জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোকগল্প—ব্রাজিল (আমেরিকা)বেহালা বাজিয়ে রাজ্য লাভ /চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প—ব্রাজিল (আমেরিকা)
বেহালা বাজিয়ে রাজ্য লাভ

চিন্ময় দাশ

এক গ্রামে ছিল এক চাষী আর তার ছেলে। গরীবের সংসার। একটা বেড়াল, একটা কুকুর, একফালি জমি, আর তাতে দু-চারটে কমলালেবুর গাছ—সম্পত্তি বলতে এটুকুই। এ ছাড়া কিছুই ছিল না তাদের। 
একদিন বাবা মারা গেল। ছোটথেকেই ছেলেটার ভারি সখ, নিজের একটা বেহালা হবে তার। কুকুরটা এক পড়শিকে দিয়ে দিল। লেবুর গাছ আর জমিটা বেচে দিল এক চাষীকে। হাতে যা টাকা এল, সেই টাকায় একটা বেহালা কিনে আনল বাজার থেকে। 
বেহালা তো হোল। কিন্তু পেট চলবে কী করে? হাতে বেহালা আর সাথে বেড়ালটাকে নিয়ে, ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল ছেলেটা। সোজা সে দেশের রাজার বাড়িতে গিয়ে হাজির হোল। 
সেপাইদের পাহারা রাজার দেউড়িতে । তারা বল্লম বাগিয়ে এগিয়ে এলো—কী চাই এখানে?
--ভেড়া চরাবার লোক লাগবে রাজার? আমার খুব উপকার হয় তাহলে?কোন কাজ নাই আমার। মনের ইচ্ছা খুলে বলল ছেলেটা।
সেপাইরা বলল—নাগো, লাগবে না। ভেড়া চরাবার অনেক লোক আছে রাজামশাইর। আর দরকার নাই। সরে পড়ো এখান থাকে। 
বাবা বেঁচে থাকতে, কথাবার্তা সব বাবার সাথেই হোত। এখন কার সাথে কথা বলবে। মনের যা কথা, এখন সব বলে বেহালাটাকে। বেহালাও যা শোনে, মিষ্টি সুরে উত্তর দেয় তাকে। 
সেপাইরা ফিরিয়ে দিয়েছে। যাওয়ার মতো আর কোন জায়গা নাই এখন। মনের দুঃখে, সোজা বনের রাস্তা ধরল ছেলেটা। হাতে বেহালা। বাড়ির পোষা বিড়ালটা রয়ে গিয়েছে সাথে। সেও চলেছে পাশে পাশে।
বনের ভিতর ঢুকে, বেহালার ছড় টানতে শুরু করল ছেলে। আহা, কী মিষ্টি সুর বাজতে লাগল তাতে। গাছগাছালির ফাঁকে ফাঁকে ভেসে বেড়াতে লাগল সেই সুর। 
বনের ভিতর একদিকে রাজার ভেড়া চরাচ্ছিল রাখালেরা। তাদের কানে গেল সুর। কে বাজায়? কোথা থেকে আসছে ভেসে ভেসে? এমন সুর কোনদিন শোনেনি কেউ। ঠাওর করতে পারল না রাখাল ছেলেরা। 
সুর লেগেছে ভেড়াদের মনেও। তারাও উতলা হয়েছে। এক এক করে অনেকগুলো ভেড়া বেরিয়ে গেল পাল থেকে। সুরের টানে চলতে লেগেছে তারা। কখন বেরিয়ে গেল ভেড়া ক’টা, রাখালছেলেরা জানতেও পারল না সেটা। 
জানল যখন মাথায় হাত তাদের। খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে গেল ছেলেগুলো। যখন মনে হয় সুরটার কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে, ঠিক তখনই মালুম হয়, সুর ভেসে আসছে একেবারে উলটো দিক থেকে।
এক সময় ছেলেটার খেয়াল হোল। এক দল ভেড়া চলেছে তার পেছন পেছন। সুরের তালে তালে নাচছে তারা। কেবল ভেড়া নয়, ছেলেটা দেখল, তাল মিলিয়ে নেচে চলেছে তার বেড়ালটাও। ছেলেটার ভারি আনন্দ হোল দেখে। 
এতক্ষণ করুণ সুর ফুটে উঠছিল তার বেহালায়। এবার ধীরে ধীরে কোথায় মিলিয়ে গেল তা। ধীরে ধীরে আনন্দ উচ্ছ্বল হয়ে উঠতে লাগল সুর। বুক ভরে যায় শুনলে। 
এক পাল হনুমান চলেছিল সেদিক দিকে। সুর শুনে তারা দাঁড়িয়ে পড়ল। লাফ-ঝাঁপ থেমে গেল হনুমানগুলোর। নাচতে নাচতে তারাও পিছন পিছন চলতে লাগল। 
এবার একটা তাপির (অনেকটা শুঁড়ের মতো খানিকটা লম্বা নাকওয়ালা, শুকরের আকৃতির বড় চেহারার এক জীব)–এর কানে গেল সুরটা। তাপিরের পেছনের পাগুলোতে তিনটে করে আঙুল। সামনের পায়ে চারটে করে। তাই নিয়েই ধেই ধেই করে নাচ শুরু হোল তাপিরের।
সামনে বেহালা বাজাতে বাজাতে চলেছে ছেলেটা। এতক্ষণ পেছনে নাচতে নাচতে চলছিল একটা বেড়াল, কয়েকটা ভেড়া, একপাল হনুমান। এবার একটা তাপির যোগ হোল তাতে। 
এর পরে, সুর শুনল একটা আর্মাডিলো (অনেকটা আমাদের পাঙ্গোলিন-এর মত প্রাণী, গায়ে মোটা আর শক্ত আঁশের কোট)। গায়ে আঁটোসাটো করে ভারি বর্ম সাঁটা। তবুও, না নেচে পারল না বেচারা পিঁপড়েখেকো জীবটা। খানিক পরেই, এক পাল ছোট হরিণ এসে নাচের দলে ভীড়ে গেল। 
এর পর হোল কী, কথা থেকে একটা বুনো বেড়াল আর একটা বাঘ এসে হাজির। দেখে তো ভেড়া আর হরিণদের বুক ঢিপঢিপ। কিন্তু বেড়াল আর বাঘের সেদিকে কোন হুঁশই নাই। অন্য সবার সাথে তারাও নাচতে লেগেছে।
গাছের ডালে জড়িয়ে আছে বড় বড় সবুজ এনাকোণ্ডা সাপেরা। তারা হিসহিস করে আফশোস করতে লাগল। তারা নাচতে পারছে না, পা নাই বলে। 
এদিকে পাখির দল মেতে উঠেছে মিষ্টি সুর শুনে। নাচবার চেষ্ট করেও পারল না তারা। তখন নীচের নাচিয়ে দলটার মাথার উপর উড়ে উড়ে চলতে লাগল পাখিরা। 
বাজপাখি, ম্যাকাও, গগণবেড়, মাণিকজোড় আর অন্য অন্য সব পাখিরাও ডানা মেলে দিয়েছে। পাখির সেই ঝাঁক দেখলে মনে হবে, বনের কেউ বাদ যায়নি সেই মহা মিছিলে সামিল হতে।
বেশ চলছিল সুর আর নাচের সেই মিছিল। কিন্তু একটা উঁচু পাহাড়ের সামনে এসে, থেমে পড়তে হোল তাদের। দৈত্যদের রাজ্যের সীমানা এই পাহাড়।
বিশাল চেহারার একটা দৈত্য পাহারা দিচ্ছিল পাহাড়টার মাথায় দাঁড়িয়ে। বেহালার সুর দৈত্যটার কানে গিয়ে ঢুকে পড়ল, পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে । বেশ ভালোই লাগল সুরটা। কৌতুহলে নীচের দিকে তাকাতে, মিছিলটা চোখে পড়ে গেল তার। 
অদ্ভূত দৃশ্য। সামনে একটা মানুষ। কিন্তু বনের যে যেখানে ছিল, সবাই দেখি এসে জুটেছে একসাথে। সেই সাথে চলেছে তাদের উদ্দাম নৃত্য। দেখে, পেটের ভিতরটা কেমন গুড়্গুড় করে উঠল দৈত্যটার। 
হাসি কতক্ষণ আর চেপে রাখা যায়? পেট ফেটে যাবার জোগাড় হলে,হেসে উঠল দৈত্যটা। সে কী হাসি। বিকট শব্দে আকাশ কাঁপল। বাতাস কাঁপল। বন কাঁপল। এমনকি, পাহাড়টাও কেঁপে উঠল থরথর করে। তাতে দৈত্য বেচারার নিজেরই পা দুটো গেল ফস্কে। 
আর, পা ফস্কালে যা হয়। গড়াতে গড়াতে একেবারে নীচে এসে পড়ল ধপাস করে। পড়বি তো পড়, একেবারে বেহালা হাতে ছেলেটার সামনে। 
গা ঝাড়া দিয়ে উঠে, একটু সময় নিয়ে, পুরো দলটাকে চেয়ে চেয়ে দেখল দৈত্য। আসলে জরীপ করে নিল ভালো করে। ছেলেটাকে বলল—চলো, আমাদের রাজার সামনে নিয়ে যাবো তোমাদের। এমন বাজনা আর নাচ কেউ কোনদিন দেখেনি আমাদের রাজ্যে। 
পুরো দলটাকে ভিতরে রাজার সামনে নিয়ে গিয়ে হাজির করল দৈত্যটা। ছেলেটার হাতের বেহালা কিন্তু থেমে নেই। সেটা বেজেই চলেছে। নাচও থেমে নেই পশুপাখিদের। চলেছে উদ্দাম সেই নাচও।
এক পলক দেখেই হেসে উঠল রাজা। বেদম সেই হাসি। আকাশ, বাতাস, পৃথিবী সব কেঁপে কেঁপে উঠল। এত দিন রাজার ক্রোধ দেখেছে পৃথিবী। ব্জ্রপাত হয়ে নেমে আসে সেসব। কিন্তু রাজার গলায় হাসি শোনা গেল এই প্রথম।
হোল কী, একবার হেসেই, নিজের মেয়ের কথা মনে পড়ে গেল রাজার। ভারি সুন্দরী। একেবারে চাঁদের টুকরো এক মেয়ে আছে রাজার ঘরে । রাজার আদরের দুলালী। সাত রাজার ধন। রাজার চোখের মণি। কিন্তু মনে যে তার কিসের দুঃখ, সেই মেয়েও জানে না ভালো করে। সারাদিন সারারাত মনমরা হয়ে থাকে। কোনদিন মেয়ের মুখে হাসি দেখবার সৌভাগ্য হয়নি রাজার।
রাজা ঘোষণা করে রেখেছে, যে রাজকুমারীর মুখে হাসি ফোটাতে পারবে, তার সাথে বিয়ে দেবে মেয়ের। সেই সাথে অর্ধেক রাজত্বও দেওয়া হবে বরপণ হিসাবে। 
আজ নাচ আর বাজনার এই দলটাকে দেখে, বেশ আশা জাগল রাজার। রাজার হঠাৎ মনে হোল, এমন উদ্ভট একটা দৃশ্য, নিশ্চয় দুখিনী মেয়েটার মুখে হাসি ফোটাতে পারবে। ভোল বদলে যাবে এই রাজবাড়ির। ভোল বদলে যাবে আমার পুরো রাজ্যটারই। 
রাজা কাতর গলায় ছেলেটাকে বলল—তুমি ভেতরে চলো একবার তোমার নাচিয়েদের নিয়ে। আমার মেয়েকে নাচ দেখাবে এরা। ভারি অসুখ সে মেয়ের। 
দৈত্যরাজার মেয়ে অসুস্থ। তাকে নাচ দেখাতে হবে। অসুবিধার কী আছে এতে? ছেলেটা রাজাকে বলল—চলো। ভেতরে যাই তাহলে। আমার বাজনায় মন থেকে সব বেদনা দূর হয়ে যায় সবার। আর এই যে আমার বাহিনী তৈরি হয়েছে, এদের নাচ দেখে না হেসে পারবে না কেউ। কথা দিলাম, রাজকুমারীর মুখে হাসি ফোটাতে পারব আমরা। 
মন নেচে উঠল রাজার। আশায় বুক বেঁধে, পুরো দলটাকে ভিতর মহলে এনে হাজির করল।
তখন বিকেল হয়ে এসেছে। পাথরের প্রাসাদ। টানা অলিন্দে একটা সিংহাসনে বসে আছে রাজকুমারী। বিষাদে ঢাকা মুখখানি। চোখের কোণে কালি। চোখ দুটো কোন দিকে চেয়ে আছে, কী দেখছে সে মেয়ে, কিছুই বোঝা যায় না। এক দল দাসী-বাঁদি ঘিরে আছে মেয়েটিকে। 
প্রথমে রাজকুমারির কানে গেল বেহালার মিষ্টি সুর। চমকে উঠল যেন মেয়েটি। এমন সুর এখানে এলো কোথা থেকে? কে বাজায় এমন সুর?
তাকিয়ে বেহালা বাদক ছেলেটি চোখে পড়ল তার। তাকিয়ে রইল খানিক। তখনই দেখল পেছনের দলটাকে। সত্যিই সে এক অদ্ভূত ছবি। বেহালার সুরে সবাই নাচছে। বেড়াল নাচছে। ভেড়ার পাল নাচছে। হনুমান, বুনো বেড়াল নাচছে। এমনকি বনের রাজা যে সিংহ, নেচে চলেছে সেও। 
বেড়ালটা নাচছে থুপথুপ করে। খটখট আওয়াজ উঠছে ভেড়াদের খুর থেকে। নাচের নামে তিড়িংবিড়িং করে লাফাচ্ছে হনুমানের দল। আজব এক ছবি।
আর থেমে থাকতে পারল না। ফিক করে হেসে উঠল মেয়েটি। 
আর যায় কোথা? রাজামশাই আহ্লাদে আটখানা। মেয়ে হেসেছে। যেন সোনা রোদের আলোয় ঝলমল করে উঠল গোটা প্রাসাদ। যেন পেখম মেলে নাচতে লাগল উঠোনের ময়ূরের দল। যেন ঝাঁকে ঝাঁকে প্রজাপতি উড়ে এলো কোথা থেকে। যেন প্রাসাদের এখানে ওখানে বক-বকম করে গেয়ে উঠল পায়রার দল। যেন সাতরঙা রামধনু ফুটে উঠল পূবের আকাশ জুড়ে।
দরবার ডাকা হোল। মন্ত্রী এলো, শান্ত্রী এলো। শলা হোল, পরামর্শ হোল। রাজার পুরোহিত এসে, ভরা দরবারে টিকা এঁকে দিল ছেলেটির কপালে। দরবারে জানিয়ে দেওয়া হোল—এই মানুষের ছেলের সাথে, বিয়ে হবে দৈত্যরাজার মেয়ের। অর্ধেক রাজত্বও দেওয়া হবে বরপণ হিসাবে। 
বেহালা থামিয়েছে ছেলেটি কাড়া-নাকাড়া, তুরি-ভেরি, শিঙা-শঙ্খ বেজে উঠল। ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেল চাষীর ছেলের। 
ছেলেটির পিছন পিছন নাচতে নাচতে এসেছিল যেসব পশুপাখি, কাউকে ফিরে যেতে দেয়নি দৈত্যরাজা। সবাইকে রেখে দিয়েছে নিজের রাজ্যে। অগাধ সুখে আছে সকলে। ভেড়া বা হরিণদের বুকে কোন ভয় নাই। বনবেড়াল বা বাঘ ফিরেও তাকায় না আর তাদের দিকে। এ রাজ্যে ভোজের অভাব নাই কোনও। সবাই মজে আছে সুরের যাদুতে।  
বিকেল হলে, বেহালা আর নতুন বউকে সাথে নিয়ে রাজার প্রাসাদে যায় ছেলেটি। রাজা আর রানিকে বেহালা বাজিয়ে শোনায়। 
সামনের বিশাল উঠোন। তার নাচিয়ে বন্ধুরা মনের আনন্দে নাচ জুড়ে দেয় সেখানে। নাচে যে যার মনের মতো। কারও কোন মানা নাই সেখানে।


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



Post a Comment

1 Comments

  1. লোককথা যেগুলো পড়লাম, ভালো লাগল।

    ReplyDelete