বিস্মৃতপ্রায় কবি প্রণব কুমার মুখোপাধ্যায়
নির্মল বর্মন
"শনিবার হলে বেহিসেবি হয়ে
হুল্লোড় করা ক' বন্ধুরা"
প্রণব কুমার মুখোপাধ্যায়
কবি প্রণব কুমার মুখোপাধ্যায় বাস্তব জীবনকে শনিবারের আলোকে অনুভব করে জীবনের সত্যকে তাঁর কবিতার পাতায় স্থান দিয়েছেন। সপ্তাহের শেষে শনিবার মানেই আবালবৃদ্ধবণিতার, হিমালয় থেকে কন্যাকুমারী সব ধরনের মানুষের মধ্যে একটা আবেগ অনুভূতির সৃষ্টি হয়। তাই কবি কথয়-----
"যেহেতু শিল্পী, তাই জানা গেছে
তৃষ্ণা মেটাবে তীব্র সুরা"
কবি প্রণব কুমার মুখোপাধ্যায় কৃত্তিবাস পত্রিকার নিয়মিত রাইটার ছিলেন। এবং বিংশ শতকের পঞ্চাশের দশকের স্বনামধন্য উল্লেখযোগ্য কবিও বটে। কবি লিখতে বসে কোন রকমের ছলা, কলা, মায়াময় পরিবেশ তৈরি না করে বাস্তব জীবনের গভীর সত্যকে কবিতায় উদঘাটিত করেছেন। বর্তমান সময় ও সমাজে ডেসিং, পুশিং, ম্যাচিং চ্যাটিং ও তৈলাক্ত মর্দনের মাধ্যমে কবিতার বাজার ছেয়ে গেলেও কবি প্রণব কুমার মুখোপাধ্যায় সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী এক কবি ছিলেন।
কবি প্রণব কুমার মুখোপাধ্যায়ের বিশিষ্ট কাব্যগ্ৰন্থগুলো হল "অতলান্ত"; "বুদ্ধির্যস্য" ; "এসো, হাত ধরো"; "অপেক্ষার রঙ" প্রভৃতি।
কবি প্রণব কুমার মুখোপাধ্যায় তার সমসাময়িক কবিদের প্রায় অনুকরণে কলকাতা মহানগরকে মেলে ধরেছেন "কখনও কলকাতা" কবিতার আঙ্গিকে-------
"কখনও কলকাতা তার আদিগন্ত রহস্যের কালো
এলোচুল খুলে দিতে পারে, কোন বর্ষার সন্ধ্যায়,
ময়দানের ভিজে ঘাস, অরণ্যের শান্ত হাতছানি,
সেন্ট পলস গির্জার চারপাশে চেনা রাস্তা ফুটপাত,
অচেনা আলোয় জ্বলে উঠতে পারে, ডবল ডেকারে
যেতে যেতে কোনদিন হয়তো বা মনে হতে পারে "।
প্রসঙ্গান্তরে জনৈক কবি "এই কলকাতা" নামক একটি কবিতার কয়েকটি চরণ প্রণেধানযোগ্য---
"ভালোবাসার নাম কলকাতা
কলকাতার সঙ্গে আমি মেলাতে পারছি না
প্রতিটি রাস্তাঘাট আলোছায়া শর্টকাট
মনে হয় যেন অচেনা অজানা নারীর শিরা
সন্ধ্যায় সাটেল ট্যাক্সিতে বাড়ি ফেরার সময়
শন শনে সমিরনের স্বাভাবিক থাপ্পড়
হঠাৎ টেনে আনে, পুরনো বান্ধবীদের
পরস্ত্রীতে উত্তরণের টাটকা স্মৃতি"----!
তাই জনগণের প্রিয় কবি প্রণব কুমার মুখোপাধ্যায়
বলেছেন----
"স্থির দুই চক্ষু তার, অলৌকিক গির্জার ঘন্টায়
তোমার মুখশ্রী মায়া আভসে উজ্জ্বল প্রতিরূপ
প্রতিটি অস্থির রেখা অচেনা রহস্যে জ্বলে ওঠে
বিদ্যুৎল্লেখার মত উদ্ভাসিত, কখনও কলকাতা"।
কবি প্রণব কুমার মুখোপাধ্যায় তার "অতলান্ত" কবিতায় প্রেমের আশঙ্কা ও উদ্বেগকে যত্ন সহকারে সাবলীল ভাবেই স্পষ্ট উচ্চারণ করেছেন---
"হারিয়ে যাবার ভয়ে - ভয়ে দূরে-- দূরেই থাকি
ভীরু-হৃদয় মন!
অনেকবার ভেবেছি কাছে না হয় যাই, ডাকি
তোমাকে সেই হারানো সুরে, স্মৃতির নির্জন
খাতায় কত ক্ষতির লেখা দু- হাতে মুছে ফেলে
আবার যদি পুরানো নামে পুরনো গানে ডাকি
তাহলে তুমি দু - চোখে ঘোর অতল ছায়া ঢেলে
আপন করে নেবে আমায় কি"!
কবি প্রণব কুমার মুখোপাধ্যায় অবচেতন মনে জমে থাকা ভয়, বিস্ময় মাঝে মাঝে কবির হৃদয়কে তোলপাড় করে দিত, এই জাগরণের চালচিত্রের নক্সা "সভাবোক্তি" অলংকারের মাধ্যমে পাঠকের দরবারে "মধ্যবর্তী জাগরণ" কবিতার মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েছেন---
"এক - একদিন মধ্যরাতে এ-রকম ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘুম ভেঙ্গে, স্বপ্ন ভেঙ্গে, স্বপ্ন ভেঙ্গে চারদিক অন্ধকার ।----হৃদপিণ্ড, ধক-- ধক করে।
এক ঘুম থেকে আরেক ঘুমের মধ্যবর্তী এই জাগরণ,
এক জন্ম থেকে অন্য জন্মের মধ্যবর্তিতা,
এক অন্ধকার থেকে আরেক নিশ্চেতনতার দিকে অনিবার্য
যেতে যেতে যেতে
হঠাৎ স্পষ্ট শুনতে পেলাম জাহাজের শব্দ"।
কবি প্রণব কুমার মুখোপাধ্যায়ের "দিনযাপন" কবিতায় সমকালীন সমাজে শিল্পীদের দিন যাপনের আত্মশ্লাঘা কবিতার মাধ্যমে বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করেছেন। যেমন
"যেহেতু শিল্পী, তাই জানা গেছে
তৃষ্ণা মেটাবে তীব্র সুরা"।
কবির লেখনীতে "তাকে বলো" কবিতায় প্রেমের আশ্রয়ের প্রতি গভীর আস্তা ও শ্রদ্ধা সাবলীল ভাবে প্রকাশ করেছেন-
"আসন্ন সন্ধ্যায় আমি দূর থেকে তোমাকে দেখলুম।
যখন উত্তরে বৃষ্টি প্রয়োজন- উপচনো,
অথচ
----+-------++++---------
তোমার সর্বাঙ্গে কিছু সুবাতাস তখনও জড়িয়ে
শহরতলির কিছু গন্ধময় ধুলোর আঁচড়,
গ্ৰামান্তের কিছু শস্য - সবুজের স্বচ্ছ শিহরণ,
কিছু জলকণা - বুঝি উপহার দিয়েছিল নদী,
তোমার সর্বাঙ্গে সেই রোমাঞ্চ এবং সুবাতাস
তখনো জড়িয়ে।
এভাবেই কবি প্রেমের জ্বালা-যন্ত্রণা ও সুন্দর মানসিকতাকে সার্বজনীন রূপদান করতে পেরেছিলেন ।কবি বলেছেন ---"তুমি চলে যাবে , তুমি যাও।
শুধু তাকে
বলো, আমি কোথাও যাব না"।
কবি প্রণব কুমার মুখোপাধ্যায়ের কবিতার প্রসঙ্গে 'পুতুল নাচের ইতিকথা' উপন্যাসের মত পুতুলের সমকালীন জীবনে মানুষ যে পুতুলের মত, তাদের যা বলানো হচ্ছে তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাই উচ্চারণ করে পাঠককে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে ,এই সারসত্যটিকে কবি "কথা বলা পুতুল" কবিতায় উপস্থাপিত করেছেন------
"পুতুলকে মানুষ বানিয়ে
খেলাটা জমেছে ভাল । বিমগ্ধ দর্শক সহ শয়ে
হাততালির ঝড় তুলছে, উনিশ পয়সার বিনিময়ে।
জমেছে তামাশা । শুধু দেখতে দেখতে মনে হয়,
আরে,
ছবিটা নতুন, কিন্তু ব্যাপারটা অচেনা নয় মোটে।
মিছিলে - ময়দানে - বাসে ট্রামে কিংবা আপিসে - বাজারে
চায়ের দোকানে , পার্কে , গঙ্গাতীরে প্রকাশ্য রাস্তায়
যারা শুধু ঠোঁট নাড়ছে - একটু কান পাকলে বোঝা
যায়--
হুবহু অন্যের কণ্ঠ সেইসব পুতুলের ঠোঁটে" !
কবি প্রণব কুমার মুখোপাধ্যায়ের কাব্য কবিতার জগতে বাস্তব সত্যের সমকালীন সমাজের ভাবনা ও জীবন্ত সমস্যাকে ও সমাধান কে তাঁর কাব্যের পাতায় পাতায় উপস্থাপিত করেছেন, এই জন্য তিনি চিরন্তন শাশ্বত সুন্দর।
🍁
বাড়িতে বসেই রেজি.ডাক মাধ্যমে জ্বলদর্চির বিশেষ সংখ্যাগুলো সংগ্রহ করতে পারেন। যোগাযোগ হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৭৩২৫৩৪৪৮৪
1 Comments
কলেজ স্টিটে জ্বলদর্চির কোনও
ReplyDeleteঅফিস কিংবা কাউন্টার আছে কি?