জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা-৬৯/প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ৬৯

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

 ১৮৯৩ সালে শিকাগো ধর্ম মহাসভায় হিন্দু ধর্মের ব্যাখ্যাতারূপে স্বামী বিবেকানন্দ আন্তর্জাতিকভাবে প্রসিদ্ধি লাভ করলেন। ভারতীয় সংবাদপত্র ও পত্রিকাগুলিতে এই ধর্মমহাসভার খবর প্রকাশিত হল। আলমবাজার মঠে স্বামীজীর গুরুভাইয়েরা প্রথম প্রথম বিবেকানন্দের সঠিক পরিচয় বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে অবহিত ছিলেন না। কেননা তাঁকে তাঁরা বিবিদিষানন্দ নামে চিনতেন। আমেরিকা যাত্রার পূর্বে খেতড়ির রাজা অজিত সিং-এর অনুরোধে ‘বিবেকানন্দ’ নামটি গ্রহণ করেছিলেন স্বামীজী। একথা আলমবাজার মঠের ভাইয়েদের জানা ছিল না। যাই হোক, ধর্মমহাসভার ছ'মাস পরে স্বামীজী প্রেরিত একটি পত্র তাঁদের সমস্ত সন্দেহ নিরসন করে এবং মঠের ভাইয়েরা তাঁদের নেতার এই সাফল্যে গর্বিত হন।

 লোকে যখন ঈর্ষাকাতর হয়ে ওঠে তখন তারা সত্য ও অসত্যের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করে উঠতে পারে না। কিন্তু অন্তিমে সত্যেরই জয় হয়। বিবেকানন্দের সাফল্যে ক্রিশ্চান মিশনারিরা ও ব্রাহ্ম নেতা প্রতাপচন্দ্র মজুমদার আমেরিকার জনসাধারণের কাছে তাঁর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে সচেষ্ট হয়ে ওঠেন। তাঁরা অপবাদ দেন যে বিবেকানন্দ হিন্দু ধর্মের প্রকৃত প্রতিনিধি নন। এই অপপ্রচারের প্রতিক্রিয়ায় বিবেকানন্দ আলমবাজার মঠে গুরুভাইদের এক পত্র লিখে জানান কলকাতায় একটি জনসভা আয়োজন করতে। যে জনসভায় এটাই প্রতিষ্ঠিত করতে হবে যে আমেরিকায় তাঁর যা কিছু কর্মকাণ্ড তা হিন্দুধর্মের প্রতিনিধিত্বের সূত্রে। এর সঙ্গে মহাসভার চেয়ারম্যান ড. ব্যারোজকে একটি পত্র ধন্যবাদ জ্ঞাপনপূর্বক প্রেরণ করার কথাও লেখেন। এই পত্রের একটি কপি যেন তাঁকেও পাঠানো হয় সেকথাও জানান। 


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


 যথাসম্ভব শীঘ্র স্বামী অভেদানন্দ, রামকৃষ্ণানন্দ ও সারদানন্দ কলকাতায় এক বড় জনসভার আয়োজন করেন। অভেদানন্দজী সাময়িকভাবে বলরাম ভবনে থাকতে শুরু করেন। কারণ এখান থেকে প্রধান ধর্মীয় নেতাসমূহের, বিশিষ্ট পণ্ডিতবর্গের, উচ্চ সরকারি আধিকারিকদের, লেখক ও নামী সাংবাদিকদের এবং অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে সহজেই যোগাযোগ রক্ষা সম্ভবপর ছিল। এই পবিত্র কর্ম সম্পাদনে শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা ও অন্যান্য ভক্তবৃন্দ বিশেষভাবে প্রয়াসী হন। অভেদানন্দজী ছিলেন এই কর্মকাণ্ডের নেতৃত্বে। বেশিরভাগ সম্মানীয় ব্যক্তিবর্গ আমন্ত্রিত হয়ে জনসভায় যোগ দিতে সম্মত হন। জনসভায় সভাপতিত্ব করতে সম্মত হন রাজা পিয়ারিমোহন মুখোপাধ্যায়। তিনি বক্তব্য রাখেন --“After having him we feel how foolish it is to send missionaries to this learned nation.” আরও বলেন --“India should remain eternally grateful to him for the highest honour accorded to him in America as a representative of the Hindu religion.” ( God Lived With Them, By Swami Chetananda, Advaita Ashrama)
 ১৮৯৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর কলকাতা টাউন হলে এক বৃহৎ জনসভা আয়োজিত হয়। এই জনসভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এই বিষয়টি লিখিতরূপে অবহিত করা হয় স্বামী বিবেকানন্দ, ড. জন হেনরি ব্যারোজ এবং মি. মেরউইন মেরি স্নেলকে ( ধর্ম মহাসভার বিজ্ঞান শাখার সভাপতি )। গৃহীত সিদ্ধান্তের কিছু অংশ হল এইরকম --“This meeting desires to record its grateful appreciation of the great services rendered to the cause of Hinduism by Swami Vivekananda at Parliament Of Religions at Chicago and his subsequent work in America.” ( God Lived With Them, by Swami Chetanananda, Advaita Ashrama)
 এই বিশাল কর্মকাণ্ড সমাপনে নেতৃত্ব দানের কাজটি ছিল পরিশ্রমসাধ্য। ফলে শারীরিকভাবে নিঃশেষিত হয়ে পড়েন অভেদানন্দজী। আলমবাজার মঠে গুরুভাইদের অনুমতি নিয়ে বিশ্রাম ও ধ্যানে সময় অতিবাহিত করার বাসনায় হিমালয়ের কোলে অবস্থিত নৈনিতাল ও আলমোড়ায় পৌঁছান। সঙ্গে নিয়েছিলেন কিছু সংস্কৃত ও ইংরেজি বই। ধ্যানের সঙ্গে সঙ্গে সেগুলি পাঠ করার জন্য। কয়েকমাস পরে ফিরে আসেন আলমবাজার মঠে।

 ১৮৯৬ সালের জুন মাসে বিবেকানন্দ লণ্ডন থেকে আমেরিকায় সারদানন্দকে প্রেরণ করলেন সেখানে বেদান্ত আন্দোলনকে সজীব রাখার জন্য। জুলাই মাসে তারযোগে রামকৃষ্ণানন্দজীকে জানান কালীকে (অভেদানন্দজী ) সত্ত্বর লণ্ডনে পাঠাতে, সেখানে তাঁর কাজে সহায়তা করার জন্য। তিনি কালীর জন্য কাজের বন্দোবস্ত করে রেখেছেন। সেইমতো অভেদানন্দ লণ্ডনের উদ্দেশ্যে রওনা দেন ১৮৯৬ সালের অগাস্ট মাসে এবং সেখানে গিয়ে পৌঁছান সেপ্টেম্বরের শেষে। যাত্রাপথে তিনি সি সিকনেসে আক্রান্ত হন এবং উপযুক্ত নিরামিষ খাবারও পান নি। অবশেষে পৌঁছান উইম্বলডনে মিস হেনরিয়েটা মূলারের গৃহে। স্বামীজী প্রথমদিকে উদ্বিগ্ন ছিলেন, পরে অতীব আনন্দিত হন যখন দেখেন অভেদানন্দ নিরাপদে পৌঁছেছেন। বহু বছর পর এইভাবে দুই ভ্রাতার সাক্ষাৎ হয়, তাঁরা পরস্পর নিজেদের মধ্যে সংবাদাদি বিনিময় করেন।
 অভেদানন্দ স্বামীর জীবনের এই পর্যায়টি চমৎকারভাবে বর্ণিত হয়েছে স্বামী গম্ভীরানন্দ প্রণীত ‘শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তমালিকা’ গ্রন্থটিতে। গম্ভীরানন্দজী লিখছেন -- “১৮৯৬ খ্রীষ্টাব্দে তাঁহার জীবনের এক নূতন পর্যায় আরম্ভ হইল -- দীর্ঘ সাধনার ফলে তিনি যে শক্তি অর্জন করিয়াছিলেন, আজ তাহার বিকাশের সুযোগ ঘটিল। বিদেশে বেদান্ত প্রচারকার্যে স্বামী বিবেকানন্দের আহ্বানে তিনি ঐ বৎসর আগস্ট মাসের মাঝামাঝি ‘গোলকুণ্ডা’ জাহাজে লণ্ডন যাত্রা করিলেন। প্রায় পাঁচ সপ্তাহ পরে উইম্বলডনে মিস মূলারের বাড়িতে উপস্থিত হইলেন। লণ্ডনে প্রায় একমাস অবস্থানের পর স্বামীজী অকস্মাৎ একদিন জানাইলেন যে ‘খ্রীষ্ট-থিয়োসফিক্যাল সোসাইটি’তে হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে তাঁহাকে বক্তৃতা করিতে হইবে -- সমস্ত ব্যবস্থা ঠিক হইয়া গিয়াছে, কোন পরিবর্তন অসম্ভব। 
অভেদানন্দ তো আকাশ হইতে পড়িলেন অথচ স্বামীজী তাঁহাকে কিছুতেই ছাড়িবেন না জানিয়া তাঁহারই নির্দেশ মতো ‘পঞ্চদশী’ অবলম্বনে প্রবন্ধ লিখিয়া তাহা আয়ত্ত করিতে লাগিলেন। অবশেষে ২৭ শে অক্টোবর তাঁহার জীবনের প্রথম বক্তৃতা হইয়া গেল। উহা শুনিয়া সকলেই আনন্দিত হইলেন এবং স্বামী অভেদানন্দের ভাবী প্রচারক জীবন যে অতি সমুজ্জ্বল সে বিষয়ে কাহারও সন্দেহ রহিল না। আর সকলেই বুঝিলেন যে, স্বামীজী লোক চিনিতে পারেন এবং তাহাদিগকে কার্যের উপযুক্ত করিয়া লইতে পারেন -- ‘আশ্চর্যো জ্ঞাতা, কুশলানুশিষ্টঃ’।” গম্ভীরানন্দজী আরও লিখছেন --“নভেম্বর মাসে কার্যের সুবিধার জন্য স্বামীজী, অভেদানন্দ ও গুডউইন ১৪ নং গ্রে কোর্ট গার্ডেন্সে ভাড়াবাড়িতে উঠিয়া আসিলেন এবং বক্তৃতার জন্য ভিক্টোরিয়া স্ট্রীটে একটি হল ভাড়া লইলেন। স্বামীজী এই গৃহে তিন মাস অবস্থানের সুযোগে অভেদানন্দকে ইংরেজ-জীবনের জ্ঞাতব্য বিষয়সমূহ শিখাইয়া দিলেন। অভেদানন্দও স্বামীজীর সাহায্যে ডয়সন্, ম্যাক্সমূলার প্রভৃতি মনীষীর সহিত পরিচিত হইলেন এবং স্বামীজীর নির্দেশে লণ্ডন ও নগরোপকণ্ঠে বক্তৃতাদি-সাহায্যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করিলেন।”

Post a Comment

0 Comments