জ্বলদর্চি

ব্যাঙের বিয়ে /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ৬৬

ব্যাঙের বিয়ে

ভাস্করব্রত পতি

মাঝে মাঝে প্রকৃতির কাছে অসহায় ভাবে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় মানুষ। বিরূপ প্রকৃতির উন্মত্ত আচরণে মানুষ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। বেঁচে থাকার অধীর আগ্রহে প্রকৃতির প্রতি শরণাপন্ন হয়ে ওঠে। 'ব্যাঙের বিয়ে' বা 'ব্যাঙের বিয়াও' তেমনই এক লৌকিক উৎসবউৎসব। যেখানে মানুষ ব্যস্ত হয়ে পড়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সমস্যার সমাধানে। নিজেরাই খুঁজে নেয় আশু সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার উপায়। 

দিনের পর দিন বৃষ্টি না হলে এলকায় খরা সৃষ্টি হয়। জ্বলতে থাকে মাঠ ঘাট প্রান্তর। তখন চাষবাস থেকে শুরু করে যাবতীয় কৃষিকাজের দফারফা। কিন্তু বাঁচতে হবে নিজেদের। বাঁচাতে হবে কৃষি। মানুষ তখন দৈব নির্ভর হয়ে পড়ে। দুর্বল চিত্তে বিভিন্ন রকম সংস্কারে আসক্ত হয়ে পড়ে। অসহায় মানুষ তখন এক ফোঁটা বৃষ্টির কামনায় নানা তুকতাক করতে থাকে। ভয়ার্ত অসহায় মানুষ তখন ব্যাঙের বিয়ে দেয়। তাঁদের বিশ্বাস যে, এর ফলে বৃষ্টি আসবে। অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ 'মেঘের কথা' তে (১৩২২ এর আশ্বিনে) লিখেছিলেন "বেঙ ডাকে ঘন ঘন / বৃষ্টি হবে শীঘ্র জানো"। 
উত্তরবঙ্গের লোকসমাজে কৃষিকেন্দ্রিক লোকাচার হিসেবে 'ব্যাঙের বিয়ে' বা 'ব্যাঙের বিয়াও' বেশ জনপ্রিয় লৌকিক কৃষি উৎসব। শুধু উত্তরবঙ্গ নয়, বর্ধমান জেলাতেও ব্যাঙের বিয়ে পরিলক্ষিত হয়। বুদবুদ এলাকায় গ্রামবাসীরা আয়োজন করেছিল। বালুরঘাটেও হয়েছে। ওড়িশার উপকূলবর্তী গ্রামগুলিতে এই প্রথা রয়েছে। এখানকার কেন্দ্রপাড়া জেলার টিকনপুরে আয়োজিত হয়েছে। আসামেও উৎযাপিত হয়। পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় পালন করেন অনেকেই। ময়মনসিংহতে ব্যাঙের বিয়ের পর ডোবায় ব্যাঙকে ছেড়ে দিয়ে মহিলাদের মুখে শোনা যায় এই গান। সেখানে তাঁরা সুর করে বলেন --
“বেঙ্গী ছেড়ীর বিয়া
সোনার লাডুম দিয়া।
বেঙ্গী লো মেঘ না নামাইয়া দে।
মল্লের বউ এর দাঁত খোঁটা
মেঘ পড়ে ফোঁটা ফোঁটা।
এক ফোঁটা পানি দেও ঘরে ভিজ্যা যাই।
চাচা মিয়া কান্দন করে ক্ষেতের আইলে বইয়া।
ক্ষেত খলা বিরান অইল পানি না পাইয়া ।
বেঙ্গী লো মেঘ নামাইয়া দে।” 
আসলে বৃষ্টি না থাকলে গ্রামের মানুষের শেষ ভরসা হয়ে ওঠে এই 'ব্যাঙের বিয়ে'। ব্যাঙের ডাক শুনে বৃষ্টির দেবতা বৃষ্টি না ছড়িয়ে থাকতে পারবেন না-- এই সরল বিশ্বাস গ্রামের প্রান্তিক মানুষের। যুগের পর যুগ ধরে তা চিরায়ত আমাদের পশ্চিমবঙ্গের বুকে। 
বছরের যে সময় দীর্ঘ অনাবৃষ্টির কারনে থমকে যায় কৃষিকাজ, শুকিয়ে যায় নদী নালা, খাল বিল, পুকুর ডোবা। তখন দেখা দেয় শস্যহানির আশঙ্কা। সেসময় উত্তরবঙ্গের কৃষিজীবী মানুষজন পালন করেন ব্যাঙের বিয়ে। তাঁদের বিশ্বাস যে, একটি স্ত্রী ব্যাঙের সাথে একটি পুরুষ ব্যাঙের মধ্যে বিয়ে দেওয়া হলে এবং নিবিষ্ট চিত্তে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা ও কামনা করলে আকাশে মেঘের আগমন ঘটবে। সেই মেঘ থেকে পৃথিবীর বুকে ঝরঝরিয়ে ঝরবে অঝোর বৃষ্টিপাত। এর ফলে সবকিছু ভরে উঠবে জলে। আবার শুরু হবে কৃষিকাজ। মানুষ বিশ্বাস করে যে, মেঘ বা বৃষ্টির সাথে ব্যাঙের একটা গভীর এবং অলৌকিক সম্পর্ক রয়েছে। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কাঁথি অঞ্চলে বৃষ্টির কামনায় মানুষ জন মহান আল্লাহ তাআলা এবং ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে বলেন, -- "ঝো রে বেঙা ঝো / ক্যায়া করেগা হো / এ দেশ মে পানি নেহি / ক্যায়া করেগা হো" ( সূত্র - কবি দেবাশীষ প্রধান)। 

ব্যাঙের বিয়ে সম্পূর্ণ একটি লৌকিক উৎসব। মানুষের কুসংস্কার আচ্ছন্ন মনের বহিঃপ্রকাশ। মনুষ্য সমাজের সামাজিক বিয়ের মতো রীতি নীতি অবশ্য এই মনুষ্যেতর প্রাণীদের বিবাহ লোকাচারে অনুসৃত হয়না। কিন্তু এই লৌকিক আচারের দিনক্ষণ এবং কর্মসূচি নির্ধারিত হয় গ্রামের মোড়লদের ঐক্যবদ্ধ অনুশাসন এবং মতদানের ওপর নির্ভর করে। ব্যাঙের বিয়ে দেওয়া নিয়ে গ্রামের মহিলাদের মুখে শোনা যায় --
"ব্যাঙের বিয়াও হইলেক আজি ভর বাইস্যার আশে হাড়িয়া কোনে মেঘ নাগাইছে বুড়া ব্যাঙে হাসে। 
সোনা ব্যাঙ কোলা ব্যাঙ যত ব্যাঙের দল 
ঘোঁৎ ঘাঁৎ করি ডাকে এলায় হইবে জল। 
কালো ম্যাঘ, ধওলা ম্যাঘ, হাড়িয়া কোনে বইসে 
গিজ্জি গিজ্জি আইসে ‘দেওয়া’ মেদিনী জলে ভাসে।"

পাশাপাশি থাকা দুই গ্রামের কয়েকজন কৃষক উদ্যোগী হয়ে বরপক্ষ এবং কনেপক্ষ হয়। এইভাবে আলাদা হয়ে তাঁরা একে অপরকে ব্যাঙের বিয়ের প্রস্তাব দেয়। তখন দুইপক্ষ রাজি হলে দুটো সোনা ব্যাঙ আনা হয়। যদি কোনো ভাবে স্ত্রী ব্যাঙ এবং পুরুষ ব্যাঙ আলাদা করা সম্ভব না হয়, তখন নতুন কাপড় থেকে কেটে তা দিয়ে বর কনে সাজানো হয়। বিয়েতে মণ্ডপসজ্জা, ফুলের মালা পরানো, গায়ে হলুদ, নতুন কাপড় পরানো, আশীর্বাদের ধান দূর্বা, সাত পাকে ঘোরা, সিঁদুর দান, পুরোহিতের মন্ত্র পাঠ, শঙ্খ বাদন, নাচ গান বাজনা, চব্য চোষ্য খাওয়া দাওয়া সব কিছুই থাকে।

কনেরূপী ব্যাঙের কপালে সিঁদুর পরানো হয়। এবার কনেপক্ষ অপেক্ষা করে বরপক্ষ কখন আসবে - এই আশায়। ইতিমধ্যে বরপক্ষ এসে যায় বাদ্যি বাজনা সহ। বররূপী ব্যাঙকে নিয়ে কনের বাড়িতে এলে সামাজিক বিয়ের মতো উপচারে বর কনে ব্যাঙ দুটিকে পাশাপাশি বসিয়ে বিয়ের মন্ত্রোচ্চারণ করা হয়। যদিও সেই মন্ত্রে "যদিদং হৃদয়ং তব" উচ্চারিত হয় কিনা জানা নেই। তবে গ্রামীণ ছড়ায় শোনা যায় --
‘ব্যাঙ্গা ব্যাঙ্গির বিয়া কুলা মাথায় দিয়া, 
ও ব্যাঙ পানি আন গিয়া। 
খালোত নাই পানি, 
বিলোত নাই পানি, 
আসমান ভাঙ্গি পড়ে ফোঁটা ফোঁটা পানি।’ ( দিনাজপুর, রাজবাটি) 

এই সময় কিন্তু ব্যাঙ দুটো যাতে লাফিয়ে পালিয়ে যেতে না পারে, তার জন্য তাঁদের বেঁধে রাখা হয়। এই বিয়েটা সম্পূর্ণ প্রতীকী। এরপর গনভোজন হয়। সবশেষে ব্যাঙ দুটিকে কোনো জলাশয়ে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। গ্রামীণ মানুষের বিশ্বাস যে এরফলে দু একদিনের মধ্যেই বৃষ্টি চলে আসবে ধরাধামে। কোথাও কোথাও বৃষ্টি বন্ধ করতে ব্যাঙের বিচ্ছেদ করার রেওয়াজ রয়েছে। মধ্যপ্রদেশের ভোপাল শহরে এরকম উল্টো পথে হাঁটতে দেখা গিয়েছে। 
দীর্ঘ খরায় বৃষ্টির কামনায় আয়োজিত এই ‘ব্যাঙের বিয়াও’ লোকাচারটির সাথে উত্তরবঙ্গের আরেকটি লৌকিক উৎসব ‘হুদুম দেও’র সাথে সম্পৃক্ত বলে অনেকের ধারণা। এই দুটি লোকাচারের উদ্দেশ্য কিন্তু একই। বৃষ্টি আনয়ন। মূলতঃ অনাবৃষ্টির ফলে বৃষ্টির দাবিই এই দুই লোকাচারের মূল লক্ষ্য। কিন্তু লৌকিক উপচারে পার্থক্য প্রতীয়মান। হুদুমদেওতে উলঙ্গ নারীই মূল। পুরুষবর্জিত উপচার এটি। লোকালয় থেকে দূরে সংগোপনে পালিত হয়। বৃষ্টির জন্য কাতর প্রার্থনা করেন। সেখানে ব্যাঙের বিয়ে বা ব্যাঙের বিয়াও জনসমক্ষে হয়। যদিও নারীরাই এখানে উপচার পালন করেন। বৃষ্টির জন্য মেঘের কাছে কাতর আবেদন না করে ব্যাঙের বিয়ে দেওয়া হয়। আর ব্যাঙের ঘন ঘন ডাক শুনে মেঘ দেবতা আর অপেক্ষা করে থাকতে পারে না আকাশে। এইভাবে ব্যাঙের বিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে বৃষ্টি চাইলে তা নাকি তাড়াতাড়ি পূরণ হয়। 

মোহাম্মদ আবদুল হাফিজ রাজশাহী জেলায় ব্যাঙের বিয়ের পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে জানিয়েছেন যে, “দুটি কোলা ব্যাঙকে সাজসজ্জা পরিয়ে নাকে নোলক দেয়া হয়। সন্ধ্যা হলে গাঁয়ের মেয়েরা কলসীতে পানি ভর্তি করে মাঠে যায় ৷ . বর্ষীয়সী মেয়েরা মাটিতে কলসির পানি ঢেলে দেয় ও মাটি কর্দমাক্ত করে। পরে ব্যাঙ দুটোকে কলাগাছের খোসার বাক্সে করে পুকুরে ছেড়ে দেওয়া হয়।” উল্লেখ্য যে, কোথাও কোথাও সোনা ব্যাঙ আবার কোথাও কোথাও কোলা ব্যাঙ ব্যবহৃত হয় ব্যাঙের বিয়েতে। সোনা ব্যাঙ হল লিথোব্যাটস পাইপিয়েনস বা রানা পাইপিয়েনস। আর কুনো ব্যঙ হল দত্তফ্রিনাস মেলানোসটিকটাস (বুফো মেলানোসটিকটাস)। এটি বুফোনিডি পরিবারের। 

ব্যাঙ নিয়ে এধরনের লৌকিক উৎসব হলেও কোথাও কোথাও অন্য ধারার আচরণ পরিলক্ষিত হয়। এ প্রসঙ্গে উত্তরবঙ্গের লোকগবেষক ধনেশ্বর বর্মন লিখেছেন, "বিশ্বের কোথাও কোথাও ব্যাঙ নিয়ে বিপরীতধর্মী অনুষ্ঠানেরও প্রচলন রয়েছে। এই অনুষ্ঠানে ব্যাঙকে ইচ্ছেমতন যন্ত্রণা দেওয়া হয়, কখনো কখনো ব্যাঙটিকে মেরে বৃষ্টি আনয়ন উৎসব পালন করা হয়। বাংলাদেশে বৃষ্টির কামনায় বদনা বিয়া, পুতলা বিয়া, ব্যাঙ বিয়া লোকাচারগুলি অনাবৃষ্টি বা খরার দিনে অনুষ্ঠিত হয়। সে দেশের গৃহস্থ বধূরা অনুষ্ঠানের প্রাপর্বে একটি গর্ত খুঁড়ে জলভর্তি করে রাখে। তারপর দুটো ব্যাঙ ধরে এনে কৃত্রিম বিয়ে দিয়ে ব্যাঙ দুটিকে গর্তে ছেড়ে দেয়। এই সময় মহিলার দলটি সুর করে লোকভাষায় ছড়া বলে।"

ব্যাঙের বিয়ে অনুষ্ঠানে মূলতঃ নানা ধরনের মেয়েলি সংস্কার এবং আচার আচরণ পালিত হয়। বর পক্ষ এবং কনে পক্ষ সবসময় লক্ষ্য রাখে, যাতে ব্যাঙ দুটির কোনো কষ্ট না হয়। কারণ ব্যাঙের বিয়ে শেষ হলেই আকাশে মেঘ সেজে উঠবে। এরপর বৃষ্টি নামবে। মাঠ ঘাট নদী নালা খাল বিল জলে ভরে উঠবে। কৃষকদের তখন পোয়াবারো  অবস্থা হবে। তাঁরা লাঙল কাঁধে নিয়ে চাষ কার্যে নামতে পারবে। প্রকৃত অর্থে বৃষ্টির দেবতা বরুণদেব যাঁর আজ্ঞাবহ সেই ইন্দ্রদেবকে তুষ্ট করতেই এই প্রাচীন সংস্কার ও প্রথামতো ব্যাঙের বিয়ের আয়োজন করা হয়।


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇




Post a Comment

0 Comments