জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে -২ /বিজন সাহা


ভোলগা নদীর খোঁজে -২  

বিজন সাহা

পরিচয় পর্ব 

আগস্ট ২০২১। ইতিমধ্যে দিলীপ এসে পৌঁছেছে মস্কোয়। যোগাযোগ করেছে মস্কোয় ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের সাথে। সমর্থন পেয়েছে সেখান থেকে। যেটা ছিল একান্তই ব্যক্তিগত উদ্যোগ সেটা কিছুটা হলেও সরকারি রূপ পেয়েছে। ঠিক হয়েছে আমরা ২৩ আগস্ট দিলীপের সাথে দেখা করব মস্কোয়। পরের দিন সকালে তিনজনে মিলে পথে নামব। প্রস্তুতি চলছে সেভাবেই। এরমধ্যে আমার অন্য বেশ কিছু কাজ হাতে চলে এসেছে। ছোট মেয়ে ক্রিস্টিনা ভোকাল শিখতে সেন্ট পিটার্সবার্গে মিউজিক ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়েছে। ও এর আগে একা বাইরে থাকেনি। হোস্টেলে সীট পায়নি তাই বাসা ভাড়া করতে হবে। এদিকে আমি যাচ্ছি দিলীপের সাথে। আমার স্ত্রী গুলিয়া যাচ্ছে ক্রিমিয়ায় দিন সাতেকের জন্য বেড়াতে। তবে আন্তন, মনিকা, সেভা – সবাই এগিয়ে এসেছে ক্রিস্টিনার সাহায্যে। যেকোনো মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির যেটা হয় - ইচ্ছে অনেক কিন্তু সামর্থ্য সীমিত। তাই বাসা ভাড়া করতে চাইলেই হয়না, দেখতে হয় গ্রহণযোগ্য মূল্য। সব মিলিয়ে দিলীপের সাথে গেলেও পেছনে অনেক কাজ পরে রইল। তবে বর্তমান যুগে শারীরিক ভাবে উপস্থিত না থেকেও কাজকর্ম করা যায় তাই রক্ষা। 

জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
২৩ তারিখ সকালে দেমিদ গেল গাড়ি ভাড়া করতে। প্রথমে গেল মস্কো। এখন ঘুরে বেড়ানোর সিজন তাই গাড়ির ভাড়া অন্য সময়ের তুলনার বেশি। কিন্তু আমাদের বাজেট সীমিত। তাই অনেক খুঁজে গাড়ি পাওয়া গেল ক্লিন নামক এক শহরে। এটা চাইকোভস্কির জন্মভূমি, দুবনার দিকে। ক্রিস্টিনা এসেছে দুবনা। ওকে মস্কো যেতে হবে। গুলিয়াও মস্কো হয়ে ক্রিমিয়ায় যাবে। আসলে ওর প্ল্যান ছিল আমাদের সাথে যাবে। ভোলগার উৎস দেখে তভের থেকে ক্রিমিয়ার ট্রেন নেবে। ভাগ্যিস সেটা করেনি, কারণ আমরা যেভাবে প্ল্যান করেছিলাম – সেটা বদলে গেছিল। যাহোক দেমিদকে বললাম দুবনা থেকে আমাদের নিয়ে যেতে। দুপুরের পরে সবাই পথে নামলাম। দেমিদ ওদের বাসায় পৌঁছে দিল। আমিও লাগেজ বাসায় রেখে গেলাম দিলীপের সাথে দেখা করতে। যখন ওখানে পৌঁছলাম রাত প্রায় দশটা। দিলীপ আর অরূপ অপেক্ষা করছিল আমাদের। পাশেই একটা রেস্টুরেন্টে বসলাম। আলাপ হল। আবার নতুন করে প্ল্যান মিলিয়ে নিলাম। অরূপ আমাকে ফাইনান্সিয়াল দিকটা দেখতে বলল। 

ঐ আলাপেই জানলাম দিলীপ ব্যানার্জি খুব নামকরা চিত্র সাংবাদিক। অরূপ নিজেও কিছু বলেনি আর আমার নিজেরও গুগল করে ওর সম্পর্কে আগে থেকে কিছু জানা হয়নি। এটা অবশ্য আমার সমস্যা। সেই বসা ছিল আসলে যাকে বলে শুধুই পরিচয় – এতদিন কথা হয়েছে হোয়াটসাপে, এবার চাক্ষুস দেখা। নিজেদের আগামী তিন সপ্তাহ কেমন যাবে মনে মনে তার এক খসড়া ছবি এঁকে নেওয়া। কেননা এই তিন সপ্তাহ দিনরাত চব্বিশ ঘন্টা আমাদের একসাথে থাকতে হবে, যত সমস্যাই হোক না কেন মিটিয়ে নিতে হবে। আসলে এ কারণেই আমি  প্রথম দিকে যেতে চাইছিলাম না। ছোটবেলা থেকেই আমি একা একা সময় কাটাতে পছন্দ করি। এমনকি ছেলেমেয়েরা যখন ছোট ছিল, ওদের যখন অনেক সময় দিতে হত তখনও আমি দিনের একটা বড় অংশ একা কাটাতাম। যখন কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করে কার সাথে আমি সময় কাটাতে পছন্দ করি, আমার উত্তর “আমার নিজের সাথে।” কেননা আমি প্রায় সব সময় মনে মনে নিজের সাথে কথা বলি, তা সে ফিজিক্স নিয়েই হোক, রাজনীতি বা অন্য কোন বিষয় নিয়েই হোক। সেটা ঠিক কথা বলা যায় না, বরং বলা চলে তর্ক করি। যে লোক নিজের সাথেই সব সময় একমত হতে পারে না সে কীভাবে অন্যদের সাথে একমত হবে, কীভাবে তিন সপ্তাহ দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা একসাথে কাটাবে? অন্য দিকে এটা একটা চ্যালেঞ্জও ছিল। নিজের প্রতি নিজের। আমাকে অনেক সময়ই বন্ধুরা সামারে বিভিন্ন ধরণের হাইকিং–এ ডাকে। ওরা নৌকা করে বুনো বা পাহাড়ি এলাকায় চলে যায়, ছবি তুলে। আমারও ইচ্ছে করে সেসব জায়গায় ছবি তুলতে যেতে। কিন্তু একাকীত্বের জন্য আমার যে ভালবাসা সেটাকে কিছুতেই জয় করতে পারি না। কে জানে আমার নাম বিজন বলেই এমন কিনা? যাই হোক শেষ পর্যন্ত যখন রাজী হলাম যেতে তখন এসব মানিয়ে নিতেই হবে। যদিও আমি যখন দিলীপের সাথে দেখা করতে মস্কো যাই তখনও নিশ্চিত ছিলাম না যে আমি ঠিকই যাব ওদের সাথে। 

কথায় কথায় জানলাম যে দিলীপ বেশ কিছুদিন ঢাকায় ছিল, বাংলাদেশের একটা পত্রিকায় কাজ করেছে। সেই পত্রিকায় আমার দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু কাজ করত – জাহীদ রেজা নূর ও মশিউল আলম ববি। দু’ জনেই দেশের প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক। তাছাড়া মশিউল আলম সাহিত্যিক হিসেবেও ইতিমধ্যে বেশ নাম করেছে। মানুষে মানুষে আলাপের অন্যতম প্রধান বিষয় কমন স্মৃতি, আর সেটা না থাকলে কমন পরিচিত মানুষ যাদের সম্পর্কে গল্প করে সময় কাটানো যায়। বাঙালি যদিও প্রায়ই কমন পরিচিতদের হাড্ডি কচলিয়ে মানে পরনিন্দা পরচর্চা করে সময় কাটায় হয়তো দীর্ঘদিন বাইরে থাকার ফলে, বিশেষ করে পাণ্ডব বর্জিত মানে বাঙালি বর্জিত শহরে থাকার ফলে সেই অভ্যেস থেকে প্রায় মুক্ত হতে পেরেছি। আরও যে কমন পয়েন্ট আমি পেলাম দিলীপের সাথে সেটা তার রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড বা পশ্চাৎপট। হ্যাঁ, সত্তরের দশকে পশ্চিম বঙ্গ যখন উত্তাল ও নিজে তখন নক্সাল আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিল। আমার দাদা নক্সাল করত। সেই দাদা দেশ ছাড়ে আমার ছয় মাস বয়সে। এতদিন জানতাম আমার যখন ছয় মাস বয়স তখন আমাদের বাড়িতে ডাকাত পড়ে। ডাকাতের প্রহারে বাবা মা অজ্ঞান হয়ে গেলে ওরা আমাকে ন্যাকড়ায় পেচিয়ে পুড়িয়ে মারতে চায়। তখন আমার স্বপন দা ওদের কাছ থেকে  প্রাণ ভিক্ষা করে আমাকে বাঁচায়। তবে মাত্র কিছুদিন আগে স্বপন দা আমাকে জানাল ঘটনা ঠিক তেমন নয়। ওরা যখন সিন্দুকের চাবি খুঁজছিল আমি প্রায় তোষকের নীচে চাপা পড়ে যাচ্ছিলাম। তাই ও ডাকাতদের বলে তোষক সরাতে। ঐ বয়সে আগুনে বা শ্বাসরোধ হয়ে মরার পার্থক্য বোঝার বুদ্ধি আমার ছিল না। তবে আমি যে মরিনি, প্রায় ষাট বছর পরে বসে গল্প লিখছি সেজন্যে স্বপনদার কাছে কৃতজ্ঞ। যাহোক, এরপর স্বপন দার সাথে আমার দেখা হয়েছে মাত্র কয়েকবার, তাও স্বল্প সময়ের জন্য। মহাশ্বেতা দেবীর “হাজার চুরাশির মা”, সুনীল গাঙ্গুলির “পূর্ব পশ্চিম” পড়ে কিছুটা জানলেও নক্সাল আন্দোলন সম্পর্কে জানার আগ্রহ আমার বরাবরই ছিল। তাছাড়া কিছুদিন আগে এই লেখালেখির কল্যাণে স্বপন দার এক বন্ধু কৃষ্ণলাল সরকার দার সাথে ফেসবুকে আলাপ। আমার এক লেখায় স্বপন দার কথা পড়ে তিনি আমাকে লেখেন। এরপর তার নক্সাল আন্দোলনের উপর ধারাবাহিক লেখা “দাবানল” পাঠাতে শুরু করেন। দিলীপ তাকেও চেনে। সব মিলিয়ে সেই জার্নি সম্পর্কে আমার আগ্রহ বেড়ে যায়।
যে কথাটা না বললেই নয়, দিলীপের মুখে প্ল্যান শুনে আমি তখনই বুঝতে পারি এই মিশন সার্থক হবার নয়। কারণ দিলীপ যে কারণে এই জার্নিতে বেরিয়েছে বা যেসব মানুষের সাথে দেখা করার পরিকল্পনা করছে সেটা ম্যানেজ করা প্রায় অসম্ভব। কারণ একটাই। বিপ্লবের পরে রুশ সমাজ আর আগের মত নেই। সেই অর্থে পুরোপুরি শ্রেণিহীন না হলেও শ্রেণির বন্ধন ছিল খুবই আলগা। তাই বিভিন্ন পেশার লোকজন আর বংশানুক্রমে একই কাজ করে না আর বিভিন্ন পেশার লোকজন মিলেমিশে বাস করে। তাই একবিংশ শতাব্দীতে উনবিংশ শতাব্দীর শ্রেণী বিন্যাস খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর এর উপর ভিত্তি করেই দিলীপ ওর জার্নি কাম গবেষণা করতে চেয়েছিল। যাহোক, ঠিক হল পরের দিন বারোটায় আমরা পথে নামব। ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি আর দেমিদ চলে গেলাম নিজ নিজ ডেরায়।                                   
 

Post a Comment

0 Comments