দেশান্তরী -১৬
হিল্লোল রায়
থাকতে আর পারলি কই? আমারে তুই ছাড়লি কই?
এরপর মানক সংস্থায় সঞ্চয়ের সংগে দেখা হল ওর অফিস ছুটীর পর বিকাল ৫-২৫। গল্প করতে করতে সময় কেটে গেল। হাবড়া ফিরলাম ৭-৫০। সেজমাসি মলিনা নিয়োগীর বিয়ের দিন স্থির হয়েছে ফেব্রুয়ারী ২৭, ১৯৭৫, কাজেই ঐ দিনটা বেশ ব্যস্ততার মধ্যেই কেটে গেল। পাইকপাড়ার বড়মামার বাসায় বিয়ে, রাতটা ওখানেই কাটিয়ে দিলাম। আমার অফিস অনুপস্থিতি হল। পরদিন সকালে ফেব্রুয়ারী ২৮, ১৯৭৫ হাবড়ায় ফিরে গেলাম। খাটাখাটুনি করে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। তাই বিশ্রাম নেবো ঠিক করেছি শনিবার ও আর্গোসিতে।
আমার পাস্পোর্ট এ্যাপ্লিকেশান ফর্মের exact copy তৈ্রী করে রাখলাম ঐ blank application ফর্মেই। ভবিষ্যতে যাতে ঐ কপি দেখেই এ্যাপ্লাই করতে পারে মা ও ভাইরা সবাই। এখন শুধু দিন গুনছি, কবে আমেরিকা পাড়ি দিতে হবে। আর কি কি জিনিস সঙ্গে নিতে হবে তার লিস্ট তৈরি করছি আর্গোসিতে বসে।
মার্চ ২, ১৯৭৫ রোববার আমার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র(মার্কসশীট, বি ই সার্টিফিকেট-যা যা প্রয়োজন হবে আমেরিকা পৌঁছাবার পরে) আমার বি ই কলেজ থাকাকালীন ট্র্যাঙ্কে যেগুলো ছিল সেগুলো থেকে বেছে গুছিয়ে নিলাম। মার্চ ৩, ১৯৭৫ সোমবার ৮-৩৬ এর হাবড়া লোক্যালে বেরিয়ে পড়লাম মিঃ সিনহার আয়োনা ট্র্যাভেলস -এর অফিস লক্ষ্য করে। কিন্তু মিঃ সিনহা অনুপস্থিত। একটা হাত চিঠি লিখে বেরিয়ে এলাম।
হাত চিঠিটার বক্তব্য বিশেষ কিছুই নয়। ভিসা পাবার পর আর কি কি করণীয় সেটা জানবার ইচ্ছা এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ক্লীয়ারেন্স সংক্রান্ত ব্যাপার। আর কী করতে হবে সেটাও জানা আমার প্রয়োজন। কিন্তু সিনহার দেখা পেলাম না। সোজা আমার অফিস চলে গেলাম পায়ে হেঁটেই। তারপর অফিসের কাজকর্ম সেরে আর্গোসিতে ফিরলাম সন্ধ্যা ৭-২১।
পরদিন অর্থাৎ মার্চ ৮, ১৯৭৫ মংগলবার ৮-৩৬ এর হাবড়া লোক্যাল ধরে শিয়ালদায় এলাম ১০-১০। ওখান থেকে আয়োনা ট্র্যাভেলস এ ঠিক ১০-৪৫ পৌঁছালাম।
মিঃ সিনহার সংগে সব আলোচনা হল, এমন কি প্লেনের টিকিট সংক্রান্ত ব্যাপারেও। আমার ভিসা খানা ডেলিভারী নেওয়ার সময় TWA অর্থাৎ Trans World Airlines থেকে “Fly now......Pay Later” স্কিম সম্বন্ধে কয়েকখানা Leaflet দিয়েছিল। মিঃ সিনহার সংগে আলোচনা করে জিনিষটার সত্যতা ও সুবিধা সম্পর্কে কৌ্তূহল বাড়িয়ে নিলাম।
পরে ওঁনার সংগেই স্কুটারে চেপে বেরিয়ে পড়লাম এয়ার ইন্ডিয়ার ডালহৌসী স্কোয়ার অফিস অভিমুখে। এয়ার ইন্ডিয়া থেকে কলকাতা -নিউ ইয়র্ক-ফিলাডেলফিয়া, দিল্লী/মুম্বাই-নিউইয়র্ক-ফিলাডেলফিয়া ইত্যাদি Details & Latest ভাড়া জেনে নিলাম মিঃ বর্ধন, পি এ টু কমার্শিয়াল ম্যানেজারের কাছ থেকে। এয়ার ইন্ডিয়া থেকে বেরিয়ে স্কুটারে চেপে গেলাম TWA এর অফিস, Govt. Place North, Cal-1। শুনলাম Fly now...scheme টা গত মাস থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে এবং কলকাতা থেকে কোন flight-ই নেই।
মাতলো দিক-বসনা, মনটা রাঙা রসনা
সুনিশ্চিত হলাম এয়ার ইন্ডিয়ার ভাড়া সম্পর্কে এবং TWA এর সার্ভিস তুলে নেওয়া কলকাতা থেকে। TWA র অফিস থেকে বেরিয়ে সিনহার স্কুটার চেপে সি এম পিও র গার্সটিন প্লেস, কলকাতা -১ অফিসে গেলাম কিন্তু কারও দেখা পেলাম না। বেরিয়ে এলাম।। মিঃ সিনহাকে বিদায় জানালাম বেলা একটায়।
আমিও হেয়ার স্ট্রীট থেকে হাওড়া মুখী ১২ নং ট্রাম চেপে হাওড়া গেলাম। ওখান থেকে আমার কাজের site(বংগবাসী সিনেমা হলের কাছে) দেখাশোনা করে অফিসে ফিরলাম ৪-১৫ নাগাদ। খুবই ক্লান্ত।
গল্পগুজব করে সময় কাটিয়ে বিকাল ৫-০৫ নাগাদ অফিস থেকে বেরুলাম। তারপর ট্রাম-ট্রেণ চেপে রাত ৮-৩০ এ হাবড়া পৌঁছালাম। পরদিন বিশ্রাম নিলাম পুরোপুরি, আর্গোসিতে বসে। বিকালে ৩-৩৬ এর হাবড়া লোক্যালে কলকাতা চলে এলাম।
বড়মামার পাইকপাড়ার বাসায় মার্চ ৬, ১৯৭৫ বৃহস্পতিবার সকাল সাতটায় উঠলাম। বেলা দশটা নাগাদ বড়মামার জীপে চেপে বাগবাজার নামলাম। ওখান থেকে বাসে চেপে “কাটাকল” স্টপেজে আমার site দেখতে গেলাম। ওখান থেকে বেলা একটায় বেরিয়ে ট্রামে-বাসে চেপে সোজা ডালহৌসী স্কোয়ার। এয়ার ইন্ডিয়ার অফিসে বসে প্লেনের ভাড়া নতুন করে জেনে নিলাম। তারপর রিজার্ভ ব্যাঙ্কে গিয়ে ক্লীয়ারেন্স সম্পর্কে আলোচনা করলাম। এবার অফিসের দিকে ৩-৪০ নাগাদ গেলাম।
পায়ে হেঁটে অফিস পৌঁছাতে ঠিক চারটে। কোনই কাজ নেই। গল্পগুজব করে ৫-০৫ এ বেরুলাম। আজ রাত্রে পাইকপাড়াতেই থাকব আর্গোসিতে বলা রয়েছে। তাই অফিস ছুটীর পর গন্তব্যস্থল বড়মামার পাইকপাড়ার বাসা। রাত্রে বড়মামার সংগে বিস্তারিত আলোচনা হল।
দিল্লী অথবা মুম্বাই থেকে নিউ ইয়র্ক-ফিলাডেলফিয়া টিকিট করলে কিছুটা সস্তায় হবে। তবে একটা অসুবিধা হল কলকাতা থেকে দিল্লী/মুম্বাই ট্রেণে গিয়ে ওখান থেকে প্লেনে চাপতে হবে। কিছু টাকার সাশ্রয় হলেও ধকলটা তো নেহাৎ কম হবে না- এসবই ভাবছি মনে মনে। তাছাড়া হাওড়া ডিভিশানে কোনো ট্রেণেই চাপি নি কোনদিনই, অভিজ্ঞতাও নেই।
বড়মামার পরামর্শ মত এটাও ঠিক করলাম, কলকাতা থেকে দিল্লী/মুম্বাই পর্য্যন্ত ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের প্লেনে গেলেও মন্দ হয় না। আলোচনা শেষ হতে বেশ রাত হল, এগারোটা। শুয়ে পড়লাম দেরী না করেই।
পরদিন অর্থাৎ মার্চ ৭, ১৯৭৫ শুক্রবার সকাল দশটায় পাইকপাড়া থেকে বেরিয়ে সঞ্চয়ের অফিসে এসে ওর কাছে রাখা আমার পাস্পোর্ট ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে নিলাম। ওখান থেকে আয়কর ভবনে ১১-৩০ নাগাদ শান্তিমামার দেখা পেলাম।
ইঙ্কাম ট্যাক্স ক্লীয়ারেন্স সার্টিফিকেটখানা Renewal এর জন্য আলোচনা হল। শান্তিমামার সংগে পায়ে হেঁটে আর একটা অফিস Income Tax Building, Govt. Place North, cal-1.(রাজভবনের পেছনে) গিয়ে জনৈক ভদ্রলোকের সংগে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন শান্তিমামা।
শান্তিমামার পরিচিত ভদ্রলোক বেশ উৎসাহী মনে হল এবং উনি যথাসাধ্য সাহায্যেরও আশ্বাস দিলেন। আমার Income tax Clearence সংক্রান্ত কাগজপত্র উনি রেখে দিলেন। এবং আগামী সোমবার অর্থাৎ মার্চ ১০, ১৯৭৫ ওনার সাথে দেখা করতে বল্লেন ঠিক এগারোটায়। আবার শান্তিমামার অফিসে ফিরলাম। গল্পগুজব করে সঞ্চয়ের অফিসে।
কথার ভিতরে কথা, খুঁজে ফিরি হেথা হোথা
ক্ষণিক বিশ্রাম নিয়ে পায়ে হেঁটেই ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের (সেন্ট্রাল এভিনিউ) অফিস। ওখান থেকে একখানা টাইম -টেবল নিয়ে এয়ার ইন্ডিয়া অফিসে ২-১৫ এ পৌঁছালাম। ভাড়া সংক্রান্ত ব্যাপারে মিঃ এ বর্ধনের সংগে খোলাখুলি আলোচনা হল। উনি আমাকে সাহায্য করতে রাজী হলেন। প্রায় এক ঘন্টার কিছু বেশি আলোচনা করার পর ৩-৩৫ নাগাদ এয়ার ইন্ডিয়া থেকে বেরিয়ে সি এম পি ও র গার্সটিন প্লেস অফিসে গেলাম।
বড়মামা অনুপস্থিত থাকায় মিঃ অজিত ভুঁইঞ্যার সংগে আলোচনা করলাম। ওখান থেকে বেলা ৪-৩৫ নাগাদ বেরিয়ে হেঁটে সঞ্চয়ের অফিস ঠিক পাঁচটায় পৌঁছালাম। সঞ্চয়ের সংগে বেরিয়ে পড়লাম ওর অফিস ছুটীর পরেই।
বিভিন্ন দোকানে প্যান্টের কাপড় পছন্দ করবার ব্যাপারেই সঞ্চয়কে সংগী হিসাবে নিয়েছি। প্রচন্ড দাম দেখে একটু পিছিয়ে যাচ্ছিলাম। মোটামুটি একটা কাপড় পছন্দ করে- পরে কিনবো বলে বেরিয়ে পড়লাম দুজনেই। ট্রাম-ট্রেণ ধরে হাবড়া ফিরতে রাত ৯-১৫। ভীষণ ক্লান্ত। সারাদনের খাটুনীর পরিমাপ রাত্রে বুঝতে পারছি।
নতুন কিছু করণীয় না থাকায় সকাল ৯-২৪ নাগাদ বাড়ী থেকে বেরিয়ে পড়লাম অফিসকে উদ্দেশ্য করে। কারণ এই সব ব্যাপারে আমাকে এত বেশী ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে যে অফিসে প্রায়ই অনুপস্থিত থাকতে বাধ্য হচ্ছি।
তাই আজ অর্থাৎ শনিবার, মার্চ ৮, ১৯৭৫ অফিসে যাব ঠিক করেই বেরিয়েছি। অফিসে কোনই কাজ নেই। সময় কাটিয়ে বিকাল ৩-১৫ নাগাদ ট্রামে চেপে এসপ্ল্যানেড ।
গতকালের পছন্দ করে যাওয়া প্যান্ট-এর কাপড়টাই নেব বলে ঠিক করেছি। তাই এসপ্ল্যানেডে নেমে সোজা চলে এলাম “লীলা”, ৫ নং ধর্মতলা স্ট্রীট, কলকাতা -১৩। ওখান থেকে দাম ঠিক করে প্যান্ট লেংথ-টা নিয়ে নিলাম ১১০ টাকায়। কাপড়টার সম্পর্কে উক্ত দোকানীর বক্তৃতার অংশ বিশেষ শুনেই বেরিয়ে পড়লাম। সামনেই ২৪ নং বাসে চেপে শিয়ালদা। হাবড়া পৌঁছাতে ৫-৫০। হাতমুখ ধুয়ে বিশ্রাম করে পেটে কিছুটা “লোড' চাপিয়ে চাঙ্গা হলাম।
“ইউনিক টেলর্স”, যশোর রোড, হাবড়া গিয়ে প্যান্টের মাপ দিলাম সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ। সঞ্চয়ের সংগে দেখা হয়ে গেল ওখানেই। দুজনের পছন্দমত প্যান্টের ডিজাইন বল্লাম। প্যান্টের কাপড়টা ইউনিক টেলর্স -এ দিয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম।
তারপর গল্পগুজব করে আর্গোসিতে ফিরতে রাত ৮-২০। সামান্য গল্প, আলসেমি, খাওয়া-দাওয়া সেরে রাতের বিশ্রাম, প্রায় সাড়ে দশটায়। মনে মনে পরিকল্পনা নিচ্ছি আগামী সপ্তাহের। কখন ঘুমিয়েছি খেয়াল নেই।
রবিবার অর্থাৎ মার্চ ৯, ১৯৭৫ সকাল সাতটায় ঘুম থেকে উঠে পড়লাম। চারিদিকে কুয়াশাছন্ন থাকায় বেলা হয়ে গেল উঠতেই। সকাল ১১-৩০টা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম শপিং করতে।
আমেরিকায় আসবার সময় কি কি জিনিষ সংগে নেব তার একটা লিস্ট আগে করেই রেখেছিলাম। বোরোলিন, টুথপেস্ট-ব্রাশ ইত্যাদি -মার্কেটিং করে আর্গোসিটে ফিরতে বেলা দেড়টা। তারপর স্নান, খাওয়া -দাওয়া , বিশ্রাম নিয়ে গতানুগতিক ভাবে রবিবার কেটে গেল। বেশ মনে আছে, মার্চ ১০, ১৯৭৫ সোমবার সকাল ৮-৩৬ এর হাবড়া লোকাল ধরে কলকাতায় চলে এলাম। মিঃ সিনহার দেখা পেলাম না।
আয়োনা ট্রাভেলস থেকে বেরিয়ে সোজা গভর্নমেন্ট প্লেস নর্থ, কলকাতা -এক এ ইঙ্কাম ট্যাক্স সার্টিফিকেটের extension করার জন্যেই ওখানে যাওয়া। শুনলাম, আমাকে AIR INDIAর প্লেনে প্যাসেজ বুকিং হয়েছে তার একটা সার্টিফিকেট ওখানে দেখাতে হবে। ছুটলাম এয়ার ইন্ডিয়ার ডালহৌসী স্কোয়ার অফিসে। মিঃ বর্ধনের সংগে কথা বলতেই উনি একখানা সার্টিফিকেট দিয়ে দিলেন ১২টা নাগাদ। উক্ত সার্টিফিকেট নিয়ে আবার ইঙ্কাম ট্যাক্স অফিসে গেলাম। এবার এইখানা নিয়ে আমার পদার্পণ আয়কর ভবনে(এসপ্ল্যানেড অফিস) বিদেশ বিভাগ, সপ্তম তল। আয়কর বিভাগের ছাড়পত্র পেয়ে গেলাম সংগে সংগেই। স্বস্তি পেলাম।
ক্রমশঃ
বাড়িতে বসেই রেজি.ডাক মাধ্যমে জ্বলদর্চির বিশেষ সংখ্যাগুলো সংগ্রহ করতে পারেন। যোগাযোগ হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৭৩২৫৩৪৪৮৪
0 Comments