জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে- ৭৩/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে

রোশেনারা খান

পর্ব ৭৩

৫ জানুয়ারি আজকাল সংবাদপত্রে নারী পাচারের ওপর একটি লেখা পাঠিয়েছিলাম।  মনোনীত হওয়া  নিয়ে মনে সন্দেহ ছিল। আজকাল মনস্থির করে লেখার সুযোগ পাইনা। যদিও বিশ্বনাথ বাবু বলেন, আপনার লেখা বাতিল হবে না। তবুও  প্রতিবার মনে হয় এবারের লেখা ভাল হয়নি। আজ(১৭জানুয়ারি)সেই লেখাটি আজকাল এর উত্তর সম্পাদকীয়তে প্রকাশিত হয়েছে। কিছু সময়ের জন্য মনটা ভাল হলেও এদিকে হঠাৎ করে খান সাহেব অসুস্থ বোধ করছেন। কী করব? ভাবছি। দুপুরবেলা কলকাতা দূরদর্শনের ‘মুশকিল আসান’ অনুষ্ঠানের পরিচালক (বর্তমানে দূরদর্শন প্রোগ্রাম এক্সিকিউটিভ)রামকৃষ্ণ সাহা ফোন করে বলেন, আমি কলকাতা দূরদর্শন থেকে বলছি, আজকের আজকাল কাগজে আপনার লেখাটি পড়ে ভাল লাগল। আগামীকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিটের ‘মুশকিল আসান’ প্রোগ্রামের বিষয় থাকছে ‘নারীপাচার’। ম্যাডাম আপনি যদি অংশগ্রহণ করেন। আমি মেদিনীপুরে থাকি শুনে একটু অবাক হলেন মনে হল। বললাম, আমি একঘণ্টা পরে জানাচ্ছি। এই সময়ের মধ্যে খান সাহেবের কাছে থাকার জন্য বোনকে ডেকে পাঠালাম, গাড়ির ড্রাইভার ঠিক করলাম। বাড়ি ফিরতে রাত ১২টা হতে পারে। তিন ঘণ্টা সময় তো লাগবেই। চন্দ্রিমা তো সঙ্গে যাবে, সৌনককেও বললাম। ও স্কুলে ছুটি নেবে বলল। সব ঠিক করে রামকৃষ্ণ বাবুকে জানালাম।  সময় হাতে নিয়ে বেরিয়েও দেরি হতে লাগল, দূরদর্শন থেকে বার বার ফোন আসছে, ড্রাইভার বারবার রাস্তা ভুল করছে। শেষে ট্যাক্সি নিলাম, আর ওকে পিছনে আসতে বললাম। অনুষ্ঠান খুবই ভাল হয়েছিল আমার সঙ্গে লালবাজারের একজন গোয়েন্দা ছিলেন। নাম গৌতম,পদবি মনে নেই। সঞ্চালনায় ছিলেন সঞ্জয়  ব্যানারজি। আমার বক্তব্য ও যুক্তি রামকৃষ্ণবাবু ছাড়াও স্টুডিওর অন্যান্যদের খুব ভাল লেগেছিল। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে থাকা আত্মীয় বন্ধু, প্রচুর মানুষ অনুষ্ঠানটি দেখেছেন।পরদিন প্রচুর ফোন পেয়েছিলাম। সেদিন বাড়ি ফিরতে প্রায় ১২টা বেজে গিয়েছিল। আমাদের মত মফস্বলের একজন সাধারণ মহিলাকে দূরদর্শন, আকাশবাণী বা অন্য কোনো অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে হলে এতগুলি সমস্যার মুখোমুখি হতে  হয়, এবং তার  সমাধান করে তবেই যাওয়া সম্ভব হয়। তাই অনেক অনুষ্ঠানে ডাক পেয়েও যেতে  পারি না।

     গত বুধবার ডায়ালিসিস করা যায়নি। ওনার সারা শরীরে অসম্ভব ব্যথা, ছোঁয়া যাচ্ছে না। কালো হয়ে হাতে রক্ত জমে গেছে। আজ শুক্রবার নার্সিংহোম থেকে বলা হল আম্বুলেন্সে করে নিয়ে যেতে। না হলে অবস্থা খুব খারাপ হবে। তাই নিয়ে গেলাম। যাওয়ার সময় পাপু, সৌনক, ড্রাইভার, তিনজনে মিলে ট্রেচারে করে দোতলা থেকে নামিয়ে আম্বুলেন্সে তুলেছিল, কিন্তু ফেরার সময় ভাবছি, এখন কী ভাবে ওনাকে নামানো ওঠানো হবে? ড্রাইভার বাড়ির বাম দিকের রাস্তা দিয়ে নিয়ে আসছিল, পার্টি অফিসের দিকে চোখ যেতেই ড্রাইভারকে দাঁড়াতে বললাম। নেমে গিয়ে  কাউন্সিলার নির্মাল্যকে বললাম, ও সঙ্গে সঙ্গে ৫/৬ জনকে পাঠিয়ে দিল। ওরা একেবারে ট্রেচারসহ দোতলায় উঠিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে যাওয়ার একজন ফোন  নাম্বার দিয়ে বলে গেল,  কাকিমা, যে কোনও প্রয়োজনে ফোন করবেন। আমরা হাজির থাকব।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
কিন্তু ওনাকে নিয়ে কি করব? ভেবে পাচ্ছি না। দীপকে ফোন করলাম, ও সব শুনে বলল, ব্লাডে ইনফেকশন হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। স্পন্দনে ভর্তি করে কয়েকটা টেস্ট লিখে দিচ্ছি, এগুলো করতে বলবেন। এ্যাম্বুলেন্স ডেকে ওনাকে নার্সিংহোমে ভর্তি করলাম। দেখলাম ডাক্তার নিজের থেকেই ওই টেস্টগুলি করতে দিয়েছেন। উনিও ইনফেক্সনের কথাই বললেন। পরদিন হাঁটাচলা করতে পারলেও ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলাম ভয়ের কিছু আছে কি না?- ‘ভয় তো আছেই’। এই কথা শোনার পর সঙ্গে সঙ্গে কলকাতা নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। মেডিকেলের ছাত্র আসাদুলকে সঙ্গে নিয়ে এ্যাম্বুলেন্সে করে ওনাকে ডঃ দাসের ক্লিনিকে নিয়ে গেলাম। উনি আগের নার্সিংহোম পুনমে ভর্তি করতে বললেন। ভর্তি যে করতে হবে, সেটা আমি ভেবেই ছিলাম। ওসমান এবারেও ওর ওখানে থাকার কথা বলেছিল, কিন্তু বার বার থাকাটা আমার ঠিক মনে হয়নি। তাই সেদিন রাতে ট্যাক্সি করে এয়ারপোর্টের কাছে হলদিরামের পিছনে মেয়ের ফ্ল্যাটে গিয়ে উঠলাম। আমাকে বসতে বলে আসাদুল নিজেই ঘর পরিস্কার করে রাতের খাবার কিনে নিয়ে এল।সকালে রিক্সা, অটো ও মেট্রো ধরে নার্সিংহোম পৌঁছালাম। ডাক্তারের পারমিশন নিয়ে ওনার সঙ্গে দেখাও করলাম, সেই একই রকম অবস্থা।

      দুপুরে চন্দ্রিমা এলে ড্রাইভারকে বললাম কাছাকাছি কোনও ভাল রেস্টুরেন্ট থাকলে নিয়ে যেতে। ড্রাইভার আমাদের আমিনিয়াতে হাজির করল।আমাদের খাওয়া যখন প্রায় শেষের দিকে, সেই সময় চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষ এসে বসলেন। আমি চিনতে পেরে গিয়ে আলাপ করলাম। ‘পার’ এর মত সিনেমার পরিচালক  বলে, তাঁর সাম্প্রতিক কালের রাজনৈতিক পরিচয়ের জন্য নয়।

     চন্দ্রিমা আজ আমার সঙ্গে থাকবে, তাই গাড়িটা তখুনি ছেড়ে দেবার কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু অনেকগুলো ব্যাগ সঙ্গে থাকায় পাঁচটার সময় ওনার সঙ্গে দেখা করে ওই গাড়িতেই ফ্ল্যাটে এসে সব নামিয়ে নিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিলাম। আসাদুল বিকেলে ওর বন্ধুর বাড়ি চলে গেছে, আজ ওখানে থাকবে। আমি আর  চন্দ্রিমা মলরোডে গিয়ে রাতের খাবার কিনে নিয়ে এলাম। পরদিন চন্দ্রিমার গাড়ি এলে আমরা লাঞ্চ করে আসার পর ও বাড়ি ফিরে গেছে। সন্ধ্যাবেলা মিলন এল, ও আমার আইনজীবী দাদার সহকারি। দূরসম্পর্কের আত্মীয়ও। ছেলেটি বেশ ভাল, যতক্ষণ সময় ছিল, ওনার পা-হাতে হাত বুলিয়ে দিল। এখন উনি অনেকটাই সুস্থ। আজ ডায়ালিসিস হবে, তবে সেটা অনেক রাতে। আপত্তি জানিয়েছিলাম, আমি পাশে না থাকলে উনি নার্ভাস হয়ে পড়েন। কিন্তু সিরিয়ালি টাইম সেট করা হয়েছে। ডাক্তার বললেন ভয়ের কিছু নেই।

     বিকেলে কমলবাবু এসেছিলেন। গতকাল দূরদর্শন থেকে জানিয়েছিল আজ বিকেলে আমার ‘মুশকিল আসান’ প্রোগ্রামটি পুনঃপ্রচারিত হবে। কিন্তু নার্সিংহোমের টিভিতে দূরদর্শন আসেনা। শুনে অদ্ভুত লাগল। তবে অল্প সময়ের মধ্যে দুবার আসাতে রিসেপসেনিস্টরা চিনে গেছেন এবং খুবই ভাল ব্যবহার করেন। একদিন একজন (সুচিত্রা)জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কী করেন’? – ‘কিছু না, সংসার করি’। তখন মাথা নেড়ে বললেন, ‘না, আপনাকে দেখে শুধু হাউস ওয়াইফ মনে হয় না’। যাইহোক সাতটার পর ট্যাক্সি করেই ফ্ল্যাটে ফিরলাম। আজও রুটি  তরকারি কিনে নিয়ে এসে খাওয়া হল। রাতে বার বার নার্সিংহোমে ফোন করে ওনার খবর নিয়েছি। ডায়ালিসিস শেষ হতে ওরা ফোন করে জানিয়েছে উনি ঠিক আছেন। সকালে মিলন চাল ডাল কিনে নিয়ে এসে রান্না করল। ভাতে ভাত খেয়ে  নার্সিংহোমে এসেছি। ওসমানের ফ্ল্যাট চিড়িয়া মোড়ের কাছা কাছি, ও আজ দমদম থেকে আমাদের পৌঁছে দিয়ে গেছে। খান সাহেবের সঙ্গে দেখা হয়নি, তাই আগামিকাল সন্ধ্যায় আসবে।

     আজ নার্সিংহোমে আসার সময় মহাত্মাগান্ধী রোডে নেমে কলেজ স্ট্রিট গেছলাম ‘সাহিত্যের ইয়ারবুক’ কেনার জন্য। দেজ পাবলিশিং এ ঢুকে ছিলাম। আমার  ‘বাঙালি মুসলিম সমাজ ও নারী’ বইটির খোঁজ নিয়ে জানলাম ভাল বিক্রি হচ্ছে। অন্য এক প্রকাশক ওটি আমার বই জেনে, প্রস্তাব দিলেন, তালাক নিয়ে লেখা দিলে উনি বিনা পয়সায় ছাপবেন।

    কথা হয়েছিল, ডাক্তার যদি আগামীকাল ওনাকে রিলিজ করতে রাজি হন, তাহলে মিলন আজ থেকে যাবে। কিন্তু সেদিকে নাকি মিলন না থাকায় মেজদার খুব কাজের ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। তাই আমি ওকে চলে যেতে বললাম। আমার অবস্থাটা একবারও ভাবল না। অথচ ওরা অসুস্থ হলে আমার বাড়িতে রেখে আমাকেই সব ব্যবস্থা করতে হয়েছে। অথচ এক সময় ওরা যতবার অসুস্থ হয়েছে,  আমার বাড়িতে রেখে আমি সমস্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি। মিলন বলেছিল,মাসি তোমাকে ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিয়ে আমি রাতের ট্রেনে ফিরব। আমি রাজি হইনি।আমি জানি, আমার লড়াই আমাকেই লড়তে হবে। টেস্টের সমস্ত রিপোর্ট দেখে ডাক্তার আগামীকাল রিলিজ করতে রাজি হয়েছেন, সেটা আমার পিড়াপিড়িতে। না হলে আরও দুদিন রাখার কথা বলছিলেন। ফোন করে পরদিন পাপুকে গাড়ি নিয়ে আসতে বললাম। এখানে ডাক্তারের ফিজ ও শেষদিনের সমস্ত খরচের টাকা ক্যাশে পেমেন্ট করতে হবে। আমার কাছে বেশি টাকা ছিল না। ওসমানকে বলাতে ও আজ ১৫০০০ টাকা দিয়ে গেছে। আমার এত টাকার দরকার ছিল না, একরকম জোর করেই দিয়ে গেল। গাড়ি নিয়ে এসেছে পাপু। এদিকে বিল নিয়ে বেশ ঝামেলা হল। গতকাল ওনার ড্রয়ার খুলে দেখেছিলাম তিনখানা ইনজেকশন আছে, যার মুল্য ৬০০০ টাকার মত। আজ দেখি ওরা তিনটে ইনজেকশনের দাম মাইনাস করে  আবার একটার দাম অ্যাড করেছে।খান সাহেব বললেন, গতকাল থেকে কোনও ইঞ্জেক্সন ওরা দেয়নি। ওরা নানারকম কথা বলছে, নার্স বলছে কাল ইঞ্জেক্সন দিয়েছি। একজন পেসেন্ট অযাচিত হয়ে বললান, উনি হয়ত বুঝতে পারেননি। তাঁকেও ধমক দিয়ে বললাম,আপনি চুপ করুন। আপনার বোধ না থাকতে পারে, ওনার আছে। নার্স তখন স্বীকার করল, সে গতরাতে ইঞ্জেক্সন দেয়নি। মেডিক্যাল স্টোর থেকে লোক এসে বোঝানোর চেষ্টা করে বললেন। মেসিন খারাপ হয়ে যাওয়াতে একটা ইঞ্জেক্সনের দাম ধরা হয়েছিল না, সেই দামটাই পরে অ্যাড করা হয়েছে। সব দুর্বল যুক্তি, ওরা মিথ্যে বলছে বুঝেও আমাকে থামতে হল। উনি অস্থির হয়ে উঠেছেন বাড়ি যাওয়ার জন্য। নার্সিংহোম থেকে ফ্ল্যাটে গেলাম। যে  সমস্ত জিনিস গুছিয়ে রেখেছিলাম, সেগুলি নেওয়ার জন্য। বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেছল।
     পৃথিবীর রঙ রূপ কখন যে বদলে যাচ্ছে টেরই পাচ্ছি না। অতিরিক্ত গরম আর ঠাণ্ডা হলে বুঝতে পারি। সব সময় মনে হয় জীবন যেন  থমকে  গেছে, কী যেন নেই, হারিয়ে ফেলেছি। অর্ধেকটা মন ও জীবন মরে গেছে। শুধু আবহাওয়া নয়, শহর ও গ্রামে বহুদিন ধরেই পরিবর্তন ঘটে চলেছে। এখন গ্রামে গেলে খড়ের (বিচালি)ছাওনি দেওয়া মাটির বাড়ি চোখেই পড়ে না। একসময়  দেখেছি খড়ের চাল পচে গিয়ে জল পড়ছে। ঘর ছাওয়ার জন্য লম্বা আঁটির খড় প্রয়োজন হত, সেই খড়ের অনেক দাম। এখন উচ্চ ফলনশীল ধানগাছ ছোট ছোট হয় তাতে ঘরের চাল ছাওয়া যায় না। তাই মানুষ খড়ের পরিবর্তে টালি দিয়ে ঘর ছাওয়া শুরু করে। বিদ্যুৎও এসে গেছে অনেকদিন। অনেকে হুক করে বাড়িতে বিদ্যুৎ নিয়েছে। হিটার জ্বেলে রান্না করছে। এই কাজ করতে গিয়ে মারাও যাচ্ছে কেউ কেউ। গ্রাম এখন আধা শহর হয়ে গেছে। এই পরিবর্তন আমার ভাল লাগে  না। তাতে অবশ্য কারো কিছু এসে  যায় না।

                               ক্রমশ

Post a Comment

0 Comments