জ্বলদর্চি

কর্মযোগী রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়/ অরুণকুমার রায়

কর্মযোগী রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়
( ২৯.০৫.১৮৬৫ -৩০.০৯.১৯৪৩ )

 অরুণকুমার রায়
                 
অংতি সংতং ন জহাতি অং তি সংতং ন পশ্যতি ।।
অর্থাৎ " যত দিন কাছে আছে তত দিন তাহার গৌরব বুঝিতে পারা যায় না,হারাইলে তখন দেখা যায় তাহার মহিমা ।"...,  অথর্ব বেদ,১০,৮,৩২ সুক্তির এই শ্লোক ও তার ব্যাখ্যাটি করেছিলেন মহা পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেনশাস্ত্রী প্রবাসী পত্রিকার ১৩৫০ পৌষ সংখ্যায় তাঁর লেখা 'পুণ্যচরিত কথা' নামক দীর্ঘ লেখায়। 
  উপরোক্ত কথাগুলি যার সম্বন্ধে লেখা তিনি হলেন বিশ্ববরেণ্য রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। আজ তাঁর ১৩৮তম জন্ম দিবস। ভারতীয়  সাংবাদিকতার জনক,মহান কর্মযোগী বিশ্ববরেণ্য রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম রাঙা মাটির দেশ বাঁকুড়ার পাঠক পাড়ায়। পিতা শ্রীনাথ ও মাতার নাম হরসুন্দরী। খুব কম বয়েসেই পিতার আকস্মিক মৃত্যুতে ভেঙে না পড়ে, ও সমস্ত প্রতিকূল অবস্থাকে পাশ কাটিয়ে রামানন্দ ১৮৮৫ সালে কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে এফ.এ পাশ করে সিটি কলেজে ভর্তি হন। এরই মধ্যে বাঁকুড়া জেলার ওঁদা গ্রাম নিবাসী ও ধলভূম  রাজ স্টেটের মোক্তার স্বর্গীয় হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বিতীয়া কন্যা   শ্রীযুক্তা মনোরমা দেবীর সহিত প্রাচীন হিন্দু মতে রামানন্দের বিবাহ হয়।  এই সময়েই ১৮৮৮সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসাবে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান পেয়ে ৪০ টাকা রিপন স্কলারশিপ পান। ১৮৮৮সালে এম.এ পাশ করেন।
সেই সময় সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের মুখপত্র ' Indian messenjer ' এর সম্পাদক ছিলেন হেরম্ব চন্দ্র মৈত্র। তিনি রামানন্দের প্রতিভায় খুশি হয়ে তাকে পত্রিকার সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব দেন। 
১৮৮৯ সালে রামানন্দ ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত হন এবং সেই সময় কালেই শিবনাথ শাস্ত্রীর অনুসরণে উপবীত বিসর্জন করেন। ১৮৯৫ সালে আগে জগদীশচন্দ্র বসুর সঙ্গে শিবনাথ শাস্ত্রীর সম্পাদনায় শিশুদের পত্রিকা মুকুল শুরু করেছিলেন। কলকাতা থাকাকালীন সময়েই মা সারদামণি ও ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং ঠাকুরের কিছু বাণী নিয়ে ' ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরহংসের উক্তি' শিরোনামে ' ধর্মবন্ধু ' পত্রিকায় বাংলা ১২৯৭ বঙ্গাব্দের আশ্বিন সংখ্যায় প্রকাশ করেন। তাঁর সম্পাদনার বিখ্যাত দুই পত্রিকা প্রবাসী প্রকাশ কাল  যথাক্রমে ( বাংলা বৈশাখ ১৩০৮ ইং ১৯০১ এপ্রিল ) ও মডার্ন রিভিউ (১৯০৭ সালের জানুয়ারি)। দুটি পত্রিকাই এলাহাবাদ থেকে  প্রকাশিত হয়। এই দুটি বিখ্যাত সাময়িক পত্রিকা প্রকাশক ছিলেন দ্য ইন্ডিয়ান প্রেসের কর্ণধার বাবু চিন্তামণি ঘোষ মহাশয়। তিনি আদতে হাওড়া শহরের বালি গ্রামে নিবাসী হলেও এলাহাবাদ শহরেই বহু পরিশ্রমে গড়ে তোলেন  বিশাল সাম্রাজ্য 'দ্য ইন্ডিয়ান প্রেস'।  এখান থেকেই রবীন্দ্রনাথের ৮৭টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিলো। তাঁর সেই জীবন সংগ্রামের কাহিনীও  যেমন চিত্তাকর্ষক তেমনই তাঁর হাতে গড়া 'দ্য ইন্ডিয়ান প্রেস চিরকালীন হয়ে আছে ভারতবর্ষের মুদ্রণ - প্রকাশনা জগতে এবং বাংলা তথা হিন্দী সাহিত্যের ইতিহাসে ... চিন্তামণি, রবীন্দ্রনাথ, রামানন্দ সে এক আলাদা কাহিনী।  
রামানন্দের অন্তর মনে সদা সর্বদা বহমান করুণার সাগর। ১৮৯৬ সালে ভারতবর্ষের বহু জায়গায় বিউবোনিক প্লেগ নামে এক মহামারীর প্রকোপ দেখা যায় । এই রোগটির পাদূর্ভাব হয়েছিল চিন রাষ্ট্রের ইউনান থেকে। রামানন্দ সেই সময়ের কিছুদিন আগেই  এলাহাবাদে আসেন  (১৮৯৫ -১৯০৮) কায়স্থ পাঠশালা কলেজের প্রধানাচার্য পদে । এখানেও তখন এই রোগের দুরন্ত প্রকোপ। চারপাশে মৃত্যুর বিভৎস করাল রূপ। রামানন্দ ও তাঁর  সহযোগী বন্ধু ইন্দুভুষণ রায়কে নিয়ে শহরের ঘিঞ্জি বস্তিতে বস্তিতে গিয়ে ওষুধ বিতরণ, তাদের সেবা - শুশ্রুষা করায় রাত দিন নিজেদের নিয়োজিত করেন । এই সময়ে এখানে মুঠিগঞ্জ পাড়ায় স্থানীয় বাঙালি - অবাঙালিরা নিজেদের ব্যাক্তিগত প্রয়াসে একটি অনাথাশ্রম গড়ে তোলেন।   রামানন্দ এই অনাথাশ্রমের সেক্রেটারি ছিলেন সম্ভবত ১৮৯৬ ও ১৯০৩ সালের মধ্যবর্তী কোনো সময়ে ।
  রামানন্দ তাঁর গঠনমূলক কাজের মাধ্যমে এই অনাথাশ্রমের প্রভূত উন্নতি সাধন করেন। সেই সময় স্কুল- আশ্রমে,কুটির শিল্প ইত্যাদির কাজ শেখানো হতো না। রামানন্দ ও তার বন্ধু এই কাজের প্রবর্তন করেন। সেই সময়ে অর্ধকুম্ভের সময় তথা  প্রতিবৎসর মাঘ মেলায় প্রচণ্ড শীতে এবং কলেরায় বহু মানুষ মারা যেতেন। রামানন্দ এই সব কাজেও কখনো সরাসরি নেমে পড়তেন । আবার কখনও বিভিন্ন সেবা 
কমিটির মাধ্যমে নিজের মূল্যবান পরামর্শ দিতেন। 
রামানন্দ এলাহাবাদে কায়স্থ পাঠশালা কলেজে (কেপি কলেজ) থাকাকালীন দীর্ঘ তেরো বছর সময়ের মধ্যে বর্তমান উত্তর প্রদেশ তদানীন্তন সংযুক্ত প্রদেশের শিক্ষা, সামাজিক কাজে বহু সাড়া জাগানো কাজ করেন।
নিজের স্কুলের ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যে তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তাঁর ব্যবহারে ও কাজের মাধ্যমে। তিনি কলেজে ইংরাজি সাহিত্য পড়াতেন।  তাঁর ক্লাসে ছাত্ররা তম্নয় হয়ে শুনত তাঁর পড়ানো। এমন কি ক্লাসের নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেলেও শিক্ষক ও ছাত্রদের সময়ের কোনো খেয়াল থাকতো না। সেই সময়ে কলেজের লাইব্রেরী,ব্যায়ামাগার, গবেষণার জন্য আধুনিক সাজ- সরঞ্জামের ব্যবস্থাও তিনি করেছিলেন। তাঁর মস্তিষ্কে সর্ব সময় ছাত্রদের  আধুনিক শিক্ষার সাথে-সাথে নৈতিক মূল্যবোধের প্রতি সজাগ দৃষ্টি থাকতো। সেই সময় নিজের স্কুল ছাড়াও শহরের অন্য স্কুলের ছাত্র - শিক্ষক ,অভিভাবক এবং শহরের সর্বসাধারণ থেকে নিয়ে গণ্যমান্য নাগরিক বৃন্দের মধ্যেও তাঁর পঠন পাঠন পদ্ধতি ও কার্যের  সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। অল্পদিনের মধ্যেই বহু গণ্যমান্য জন যথাক্রমে মহামানা মদনমোহন মালব্য, মতিলাল নেহরু , ড:বামনদাস বসু, শ্রীশ চন্দ্র বসু, স্বামী বিজ্ঞানানন্দ, (এলাহাবাদ রামকৃষ্ণ মিশন এর অধ্যক্ষ , পূর্বাশ্রমের নাম হরিপ্রসন্ন  চট্টোপাধ্যায় ) সতীশচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়,মহা মহোপাধ্যায় পণ্ডিত আদিত্যরাম ভট্টাচার্য প্রমুখের সহিত তাঁর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এই বন্ধুত্ব তাঁর সারা জীবন যেমন অটুট ছিলো তেমনই এলাহাবাদের প্রবাসী বাঙালিদের সাথেও তাঁর নিবিড় ভালোবাসার বন্ধন গড়ে ওঠে এবং এই ভালোবাসার বন্ধন শহরের সীমানা ছাড়িয়ে প্রদেশ ও সারা দেশের সেখানেই যেখানে প্রবাসী বাঙালিরা বসত করেছেন তাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
   রামানন্দ প্রাচ্যের অক্সফোর্ড রূপে খ্যাত এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি ম্যাকডোনাল্ড শিক্ষা কমিটির সদস্য ছিলেন। 
    রামানন্দ এলাহাবাদে আসার পূর্বেও কলকাতায় বিভিন্ন সেবা কাজে যুক্ত ছিলেন । নিজের গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করবার আগেই তিনি বিভিন্ন সমাজ সেবামূলক কাজের সঙ্গে মনেপ্রাণে জড়িয়ে পড়েছিলেন। কয়েকজন সৎ ও উদ্যমী যুবকের প্রচেষ্টায় জালালপুর (বশিরহাট ) দাশাশ্রম স্থাপিত হয়। এর এক বৎসর পরে অর্থাৎ ১৮৯২ সালে কলকাতায় 'দাসী ' পত্রিকা প্রকাশিত হয়। দাসী পত্রিকার উদ্দেশ্য ছিল জনসেবা। এই যুবকেরাই কলকাতায় পথের ধারে পড়ে থাকা রুগ্ন মরনাপন্ন রুগীদের নিয়ে একটি ঘরে আশ্রয় দেন। রামানন্দ ইহাদের কাজে নিজেকে জড়িয়ে নেন। দাশাশ্রম কমিটি গঠন হইলে তিনি সভাপতি হন। এই সব স্থানে পরে কোনো কারণে বাড়ি ভাড়া ইত্যাদি বকেয়া পড়িলে দাসী পত্রিকার সম্পাদক হিসাবে তাঁর কাধে এই ব্যায়ভার চাপিয়া বসত। রামানন্দ এলাহাবাদে চলে আসার পরেও বেশ কিছু দিন দাসী পত্রিকার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন। রামানন্দ এলাহাবাদে থাকাকালীন সময়েই মাদকতার বিরুদ্ধে দেশব্যাপী আন্দোলনের কেন্দ্রভূমিতে ছিলেন। তিনি সেই সময় উত্তর পশ্চিম প্রদেশে  Provincial Temperence Association এর সভাপতি ছিলেন। 
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
প্রবাসে ' প্রবাসী ' পত্রিকার  কথা : 

  প্রথমে প্রবাসে প্রবাসীর দ্বারা পরিচালিত বলে পত্রিকার নাম ' প্রবাসী '  হয়। পত্রিকাটিতে প্রবাসী বাঙ্গালীদের জীবনী, তাঁদের নানা বিষয়ের কার্য , প্রবাসে বঙ্গসাহিত্য, প্রবাসীদের দুঃখ সুখের কথা তাঁদের স্বার্থ রক্ষার কথা
' প্রবাসী ' পত্রিকার একটা অঙ্গ ছিল। প্রথম দিকে
' প্রবাসী'তে প্রবাসী বাঙ্গালীদের কথা বেশী থাকতো। পরে প্রবাসীর ব্যাপক অর্থ হওয়াতে সমগ্র দেশবাসীই '  প্রবাসী ' "নিজ বাসভূমে পরবাসী " এই ' মটো ' নিয়ে এগিয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন " প্রথম যখন রামানন্দবাবু প্রদীপ ও পরে প্রবাসী বের করলেন তাঁর কৃতিত্ব ও সাহস দেখে মনে বিস্ময় লাগল । " 
প্রবাসীর প্রথম সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত
" প্রবাসী " কবিতা : " সব ঠাঁই মোর ঘর আছে আমি
সেই ঘর মরি খুঁজিয়া। " প্রকাশিত হয়। প্রথম সংখ্যাতেই অজন্টা গুহা চিত্রাবলী বিষয়ে তিনি স্বয়ং প্রথম বাংলা প্রবন্ধ লেখেন।  বাংলার কোনো বই ও সাময়িক পত্রিকায় ইতিপূর্বে কোনো চিত্র ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়নি। স্যর অতুল চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন " ইহার মতন প্রবন্ধ বোধহয় বাংলা সাহিত্যে সম্পূর্ণ অভিনব " । 
ভারতবর্ষের ও বাংলার সর্বাঙ্গীন উন্নতির চেষ্টা ছিলো প্রবাসীর সম্পাদক রামানন্দের জীবন ব্রত। 
পৃথিবীর সব মানুষের সর্বাঙ্গীণ  উন্নতিতেই তিনি বিশ্বাস করতেন। মানুষকে তিনি খন্ড খন্ড করে দেখতেন না। সমগ্ররূপে দেখতেন। 
প্রবাসীতেই প্রথম শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ ও তাঁর শিষ্য নন্দলাল বসুর চিত্র প্রকাশিত হয়। এর আগে আর কোনো সাময়িক পত্রে এই রকম চিত্র প্রকাশিত হয়নি। 
' প্রবাসী 'কে ভারতীয় চিত্রকলার শ্রেষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক
বলা হয়ে থাকে। প্রবাসী পত্রিকাই প্রথম নিয়মিত ভাবে লেখকদের লেখার বিনিময়ে দক্ষিণা দানের ব্যবস্থা করেন। 
সম্ভবত বাংলা ১৩০৯ সাল থেকে এলাহাবাদের ইন্ডিয়ান প্রেসে বাংলা কম্পোজিটারের  অভাব হওয়াতে ' প্রবাসী ' পত্রিকা কলকাতার কুন্তলীন প্রেসে ছাপা হতে লাগলো। 
প্রবাসীর জন্মলগ্ন থেকেই তার ভাগ্য ললাটে লেখা শুধু সমাজের নানান স্তরের মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন
ও প্রশংসা। আচার্য সুনীতি প্রসাদ চট্টোপাধ্যায় থেকে নিয়ে বহু বিখ্যাত ব্যাক্তিরা প্রবাসীর প্রশংসায়
পঞ্চমুখ ছিলেন। অনেকেই তো প্রবাসীর জমকালো মলাট দেখেই খুশি হয়ে উঠেছিলেন। প্রবাসীর প্রথম সংখ্যা এমনই চিত্তাকর্ষক হয়েছিলো যে প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশ হইতেই নিঃশেষ হয়ে  যায় এবং এই
সংখ্যাটির দ্বিতীয় সংস্করণ ছাপতে হয়। সাময়িক
পত্রের ইতিহাসে এও এক বিরলতম ঘটনা বলতে
পারা যায়।

প্রবাস : কেপি কলেজ থেকে পদত্যাগ ও মডার্ন রিভিউ প্রকাশনার পূর্ব কথা।

কেপি কলেজে শিক্ষকতা করতে করতেই তার ইংরাজি
কাগজ প্রকাশ করার সুপ্ত ইচ্ছা ছিল। এদিকে কলেজ কর্তৃপক্ষের সহিত মতভেদ হওয়াতে উনি পদত্যাগ করেন। যদিও এর পূর্বেও তিনি কয়েকবার পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই সময় মদনমোহন মালব্যের মধ্যস্থতায় তিনি নিরস্ত হন। কিন্তু এইবার তিনি  মালব্যজীর মধ্যস্থতাকে বিফল করে পদত্যাগ করলেন। ছাত্র হিতৈষী ও তাদের সার্বিক পড়ালেখা ও নৈতিক মান ও তাদের মধ্যে আধুনিক চিন্তাধারার জাল বুনে দেবার প্রচেষ্টা, এটাই ছিল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতভেদ ও পদত্যাগের কারণ। কলেজ থেকে তাঁর বিদায় সমারোহের দিন সমস্ত ছাত্র, শিক্ষক-অশিক্ষক কর্মচারীদের মধ্যে বয়ে যায় পিতৃশোকের বেদনা । বিদায় বেলায় তারা সকলে একটি ঘোড়া গাড়িতে তাঁকে বসিয়ে নিজেরাই তাঁর বাড়ি অবধি গাড়ি টেনে নিয়ে যায়। বাড়ির সন্নিকটের রাস্তায় ,বাড়ির বারন্দায় ছাত্রদের ভিড়ে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। প্রতিটি  ছাত্রই তাঁর পায়ের কাছে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করার সময় কেঁদে ফেলে। সেই দৃশ্য দেখে আসে পাশের সকলেরই দু চোখে জল ভরে ওঠে। দিন শেষ হয়ে প্রায় অর্ধ রাত্রি অবধি  ছাত্রদের ভিড় যেন শেষ হতেই চায় না।
পাঁচটি ছোট্ট ছেলে -মেয়ে ও স্ত্রী ছাড়াও তাঁর উপর নির্ভরশীল কিছু আত্মীয় স্বজন। ভাড়া বাড়ি । তবুও
তিনি মনস্থ করলেন আর চাকুরী করবেন না। ইন্ডিয়ান প্রেসের কর্ণধার বাবু চিন্তামণি ঘোষ, লাহোরের লালা লাজপত রায় ও কলকাতার সিটি ও রিপন কলেজে হইতে চাকুরীর প্রস্তাব তিনি স্বীকার করেননি। তাঁর অন্তর মনে ধ্বনিত হয়ে চলেছে 'মর্ডান রিভিউ '।
     পরে চিন্তামণিবাবু চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলেছিলেন ,রামানন্দ বাবু হলেন এক জীবন্ত শব্দকোষ এবং mine of informations. কলকাতায় চলে যাবার বেশ কিছু দিন পরেও বন্ধু মতিলাল নেহরু তাঁকে তার Independent পত্রের সম্পাদকরূপে এলাহাবাদে ফিরিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করেন। সম্পাদকের বেতন ভার তিনি রামাননন্দের উপর দিয়া লেখেন,
" Name your own salary."  যদিও তিনি বিনম্রতা
সহকারে তা নিতে অস্বীকার করেন।

  কেপি কলেজ থেকে পদত্যাগ করে তিনি সম্পূর্ণ
মনোনিবেশ করেন ' প্রবাসী ' ও মর্ডান রিভিউ নিয়ে।
প্রবাসী তখন বেশ সাড়া জাগিয়েছে বাঙালি পাঠক
মহলে। ঠিক এই সময়ের মধ্যে  ১৯০৭ সালের জানুয়ারি মাসে মডার্ন রিভিউ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকা প্রকাশনার পিছনে তাঁর কি রকম চিন্তাধারা ছিলো একবার দেখে নেওয়া যাক। 
' বাংলার ও ভারতের বাহিরে নিজের বক্তব্য শুনাইতে হলে ইংরেজির সাহায্য প্রয়োজন। তা ছাড়া আমাদের দেশের হর্তাকর্তাদের সহিত বাংলা
ভাষার লড়াইতো বেশী কার্যকরী নয় । '
মর্ডান রিভিউ দিয়ে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে অপ্রত্যক্ষ সংগ্রাম শুরু হলো রামানন্দের। মর্ডান রিভিউ পত্রিকা বেরুবার পর তার প্রথম সংখ্যা দেখেই  সর্বত্র ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়।
দেশের ইংরাজি পত্রিকা সমূহদের মধ্যে যথাক্রমে The Indian Economist, Advocate,Amrita Bazar patrika,Indian Social Reform,The Hindu দৈনিক পত্রিকা গুলি উচ্ছসিত প্রশংসা করেন। মর্ডান
রিভিউ পত্রিকার দুটি সংখ্যা দেখে একটি বিলাতি
কাগজ  লেখেন - " We are certainly serprised to see them. We have nothing in England more important - looking, more enterprising
& more serious." 
রামানন্দ MR প্রকাশনার পিছনে যাঁদের প্রভূত সাহায্য পেয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে প্রকাশক বাবু চিন্তামণি ঘোষ ছাড়াও ছিলেন মেজর বামনদাস বসু,  সিস্টার নিবেদিতা প্রমুখ। MR এর লেখক সুচিতে ছিলেন সেই সময়কার সব নামজাদা লেখক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যথা বামনদাস বসু, সি.ওয়াইচিন্তামণি, লালা লাজপত রায়, শিবনাথ শাস্ত্রী, সিস্টার নিবেদিতা, সন্ত নেহাল সিং, বিনয়েন্দ্র নাথ সেন, সতীশচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় এ ছাড়া বহু নামি -দামি ব্যক্তিত্ব। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ইতিহাসেই কেবল নয় বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে MR এর অবদান অনস্বীকার্য ।

প্রসঙ্গ : রামমোহন , রবীন্দ্রনাথ এবং রামানন্দ।
রামমোহন ছিলেন রামানন্দের আদর্শ পুরুষ। রামানন্দকে অনেকেই রামমোহনের আত্মিক সন্তান বলে অবিহিত করেছেন। রাজা রামমোহন সেই শ্রেণীর মহাপুরুষ যাঁদেরকে কার্লাইল আখ্যা দিয়েছেন ' heroes ' এবং এমার্সন বলেছেন
' representative men ' ।   ভগবদভক্তি, মানবপ্রীতি,সমস্ত কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে মানুষকে এক নুতন দিশার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া,তাঁদের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ, সত্যপ্রিয়তা, সাহস,বুদ্ধিমত্তা, অদম্য উৎসাহ,অক্লান্ত পরিশ্রম এই সব উপাদানের ঘনীভূত রূপ হলেন রামমোহন।
রবীন্দ্রনাথ ও রামানন্দও এই গোত্রীয়। তাই তাঁদের জীবনের ও কর্মের মধ্যে এতো মিল।
রামমোহনের প্রতি রামানন্দের হৃদয়ে গভীর  ভক্তি ও শ্রদ্ধা সদা সর্বদাই বহমান। বিভিন্ন সভা সমিতিতে তাঁর অসংখ্য বক্তৃতার গুলির মধ্যে দিয়ে তিনি রামমোহনের
আদর্শ ও ভাব প্রচার করেছেন। এলাহাবাদে চক স্থিত বসু ভাতৃদ্বয়েদের বিখ্যাত পাণিনি কার্যালয় থেকে প্রকাশিত রাজা রামমোহন রায়ের গ্রন্থাবলীর ইংরাজি সংস্করণের দীর্ঘ ভূমিকা লেখেন রামানন্দ। এবং শ্রীশচন্দ্র বসু ও বামনদাস বসু ( বসু ভাতৃদ্বয় ) এবং তাঁর বিশেষ উদ্যোগেই রামমোহনের ইংরাজি ও বাংলা রচনাবলী প্রকাশিত হয়। পরে এটি রামানন্দের বিখ্যাত পুস্তক রূপে প্রকাশিত হয়। 
  রামমোহন প্রসঙ্গে তিনি বলেন ,' গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাবের আড়াই হাজার বৎসর পরে পাশ্চাত্য ও ভারতবর্ষ তাকে কিঞ্চিৎ সম্মান দিতে পেরেছে। রামমোহনকে কোনো দেবতার সঙ্গে তুলনা না করলেও তাঁকেও চিনতে সহস্র বছর বা তার বেশি সময় লাগবে। '
রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে রামানন্দ বলতেন " আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সৌভাগ্য রবীন্দ্রনাথের বন্ধুত্বলাভ । " মৃত্যুর কয়েক দিন পূর্বে বলেছিলেন 
" Rabindranath for ever এই আমার moto।" 
প্রবাসীর প্রথম সংখ্যাতেই রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত কবিতা
" প্রবাসী " তে প্রকাশিত হয় যা উপরে উল্লেখিত হয়েছে। দীর্ঘ সময় কালে তাঁদের বন্ধুত্ব অটুট ছিল। রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য কবিতা,ছোট গল্প ,উপন্যাস,প্রবন্ধ প্রবাসীতেই প্রথম প্রকাশিত হয় যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য গোরা , শেষের কবিতা, রক্ত করবী,মাস্টার মশাই ( ছোট গল্প ) ব্যাধি ও প্রতিকার ( প্রবন্ধ ) পশ্চিম -  যাত্রীর ডায়েরি ইত্যাদি ইত্যাদি। 
প্রবাসীতে শুধু রবীন্দ্রনাথের  লেখাই নয় ,ঠাকুর পরিবারের বহু জনের লেখা যথা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর,সৌদামিনী দেবী,মাধুরীলতার অনুবাদ ইত্যাদিও প্রকাশিত হয়।প্রবাসীর পাড়ায়। শুধু তাই কেনো ' প্রবাসী ' র একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ 'বিবিধ প্রসঙ্গ ' তে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে  সমস্ত নিন্দা ও সমালোচনার জবাব দিয়েছেন।
   
রামানন্দ প্রসঙ্গে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর একবার শান্তিনিকেতনে তাঁর  সম্পর্কে বলেছিলেন: 
“বিরাট পুরুষের চারি অঙ্গে চারি বর্ণের মূলাধার। আপনার মধ্যেও তেমনি ব্রাহ্মণের মনীষা, ক্ষত্রিয়ের নির্ভীক সাধনা, বৈশ্যের জ্ঞানভাণ্ডার ও শূদ্রের ঐকান্তিক সেবা আছে। আপনি সেই হিসাবে পরিপূর্ণ মানুষ। শুধু ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় হইলে এমন পরিপূর্ণতা হইত না।” 
লীগ অব নেশন্স কর্তৃপক্ষের আমন্ত্রণে তিনি ১৯২৬ সালে জেনিভায় যান। সেখানে কাজ করতে করতে বিখ্যাত লেখক দার্শনিক রম্যা রল্যার
আমন্ত্রণে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন । তাঁদের মধ্যে দীর্ঘ সময় নানান আন্তর্জাতিক সমস্যা ও আরো গভীর বিষয়ে আলোচনা হয়। রম্যা রল্যা রামানন্দের ব্যক্তিত্ব ও বিদ্বতায় এতটাই প্রভাবিত হন যে তিনি তাঁকে দেখে লিখেছিলেন - ইহাকে দেখিলে টলষ্টয়ের কথা মনে হয়। 

 কর্মযোগী রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের দেহাবসান হয় ১৯৪৩ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর। মাত্র দু বছর  আগেই তাঁর প্রাণের বন্ধু রবীন্দ্রনাথ চলে গেছেন। তাঁর মহাপ্রয়াণের সমাচার শুনে বলেছিলেন: ‘আকাঙ্খা ছিল কবির আগে আমার মৃত্যু হবে। রবীন্দ্রবিহীন জগতে কল্পনা কখনো করি নাই। ভাবি নাই রবীন্দ্রবিহীন জগৎ  দেখতে হবে।’ তাই হয়তো তিনিও বিদায় নিলেন মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে। 

    অধ্যাপক বিধুশেখর শাস্ত্রী তাঁর বন্ধু এবং আত্মীয় রামানন্দ স্মৃতি লেখায় প্রবাসী'-তে লিখছেন - 
"প্রকৃতিতে তিনি কালিদাসের ভাষায় ছিলেন
" অধৃষ্যশ্চাধিগম্যশ্চ", হৃদয়ে ছিলেন সদাশয় ও মহাশয়, এবং কর্মে ছিলেন আজীবন ভারতের নির্ভীক মুক্তিদুত। 
  এই সময়ে, রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রস্থানের অল্পকালের
মধ্যে তাঁহারও মহাপ্রস্থান ভারতের, বিশেষত বঙ্গদেশের পক্ষে দুর্বিষহ।  কী এ দৈবদুর্বিপাক ! কে এখন বিশ্বের সম্মুখে বঙ্গদেশের হইয়া ভারতের মুক্তির বার্তা শোনাইবার  ভার গ্রহণ করিবেন? কাঁহার দিকে বঙ্গভূমি এ জন্য অঙ্গুলি নির্দেশ করিবেন ?   
  " শ্রী রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় আধুনিক ভারতবর্ষের একজন স্রষ্টা। জাতির ইতিহাসে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে
লেখা থাকবে। তাঁর পবিত্র স্মৃতির উদ্দ্যেশ্যে আমার
অশ্রুসজল প্রণাম নিবেদন করি। " 
 (রামানন্দ স্মরণ - বিজয় লাল চট্টোপাধ্যায় )

Post a Comment

0 Comments