জ্বলদর্চি

অলংকার, ছন্দ, চিত্রকল্পের সার্থক রূপ কৃষ্ণা গায়েনের 'কথা ছিল' /মায়া দে

অলংকার, ছন্দ, চিত্রকল্পের সার্থক রূপ কৃষ্ণা গায়েনের 'কথা ছিল'

মায়া দে

আমাদের এই আর্থসামাজিক সংকটময় জীবনে আমরা প্রচন্ড ব্যস্ত নিজেকে নিয়ে।তার উপর মোবাইল ,মিডিয়া।এতে সময় কেড়ে নিচ্ছে বিস্তর । বই হাতে করে পাতা উল্টানোর সময় কোথায় ? এ এক ভারী উদ্দীপনার কথা। উদ্দীপনার কাল ও। ঠিক এমতাবস্তায় কৃষ্ণা গায়েনের লেখা বই "কথা ছিল" । শিশু ,কিশোর থেকে বড়দের জন্য গভীর মমতায় মোড়া লেখা। কবির  যে অভ্যন্তরীণ সত্তা - ভালোবাসার পূজারী, প্রকৃতিপ্রেমী, কর্মযোগী ,সমাজসংস্কারকে  খুঁজে পাই তাঁর কবিতা গুলো পড়ে। অপূর্ব বৈচিত্রে ভরা নানান ভাব ভাবনায় লেখা  বই খানি।হাতে পেয়ে সাগ্ৰহে পড়ে ফেললাম।

বইটির প্রথম কবিতার নাম "কথা ছিল" ভারী চমৎকার কবিতা । কথা ছিল অথচ কথা রাখার আগেই কথা ফুরিয়ে যায় ভাবনাগুলো বেঁচে থাকে বিরহ কাতরতা নিয়ে । "স্বপ্নে "কবিতায় পেলাম তিনদশক অদর্শনের সেই ভালোবাসার মানুষটিকে। অবচেতনে মনের গহীনে এখনো পুরনো স্মৃতির মত অবিচল । স্বপ্নে ও যার আসা যাওয়া । "যখনই কলকাতা ছুঁয়ে যাই" কবিতায়  পাই প্রথম যৌবনের টাটকা হৃদয়ের উত্তাপ আর রোমান্স । যেন ছুঁয়ে দেখা যায় সেই অভিন্ন মধুময় যৌবন। প্রকৃতিপ্রেমী কবির অপরূপ নিসর্গ রচনা "হলুদ পাতার বনে"। –

 "এখনো বাতাস এসে মৃদু হেসে উড়ায় আঁচল 
হলুদ পাতার বন 
স্বপ্ন চোখে চৈত্র শেষে ফিরে পাবেন কিশলয়।"

কবিতা "নদী "---

এতটুকু ভালোবাসা পেলে 
জীবনটা নদী হয়ে যায় 
দোয়েল এর শীষ কানে নিয়ে 
মন ওরে অবাধ ডানায়।"
                                  অপূর্ব অপূর্ব ।


আসলে কবি কৃষ্ণা গায়েনের কবিতার ভাষা বুঝতে, পড়তে- ঠক্কর খেতে হয় না ।কাব্য ঘিরে এক অনাবিল সহজ সরল সৌন্দর্য। কবিতার প্রতি তাঁর ভালোবাসার অমোঘ আকর্ষণ।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇

ছোট্ট পরিসরে কবির লেখা কবিতা "অবগুণ্ঠন "কবিতাতে দেখি সমাজের বিকৃত  রুচির দানবদের দাপাদাপি ।কোলের শিশুটি ও তার থেকে নেই নিস্তার। তাই "অধিকার "কবিতায় শিশুদের জন্য কবির দরদী মমতাময়ী হৃদয় কেঁপে ওঠে নিদারুণ আতঙ্কে ।

"পৃথিবী দেউলিয়া আজ 
বড় হিংস্রতায় নিঃস্ব পৃথিবীতে 
যে শিশুর জন্মালো আজ
তাকেই গড়তে হবে ফিরে পেতে সুস্থ পরিবেশ স্বার্থহীন সুশীল সমাজ।"

 অবগুন্ঠন কবিতার  ছায়া পাওয়া যায় "নিদান"কবিতাতে —-

 "মানুষ এখন আতঙ্ক রোগে ভুগছে 
কি জানি কখন হঠাৎ প্রাণটা যাবে
 খুন ধর্ষণ রাহাজানি হয়রানি 
প্রতিদিনে রাতে হরদম হেথা ঘটছে। "

ছোট্ট পরিসরে লেখা ঠিক ভিন্নতর রূপ দেখি "নববর্ষ "কবিতায়।

"জীবনের বালুতটে কত শত পদচিহ্ন আঁকি 
সুখে-দুখে মাখামাখি বছরের পরিক্রমা শেষে ফিরে আসে নতুন বছর। 
—-----------------------------------------
এই পৃথিবীতে পুরাতন বলে কিছু নেই। 
সবই ফিরে পুনর্বার নতুনের কোলে। "

বিশ্বায়নের যুগে সৃষ্টি ও আঘাত হানে। মানুষের ক্রমাগত লোভ লালসায় ঘটে চলেছে বিশ্বউষ্ণায়ন ,শুকিয়ে যাচ্ছে স্রোতস্বিনী ,উত্তাল হচ্ছে সমুদ্র। নিজের জীবন নিয়ে খেলছে মানুষ। "সৃষ্টি ও স্রষ্টা" কবিতায় কবি যে ভয়ংকর ভাবনায় তাড়িত হয়েছেন "হৃদয়ের সমুদ্র" পড়ে পেলাম এক সাগর গভীর প্রশান্তি । মানুষ ভুলবে তার ক্ষুদ্র স্বার্থ বিবাদ, মনুষ্যত্বের অপমান।

আর একখানি চমৎকার"কবিতা হেমন্তের শেষে" । কবিতার অংশ বিশেষ—-

"জীবনের সব কাজ শেষ হলে 
কাছে এসে ধরা দেয় 
হেমন্তের বিষন্ন বিষন্ন দিন ঘিরে  ধরে জীবনের শেষ লগ্ন ভাগ।"

কবির প্রতিটি কবিতায় আমাদের ভাষা, আমাদের ভাবনা ,আমাদের বোধ- বুদ্ধিকে সমৃদ্ধ করেছে । সমাজ- প্রকৃতি  প্রতিটি ক্ষেত্রেই কবির অবাধ  বিচরণ। প্রতিটা কবিতাই নিজ নিজ গুনে আলোকিত।  "স্বাধীনতা,"  "জটায়ু" ,"একা" "শরশয্যা ", "নদী" পাঠকের মনে নিশ্চিত ছাপ রেখে যাবে।

 যে মানুষের মনে জাত  নেই, বৈষম্য নেই ,পক্ষপাত নেই ,এমনকি মানুষের রং নিয়ে মাথা ব্যথা নেই -সে তো মানবতার পক্ষেই। 
মানুষ বড়ো কাঁদছে, বড় যন্ত্রণায় মানুষ। সমবেদনায় কবিহৃদয় কাতর।সেই কাতরতা থেকেই সৃষ্ট  কবিতা "মানব ধর্ম"।

 "সংক্ষেপে" কবিতায় ভীষণ সুন্দরভাবে ছন্দে ছড়ায় জীবনের গভীর গূঢ় কথাগুলো তুলে ধরেছেন । "খাদ্য খাদ্য বিচার"
 দারুন- দারুন । পড়ে আনন্দ পেলাম।
"সব জেনে বুঝে "এই কবিতাটি ভীষন ভাবে মন ছুঁয়ে গেল। কবিতার কথা গুলো একান্ত সত্য। তুলে ধরলাম দুয়েকটি লাইন —-

"সব জেনে বুঝেও বুকে পাথর বেঁধে 
সমাজ পাল্টাচ্ছে 
নীতি কথা বললে মুখ ভেঙ্গে দেব।"

সর্বোপরি যে কবিতাটি পড়ে আমার হৃদয় বিদীর্ণ হলো সেটি  "মান "। সত্যি আমরা বড়োরা কি অবোধ। নিজেদের মান রাখতে যে সর্বনাশা খেলায় মেতে উঠি,  তাতে ভেবে ও দেখি না  নিজেরাই আপন সন্তানদের সর্বনাশ  করে ফেলি। সেই "মান" কবিতাটি সকলের পড়ার জন্য —-

 বড়রা সব ঝগড়া করে
 রাখতে নিজের মান 
মায়ে বাবার ছাড়াছাড়ি
 কাঁদছে শিশুর প্রাণ। 
কে থাকবে বাবার কাছে 
কেই বা পাবে মা। 
একলা শিশু হাঁপিয়ে মরে,
 নেইকো কারো গা 
বড় হয়ে এরাই হবে 
অমানবিক মুখ। 
 কিশলয়ের পাঁপড়ি ছিঁড়ে 
বড়রা পাবে সুখ।"

কবির অন্তর জগত অনুভবের প্রেরণায় তাড়িত হয়ে আবেগ ও কল্পনায় জন্ম হয় কবিতার। অলংকার ,ছন্দ, চিত্রকল্পের মাধ্যমে কবিতা তখন সার্থক রূপ পায়। কবি কৃষ্ণা গায়েন এখানে সার্থক কবি। সার্থক তার কাব্যগ্রন্থ "কথা ছিল"।

Post a Comment

0 Comments