জ্বলদর্চি

বাগদি চরিত (ষষ্ঠ পর্ব)/শ্রীজিৎ জানা

বাগদি চরিত (ষষ্ঠ পর্ব)

শ্রীজিৎ জানা

বৈশাখের মাঝামাঝি সময়। তপ্ত রোদে পুড়ছে চরাচর। বিস্তৃত কালসাবার মাঠে রোদ যেন ঢেউ খেলছে। গনগনে আগুনের আঁচের মতো রোদের নিঃশ্বাস। দমকে দমকে গরম বাতাসের হলকা মাঠ ছাপিয়ে ছুটে আসছে শিলাইয়ের বাঁধের দিকে। খাল বিলে হাঁটু ডোবা জল। বেড়াকলমীর বেগুনী রঙের ফুলেদের মুখে মিয়ানো হাসি। মাঠের আলপথ ঘিরে ধরেছে ব্যানাঘাসের ঝাড়। ভূতভৈরি বনের ভিতর একরত্তি নাম না জানা পাখিদের উড়াউড়ি। বনকপসিমা লতা এই গ্রীষ্মের দহন উপেক্ষা করে নিজের হরিৎ লাবণ্যে ডগমগ করছে।

কালসাবা মাঠের বুকে এখন চরম শূন্যতা। পাকা ধানের সুঘ্রাণ নেই। শস্যের ভারে আনত শীষের দুলুনির আহ্লাদ নেই। রুনুঝুনু নিক্কন নেই। মাউসিপালার সপ্রেম আদর নেই। চাষীরা বর্গির মতো সোনালী শস্যকন্যাকে লুঠ করে নিয়ে গেছে তাদের খামারে। কত না অত্যাচার সইতে হবে  সোনাবরণ কন্যাকে। যেন অশোক কাননে সীতার উপর চেড়ি রাক্ষসীদের নির্যাতন।তাদের এই নিষ্ঠুরতার পেছনে আছে ক্ষুধার তাড়না। কালসাবার এই ধান ঢোলের মানুষদের কাছে দুমুঠো অন্নের ভরসা।, অন্ন দেবতা,অন্ন লক্ষ্মী, অন্ন সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা জননী। বোশেখ-জষ্টি পেরোলেই কালসাবাকে গিলে খাবে শিলাইয়ের বেনো জল। থই থই জলের মাঝে জেগে থাকবে ইতিউতি উঁচু ভিটে-ডাঙাগুলে। ঢোল জানে হাঁড়িতে চাল থাকলে ভরসা থাকবে বুকে। বানবন্যার আঁকড়া আঁকড়ির সময় দুমুঠো ফ্যানভাত রেঁধে ছেলেমেয়েদের মুখে দিতে পারবে তারা। রোদ তাদের কাছে মালুম হয় না। তাত-বাত গায়ে মেখে  অন্ন লাভের অপরিমেয় আনন্দে মাথায় বোঝা নিয়ে হাঁটা দেয় খামারের দিকে। ক্ষুধার কাছে পাকা ধানের  স্বর্ণবেশী সাজের কালসাবার সৌন্দর্য ঢোলবাসীর কাছে অর্থহীণ। সারা বিশ্বের ক্ষুধার্তের কাছেও তথৈবচ। 
আলের ধারে বাবলাগাছের তলায় বসে ছিল ভগীরথ বাগরা। ছাগল চরাতে এসেছে এই দুপুর রোদে। নরম দুব্বার পাতা,বাজামুথার পাতা পরিপাটি করে ছিঁড়ে খেতে ব্যস্ত লম্বকর্ণের দল।লোখা তার পাশটাতে থপ করে বসে পড়ে। দেখে ভগীরথের হাতে একটা গঙ্গা ফড়িং। ধানাকাটার পর মাঠে ঝাঁকে ঝাঁকে গঙ্গাফড়িং উড়ে বেড়ায়। গুয়া শালিকের দল বিকেলে এদের ধরতেই দলবেঁধে ঝগড়া বাঁধায়। ভগীরথের মুখে আলতো হাসির প্রলেপ লোখার চোখ এড়ায় না।
—কি গো ভগীখুড়া হাসঠ যে? মনে মনে কিছু ভাবঠ না কি? 
—ওই ফড়িংটা ধরে ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল, জানু!
লোখা জানে ভগীরথ বেশ রসিক মানুষ। পুরানো দিনের কত কথা জানে সে। পুঁথি পুরাণের গল্প তার ঠোঁটস্থ। কেউ তাকে কোনদিন রাগতে দেখে নি। গলায় তার  সবদিন তুলসীর মালা। ঠাকুরঠুকুর নিয়েই তার দিন কাটে। কাজের মধ্যে দু'বেলা ছাগল চরায়। সন্ধ্যায় হরিনামের আখড়ায় কালিতলার খোলঘরে যায়। সবাই বলে 
—জাতে বাগদি হলেও ভগী বাগরা বামুন - বোষ্টমের গুণ পেইচে।
কারো বাড়িতে পূজা আচ্চা হলেই খাতির করে ডেকে নিয়ে যায় ভগীরথকে। লোখা তাকে খুব মান্য করে। সময় সুযোগ পেলে তার কাছ থেকে লোখা আগের দিনের কথা শুনতে চায়। বয়স কবেই আশি ছুঁয়েছে ভগীরথের। শরীরের কাঠামো এখনো শক্তপোক্ত। চোখের জ্যোতিও ছুরির মত ধারালো। দাঁত পড়েনি। ছিটেফোঁটা পাক ধরেছে চুলে।লোখা উসাহ ভরে বলে,
—তমার কি কথা মনে হচ্ছে আমি জানি! তমাকে ত ছোটবেলা থিকে চিনি তাই জোর দিয়েই কথাটা বলিঠি।
—-ত কি ভাবিঠি বল দেখি?  
—-ওই ত গঙ্গাফড়িং ধরে আমরা একটা ছড়া কাটতম ছোটবেলায়--গঙ্গাফড়িং বল/ নদীয়ে কত জল/ না যেদি তুই বলতে পারু /হোদার খালে ডুবে মোরু। ইসব ত তমাদের কাছ থিকেই শুনা!
—-তা ঠিকই ধরেচু। মোর লাতি লাতনিরা এসব কিছুই জানেনি। সেইসব দিনের কথা বল্লে ফুরাবেনি রে লখি। 
লোখার উৎসাহ বাড়ে।ভগীরথ খুড়া তাদের গাঁয়ের কথার খনি। কেউ না জানুক লোখা জানে। সেই হিরন্ময় খনি থেকে মূল্যবান ধনরত্ন খোঁজার মতো লোক দরকার। মনিমানিক্য চেনার মতো জহুরি দরকার। লোখা সেই জহুরি। লোখাকে পাড়াগাঁয়ের সকলে বলে গল্পবাজ। তা যে যাই বলে বলুক। লোখা গায়ে মাখে না। তার আনন্দ গৃহসুখে নেই, স্ত্রী সুখে নেই,সন্তান সুখে নেই,অর্থ সুখে নেই,তার আনন্দের সাকিন কালসাপাটির মাঠে,ডোবরি বিলের কাঁচপারা জলে,শিলাইয়ের চরে, শ্রীখোলের বোলে,আড়বাঁশির সুরে আর সেকালের কথকতায়। যখন পুরানো দিনের কথা কেউ বলে লোখার চোখে তখন আলো ঠিকরায়। বালি বিলের জলে শ্রাবণ পূর্ণিমার জ্যোৎস্নার  ঝলকানির মতো তার ঔজ্জ্বল্য। লোখা তখন মুগ্ধ শ্রোতা। জাদুকর কথকের সামনে গল্পের মায়াজালে সে আবিষ্ট। শুধুমাত্র তার গলা থেকে খানিক বাদে বাদে উচ্চারিত হবে, তারপর? তারপর? সেই স্বরভাষ যেন বীরুৎ লতার মতো নরম, আবেগে ভারাক্রান্ত আর গভীর মায়া জড়ানো।
—-সেই আগেকার দিনের কথা কিছু বলো না,ভগী খুড়া!
—-কি আর বোলবো বাবা!সেসব দিন আর নাই। তবে ভাল যেমন হইচে,খারাবও হইচে ঢের। ভাল-মন্দ লিয়েই ত ঠাকুর সংসার গড়েছে। সবকেই মেনে লিতে হবে।
—-মোদের জাত কি এরকমই আছে সবদিন?
—-জাতের দশা ফিরেছে বাবা কিন্তু দিশা ফিরেনি। আজকে আর মুনিবের দয়রে দুটা ফ্যান ভাতের জন্য গামছা পাততে হয়নি। পেট পঁদের জগাড় কত্তে পেরেচে। তবু এখনো লোকের মন থেকে নীচু জাতের ঘেন্না- তাছিল্য মুছতে পারেনি। বামুন -কৈবত্ত কথায় কথায় বলে শুনুনু – বাগদি দুলা / জাতের খোলা।
—-সত্যিই কি আমরা এরকম খুড়া?
—--তরা পড়া লিখা করেচু,তরা ত বেশি জানবি রে। জাত বলে কি কিছু হয় জগতে? জেলার মেইছেনার গভ্ভে জন্মাল ব্যাসদেব। সে লিখল পুরাণ। জগত তাকে পূজা করে। তার ছ্যানা শুকদেব। তাকে বাদ দিয়ে বোষ্টমরা ভাগবত পড়েনি।থাইলে কি হবে বল দিখি। আসলে ইসব মানুষের মনের রোগ। জগতে সৎ কম্ম করে যেতে হবে। চরিত্তি ভাল না হলে আর কি হোল! দেখিঠি বামুন বোষ্টম কায়েত মাহিষ্য মোদের মেইয়াদের গতর দেখে লাল ফ্যালাইঠে। ছ্যা! অদের আমি মোদের চেয়েও ছোট জাত ভাবি, বইলু।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
চোখের পাতা ফেলতে পারে না লোখা। তার ভোগী খুড়া দিনমান মাঠে,নদীর পাড়ে ছাগল চরিয়ে বেড়ায়। মুখে সারাক্ষণ হরিনাম করে। ছেলেবৌমার সংসারে সে গলগ্রহ নয়। তার বদলে ছেলেকে উল্টে এখনো সাহায্য করে।কোথা থেকে এত কথা জানল সেটাই বিস্ময় লোখার কাছে। হাবাগোবার মতো মুখ করে থাকা লোখা একটা ঘোরের মধ্যেই বলে উঠে,
—-এগদম ঠিক কথা বলেচ খুড়া। অভাবের দিন কিছুিটা হলেও ফুরিচে। দেখতম বাপ গুছাত ঘরে আটমেনা খাটচে। বাপকে যাই খেতে দিত সবটাই আনত মোদের ভাইদের জন্যে। খেতে পরতে তখন কি কষ্ট!
—তখন কালসবায় ধান এগবার হোত! বেশিরভাগ মোদের গেরামের লোক জন খাটতে যেত দূর দূরজন্তে। কালসাবার ধান,নদী -খালবিলের মাছ আর গায়ে গতরের খাটনি– এই ছিল মোদের বেঁচে খাকার সম্বল। বিষ্টি  আর শিলাইয়ের জল ছিল ফসল বাঁচাবার উপায়। বলদ- লাঙলে হাল, খালের জলকে সেমনি দিয়ে সেঁচা আর গোবর খতের সার তাতেই যেটা ফলার ফোলত মাঠে। এখনকার মতো দু 'আড়াই মাসে ধান কাটা যেতনি। কালসাবার মাঠে তখন অড়ামেটা,কালমেটা,ভজনা,জটা,বালাম,কালন্দী, কোলমু, কটকি, বাঁকই,ভোগজিরা ধান রুইত। তার পর চিন থেকে এল ধান,তাইচুং তাইনান। ছোটবেলায়  ছড়া কাটতম আমরা। হালে কতসব জাতের ধান এসচে বাজারে। কালসাবায় এখন দুবার ধান ফলে। সারে বিষে জমি ফসল সব বিষময়। তার উবরে হালের মেশিন,কাটার মেশিন, ধান লিকানার মেশিন, বিষ দিয়ার মেশিন, লে বসে বসে এবার আঁঠি চুষ। বাগদির কার কত জমি আছে, যে চষবে! ইদিকে মেশিনের গুঁতায় জন খাটার দিন ফুরাল । যে বাগদি গতরের জোরে সংসার টানত, তার বাড়া ভাতে পড়ল ছাইপঁশ। অ্যার নাম কপাল বুইলু, বাপধন!
🍁
বাড়িতে বসেই রেজি.ডাক মাধ্যমে জ্বলদর্চির বিশেষ সংখ্যাগুলো সংগ্রহ করতে পারেন। যোগাযোগ  হোয়াটসঅ্যাপ - ৯৭৩২৫৩৪৪৮৪


Post a Comment

0 Comments