জ্বলদর্চি

জল সংক্রান্তি /ভাস্করব্রত পতি


পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ৭০
জল সংক্রান্তি 

ভাস্করব্রত পতি


জল সংক্রান্তি ব্রত  তথা এই লৌকিক উৎসবটি পালন করলে ব্রতীনী নারী কোনোদিনই তাঁর স্বামীকে হারাবে না। সুস্থ সবল থাকবে স্বামী। শাঁখা সিঁদুর পরে সুখে ঘর করার সুযোগ পাবে সে। 

বৈশাখ মাসের বিষ্ণুপদী সংক্রান্তির দিন এই ব্রত পালন করতে হয়। 'বিষ্ণুপদী সংক্রান্তি' হল বৃষ বৃশ্চিক সিংহ এবং কুম্ভ রাশির সংক্রান্তি। শ্লোকে আছে -- "বৃষবৃশ্চিককুম্ভেষু সিংহ বিষ্ণুপদী স্মৃতি"। এছাড়াও বিষ্ণুপদসম্ভুতা গঙ্গাকে বলে 'বিষ্ণুপদী'। দ্বারকা হলো 'বিষ্ণুপদী'। 

জল সংক্রান্তির উদযাপনের একটি পৌরাণিক কাহিনী শোনা যায়। একসময় পিতামহ ভীষ্ম ইচ্ছামৃত্যুতে নিমজ্জন করেছিলেন নিজেকে। সেসময় তিনি যখন শরশয্যায় শুয়েছিলেন তখন রাজা যুধিষ্ঠির তাঁর কাছে আসেন। তিনি ভীষ্মকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, মানুষ কি কাজ করলে পৃথিবীতে ধনবান, গুণবান ও জীতেন্দ্রিয় হবে। এবং সব বিষয়ে জয়লাভ করতে পারবে। আর তাঁকে যাতে নরকে যেতে হয় না সেই বিষয়ে কি কি করতে হবে। 

পিতামহ ভীষ্ম তখন যুধিষ্ঠিরের ওপর খুব সন্তুষ্ট হয়ে শোনালেন একটি সুন্দর কাহিনী। অনেক আগে ঋষি মন্তিব্যের গুণবতী নামে এক স্ত্রী ছিল। সেই গুণবতী নানা রঙের গুঁড়ো দিয়ে তাঁদের পর্ণ কুটীরটি প্রতিদিন সাজিয়ে রাখতো। আর তাতে তাঁর স্বামী তথা ঋষি মন্তিব্য খুবই আনন্দিত হতো। খুশি হতো। 
গুণবতী একদিন এইভাবে তাঁদের কুটীরখানি সাজিয়ে, তাঁর স্বামীকে বললেন, "হে প্ৰভু ! কি কাজ করলে মানুষ পৃথিবীতে ঠাণ্ডা জল পেতে পারে? কি করলে নীরোগ থাকতে পারে? কি করলে আর কখনও তাঁকে নরকে যেতে হবেনা? সেসব আমাকে বুঝিয়ে বলুন আজ"। মন্তিব্য এই কথা শুনে খুব সন্তুষ্ট হলেন স্ত্রীর প্রতি। এরপর গুণবতীকে বললেন যে, "জল সংক্রান্তি ব্রত এজন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক কাজ। এই ফল লাভের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো। আর সকল ব্রতের সেরা এটি। এই ব্রতের সৃষ্টিকারী স্বয়ং ব্রহ্মা। আমি তোমাকে সেই ব্রতের বিষয়েই বলছি আজ"। তিনি বললেন, "প্রত্যেকেরই খুব ভক্তি এবং নিষ্ঠার সঙ্গে এই ব্রত পালন করা উচিত। কোনও খামতি যেন না থাকে পালনের ক্ষেত্রে। এর ফলে এই ব্যক্তি অফুরন্ত ঠাণ্ডা জল পেতে পারবে। সবচেয়ে বড় কথা, সবশেষে অনেক সুখ ভোগ করে মৃত্যুর পর বিষ্ণুপদ প্রাপ্ত হতে পারবে"। 
গুণবতী তখন এই ব্রতের প্রকৃত বিধান কি, তা শোনাতে বললেন। গুণবতীর কথামতো ঋষি মন্তিব্য জানালেন, "এজন্য খুব সকালে স্নান করে শুদ্ধ হতে হবে। এরপর শুদ্ধাচারে নারায়ণের অর্চনা ও সঙ্কল্প গ্রহণ করতে হবে। তারপর লক্ষ্মী জনার্দনের পূজো করে ভোজ্যি, জলভরা কলসী আর দক্ষিণা দান করে ব্রতকথা শুনতে হবে। শেষে সামর্থ্য অনুযায়ী ব্রাহ্মণ ভোজন করানো প্রয়োজন। যে এয়োস্ত্রী এই জল সংক্রান্তির ব্রত পালন করবে, তাঁর জয়লাভ হবে সবসময়। আর সেই মহিলা তাঁর পিতৃকুল ও স্বামীর কুলকে উদ্ধার করতে পারবে অনায়াসে"। 

এই ব্রত উদ্‌যাপন করার সময় প্রথমে একটি নতুন তামার কুণ্ড একখানি নতুন কাপড় বা গামছায় জড়িয়ে নিতে হয়। এর পর তিনটি ডালা, একটি ভোজ্যি, পৈতে ও সাধ্যমতো দক্ষিণা ব্রাহ্মণকে প্রদান করতে হয়। এই মুহূর্তে এই লৌকিক উৎসবটি হারিয়ে গেছে বলা যায়। গ্রামে গঞ্জে এসবের চল নেই বললেই চলে। অনেক মহিলা জানেই না জল সংক্রান্তির রকমসকম। 

মূলতঃ বৈশাখের সংক্রান্তির দিন, সকালে ভালভাবে স্নান করে, ষোড়শ উপচারে লক্ষ্মী জনার্দনের পুজো করার নিদান রয়েছে। সেইসাথে একজন ব্রাহ্মণকে জলভরা কলসী ও একটি ভোজ্যি প্রদান করতে হয়। এইভাবে প্রত্যেক সংক্রান্তিতে ব্রত পালন করে বছরের শেষে উদযাপন করার সময় সোনার লক্ষ্মীমূর্তি এবং জনার্দনের রূপোর মূর্তি গড়িয়ে পূজো করার চল রয়েছে। যদিও এখন এসব ক্রমশঃ হারিয়ে যাওয়ার মুখে।

জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇



Post a Comment

0 Comments