জ্বলদর্চি

ইলা দত্ত সিং (আন্তর্জাতিক ক্রীড়াবিদ, ঝাড়গ্রাম)/ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৫১
ইলা দত্ত সিং (আন্তর্জাতিক ক্রীড়াবিদ, ঝাড়গ্রাম) 

ভাস্করব্রত পতি

এখনও পর্যন্ত বয়স্কদের জাতীয় ক্রীড়ায় অংশ নিয়েছেন ২০ বার। সেই ২০০২ থেকে ২০২৩ তাঁর পথচলা। এ পর্যন্ত পেয়েছেন মোট ২৫ টি সোনা, ১৫ টি রুপো এবং ১০ টি ব্রোঞ্জ পদক। আপাতত তেষট্টি বছরের এই 'তরুণী' এখনও সমানভাবে সচল। তিনি সাবলীল ভঙ্গীতে শেষ করতে পারেন ৫ হাজার ও ১০ হাজার মিটার দৌড়, ৫ কিমি হাঁটা, ২ কিমি স্টেপল চেজ প্রতিযোগিতার হার্ডলগুলো। এককথায় ২০০২ থেকে আজ পর্যন্ত MAFI (Masters Athletics Federation of India) National Champion মহিলা তিনি। এ পর্যন্ত ৫ বার এশিয়াড, ২ বার ইটালি (২০০৭) ও আমেরিকা (সাক্রামেন্টো, ২০১১) ওলিম্পিকে অংশগ্রহণ করেছেন। এছাড়া ২০০৮ এ মালয়েশিয়া, ২০১০ এ থাইল্যান্ডের চিয়ানমাই গিয়েছেন বয়স্ক ক্রীড়ায় অংশগ্রহণ করতে। এহেন মহিলা মেদিনীপুরের লাল মাটির বুক থেকেই উঠে এসেছেন বিশ্ব ক্রীড়া জগতে। 

তিনি ইলা দত্ত সিং। ঝাড়গ্রাম জেলা শহরের বাছুরডোবা এলাকায় বসবাসকারী এই প্রৌঢ়া অ্যাথলিট কিন্তু আজ জঙ্গলমহলের অতি পরিচিত মুখ। তিনি প্রমাণ করতে পেরেছেন বয়স নয়, শারীরিক সক্ষমতা এবং মনের জোর মিশে গেলে সব বাধা সরে যেতে বাধ্য। ষাট পেরিয়েও অদম্য লড়াই করতে পারা যায়। এবং তিনি তা করে চলেছেন সাবলীলভাবে। 

২০১৯ এ ৫৯ বছর বয়সে পুরুলিয়ার বেরো পাহাড়ে ট্রেকিং করেছেন। ২০২০ তে সান্দাকফু এবং ফালুটে ট্রেকিং করার দুঃসাহস দেখিয়েছেন ৬০ বছর বয়সে। শুশুনিয়াতেও করেছেন। তিনি এখন ইলেকট্রো হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। ঝাড়গ্রামের ভারত সেবাশ্রম সংঘে তাঁর OPD। এখানে বুধবার, বৃহস্পতিবার, শুক্রবার এবং শনিবার বসেন। তিনি এখন MAFI র ঝাড়গ্রাম জেলার কার্যনির্বাহী সম্পাদক এবং পরিচালক। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তিতে সম্মানিত হয়েছেন INO থেকে। গঠন করেছেন নিজস্ব যোগ সংগঠন "ইলু যোগা অ্যাথলেটিক্স অ্যাসোসিয়েশন"। 
আদপে তিনি পূর্ব মেদিনীপুরের মহিলা। ১৯৬০ এর ২৬ শে অক্টোবর মুগবেড়িয়ার বাসুদেববেড়িয়া গ্রামে জন্ম। বাবা ছিলেন প্রবোধ চন্দ্র দত্ত। পড়াশোনাতে খুব ভালো ছিলেন ইলা। বি এস সি বায়োতে গ্র্যাজুয়েশন। বি এডও করেছেন। বিবাহ সূত্রে তাঁকে যেতে হয়েছিল ঝাড়গ্রামের নয়াগ্রাম থানার বাছুরখোয়াড় গ্রামে। স্থানীয় রাধানগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক অনিল সিং তাঁর স্বামী। দুই মেয়ে এক ছেলে নিয়ে সংসার। বড় মেয়ে অণিমা বেলপাহাড়ি গ্রামীণ হাসপাতালের চিকিৎসক। ছোট মেয়ে মণিমাও এমবিবিএস পাস করে বেলপাহাড়ির তপসিয়া রামচন্দ্রপুর ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডাক্তার। এক ছেলে শুকদেবও ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে WBCS করে এখন মাথাভাঙ্গাতে Labour Assistant পদে কর্মরত। সংসারের প্রতি অবহেলা ছিলনা বিন্দুমাত্র। বাড়ির প্রতিটি সদস্যই সুপ্রতিষ্ঠিত আজ। আর তিনি নিজেকে মেলে ধরেছেন খেলার মাঠে। সোনা, রূপো ও ব্রোঞ্জ পদকের লড়াইতে। 

একসময় অ্যাথলিট হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। গ্রামের বাড়িতে সাংস্কৃতিক চক্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। শুরু সেখান থেকেই। নিজের পড়াশুনাতেও খামতি ছিলনা তাঁর। কিন্তু মনের মধ্যে খেলাধূলার যে বাসনা জমা ছিল তা তিনি পূরণ করেছেন প্রৌঢ়ত্বে এসে। সাধারণ এক বীমা সংস্থায় কাজ করে যৎসামান্য আয়। নিজের খেলার খরচের জন্য কারও কাছে কিছুই পাননি। বলা বাহুল্য, হাত পেতেও পাননি। আজ পর্যন্ত কোনও সরকারী অনুদান পাননি নিজের খেলার রাহাখরচ হিসেবেও। আবেদন নিবেদন করেও জোটেনি। অথচ অন্যান্যরা পেয়েছেন। তিনি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে ক্রীড়ায় ভারতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করেও সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন বারেবারে। নিজের যৎসামান্য উপার্জিত অর্থেই চালিয়েছেন যাবতীয় খরচ। এগিয়ে গিয়েছেন সামনের দিকে। থামেননি। লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন নিজের সঙ্গে। প্রতিকুলতার সঙ্গে। এবং জিতেছেন। 
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
ছেলেকে নিয়ে ঝাড়গ্রাম স্টেডিয়ামে নিয়মিত খেলতে যেতেন। সেখানে গিয়েই দেখা হয় ঝাড়গ্রাম ভেটারেন্স স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশানের সম্পাদক হরেন্দ্রনাথ দাসের সাথে। মূলতঃ তাঁরই উৎসাহে শুরু হয় নতুন জীবন। খেলোয়াড়ি জীবন। ছোটাছুটি জীবন। মাঠের জীবন। 

১৯৯৮ থেকে তাঁর পা চলা শুরু। মহকুমা, জেলা, রাজ্য স্তর থেকে একের পর এক পদক আসতে শুরু করে ইলা সিংয়ের। ২০০২ সালে বেঙ্গালুরুতে জাতীয় স্তরের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় সোনা জেতেন। ২০০৮ এ থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বয়স্কদের এশিয়াডে একশো মিটার রিলে দৌড়ে জেতেন রুপো এবং চারশো মিটার রিলেতে জেতেন ব্রোঞ্জ পদক। ২০০৬ সালে বেঙ্গালুরুতে বয়স্কদের এশিয়াডে ৫ কিমি হাঁটাতে সোনা জেতেন। ২০১০ সালে মালয়েশিয়াতে পেয়েছিলেন রৌপ্য পদক। ২০১৩ তে শ্রীলঙ্কায় বয়স্কদের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় ৫ কিমি হাঁটাতে রুপো এবং ২ কিমি স্টেপল চেজে জেতেন ব্রোঞ্জ পদক। এছাড়াও সদ্য ২০২৩ এ ঝাড়গ্রামে আয়োজিত রাজ্য ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় পেয়েছেন Best prize of WB State। 
তবে তাঁর এই উত্তরণের পথ মোটেও সহজ সরল ছিলনা। অর্থাভাব তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। ২০০৪ সালে প্রথমবার বিদেশযাত্রায় সুযোগ আসে তাঁর। সেবার থাইল্যান্ডের ব্যাঙ্ককে বয়স্কদের এশিয়াডে যাওয়ার সময় আর্থিক সমস্যা দেখা দেয়। চাঁদা তুলে অর্থ সংগ্রহ করা হয়। তেমনি পরবর্তীতে একই রকম কারণ তথা অর্থাভাবে অস্ট্রেলিয়া ও শ্রীলঙ্কায় আন্তর্জাতিক মিটে যেতে পারেননি ইলা দত্ত সিং।

তবে ২০০৭ সালে ইতালির ইচিওন শহরে বয়স্কদের মিটে যেতে পেরেছিলেন তিনি। কিন্তু সেখানে অন্য ফ্যাসাদ। ভাষা সমস্যার দরুণ ইভেন্টে যোগ দিতে পারেননি। এরপর ২০১১ সালে আমেরিকার সেক্রেমেন্টো ওয়ার্ল্ড মিট এ ২ কিমি স্টেপল চেজ প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। পদক পাননি। কিন্তু জুটেছিল 'অল অব দ্য বেস্ট' শংসাপত্র। তাঁর কর্মকাণ্ডের মূল ছিলেন তাঁর মা ইন্দুমতী দত্ত। মেয়ের সাফল্যের জন্য ২০১৭ তে তাঁর মাকে দেওয়া হয়েছিল বিখ্যাত 'জিজাবাঈ পুরস্কার'। ২০১২ তে মমতা ব্যানার্জী দিয়েছিলেন বিবেক পুরস্কার এবং ৫ হাজার টাকা। ইলা দত্ত সিংকে দিয়েই শুরু হয়েছিল প্রথম এই পুরস্কার প্রদান কর্মসূচি। কিন্তু আজ পর্যন্ত আর কোনো পুরস্কার বা আর্থিক সহায়তা পাননি সরকারের থেকে। 

শুধু দৌড় নয়, ক্রীড়া পরিচালনা সহ নানা বিষয়ে তিনি জড়িয়ে রেখেছেন নিজেকে। ২০১৮ তে তিনি Kabadi Bengal Amateur Association এর কোচ নির্বাচিত হন। হয়েছেন যোগ ব্যায়ামের কোচ। Pre Level AFI এর Coach হয়েছেন ২০১৯ এ। ইতিমধ্যে ফুটবল রেফারি অ্যাসোসিয়েশনের লিখিত পরীক্ষাতে পাস করে রয়েছেন। অনেক মেডেল পেলেও বয়স্কদের অলিম্পিকে সোনা জেতা হয়নি তাঁর। এই অপূর্ণ সাধটুকু পূরণ করতে চান ইলা দত্ত সিং। অদম্য মনের জোর অবশ্য তাঁকে নিরাশ করবেনা বলে তাঁর অভিমত। সেইসঙ্গে চান আট হাজারী যেকোনো পর্বতশৃঙ্গ জয় করতে। এক্ষেত্রে তাঁর প্রথম পছন্দ অন্নপূর্ণা শৃঙ্গ। শারীরিক ভাবে তিনি এখনও ফিট এই শৃঙ্গ জয় করার ক্ষেত্রে। কিন্তু আর্থিক সমস্যা এই স্বপ্ন পূরণে বাধা। স্পনসরশিপ পেলে তিনি এই আট হাজারী শৃঙ্গ জয় করবেনই। 

অসাধারণ বহুমুখী প্রতিভা ইলা দত্ত সিংয়ের। তিনি তাঁর বর্ণময় খেলোয়াড়ী জীবনকে পাথেয় করে গর্বিত করেছেন ঝাড়গ্রামের মাটি। উঁচুতে তুলে ধরেছেন মেদিনীপুরের গৌরব। সকলের মনের মণিকোঠায় আখ্যায়িত হয়েছেন 'মেদিনীপুরের মানুষ রতন' হিসেবে।

🍁
বাড়িতে বসেই রেজি.ডাক মাধ্যমে জ্বলদর্চির বিশেষ সংখ্যাগুলো সংগ্রহ করতে পারেন। যোগাযোগ  হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৭৩২৫৩৪৪৮৪

Post a Comment

0 Comments