অন্তর্নিহিত অর্থই বুঝবেন )। আসল কথা ঐ সৎ ব্যক্তিটি এক সংক্রামক সামাজিক ব্যাধি থেকে নিজেকে মুক্ত রেখেছেন বহু বছর ধরে। স্রোতের বিপরীতে হাঁটতে গেলে যা হয়, সততার মূল্য দিতে হচ্ছে তাঁকে, তাঁর পরিবারকে। 

ব্রহ্মা ও নারদ না বলে কয়ে যখন তখন সৎ ব্যক্তি অঞ্জনের বাড়িতে ঢুকে তাঁর মগজ ধোলাইয়ের ব্যবস্থা করেন। ব্রহ্মার দেওয়া টোপ গিলে অঞ্জনের জীবনের মানচিত্র বদলাতে থাকে। টাকা আসতে থাকে রাশি রাশি। 
   টাকার রাজ্যে ভালো না থাকা অঞ্জনের স্ত্রী সর্বাণী  তাঁর মা'কে ফোন করে বলে, "জানো মা, আমাদের এখন অনেক টাকা।" 
   কিন্তু অঞ্জন বলে, "যেমন বেণী তেমনি রবে চুল ভিজাব না! ...... যে খেলার যে নিয়ম, বাণী।"
   হলের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ভেসে যায় অঞ্জনের কেটে কেটে বলা কণ্ঠস্বর, "তুলে রাখো। টাকা।"

কী অসাধারণ অভিনয়! ব্রহ্মার ভূমিকায় স্বয়ং নির্দেশক শ্রী স্বপন সেনগুপ্ত এবং সৎ ব্যক্তি অঞ্জনের ভূমিকায় নাট্যকার শ্রী স্নেহাশিস ভট্টাচার্য্য, অভিনয়কে যে কোন্ পর্যায়ে নিয়ে গেলেন, তা এই নাটকটি না দেখলে অজানাই থেকে যেত। 


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



 'কুকুর হইতে সাবধান' হাস্যরস সমৃদ্ধ একটি সিরিয়াস নাটক। নাট্যরঙ্গ এই নাটকের মধ্য দিয়ে সমাজকে যে বার্তা দিল, তা প্রশংসার দাবি রাখে। একজন ব্যক্তির সৎ থেকে অসৎ হওয়া এবং পুনরায় সৎ হয়ে ফিরে আসার কাহিনী নিয়েই তৈরি 'কুকুর হইতে সাবধান'।
চোখে পড়ার মতো ভালো লেগেছে অঞ্জনের স্ত্রী সর্বাণীর ভূমিকায় শ্রীমতি অনিন্দিতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও বাড়িওয়ালার ভূমিকায় শ্রী সায়ন্তন রায় চৌধুরীর অভিনয়। বাকি শিল্পীদের কোনও অংশে ছোটো না করেই বলছি, সম্পূর্ণ টিম ওয়ার্ক ছিল অসাধারণ। 

নাটক থাকবে আর উৎপল দত্ত থাকবেন না, তা তো হয় না। দুঃখের বিষয় উৎপল দত্তর কোনও নাটক সামনে থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়নি। 

তিনি এমন একজন, যিনি বুক বাজিয়ে বলতেন, তিনি প্রপাগান্ডিস্ট। তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটকগুলির মধ্যে ' কল্লোল ' নাটকটির কথা বলতেই হয়। 
মিনার্ভা থিয়েটারে দর্শক বিস্মিত হয়ে দেখলেন মঞ্চে একটি গোটা জাহাজ। নাম 'খাইবার'। নাবিক খালাসিরা নিজেদের মধ্যে কথা বলার সময় খুলে যায় গনগনে লাল আগুনের চুল্লি। আলোর খেলা বুঝে নিয়ে সকলে বাহবা দেন আলোর জাদুকর তাপস সেনকে। কিন্তু সকলকে অবাক করে জাহাজের এক কর্মী চুল্লি থেকে চিমটে দিয়ে আগুন তুলে পাইপে অগ্নি সংযোগ করে। দর্শক স্তম্ভিত। উৎপল দত্তই পারেন মঞ্চে এভাবে নাটক উপস্থাপন করতে। 
 
তিনি বলতেন নাটকে ইমাজিনেশন আর অবজারভেশন দুটোই দরকার। একটি অপরটির পরিপূরক। সমকালীন কোনও ব্যক্তি ,যাকে বারবার দেখা হয়েছে সামনে থেকে বা টিভি, সিনেমার পর্দায়। সেখানে দরকার অবজারভেশন। কিন্তু কোনও ঐতিহাসিক চরিত্র যাকে কোনওদিন কোনওভাবে দেখা হয়নি ইতিহাস বইয়ের পাতায় ছবি ছাড়া। তাঁর  চরিত্রে অভিনয় করার সময় ইমাজিনেশন ছাড়া উপায় কী! উৎপল দত্তর কথায় শিল্পী হবে বিড়ালের মতো, যে বালির ওপর আরামে শুয়ে থাকবে কিন্তু সে সতর্ক। সামান্যতম আওয়াজে সে উঠে দাঁড়াবে। বালিতে পড়বে পায়ের ছাপ। ডান দিকে তুড়ি দিলে ডান দিকে তাকাবে। বাঁ দিকে দিলে বাঁ দিকে।
নাটক নিয়ে কতটা ভাবনা চিন্তা থাকলে এই ধরনের ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব! এভাবেই তিনি পরবর্তী প্রজন্মকে শিখিয়ে গেছেন। 
যে কোনও বিষয়কে নিখুঁত করে গড়তে গেলে শিক্ষার প্রয়োজন। পড়াশুনা করতে হয়। না খেটে, না ভেবে, না সময় দিয়ে উৎপল দত্ত হওয়া যায় না। 
শুনেছি, নাটকে থার্ড বেল পড়ার আগে তাঁর মতো দাপুটে অভিনেতারও নাকি বুক কাঁপত।
উৎপল দত্ত সম্পর্কে যা যা বললাম, সবটাই নাট্য ব্যক্তিত্বদের থেকে শোনা। 

হ্যাঁ, নাটক দেখতে অবশ্যই ভালোবাসি। শুধু সামনে থেকে নয়। ইউ টিউবের দৌলতে বহু ভালো নাটক দেখার সুযোগ হয়। 
জীবনটাই তো নাট্যশালা। ভালো মন্দ যাই থাক। জীবনকে ভালোবাসলে নাটক ভালো না বেসে উপায় কী! বিশেষ কারণে নাটক একা দেখাই সুবিধাজনক হলেও সবাই নাটক দেখুন এটাই চাই। নাটক দেখুন, নাটক নিয়ে ভাবুন। এমন ভাবে দেখুন, যাতে নাটকের বিষয়, শিল্পীদের অভিনয় দক্ষতা অন্তত সাত দিন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়। আর মনের মধ্যে থেকে যায় আজীবন। তবেই নাটকের সার্থকতা।

Post a Comment

2 Comments

  1. আমিও একমত আপনার সঙ্গে।

    ReplyDelete
  2. জ্বলদর্চি পত্রিকার সঙ্গে আমার পরিচয় কবি ও প্রচ্ছদ শিল্পী শোভন পাত্রের মধ্য দিয়ে। সে অনেককাল আগে।
    তারপর পত্রিকা হাতে পেতাম বিচ্ছিন্নভাবে। কালান্তর দৈনিক এর পাতায় আলোচনাও করেছি।
    এখন নেট সংখ্যা পেয়ে খুব ভালো লাগছে।
    লেখাগুলো বিশেষত নিমাই জানার গুচ্ছ কবিতা ভালো লাগলো।
    অনেক ধন্যবাদ ও শুভকাম।মনা

    ReplyDelete