জ্বলদর্চি

তাপগতিবিদ্যা ও মানবমন /সৌমেন রায়

চিত্র - অসিত কুমার সেনাপতি।


তাপগতিবিদ্যা ও মানবমন

সৌমেন রায়


 মানুষের জীবন নিরন্তর রূপান্তরের যাত্রা ,শরীরে ও মনে।পৃথিবীর যাত্রাও তেমনই  শুধুমাত্র রূপান্তরের যাত্রা, সৃষ্টির নয়। জড়বিজ্ঞানের দুটি সবচেয়ে শক্তিশালী সূত্র হলো ভরের নিত্যতা সূত্র ও শক্তির নিত্যতা সূত্র ( আসলে একটি সূত্র আইনস্টাইনের ভর – শক্তির নিত্যতা)। ভরের নিত্যতা সূত্র বলে পৃথিবীতে ভর সৃষ্টিও করা যায় না ধ্বংসও করা যায় না। ভরের নিত্যতার কথা বলেছিলেন  লাভোসিয়ার (1743-1798)। তাকে বলা হয় রসায়নের জনক। তার দুঃখজনক মৃত্যুর কথা ‘ টরিসেলির শুনস্থান ‘ নিবন্ধে আছে।তাই আর পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন নেই।সূত্রটির মানে দাড়ায় যে আমরা নতুন কিছু বানাতে পারি না,এটা ওটা দিয়ে সেটা বানাই। শক্তির নিত্যতা সূত্র বলে পৃথিবীর মোট শক্তি নির্দিষ্ট। শক্তি আমরা তৈরি করতে পারি না। যেটা পারি তাহল এক শক্তি থেকে আরেক শক্তিতে রূপান্তর করতে পারি।অর্থাৎ আমাদের চারপাশে এই যে এত ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র, খাদ্য সমস্ত ভর যুক্ত জিনিস দেখছি তার সামান্যতম আমাদের সৃষ্টি নয়। আমরা শুধু এক ধরণ থেকে অন্য ধরনের জিনিস তৈরি করেছি। এই যে কল কারখানা চলছে, তাতে যে শক্তি লাগছে তার একটাও আমরা তৈরি করিনি। যেমন গাড়ি চালানোর জন্য যে শক্তি লাগে তা আমরা এখন ডিজেল পেট্রোল ব্যবহার করে পাই। আমরা বিদ্যুৎ তৈরি করি জলের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে( জলবিদ্যুৎ) , সূর্যের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে(সৌরবিদ্যুৎ),  কয়লার শক্তিকে কাজে লাগিয়ে তা দিয়ে জল গরম করে বাষ্প তৈরি করে (তাপ বিদ্যুৎ)। সেই বিদ্যুৎ থেকে আমরা আবার বিভিন্ন রকম কাজ করে থাকি, যেমন ইনডাকশন কুকার চালিয়ে রান্না করি, ফ্যান চালিয়ে হাওয়া খাই, আলো জ্বালিয়ে অন্ধকার দূর করি। অর্থাৎ পুরোটাই শক্তির রূপান্তরের যাত্রা।আমরাও একই খাবার খেয়ে ভিন্ন ভিন্ন রূপান্তর করি।কেউ বাগান করি কেউ পাইপগান ধরি। গাছেরা একই রস সংগ্রহ করে ভিন্ন ফল দেয়। এ লেখায় আমাদের বিশেষ দৃষ্টি থাকবে  একটি বিশেষ রূপান্তরের দিকে।তাপ থেকে গতির রূপান্তর যা  তাপগতিবিদ্য বলে পরিচিত।

জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇

            এই যে এত গাড়ি চলছে রাস্তায় তার পিছনে বিজ্ঞানের  শাখাটি  হল তাপগতিবিদ্যা। যানবাহনের ক্ষেত্রে ডিজেল- পেট্রোল পুড়িয়ে তাপশক্তি উৎপন্ন করা হয়।আর সেই তাপ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে গ্যাসের প্রসারণ সংকোচন ঘটিয়ে গাড়ি চলে। তা সেখানে ঢোকার আগে তাপ সম্পর্কে, তাপের অতীত সম্পর্কে দু-চারটে কথা জেনে নেওয়া যায়। মধ্যযুগে প্রচলিত ছিল তাপের ক্যালরিক মতবাদ। মনে করা হতো ক্যালোরিক বলে ভরহীন কোন জিনিস  পদার্থের মধ্যে ঢুকে গেলে তা গরম হয়, বেরিয়ে গেলে ঠান্ডা হয়। কাউন্ট রামফোর্ড একবার জলের মধ্যে রেখে কামানে ফুটো করছিলেন। দেখা গেলো যে কামান জল দুটোই গরম হচ্ছে। এই ঘটনার পর তিনি প্রথম ক্যালোরির মতবাদের বিরোধিতা করেন।কারণ কালোরিক মতবাদ অনুযায়ী একটা গরম হলে অন্যটা ঠান্ডা হওয়া উচিত ছিল। তবে নতুন মতবাদ আসার আগে ক্যালোরিক মতবাদ  পুরোপুরি বর্জিত হয়নি। কাউন্ট রামফোর্ডের আসল নাম বেঞ্জামিন থমসন।তিনি ছিলেন আমেরিকান ব্রিটিশ। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে বৃটেনকে সহায়তা করেছিলেন।যুদ্ধে পরাজয় অনিবার্য বুঝে ইংল্যান্ডে চলে আসেন, পরে আবার ফ্রান্স চলে যান।  সে যাই হোক তাপের  উপর এরপর উল্লেখযোগ্য কাজ করেন জোসেফ ব্ল্যাক (1728-1799)। তিনি দেখান বিভিন্ন পদার্থের একই উষ্ণতা বৃদ্ধি করতে বিভিন্ন তাপ লাগে (আপেক্ষিক তাপ)। লীন তাপ এর ধারণাও তিনিই প্রথম বলেন। লীন তাপ হল অবস্থার পরিবর্তনের সময় প্রয়োজনীয়  তাপ। ধরা যাক জল ফুটিয়ে বাষ্প করা হচ্ছে। যতক্ষণ জল ফুটতে থাকে(পুরো বাষ্প না হওয়া পর্যন্ত) ততক্ষণ কিন্তু জলের তাপমাত্রা অপরিবর্তিত থাকে।এই সময়ে প্রযুক্ত তাপের পুরোটাই লাগে  অবস্থার পরিবর্তনের জন্য। থার্মোমিটারে ধরা যায় না ,লুকিয়ে থাকে তাই লীন তাপ। মানুষের জীবনে অনেক সময় এমনই ঘটে। দেখা যায় অনেকে প্রভূত চেষ্টার পরেও সাফল্য পায়না। হতাশ না হয়ে প্রচেষ্টা জারি রাখলে কিছুদিন পর হঠাৎ করেই যেনো একসঙ্গে চারিদিক থেকে সাফল্য আসতে থাকে।আসলে ওটা চলছিল অবস্থার পরিবর্তন।যতক্ষণ না পরিবর্তন সম্পূর্ন হচ্ছিল বাইরে থেকে বোঝা যাচ্ছিল না।বিষয়ে ফিরি। ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের সময় স্টিম ইঞ্জিন আবিষ্কার হয়, আবিষ্কার করেন জেমস ওয়াট নয় নিউকোওম্যান নামের প্রায় স্বশিক্ষিত এক যুবক(1712)। জোসেফ ব্ল্যাক এর কাছে কাজ করার সময় জেমস ওয়াট সেই ইঞ্জিনের সঙ্গে একটা কনডেন্সার জুড়ে দিয়ে তার দক্ষতা বাড়ান।এরপর সেটির ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়। সেই কারণে  আবিষ্কারক হিসেবে অনেক ক্ষেত্রে পরিচিত হয়ে থাকেন ওয়াট। স্টিম ইঞ্জিন কে কাজে লাগিয়ে রেল গাড়ি বানান আর এক স্বল্প শিক্ষিত যুবক স্টিফেনসন (1829)। ক্যালোরিক তত্ত্বের পতনের পর বোঝা যাচ্ছিল যে তাপ আর কার্যের মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে। তাপ আর কার্যের রূপান্তরের ব্যাপারে অনেকেই কাজ করলেও জেমস জুল(1818-1889) প্রথম একটা কার্যকর তত্ত্বে উপনীত হন। কত কাজ করলে কত তাপ উৎপন্ন হতে পারে বা কত তাপ ব্যয় করলে কত কাজ করা যেতে পারে তার একটা হিসাব তিনি দেন(W= JH)। তিনি ছিলেন তাপ-পাগল লোক। হানিমুনে গিয়েও ঝরনার উপরের জলের আর নিচের জলের তাপমাত্রা মেপেছেন। চৌবাচ্চায় প্যাডেল ঘুরিয়ে জলের তাপমাত্রার পার্থক্য থেকে যান্ত্রিক তুল্যাঙ্কের(J) মান নির্ণয় করেছেন। সেই মান অভাবনীয়ভাবে বহু যন্ত্রপাতি দিয়ে নির্ণীত মানের খুবই কাছাকাছি। 

                               ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের সময় এই অটোমোবাইল যুগ কিন্তু শুরু হয়েছিল কোন তাত্ত্বিক বিদ্যা ছাড়াই। আশ্চর্যজনকভাবে ইংরেজদের তুলনায় ফরাসিরা এর তাত্ত্বিক দিক নিয়ে বেশি চিন্তা শুরু করেন। প্রথম উল্লেখযোগ্য নাম হলেন সদি কার্ন (1796-1832)।তিনি একটি তাত্ত্বিক ইঞ্জিন তৈরি করলেন যেটা বিজ্ঞানে কার্ণ ইঞ্জিন নামে পরিচিত। তার মাধ্যমে তিনি দেখালেন যে কখনোই  তাপকে সম্পূর্ণ কার্যে রূপান্তর করা সম্ভব নয়। কিছু না  কিছু এই প্রক্রিয়ার মধ্যে নষ্ট হবেই।তাপ থেকে কার্য করতে গেলে তাপ কে একটি তাপ উৎস(source) থেকে একটি তাপ গামলাতে(sink) স্থানান্তরিত করলে তবেই মিলবে শক্তি। মানব সমাজেরও একই নিয়ম। জ্ঞান, বুদ্ধি, শক্তি, অর্থ তা যত বেশি হোক না কেন যদি এক স্থানে জমে থাকে তা কোন কাজে আসে না। সেগুলি ব্যবহৃত হলে, স্থানান্তরিত হলে তবেই কাজের হয়। আর কাজে লাগাতে গেলে খানিকটা অপচয় হবেই।কোনো কিছুই সম্পূর্ন কাজে লাগেনা। অপচিত শক্তি,সম্পদ, বিদ্যা আসলে অপচয় নয়। কার্নোর ইঞ্জিন ছিল সম্পূর্ণভাবে তাত্ত্বিক ইঞ্জিন। আসল অটোমোবাইল(Internal combustion engine) আসতে তখনও অনেক বাকি। কার্ন জন্মেছিলেন ফরাসি বিপ্লবের খানিক পরে। পড়াশোনা করতেন ইকোল পলিটেকনিকে। যেটি মূলত শুরু হয়েছিল সামরিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যার জন্য,কিন্তু সামগ্রিক ভাবে বিজ্ঞানে প্রভূত অবদান রেখেছে। সেখানে তার সহপাঠী ছিলেন করিওলি। যিনি পরবর্তীকালে কোরিওলি ফোর্স( ঘূর্ণায়মান পৃথিবীর উপর চলমান বস্তুর উপর ক্রিয়াশীল বল) আবিষ্কার করেন। যে বলের প্রভাবে বায়ু প্রবাহ  উত্তর গোলার্ধে ডান দিকে ও দক্ষিণ গোলার্ধে বাম দিকে বেঁকে যায় (ফেরেলের সূত্র)। আর তার শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন অ্যাম্পিয়ার, গে লুসাক এর মত বিখ্যাত লোকেরা। কার্ন কে ফাদার অব থার্মোডিনামিক্স বলা হয়। তার জীবনকালের ফ্রান্স ছিল বড়ই ঘটনা বহুল। ফরাসি বিপ্লবের পর নেপোলিয়নের উত্থান, তার পরাজয়,পুনরায় 100 দিনের রাজত্ব, জুলাই বিপ্লব(1830)  এই সবই তার ঐ ক্ষুদ্র জীবনকালের মধ্যের ঘটনা। আর এই সময়কালের ফ্রান্স নিয়ে দুখানি বিখ্যাত উপন্যাস রচিত হয়েছে। আলেকজান্ডার ডুমার কাউন্ট অব মন্টিকৃষ্ট, ভিক্টর হুগোর লা মিজারেবল। তিনি শেষ জীবন কাটান এসআইলেমএ। মারা যান কলেরায়। কলেরা তখন শুধু আমাদের দেশেই নয় গোটা বিশ্বজুড়ে খানিকটা মহামারীর মতো ছিল।

                      তবে এই যে শক্তির রূপান্তর মানে তাপ শক্তি থেকে যান্ত্রিক শক্তি যে হলো তার কিন্তু একটা পছন্দের দিক থাকে। উদাহরণ দিলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে। একটু উপর থেকে জলের মধ্যে একটা পাথর খণ্ড ফেললে শব্দ উৎপন্ন হয়। এখানে পাথরের যান্ত্রিক শক্তি শব্দ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু জলের মধ্যে পাথর রেখে ঢাক বাজালে পাথর কিন্তু উপরের দিকে উঠবে না। অর্থাৎ শব্দ শক্তি থেকে পাথরের যান্ত্রিক শক্তি আর ফিরে পাওয়া যাবে না। তাপ গতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র (প্রথম সূত্রটি আসলে শক্তি সংরক্ষণ সূত্রের রুপ)বলে বাইরে থেকে কাজ না করলে তাপ কখনো নিম্ন উষ্ণতা থেকে উচ্চ উষ্ণতার দিকে প্রবাহিত হবে না। যদি পাঠাতে হয় তাহলে বাইরে থেকে কিছু কার্য করতে হবে। যেমন আমাদের ফ্রিজ ঠান্ডা করতে গেলে ভেতরের কম তাপমাত্রা থেকেও তাপ বের করে বাইরের বেশি তাপমাত্রায় দিতে হয়।এক্ষেত্রে কাজ করা হয় তড়িৎ শক্তি দিয়ে। মানুষের প্রবৃত্তির, কিছু প্রবৃত্তির অন্তত একটি স্বাভাবিক গতি থাকে। যেমন স্নেহ স্বাভাবিকভাবেই নিম্নগামী। বড় থেকে ছোটর দিকে ধাবিত হয়। কোনরকম কারণ (বল প্রয়োগ) ছাড়াই। বাবা-মাকে কখনো বলতে হয় না সন্তানকে স্নেহ করতে হবে। কিন্তু বড়দের স্নেহ ( শ্রদ্ধা মিশ্রিত ভালোবাসা) করতে গেলে সেটা কিন্তু সর্বদা স্বাভাবিক ভাবে আসে না।এলে  ছোটবেলা থেকে আমাদের কানে পাখি পড়ার মতো সমাজকে বলতে হতনা ( কার্য করতে হতনা) 'বড়দের কথা শুনবে’, 'বড় দিকে শ্রদ্ধা করবে’, ‘বাবা মাকে  দেবতা জ্ঞান করবে’ ইত্যাদি ইত্যাদি। 

                  শক্তির রূপান্তরের এই পছন্দের দিক  এনট্রপি বলে একটি রাশি দ্বারাও ব্যাখ্যা করা যায়। এনট্রপি হলো অব্যবস্থার ( State of disorder) নির্ণায়ক রাশি বা যে শক্তি পুনরুদ্ধার করা যায় না মানে নষ্ট হয় তার পরিমাপ। অব্যবস্থা যত বাড়ে এনট্রপি তত বাড়ে। যে কোন অব্যবস্থার সম্ভাবনা (probability)  ব্যবস্থাপক ( ordered state) সম্ভাবনা থেকে অনেক বেশি। উদাহরণ দিলে পরিষ্কার হবে। একটা বই এর ordered state হল বন্ধ অবস্থায় মলাট উপরের দিকে থাকা। এটি এক রকম ভাবেই থাকতে পারে, অর্থাৎ সম্ভাবনা এক। কিন্তু বইটির disordered state হলো যেকোনো একটি পাতা উল্টে থাকা। যদি বইটিতে 500 টি পাতা থাকে তাহলে সেই সম্ভাবনার সংখ্যা হল 500 । অব্যবস্থার সম্ভাবনা অধিক হওয়ায় যেকোনো প্রাকৃতিক ঘটনা স্বাভাবিক প্রবণতা থাকে অব্যবস্থার দিকে যাওয়ার। আমাদের জীবনেও তাই ঘটে।ঘরদোর গুছিয়ে রাখার কিছুদিন মধ্যে আবার অগোছালো হয়ে যায়। ক্লাসের মধ্যে ছাত্র-ছাত্রীদের ছেড়ে দিলে গোলমাল বাড়ে, ক্রমশ তা হাতাহাতিতেও পরিণত হতে পারে। সামাজিক বন্ধন না থাকলে সমাজে বিশৃঙ্খলা বাড়ে। খানিক বল প্রয়োগ করে আবার শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হয়। 

           গতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রটি ক্লসিয়াসের অবদান। ক্যালোরিক মতবাদের পর তাপের  যে গতীয় তত্ত্বের প্রচলন হয় তার মধ্যে সম্ভাবনা( probability) এবং পরিসংখ্যান বিদ্যার( statistics)  প্রয়োগ করে সেটিকে শক্ত ভিত্তি দান করেন ম্যাক্সওয়েল(1831-1879) ও  বোলজমেন(1844-1906)।বোলজমেন কে  স্ট্যাটিস্টিকাল মেকানিক্স এর জনক বলা যায়।তার কাজের বিরোধিতা করেন অনেকেই,  সমালোচনা অনেক সময় ব্যক্তিগত আক্রমণ স্তরেও চলে যায়। শেষ জীবনে তিনি মানসিক বিকারের শিকার হন। বর্তমান বিজ্ঞানের পরিভাষায় হয়তো সেটি ছিল বাইপোলার ডিসঅর্ডার। দুঃখের বিষয় তিনি আত্মহত্যা করেন। ম্যাক্সওয়েল মাত্র ১৪ বছর বয়সে সুতো আর পিন দিয়ে উপবৃত্ত অঙ্কন করার  পদ্ধতি আবিষ্কার করে শোরগোল ফেলে দিয়েছিলেন। তা নিয়ে রয়েল সোসাইটির একটি সভা পর্যন্ত হয়েছিল। তার সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ সংক্রান্ত। শেষ জীবনে কাটিয়েছেন শয্যাশায়ী স্ত্রীর পাশে নিজে ক্যান্সার আক্রান্ত অবস্থায়। মারা গেছেন মাত্র ৪৯ বছর বয়সে।

               আমরা এখন যে সমস্ত গাড়ি বা বাতানুকূল গাড়িতে বসে হুস হুস করে এদিক থেকে ওদিক  যাই তার সূচনা হয়েছিল বিজ্ঞানী অটোর হাত ধরে। ১৮৭৬ এ প্রথম তিনি অটো সাইকেল ইঞ্জিন তৈরি করেন। ১৮৮৬ তে কার্ল বেঞ্চ যে গাড়ি তৈরি করেন সেটি বর্তমান গাড়ির প্রথম পূর্বপুরুষ বলা যায়।  সেগুলি ছিল অন্তর্দহন ইঞ্জিন (internal combustion engine)।অর্থাৎ জ্বালানিকে ইঞ্জিনের মধ্যেই পুড়িয়ে তাপশক্তি উৎপন্ন করা হয়। প্রথমদিকের  বাষ্প ইঞ্জিন, রেলগাড়ি এগুলি ছিল সব বহির্দহন ইঞ্জিন( external combustion) অর্থাৎ জ্বালানিকে মূল ইঞ্জিনের বাইরে পুড়িয়ে সেই শক্তিকে কাজে লাগানো হতো। এতে তাপের অপচয় হতো অনেক বেশি।১৮৯২ এ রুডলফ ডিজেল বানালেন প্রথম ডিজেল চালিত ইঞ্জিন। এর কিছুকাল আগেও ডিজেল একটা ইঞ্জিন বানিয়েছিলেন কিন্তু তার স্থায়িত্ব ছিল খুব কম। সেই ইঞ্জিন বানাতে গিয়ে ডিজেল মরেই যাচ্ছিলেন দুর্ঘটনায়। হাল কিন্তু ছেড়ে দেননি। ডিজেলের শেষ জীবনে অত্যন্ত রহস্যময়। জাহাজ যাত্রা কালীন মাঝ সমুদ্রে তিনি উধাও হয়ে যান।হত্যা না আত্মহত্যা জানা যায়নি।তবে পারিপার্শ্বিক তথ্য দেখে মনে হয় আত্মহত্যা। কার মনের গভীরে যে কোন অন্ধকার লুকিয়ে থাকে বোঝা দায়।না হলে কি আর  স্বদেশের জন্য দেশ জয় করা ক্লাইভ দেশে ফিরে গিয়ে আত্মহত্যা করেন!

               সে অন্তর্দহন ইঞ্জিন সম্পর্কে আমরা প্রায়ই দু চারটে কথা শুনে থাকি।যেমন ফোর স্ট্রোক, 100 সিসি ইঞ্জিন ইত্যাদি। এইসবের অর্থ কি?  গাড়ির মূল যন্ত্র হলো একটি সিলিন্ডার এর মধ্যে একটি পিস্টন এর যাতায়াত।  ফোর স্ট্রোক কথাটির অর্থ হলো যে সেই সিলিন্ডারের যাত্রা চারটি স্ট্রোকের মাধ্যমে একটি চক্র সম্পূর্ন করে আর সেই যাত্রার মাঝেই  সিলিন্ডারের মধ্যে জ্বালানি পুড়িয়ে তাপ তৈরি করা হয়। সেই তাপে গ্যাসকে প্রসারিত করা হয়, পুনরায়  সংকুচিত করা হয় ।এই প্রসারণ সংকোচনের চারটি স্ট্রোকের মাধ্যমে তা পুনরায় প্রাথমিক অবস্থায় ফিরে আসে। আবার নূতন পর্ব শুরু হয়। আর ওই সিলিন্ডারের আয়তনকেই আমরা গাড়ির সিসি বলে থাকি।যেমন 100 সিসির গাড়ির সিলিন্ডারের আয়তন টি হল 100 ঘন সেন্টিমিটার। শক্তিশালী গাড়িতে একাধিক এরকম সিলিন্ডার থাকতে পারে। তাদের আয়তন বেশি হতে পারে। সিলিন্ডারের মধ্যে ওই ফোর স্ট্রোকে পিস্টনের যে সরলরৈখিক গতি সেটিকেই ক্রাঙ্ক স্যাফট এর মাধ্যমে চাকার ঘূর্ণন গতিতে পরিণত করা হয়। মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার দের অন্যতম  বিষয় এক ধরনের গতিকে আরেক ধরনের গতিতে পরিবর্তন করা। সরলরৈখিক গতি থেকে ঘূর্ণন গতি, ঘূর্ণগতি থেকে সরলরৈখিক গতি, চক্রের মাধ্যমে ঘূর্ণনের মাত্রা কমানো- বাড়ানো ইত্যাদি।

             মূল বিষয়ে ফিরে এসে বলতে পারা যায় তাপ গতিবিদ্যার মূলনীতির সঙ্গে আমাদের মনের প্রভূত মিল। আসলে আমরা ভাবতে পারি এমন একটি যন্ত্র বই তো নই।সেই ভাবনা টুকু শুভ হোক।যন্ত্র যাতে সৎ কাজে লাগতে পারে, সভ্যতা এটুকু প্রত্যাশা তো করতেই পারে আমাদের কাছে।

🍁
বাড়িতে বসেই রেজি.ডাক মাধ্যমে জ্বলদর্চির বিশেষ সংখ্যাগুলো সংগ্রহ করতে পারেন। যোগাযোগ  হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৭৩২৫৩৪৪৮৪



Post a Comment

0 Comments