জ্বলদর্চি

জবাবদিহি /মলয় রায়চৌধুরী


আমার জীবনের ঘটনা -১২

জবাবদিহি

মলয় রায়চৌধুরী

স্কুলের পর্ব শেষ হইবার পর আমি স্বগৃহ হইতে কয়েকবার পলায়ন করিয়াছিলাম। কলেজে প্রবেশ করিয়াও পলাইয়াছি বারকয়েক। একা নয়, আমার পলায়নের সঙ্গী হইত সহপাঠী তরুণ শূর। তরুণ আমার নিকটতম বন্ধু ছিল। তাহার প্রধান কারণ আমরা দুইজনই একাকীত্ব ভালোবাসিতাম এবং একত্র হইলেও পরস্পরের সহিত কথাবার্তা বিশেষ বলিতাম না। পাশাপাশি হাঁটিতাম, ট্রাকে অথবা ট্রেনে চাপিয়া দূরদেশে যাইতাম, ধাবায় বসিয়া দ্বিপ্রহরের তড়কারুটি বা ভাত-মাংস খাইতাম। একান্ত প্রয়োজনীয় কথাবার্তা ছাড়া বিশেষ বাক্যালাপ হইত না।

গৃহ হইতে পলায়ন করিতে হইলে বাবা-মাকে অগ্রিম সংবাদটি জানাইয়া তো আর যাওয়া যায় না। হঠাৎই একদিন একবস্ত্রে দুইজনে পলাইতাম। তরুণ ছিল সচ্ছল পরিবারের। টাকাকড়ি সে-ই খরচ করিত। 

গৃহে প্রত্যাবর্তনের পর বাবা বা মা কেহই কোনো প্রশ্ন তুলিতেন না। কখনও তোলেন নাই। এমন ব্যবহার করিতেন যেন ব্যাপারটি স্বাভাবিক।

একবার পরপর বেশ কয়েকদিন তরুণ আমাদের গৃহে আসিল না। উহার পিতার সহিত যোগাযোগ করিতে উনি জানাইলেন যে, তরুণের লিউকেমিয়া হইয়াছে, চিকিৎসার জন্য পাটনা হইতে কলিকাতা লইয়া যাইতেছেন। 

তরুণ শূরের সহিত  গৃহ হইতে পলায়ন করার ব্যাপারটি সুখস্মৃতি হিসাবে মস্তিষ্কে পালন করিতাম ।  প্রথমবার তরুণের মামার ট্রাকে করিয়া পাটনা হইতে কলিকাতা গিয়াছিলাম।  ড্রাইভারটি  ঠররা নামক দিশি মদ পান করিতে বলিলেও, করি নাই , প্রেস্টিজের ব্যাপার । সন্ধেবেলা ধানক্ষেতে ট্রাকের তেরপল পাতিয়া বেশ্যাকে সঙ্গম করিতে বলিলেও করি নাই। তরুণ বলিয়াছিল উহাদের মুখে নর্দমার গন্ধ ; জড়াইয়া ধরিলে বমন অবধারিত । প্রকৃতপ্রস্তাবে আমার সাহসে কুলায়নি। তরুণ উপদেশ দিয়াছিল, “অণ্ডকোষের ব্যাঙাচিদের গিটার যতোদিন পারিস নিজেই বাজাতে থাক, অর্থাৎ স্বমেহন । সিগারেটের আগুনকে শ্বাস ধার দিতে থাক—-  পানামা সিজার্স বার্কলে ক্যাপ্সট্যান ।”

তাহার পরেও আটবার পলাইয়াছি । একবার নৌকোয় এলাহাবাদ, এক্ষণে যাহার প্রয়াগরাজ নামকরণ করা হইয়াছে। 

গৃহ হইতে পলায়নের পর্বে ছেদ পড়িল। স্নাতকোত্তরের পর আমি চাকুরিতে প্রবেশ করিলাম। চাকুরিতে প্রবেশের কয়েক বৎসর পর বিবাহ করিলাম। আমার একটি কন্যা সন্তান হইল। অফিস হইতে ফিরিয়া কন্যার সহিত খেলিতাম।

একদিন অফিসেই এক সহকর্মীর মুখে শুনিলাম যে তরুণের মৃত্যু হইয়াছে। স্কুল এবং কলেজের সহপাঠী, শৈশবের বন্ধু তরুণ শূর বত্রিশ বছর বয়সে বিদায় লইল, ব্লাড ক্যানসারে ।  আমার মনে পড়িল, কলেজে সেকেণ্ড ইয়ারে  তরুণ বলিয়াছিল, “জানিস, আমি জেমস জয়েসের ‘ফিনেগ্যানস ওয়েক’ দুবার পড়েছি, আর গল্পটা বুঝে গেছি ।” তরুণ এবং  আমার জন্মের বৎসরে, ১৯৩৯ সালে, বইটি প্রকাশিত হইয়াছিল । বইটি পড়ার কোনো প্রয়োজন  ছিল না তরুণের, তবুও জেদ করিয়া পড়িয়াছিল । উহার তুলনায় বাঁচিবার  আরও বেশি আনন্দ উপভোগ করা উচিত ছিল । যাহারা লালু যাদব এবং তাহার অগুন্তি সন্তানের ন্যায় হাফ লিটারেট, কোনো বইপত্র পড়ার প্রয়োজন মনে করে না, নিজদিগের তত্ব নিজেরাই বানায়, তাহারাই বেশি আনন্দে থাকে। চারু মজুমদার, চে গ্বেভারা হইয়া কী লাভ হইল! 

 মৃত্যুসংবাদটি শুনিয়া, গৃহে প্রত্যাবর্তন করিয়া সোফায় হেলান দিয়া চুপচাপ বসিয়াছিলাম।

সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছিল।

আমার চার বৎসরের কন্যা ঘরে ঢুকিয়া আমার সন্মুখে দাঁড়াইল, তাহার ছোটো-ছোটো দুটি হাত পিছনে। তিরস্কারের সুরে কহিল, “তুমি দাদু-ঠাকুমাকে না জানিয়ে বাড়ি থেকে পালাতে?”

জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇

Post a Comment

0 Comments