জ্বলদর্চি

মেদিনীপুরের কৃষিবিজ্ঞানী ড. রামচন্দ্র মণ্ডল-এর বর্ণময় জীবনের উত্থান-পতনের রোমহর্ষক কাহিনী /উপপর্ব — ০৮ /পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী — ৭৩
এগ্রিকালচারাল রেটুনিং

মেদিনীপুরের কৃষিবিজ্ঞানী ড. রামচন্দ্র মণ্ডল-এর বর্ণময় জীবনের উত্থান-পতনের রোমহর্ষক কাহিনী
উপপর্ব — ০৮

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা


জোরালো হুইসেল বাজিয়ে স্টেশন ছাড়ল রেলগাড়ি। খটাং খট খটাং খট শব্দে দ্রুত গতিতে ছুটে চলল আরও পশ্চিমে। শব্দের তীক্ষ্মতা ধীরে ধীরে কমে আসছে। আস্তে আস্তে রেলগাড়ির আকারও ক্রমশঃ ছোট হচ্ছে। পেল্লাই সাইজের গাড়িও কিনা শেষমেশ দৃষ্টি রেখার বাইরে একসময় বিন্দুবৎ মিলিয়ে গেল হাওয়ায়! এতক্ষণ হাওয়ায় রেলগাড়ির মিলিয়ে যাওয়া দেখছিল রাম। কুলিদের ডাকা ডাকি আর প্যাসেনজারের চিৎকার চেঁচামেচিতে সম্বিত ফিরে পায়। সমষ্টির উচ্চ স্বরে গমগম করছে স্টেশন এলাকা। টিকিট কাউন্টারের সামনেটায় বেশ ভীড়। বড় বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে রাজা-কী-মাণ্ডী রেলওয়ে স্টেশন। গুটি কতক প্যাসেঞ্জার নামিয়ে রেলগাড়ি আরও পশ্চিমে চলে যেতেই ফাঁকা হয়ে গেল স্টেশন চত্বর। টানা দুই রাত রেলগাড়ির কামরায় প্রায় বিনা নিদ্রায় কেটেছে। শরীরে ধকলের চিহ্ন স্পষ্ট। রিজার্ভেশন না থাকা সত্ত্বেও বসার সিট মিলে গিয়েছিল অযাচিত ভাবে। দীর্ঘ সময় সিটে বসে থাকার দরুন ক্লান্তি গোটা শরীরে। ঘুম নেই। খাওয়া দাওয়া তথৈবচ। কয়েকজনের হাঁকাহাঁকিতে ব্যাগপত্তর সমেত নেমে পড়া এ স্টেশনে।

স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে এল রাম। গুটি কয়েক ঘোড়ার গাড়ি, হাতে টানা রিক্সা অপেক্ষারত। সে উঠে বসল এক এক্কা গাড়িতে। টগবগ টগবগ ঘোড়ায় টানা বিশেষ গাড়ি ছুটে চলেছে। নূতন যেকোনও জায়গায় পৌঁছলে মনখারাপ এক নিমেষে উধাও। উধাও সকল ক্লান্তি অবসাদ। প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধে ম ম করে দেহ-মন। অনন্য অনুভূতির আবেশ ভাবুক করে তোলে। অপরূপা প্রকৃতির সাজ দেখতে দেখতে কখন যে রাজপুত কলেজ পৌঁছে গেছে রাম, সে খেয়াল নেই! প্রথম দিন কলেজ হোস্টেলে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল উড়িষ্যার একজন কলেজ ছাত্রের সঙ্গে। প্রথম সাক্ষাতেই আলাপ জমে ক্ষীর। সেদিন তার সঙ্গে পুরো গোটা একটা দিন কাটল রামের। সকল বন্ধু ঠিক করল বিকেলে আগ্রার তাজমহল দেখতে যাবে। পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য এই তাজমহল‍। চিরন্তন প্রেমের আজন্ম নিদর্শন। শাজাহানের অকৃত্রিম প্রেমের স্বাক্ষর। তাজমহল দেখতে বন্ধুদের সঙ্গী হল রাম। 
    
ছোট বেলা থেকে হাফপ্যান্টে সবচাইতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে রাম। পায়ে থাকত একখান সস্তার হাওয়াই চটি। চটির চটাস চটাস আওয়াজের সঙ্গে পথচলা তার বরাবরের অভ্যেস। মনে পড়ল আগ্রা আসবার সময় বাবা একখানা কোরা ধুতি কিনে দিয়েছিলেন। সস্তা দামের কাপড় দিয়ে তৈরি লালচে আধোয়া ধুতি। ধুতির গা থেকে মড়মড়ে থানের মিষ্টি গন্ধ এখনও যায়নি। ভাঁজগুলো একই রকম রয়েছে। ট্যাংক থেকে বের করা নতুন ধুতি আর জামা পরে তাজমহল দেখতে গেল রাম। তার বেশভূষা দেখে বন্ধুরা হেসে লুটোপুটি। বন্ধুদের হাসি মস্করায় বেশি কনসেন্ট্রেশন না দিয়ে তাজমহলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে রাম। তাজমহলের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে যমুনা নদী। তার মৃদুমন্দ জলধারার ছলাৎ ছলাৎ ধ্বনীতে মুখরিত এলাকা। চাঁদনী রাতে শ্বেতপাথরের মর্মর সৌধের উপর চাঁদের নির্মল আলোকের বিচ্ছুরণে নির্জন শান্ত পরিবেশেও অফুরন্ত আনন্দের হিল্লোল জেগে ওঠে।
সেটা ছিল ১৯৫৩ সাল। শুরু হল তার অদম্য লড়াই। ইতিমধ্যে আগ্রার বলবন্ত রাজপুত কলেজের বিএসসি কোর্সে ভর্তি হয়েছে সে। বিষয় এগ্রিকালচার। থাকা খাওয়া কলেজ হোস্টেলে। যদিও সেখানে বিস্তর খরচাপাতি। তার সামর্থ্যে কুলোলে হয়! যেমন ভেবেছিল, তেমনটাই ঘটল। মাস কয়েক পরে পরিস্থিতি খুব খারাপ দিকে গড়াল। টান পড়ল তার সঞ্চিত অর্থে। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তার এ পদক্ষেপ কতটা সঠিক, সময় তা পরিমাপ করবে। কিন্তু বর্তমান বড্ড বেশি কঠোর। হাজারো সমস্যায় জর্জরিত। উত্তর ভারতের হিন্দি বলয়ে তার চেনা শোনা কেউ নেই যে তাকে সাহায্য করবে। অবশ্য আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের মতো মিলে গেল সেই সলতে যার আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে রাম। কলেজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক মি. ঘোষ। তিনি কোয়ার্টারে থাকেন। তাঁর কোয়ার্টারে আশ্রয় নেয় সে আর জুটে গেল তপসিলি জাতির বৃত্তি। বৃত্তি টুকু সম্বল করে স্নাতক পরীক্ষায় উৎরে গেল সে। পাশ করল গ্র্যাজুয়েশন। সেটা ১৯৫৫ সাল।
  
আগ্রার বলবন্ত রাজপুত কলেজের অনতিদূরে এক গ্রাম্য এলাকা বীচপুরী। সম্পূর্ণ গ্রামীণ পরিবেশ। শহুরে ছোঁয়া বর্জিত এক নির্জন ভূমি। সেখানে গড়ে উঠেছিল বিশাল এক কৃষি ফার্ম। ফার্মের মালিক ড. এন কে আনন্দ রাও। আমেরিকা ফেরত। সপরিবারে তাঁর বাস বীচপুরী। সেখানে আমেরিকান ভাবধারা ও ভারতীয় সংস্কৃতি মিলে মিশে একাকার। উন্নত পশ্চিমী প্রযুক্তির বাস্তব প্রয়োগ ঘটিয়েছেন তিনি। দেশে ফেরা ইস্তক উন্নত কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে এক বিরাট কৃষি ফার্ম পরিচালনার গুরু দায়িত্ব তিনি গ্রহণ করেছিলেন। ভারতবর্ষের মতো কৃষি প্রধান দেশে হাতেনাতে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পাঠদানের সুব্যবস্থা রয়েছে তাঁর ফার্মে। ফলিত বিদ্যায় অ্যাগ্রোনমি আর হর্টিকালচার মূলত এই দুটি বিষয়ের উপর শিক্ষাদান পরিচালনার দায়িত্ব তাঁর উপর ন্যস্ত। শিক্ষার্থীদের জন্য ফার্মের মধ্যে লম্বা লম্বা ছাউনি টাঙানো রয়েছে। কম খরচে ছাউনির মধ্যে মেস সিস্টেমে থাকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন পড়া সকল বিদ্যার্থী। এ হেন কৃষি ফার্ম থেকে হাতেনাতে স্নাতকোত্তর পাঠ সম্পূর্ণ করে ফেললে পিছন ফিরে আর তাকাতে হবে না। নিদেনপক্ষে একটা কাজ জোটানো সমস্যা হবে না। ইতিমধ্যে কয়েক জন বাঙালি স্টুডেন্ট ভর্তি হয়েছে ফার্মের পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনে। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে রামও ভর্তি হয়ে গেল বীচপুরীর কৃষি ফার্মে। পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনে তার বিষয় অ্যাগ্রোনমি। ক্লাসমেট রাধাগোবিন্দ মাইতি ও অন্যান্যরা নিল হর্টিকালচার। 
মেসে থাকার বিস্তর খরচপত্তর। প্রথম বর্ষের খরচ মেটাতে বাবাকে বাড়ি থেকে দূরের একখণ্ড জমি বিক্রি করতে হয়েছে। অভাবকে নিত্যসঙ্গী করে প্রথম বছর এমএসসি পরীক্ষায় ভালো ভাবে পাশ করে গেল রাম। কিন্তু দ্বিতীয় বর্ষের প্রয়াস অসম্ভব ঠেকল। দ্বিতীয় বছরে নিরবচ্ছিন্ন লেখাপড়া চালানো ভীষণ কঠিন হয়ে পড়ল। সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাস শুরু হতে তখনও দেরি আছে। দেশে ফেরা মনস্থ করল রাম। ফেরার পথে মনে পড়ে অনন্তদার কথা। তার মহানুভবতার উপাখ্যান। নিঃস্বার্থ উপকারের কথা। অনন্তদার বাসা কলকাতায়। সে এখন লালবাজার গোয়েন্দা বিভাগে পুলিশের মস্ত বড় অফিসার। বিয়ে থা করে ঘোরতর সংসারী। সহ-প্রধান শিক্ষক সীতানাথ বাবুর সেজ মেয়েকে বিয়ে করেছে। একদিন অনন্তদার বাসায় পৌঁছল রাম। উঠল ভালোমন্দের কথা। তার পড়াশুনার খবর। আরও অন্যান্য বিষয়। কেবল লেখাপড়ার প্রসঙ্গ উঠতেই রামের চোখ খানিক ছলছল। বুকের কষ্ট চেপে রাখা দায়। অনন্তদাকে নিজের আর্থিক সমস্যার কথা খুলে বলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা হয়নি। রাম বলল —
'আর একটা বছর কীভাবে পড়াশুনা শেষ করব, কে জানে!'

'আমার কাছে একটা সমাধান আছে। (অনেক ভেবে) চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কি?' — চিন্তিত মুখে অনন্তদার উত্তর। তার স্বরে যেন কৌতূহল মেশানো।

'কী সমাধান! আমি সবকিছু করতে রাজি '— নিরুপায় রামের গলায় স্পষ্ট হতাশা ঝরে পড়ে।

'শোন, শিক্ষাগুরু সীতানাথ বাবুর একজন ছোট মেয়ে আছে। সম্পর্কে আমার শ্যালিকা। তা, স্যারের ছোট মেয়েকে বিয়ে করলে তিনি তোমার আশু সমস্যার সমাধান করে দিতে পারবেন এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস'— কথা ক'টা বলে একটু থামে অনন্তদা। রামের দিকে তাকায়। রামের চোখ তখন কপালে ওঠার জোগাড়। বিস্ময়ে হতবাক। অনন্তদা আবার বলতে শুরু করেছে —
'যদ্দিন তোমার পড়াশুনা শেষ না হচ্ছে এবং তুমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে না পারছ, তত দিন শেফালী বাপের বাড়িতে থাকবে।'
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
এক দারুণ বিড়ম্বনায় পড়ে গেল রাম। মুখ থেকে রা-টি বেরোয়নি। সাংসারিক সকল বন্ধনের উর্দ্ধে তার অভিপ্রায় প্রথমে নিজের পায়ের তলায় জমি শক্ত করা। মাথার উপর তার না আছে চাল, না আছে চুলো। একখানা পৈত্রিক ভিটা আছে বৈকি। কিন্তু রোজগার! ভাঁড়ে মা ভবানী। এমন অবস্থায় বিয়ে! একেবারে হারাকিরি সিদ্ধান্ত বইকি। অনন্তদা বড় দাদার মতো। তার কথা অমান্য করে কী করে? ঘটনার তাৎক্ষণিকতায় ঈষৎ দিশাহারা অবস্থা। কী করণীয় আর কী করণীয় নয় — মনের মধ্যে টানাপোড়েন চলছে। সেই হেতু দীর্ঘ ক্ষণ নিরব সে। ঘর জুড়ে নিরবতা। একেবারে পিন ড্রপ সাইলেন্স। মৌনতা সম্মতির লক্ষণ ভেবে অনন্তদার নিখাদ পরামর্শ —
'তোমার বউদি এখন তার বাপের বাড়িতে। ওখানে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তুমি সেখানে যাও। মেয়েটিকে দেখে এসো। যদি পছন্দ হয়, তারপর না হয় কথাবার্তা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে। কি বল?'

খটকা লাগল। এ ব্যবস্থা পূর্ব পরিকল্পিত নয় তো? (ক্রমশ...)

তথ্য সূত্র :
• প্রণম্য বৈজ্ঞানিক ড. রামচন্দ্র মণ্ডল মহাশয়
• শ্রী সুদর্শন সেন বিশিষ্ট শিক্ষক ও আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক
• 'মনীষী ড. রামচন্দ্র মণ্ডল' – সম্পাদনা শ্রী জয়দেব মাইতি ও শ্রী সুব্রতকুমার মাঝি


Post a Comment

0 Comments