যেতে যেতে পথে
রোশেনারা খান
পর্ব ৬৯
পায়ের ব্যথা যাচ্ছে না, কোনরকমে দমদম পৌঁছাতে পারলে হয়। এরমধ্যে দেশে অনেককিছু ঘটে গেছে। তাৎক্ষণিক তিন তালাক বন্ধের দাবিতে দেশজুড়ে আন্দোলন চলছে। এইভাবে তালাকপ্রাপ্ত ৫ জন মহিলা সুপ্রিমকোর্টে মামলা দায়ের করেছেন। এদের মধ্যে ইসরত জাহান নামে আমাদের রাজ্যের একজন মহিলা রয়েছেন। এখানে থাকার ফলে আমি এই আন্দোলনে সশরীরে যোগ দিতে পারিনি। এ দাবি তো আমি বহুদিন ধরে করে আসছি।
আজ ১৫ সেপ্টেম্বর, বাড়ি ফিরতে মাঝে আর একদিন রয়েছে, আজ নিনাদি এসেছিলেন আমাকে গিফট দিতে। গাড়ি থেকে নামেননি, বাড়ির সামনে নুড়ি বিছানো রয়েছে, উনি ওর ওপর দিয়ে হাঁটতে পারবেন না। এই কয়েকদিন প্রায় রোজ আমার পায়ের ব্যথার খোঁজ নিয়েছেন। সুপ্রীতিদিও খোঁজ নিয়েছেন। অন্যরা কেউ জানেন না।
ফেরার দিন এসেই গেল। রান্না খাওয়া সেরে সবাই মিলেই বিকেল ৪ টের পর বারমিংহাম এয়ারপোর্ট রওনা হলাম এবং ৫০ মিনিটে পৌঁছে গেলাম। লাগেজের ওজন নিয়ে কোন সমস্যা হল না। চেক-ইনের পর আমরা জারাকে আদর করে ভেতরে চলে গেলাম। আমরা যেখানে বসেছিলাম, আমার পাসে একটি নেপালি মেয়ে এসে বসল। ও কাঠমাণ্ড যাবে। বাবলিকে ফোন করতে, ও বলল কফি খাছে, খেয়েই বেরিয়ে যাবে। আমরা গেটের কাছে গিয়ে বসলাম। গেট খুলতে বোডিঙ পাশ দেখিয়ে ফ্লাইটে ঢুকলাম। সামনেই সিট ছিল, তিনজনের সিটে আমরা দুজন। উনি বসে রইলেন। আমি দুটি সিটে কোনরকমে শুলাম। তবে পায়ের জন্য অসুবিধা হচ্ছে। একসময় উনি বললেন, অর্ধেক পথ এসে গেছি, এবার আমি একটু শোব। আমি জানালার দিকে বসলাম। বাইরে অন্ধকার, অনেক দূরে একটা লাল আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। যা ভেবেছিলাম তাই, দূরে কোনও দেশে সূর্য উঠছে। ক্যামেরায় ছবি তুলতে থাকলাম। এখন সূর্যের রঙ গোলাপি।
হঠাৎ ঘুমের মধ্যে খান সাহেব মুখে কেমন শব্দ করতে থাকায়, মুখে জল দিয়ে উঠিয়ে বসাই, জ্ঞান ফেরে। আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেছলাম। এয়ার হোস্টেসদের ডাকতে চেয়েছিলাম, উনি নিষেধ করে আবার শুয়ে পড়লেন। তখনও দিল্লি পৌঁছাতে দুঘণ্টা সময় লাগবে। হাত-পা গরম আছে, তবুও ম্যাসাজ করতে লাগলাম। দিল্লি পৌঁছে গেলে ভয়ের কিছু নেই। ওই অল্প সময়ের মধ্যে কত কী ভেবে নিয়েছি। যদি অন্য কোনও দেশে নামিয়ে দেয় আমাদের? কী করব তখন? ভাষা বুঝব না। কাছে কোনো দেশেরই টাকা নেই্, কী হবে তাহলে? যাক, তেমন কিছু ঘটেনি। ভাল ভাবেই দিল্লী পৌঁছালাম। ফোনে যোগাযোগ করলাম ভাই আর মেয়ের সঙ্গে। ২ টো ২৫ মিনিটের জায়গায় প্রায় ৩ টের সময় ফ্লাইট উড়ান দিয়ে প্রায় ৫ টার সময় দমদম পৌঁছাল। ভাই গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল, আমরা রাত আটটায় বাড়ি পৌঁছালাম। কাল থেকে আবার শুরু হবে, থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়।
তাৎক্ষনিক তিন তালাকের বৈধতা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে জোর তর্ক বিতর্ক চলছে। কলকাতায় দুটি দল যে যার নিজেদের মত করে আন্দোলনে নেমেছে। একটি দলের অলিখিত নেত্রী বর্ধমান বিশ্ব বিদ্যালয়ের ইতিহাসের বিভাগীয় প্রধান সৈয়দ তনভির নাসরিন। অন্যটির নেতৃত্বে আছেন বেগম রোকেয়া উন্নয়ন সমিতির খাদিজা বানু ও তাঁর বোন অধ্যাপিকা আফরোজা খাতুন। তনভির ও আফরোজা দুজনেই আমার পূর্ব পরিচিত। ২০১১ তে বাসবী চক্রবর্তী সম্পাদিত ‘নারীপৃথিবী বহুস্বর’ গ্রন্থে তনভিরের আর আমার, দুজনেরই প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। তখন শুধু নামের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। সাক্ষাতে পরিচয় হল তনভির যখন আমাদের ‘সারদা কল্যাণ ভাণ্ডার’এ স্মারক বক্তৃতা দিতে এলো। আর আফরোজার সঙ্গে পরিচয় কলকাতা দূরদর্শনের ‘ঘরে বাইরে’ অনুষ্ঠানে। আমি সেই অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলাম। আফরোজা খাতুন, মাকসুদা খাতুন ও সেরিনা ছিলেন অতিথি। পরবর্তী কালে আফরোজা আজকাল সংবাদপত্রে আমার ‘আমি নারী’ বইটির রিভিউ করেছিলেন।
২০১৬র ২৩ ডিসেম্বর একই দিনে দু’দলই দুটি সমাবেশের আয়োজন করে। তনভির আগে আমাকে জানিয়েছে। আমাকে এই সমাবেশের সভানেত্রী করা হয়েছে। আফরোজাও ওদের সমাবেশে যোগ দেবার জন্য বলেছে। তনভির আমাকে জিজ্ঞেস করল, দিদি আপনি কী করবেন? আমি বললাম, তুমি আগে বলেছ, তোমার সেমিনারেই যোগ দেব। তাছাড়া যে সমস্ত বক্তাগণ আসছেন, তাতে মনে হয়েছিল, যুক্তিপূর্ণ আলোচনা হবে। সেদিন উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রিয় মন্ত্রী এম জে আকবর, সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অশোক গাঙ্গুলি, শিক্ষক মাসুম কাজি, প্রধান শিক্ষক ও্সমান মল্লিক প্রমুখ। শ্রোতার আসনে প্রচুর সংস্কার মুক্ত মানুষ যেমন ছিলেন, তেমন বেশ কয়েকজন বিরোধী পক্ষের লোকও এসেছিলেন। এম জে আকবরের বক্তব্যের পর তারা গণ্ডগোল বাধাবার জন্য হইচই করছিল। মন্ত্রী বেরিয়ে যেতে তারাও বেরিয়ে যায়।
কাজি মাসুম রেজা (পদ্মশ্রী পুরষ্কার প্রাপ্ত শিক্ষক) বক্তব্য শুরু করেন আমার কথা দিয়ে। তিনি বলেন রোশেনারা খানের লেখা পড়ে বড় হয়েছি(এটা একটু বাড়িয়ে বলেছেন, আমার যে লেখার কথা উনি বলছেন, সেটি ১৪ বছর পূর্বে ২০০২ সালে ‘মুসলিম সমাজ ও এই সময়’ গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল), ওনার লেখা পড়ে আশ্চর্য হয়ে ভেবেছি, আমাদের রাজ্যে এরকম মহিলা আছেন ? যিনি এরকম লেখা লিখতে পারেন! যে কোনো উদ্দেশ্যেই হোক কেন্দ্রের বিজেপি সরকার তালাক আইনের পরিবর্তন চায়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকার এই আইন পরিবর্তনের ঘোর বিরোধী। রাজ্য সরকারের মুসলিম নেতা, মন্ত্রী যারা, আদতে তাঁরা ধর্মান্ধ ও নারী বিদ্বেষী। কখনোই এরা নারীকে পুরুষের সমান অধিকার দেবার কথা ভাবতে পারেন না। ১৪০০ বছর পুরবে অন্ধকারাচ্ছন্ন আরবীয়দের মানসিকতা আজও এঁরা বহন করে চলেছেন। যখন নারীর কোনো অধিকারই ছিল না।নারীকে গৃহপালিত পশুর মত, পুরুষ তার সম্পত্তি ভাবত। সেই অবস্থায় নারীকে সমানাধিকার দেওয়া সম্ভব ছিল না। হযরত মহম্মদ শুধু একজন ধর্ম প্রবর্তকই ছিলেন না, তিনি একজন সমাজ সংস্কারকও ছিলেন। সেই জায়গা থেকে তিনি ওই পরিস্থিতির ওপর দাঁড়িয়ে মুসলিম নারীকে যে সমস্ত অধিকার দিয়েছিলেন, তখন অন্য ধর্মের মহিলাদের সে অধিকার ছিল না। গত ১৪০০ বছরে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। অন্যান্য সম্প্রদায়ের মহিলারাও বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানান অধিকার পেয়েছেন। মুসলিম মহিলাদের থেকে অনেক বেশি পেয়েছেন।
আসলে আমাদের দেশে ও রাজ্যে যা কিছু ঘটছে বা ঘটানো হচ্ছে তা রাজনৈতিক ফায়দার উদ্দেশ্যে। রাজ্যের যে সব নেতা মন্ত্রীরা পার্টির মহিলা সমর্থকদের অজ্ঞতা ও পুরুষ নির্ভরতার সুযোগ নিয়ে পথে নামিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যাক্তিরা হলেন রাজ্যের মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী ও সুলতান আহমেদ। পার্টির মেয়েদের দিয়ে বলানো হয়েছিল ‘তালাক ভাল’। পুরুষ শাসিত সমাজে পুরুষের কথা না মানলে চলবে কেন? যে মহিলারা তালাককে ভাল বলছেন তাঁদের তালাক দিলে বুঝতেন, তালাক ভাল না খারাপ। নেতা মন্ত্রীরা সমাবেশে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলছেন, তালাক মহিলাদের জন্য খুবই ভাল, তালাকের পর সেই মহিলা আবার বিয়ে করতে পারেন, ইসলামে তালাক আছে বলেই বধুহত্যা কম হয়। এসব যুক্তি ওই সমস্ত অজ্ঞ স্বামী নির্ভর মহিলাদের নেতা, মন্ত্রীর ও স্বামীর কথা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। ‘তালাক’ মানে ‘বিচ্ছেদ’। আমরা যারা আন্দোলন করছি তারা বিবাহবিচ্ছেদের বিপক্ষে নই, আমরা অকারণে মৌখিক তাৎক্ষণিক তালাকের বিরুদ্ধে। স্ত্রী বা স্বামী অন্যায় করে থাকলে ও দুজনেই বিচ্ছেদ চাইলে আদালতে দোষগুণ বিচার করে তালাক হোক।
আজ ইংরেজি বছরের শেষ দিন। আজ রাতেই বর্ষ বিদায় এবং বর্ষ বরণ হবে। এই উপলক্ষ্যে রাতভর নানা রকম অনুষ্ঠান হয় কলকাতাসহ জেলা শহরগুলিও সারারাত জেগে থাকে। এই রকমই একরাতে একটি মেয়েকে নিগ্রহের হাত থেকে রক্ষা করতে গিয়ে বাপী সেন নামে এক শান্তিরক্ষক প্রাণ হারিয়েছিলেন। দুঃখের ও লজ্জার বিষয়, যে মেয়েটিকে বাঁচাতে গিয়ে বাপী সেনের মৃত্যু হয়েছিল, সে খুনিদের চিনিয়ে দিতে প্রকাশ্যে আসেনি। তাই বাপী সেনের হত্যাকারিদের কোনও সাজা দেওয়া যায়নি।
কয়েকদিন ধরে জেলা পরিষদ প্রাঙ্গনে লিটিল ম্যাগাজিন মেলা বসেছে। আজ ১০টার দিকে মেলা গেছলাম। লেখক কিন্নর রায়ের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা হল। বললেন, আমার লেখা পড়েছেন। সেইসুত্রেই আমাকে চেনেন। ওনাকে ‘আমি নারী’ বইয়ের একটি কপি দিলাম। আজ এই মেলায় রাষ্ট্রপতি পুরষ্কারপ্রাপ্ত পটশিল্পী গৌরী চিত্রকরকে সম্বর্ধনা দেওয়া হল। ছবি তুললাম, কিন্তু বাড়ি ফেরার তাড়াতে আলাপ করা হল না। তাড়ার কারণ বিকেলে পিঠেমেলা যেতে হবে। পিঠে তৈরির প্রতিযোগিতায় এই মেলার শুরু থেকেই বিচারক হিসেবে অংশগ্রহণ করে থাকি। এবারেও তার আমন্ত্রণ রয়েছে।
২০১৭ সালের জানুয়ারিতে একদিন দুপুরে সাংবাদিক অঞ্জন বন্দোপাধ্যায় ফোন করে বললেন, রোশেনারাদি আমি অঞ্জন বলছি, আপনি জানেন কি আমি এখন আনলাইন আনন্দবাজারের সম্পাদক? আমি ফেসবুকে দেখেছি বলাতে, বললেন, সামনে বিশ্ব নারীদিবস, আমাকে একটা লেখা দিতে পারবেন? এমন একটি মেয়েকে নিয়ে লিখতে হবে, যে খুব লড়াই করে উপরে উঠেছে। মেয়েটি যদি মুসলিম হয়, তাহলে আরও ভাল হয়। আমি জেনে নিলাম কবে এবং কত শব্দের মধ্যে লিখতে হবে?
এই ধরণের মেয়ে পেতে হলে আল-আমিন মিশনে খোঁজ করতে হবে। আল-আমিন-মিশনের মেদিনীপুরে যে ব্রাঞ্চ আছে, সেখানে খোঁজ করে এই জেলারই দিনমজুরের এক ডাক্তারি পড়ুয়া মেয়ের খোঁজ পেয়ে গেলাম। মেয়েটির বাড়ি টাউন চন্দ্রকোণাতে। নাম মাসকুরা খাতুন। মিশনের যিনি দায়িত্বে আছেন সেই ইস্রাফিলকে বললাম মেয়েটিকে একদিন মিশনে ডেকে পাঠাতে। মেয়েটি ওর বাবার সঙ্গে মিশনে এলে আমি গিয়ে বাবা ও মেয়ে, দুজনের সঙ্গে কথা বলে লেখা শুরু করি। ‘টাচিং স্টোরি’ হিসেবে ২০১৭ র ৪ মার্চ লেখাটি অনলাইন আনন্দবাজারে প্রকাশিত হয়।
ক্রমশ
🍁
বাড়িতে বসেই রেজি.ডাক মাধ্যমে জ্বলদর্চির বিশেষ সংখ্যাগুলো সংগ্রহ করতে পারেন। যোগাযোগ হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৭৩২৫৩৪৪৮৪
0 Comments