জ্বলদর্চি

একটি স্মার্ট গ্ৰাম - গ্ৰহণ /নরেন হালদার


ভ্রমণ
একটি স্মার্ট গ্ৰাম - গ্ৰহণ

নরেন হালদার 

কাসোল থেকে দশ কিলোমিটার এবং কুল্লু থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হিমাচল প্রদেশের পার্বতী ভ্যালীর অন্তর্গত একটি নৈসর্গীক গ্রাম হল গ্রহণ। স্মার্ট গ্ৰামের তকমা পাওয়া এই গ্রামটিকে ঘিরে থাকা প্রাকৃতিক পরিবেশ সত্যিই দৃষ্টিনন্দনযোগ্য। কাসোল থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে হলেও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের আদান-প্রদান ছাড়া অন্য কোন কিছুর সাথেই এর কোনো সাদৃশ্য নেই। 
   বৈসাদৃশ্য অনেক। প্রথমত কোনো কোম্পানির মোবাইল নেটওয়ার্ক এখানে পাওয়া না গেলেও গ্রামের মোট ৭৫ ঘর বসতির প্রায় ৫০০ মানুষ ওয়াইফাই এর ঘেরাটোপে একে অন্যে এবং বহির্জগতের সঙ্গে যুক্ত। শুনে আশ্চর্য মনে হলেও কাসোল থেকে কেবল নেটওয়ার্কর তার বিছিয়ে এনে গোটা গ্রামকে ওয়াইফাই করে নিয়েছে। দ্বিতীয়তঃ কাসোলের সাথে বা অন্য শহরের সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম মিউল। তার পিঠে করেই চলে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের আদান-প্রদান।
   গ্রামটি সম্বন্ধে দুটি কিংবদন্তি পাওয়া যায়। একটি পৌরাণিক অন্যটি ঐতিহাসিক। স্থানীয় ব্যক্তির সাথে কথাবার্তার মাধ্যমে জানা যায়, প্রাচীনকালে এখানে ঋষিরা বসবাস করত। ঋষিদের এখানে আগমনের যে ঘটনা জানতে পারা যায় তা এরকম - হিমালয়ে যখন ঋষিরা নিশ্চিন্তে তপস্যা করছিল তখন একসময় সেখানে অসুরদের আধিপত্য বৃদ্ধি পায়। শান্ত হিমালয় অসুরদের কোলাহলে অশান্ত হয়ে ওঠে। ঋষিরা তখন বিকল্প তপস্যাস্থলের খোঁজে হিমালয়ের নিচে নেমে আসে এবং এই গ্রহণ গ্রামের আশেপাশে অবস্থান করে তপস্যা করতে থাকে। তখন থেকেই এই জায়গার পরিচিতি। প্রমাণ স্বরূপ এখানে তিনটি পুরনো মন্দির রয়েছে। স্থানীয়দের বক্তব্য অনুযায়ী, এগুলি সবই ঋষি যাগ্যবল্কর মন্দির। বর্তমানে মন্দির তিনটি নতুন করে সাড়িয়ে তোলা হয়েছে এবং পুরোটাই কাঠের উপর নকশা কেটে তৈরি করা।
   মন্দিরের আরো একটি বৈশিষ্ট্য এই যে মন্দির তিনটি বছরের বেশিরভাগ সময়েই বন্ধ থাকে। মন্দিরে কোনো নিত্য পূজার প্রচলন নেই। মন্দির খোলার নির্দিষ্ট কোনো তিথিও নেই। মন্দির খোলার জন্য দৈব আদেশের উপর নির্ভর করতে হয়। পূজার দায়িত্বপ্রাপ্ত পূজারীর মাধ্যমে সে বার্তা গ্রামবাসীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং তখন ধুমধাম করে অনুষ্ঠান হয়।
   গ্রাম স্থাপনের ঐতিহাসিক কিংবদন্তিটি হল - আজ থেকে প্রায় পাঁচশ বছর আগে এখানে কোনো মানুষ বসবাস করত না। এখান থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত মালানা গ্রাম থেকে (মালানা গ্রামকে ট্যাবু গ্রাম বলা হয় এবং এটি একটি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী গ্রাম। এখানেও ঋষি জমদগ্নীর নামে জমদগ্নী মন্দির রয়েছে) একটি গোষ্ঠী আধুনিক জীবন যাপনের প্রয়োজনের কথা বিবেচনা করে এখানে (গ্রহণ) এসে বসবাস শুরু করে। দুর্গম মালানা থেকে তুলনামূলক সুগম এই গ্রহণ।
   উল্লেখ্য ট্যাবু গ্রাম মালানা গ্রামের একটি গোষ্ঠী এখানে চলে এলেও একটি ধর্মীয় আচর(Ritual) বয়ে এনেছিল। সেটি হল বৈবাহিক সম্পর্কের ক্ষেত্র। আচারটি এমন ছিল যে, ওই গ্রামের লোকেদের সাথে অন্য কোনো গ্রামের বা অন্য কোনো স্থানের মানুষের সংস্পর্শ থাকবে না। সেক্ষেত্রে বিবাহও হতো গ্রামের মধ্যেই। ফলে সঙ্গত কারণেই দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে গ্রামের সকলেই পরস্পরের সাথে আত্মীয়র বন্ধনে আবদ্ধ। তবে ইন্টারনেট (ওয়াইফাই) এর দৌলতে গ্লোবালাইজেশনের প্রভাব এদের মধ্যেও পড়েছে। স্থানীয় জীবন নাম্বী ট্র্যকার গাইড-এর বক্তব্য অনুযায়ী, তিনিও বিবাহ করেছেন দূরবর্তী কুল্লু শহরের মেয়েকে এবং তাদের পরিচিতির মাধ্যম স্যোসাল মিডিয়া (ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইন্স্টাগ্ৰাম )।
   কাসোল থেকে ১০ কিলোমিটার রাস্তার প্রায় ৬ কিলোমিটার রাস্তা গ্রহণ নালার পাশ ধরে ছোট মালবাহী গাড়ি যাওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছে সাম্প্রতিক। বাকি ৪ কিলোমিটারের জন্য ভরসা মিউল বা আপন চরণযুগল। এখানকার মানুষের অন্যতম জীবিকা কৃষিকাজ হলেও বর্তমানে ট্যুরিস্ট প্রাধান্য পাওয়ায় ছোট ছোট হোমস্টে গড়ে উঠেছে। এবং সেইসাথে টুরিস্ট এবং ট্র্যকার গাইড হিসেবেও এরা কাজ করছে। ফসলের মধ্যে দেখা যায় যব, গম, সর্ষে, এবং ধান আর কিছু আপেল বাগান।
   তবে গ্রামের প্রাচীন ঐতিহ্য যাই হোক আমরা টুরিস্ট বা ট্র্যাকারদের কাছে পার্বতী ভ্যালী, গ্ৰহণ নালা, গ্ৰহণ গ্ৰামের নৈসর্গিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ না হয়ে পারি না। গ্রহণ নালার স্বচ্ছ জল পাথরে বাধা পেয়ে উচ্ছ্বলিত যৌবনের মতো কলরব করে উঠে আমাদের কানে মধু ঢেলে দিচ্ছে আর কোথাও সারি সারি কোথাও এলোমেলো পাইন বনানীর মধ্য দিয়ে বয়ে আসা নালার সৌন্দর্য দৃষ্টিতে ঢেলে দিয়েছে মদিরতা। আর তারি মাঝে এ গ্রাম নাগরিক সমস্ত ব্যস্ততাকে ভুলিয়ে দিয়ে সময়কে ভাসিয়ে দিয়েছে অনন্তের দিকে।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
               

Post a Comment

0 Comments