জ্বলদর্চি

আধুনিকতা ও আধুনিক সাহিত্য /সন্দীপ কাঞ্জিলাল

আধুনিকতা ও আধুনিক সাহিত্য 

সন্দীপ কাঞ্জিলাল

'আধুনিক কাব্যে' রবীন্দ্রনাথ বলেছেন - পাঁজি মিলিয়ে মর্ডানের সীমানা নির্ণয় করবে কে? কালের কথা ততটা নয়, যতটা ভাবের কথা। এই প্রবন্ধে তিনি আরও বলেছেন- 'নদী সামনের দিকে চলতে চলতে হঠাৎ বাঁক ফেরে, সাহিত্যও তেমনি বরাবর সিধে চলে না। যখন সে বাঁক নেয়, তখন সে বাঁকটাকেই বলতে হবে মর্ডান। বাংলায় বলা যাক আধুনিক।' অবশ্য তিনি এও বলে গেছেন- 'এই আধুনিকতা সময় নিয়ে নয় মর্জি নিয়ে।'

তবে কালবদল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবন দর্শনও বদলে যায়। ফলে সাহিত্য আদর্শও বদলে যায়। মানব ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যাবে যে, তার মধ্যে চেতন অচেতনের সংঘাত। সেই সংঘাতের মধ্য দিয়ে জীবনের বিকাশ এবং কাল থেকে কালের অভ্যন্তরে অভিযান। সাহিত্য এই যুগগত বা কালগত ধারণাকেই বহন করে চলে। মানুষ এবং জীবন হল সাহিত্যের অবলম্বন বা আশ্রয়। সাহিত্য থেকে জীবন তার উপাদান সংগ্রহ করে বিকাশের আভাস পায় এবং প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে। এদিক থেকে বলা যেতে পারে,  সাহিত্যের মধ্যে যে দেশের কালের যৌক্তিক ছাপ, তা শুধু যুগের একান্তই ছাপ নয়। তাতে পারিপার্শ্বিক পরিবেশেরও প্রভাব আছে। সাহিত্যিকরা তাই দুই শ্রেণির হয়ে ওঠে। এক বিশেষ যুগ বা কাল থেকেই কবি তার সাহিত্যের রসদ সংগ্রহ করেন। এঁরা যুগসৃষ্ট কবি। আর একরকম থাকেন যুগস্রষ্টা কবি। যাঁরা কেবল যুগ থেকে শুধু নেন না, যুগকে কিছু দানও করেন। 

এবার প্রশ্ন আধুনিকতা কাকে বলব? আধুনিকতা বর্তমানকে উচ্চমূল্য দেয়, বর্তমানকে কল্পনা করার এক মরিয়া আগ্রহ তৈরি করে। বর্তমান যা তার থেকে তাকে অন্যভাবে কল্পনা করা, রূপান্তর করা। তবে তা বর্তমানকে ধ্বংস করে নয়, তাকে দৃঢ়ভাবে ধরে রেখেই - এই হল আধুনিকতা। আধুনিকতার ধারণা পাই - সত্যদ্রষ্টা কবি শার্ল বোদলেরের  কঁস্তাতাঁ গি-কে নিয়ে লেখা একটি প্রবন্ধে। যেখানে তিনি লিখেছেন - 'আধুনিকতা বলতে আমি বুঝি ক্ষণস্থায়ী, বিলীয়মান, অনিয়ত। এটা হল শিল্পের অর্ধেক। যার অন্য অর্ধেক হল চিরন্তন অপরিবর্তনীয়।' একজন কবি বা লেখক আধুনিক মানে হল - যিনি আধুনিক জীবনের নিকৃষ্টতম ব্যাপারেও সংবেদনশীল। বেদনাদায়কভাবে যুগের চরিত্রকে বুঝবেন। আর তখনই বোঝা যায়- আধুনিকতার আসল সাবজেক্ট হল হিরো। কারণ আধুনিক জীবনে বাঁচতে গেলে নায়কোচিত ধাত থাকা প্রয়োজন। আধুনিকতা মানে নিয়ত পরিবর্তনশীল অস্তিত্বে নিত্যতার সন্ধান করা। দার্শনিক নিটশে শিল্পী এবং  কবিদের এই অতিমানব গোত্রের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। কারণ তাঁদের সৃজনশক্তি শূন্যতা এবং নৈরাশ্যকে রূপান্তর করে সৌন্দর্যে। শূন্যতার সঙ্গে মোকাবিলা করার যন্ত্রণা ও আনন্দ খাঁটি শিল্পীরাই জানে। তাই তিনি মনে করতেন যথার্থ কবি ও শিল্পী মাত্রই বিপ্লবী।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
এই অর্থে বোদলের ছিলেন একজন খাঁটি আধুনিক মানুষ। যাঁর জীবন থেকে এক এক করে বুর্জোয়া জীবনের নিরাপত্তা ও স্বত্বাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে এবং তাঁকে রাস্তায় আশ্রয় নিতে বাধ্য করা হয়েছে। আধুনিক জীবন তাঁর শরীরে যে ক্ষত চিহ্ন এঁকে দিয়েছিল, তাঁর যন্ত্রণার কাছে তিনি পরাজিত হননি। যন্ত্রণার সঙ্গে অবিরত যুদ্ধে কেউ যদি মৃত্যুর কোলে আশ্রয় নেয়, তাতেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ প্রকৃত হিরো সব সময় মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকেন। 
আধুনিক মানুষ হল কখনো নিজেকে বা নিজের গোপন কথা, বা নিজের গোপন সত্যকে খোঁজে না, সে নিজেকে আবিষ্কার করতে চায়। আর এই আবিষ্কার করতে হলে তাকে 'ভিড়ের মানুষ' হতেই হবে। জনতার ভিড়ে নিজেকে মিশিয়ে দিতে হবে। 'যে খুশিমতো নিজের বা অন্যের মতো থাকতে পারে, ইতস্তত চরে বেড়ায়, বিদ্রোহীর মতো যারা খোঁজে একটা দেহ, খুশীমতো প্রবেশ করে প্রত্যেকের চরিত্রে।' কারণ একজন আধুনিক মানুষ জানে, নিজের মধ্যে বিভিন্ন রূপকে আবিষ্কার করতে হলে, তাকে ভিড়ের মানুষ হতেই হবে। যেহেতু পৃথিবী কালকের জন্য অপেক্ষা করছে না - তাই আধুনিক মানুষ বর্তমানকে উপেক্ষা করতে পারে না। তাকে হতে হবে সেল্ফ - ক্রিয়েটর। কারণ, আমরা আধুনিকতা বলতে বুঝি- ক্ষণস্থায়ী, বিলীয়মান অনিয়ত, এটা হল শিল্পের অর্ধেক। যার অন্য অর্ধেক হল চিরন্তন অপরিবর্তনীয়। তাই পূর্বাচার্য মালার্মে মনে করতেন জগৎ বিরাজ করে এক চমৎকার বইয়ের মধ্যে। আধুনিকতার প্রজেক্ট হল, অন্য সবকিছুর মতো ভাষাকেও স্বচ্ছ ও ব্যবহারোপযোগী করে তোলা। কবি জীবনানন্দ দাশ তাই বলেন - 'মানুষের মনের চিরপদার্থ কবিতায় বা সাহিত্যে, মহৎ লেখকদের হাতে যে বিশিষ্টতায় প্রকাশিত হয়ে ওঠে তাকেই আধুনিক সাহিত্য বা আধুনিক কবিতা বলা যেতে পারে।

সমস্ত পৃথিবী যখন ঘুমিয়ে পড়ে, আধুনিক মানুষ তখন কাজ আরম্ভ করেন এবং পৃথিবীর রূপান্তর ঘটান। তাঁর রূপান্তর বাস্তবকে নাকচ করে নয়, বরং বাস্তবের সত্য এবং স্বাধীনতার প্রয়োগের এক দুরূহ পারস্পরিক ক্রিয়া, 'প্রাকৃত' বস্তু পরিণত হয় প্রাকৃতের চেয়ে বেশিতে, সুন্দর জিনিস হয় সুন্দরের চেয়ে বেশি, এবং প্রতিটি বস্তু এক আবেগার্দ্র জীবন দ্বারা গুণসমৃদ্ধ হয়ে প্রতিভাত হয় তাদের স্রষ্টার আত্মার মতো। দার্শনিক ফুকোর কথায় - 'আধুনিকতা এমন এক প্রয়াস যেখানে বাস্তবের প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগ আর স্বাধীনতার প্র্যাকটিস পরস্পরের মুখোমুখি হয়, যা একই সঙ্গে এই বাস্তবকে সম্মান করে ও লঙ্ঘন করে।'
----

Post a Comment

2 Comments

  1. খুব ভালো লিখেছেন।

    ReplyDelete
  2. পড়লাম দাদা ।‌‌অসাধারন লিখেছেন। খুব গুরুত্বপূর্ণ লেখা । ভালো থাকবেন সবাই

    ReplyDelete