জ্বলদর্চি

বাগদি চরিত ( একাদশ পর্ব) /শ্রীজিৎ জানা

বাগদি চরিত (একাদশ পর্ব)

শ্রীজিৎ জানা

একসময় বর্ধমান রাজার অধীন ছিল ঘাটাল জনপদ। জনশ্রুতি বলে মা বাটুলবুড়ি দেবী  ছিলেন বর্ধমান রাজ্যের কুলদেবী। রানীর অবহেলায় দেবী রাজান্তঃপুর ত্যাগ করেন। দেবীকে কৃষিক্ষেত্রে স্বর্ণাবয়বে পান প্রেমচাঁদ পন্ডিতের পূর্বপুরুষ। স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে তিনি মন্দির প্রতিষ্ঠা করলেন দেবী- নির্দিষ্ট স্থানে। মন্দিরের সামনে দিয়ে বয়ে গেছে প্রশস্ত খাল। ঘাটাল জনপদের বিস্তৃত অংশের নিম্ন ভূমিরূপ প্রমাণ করে এই অঞ্চলের জল যন্ত্র্রণার ইতিবৃত্ত। মরার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো একাধিক  নদনদী,খালবিল,দিঘি পুষ্করিণী, পুকুর ডোবাতে আকীর্ণ এই ভূভাগ। একদিকে বয়ে গেছে কংসাবতী জলধারা। অন্যদিকে ঘাটালের বুক চিরে বয়ে যাওয়া শিলাবতীর বুকে  মিশেছে কেঠিয়া, দনাই, দ্বারকেশ্বর, ঝুমি। বুড়িগাঙে মিশেছে পারাং। ঘাটালের পূর্ব প্রান্তকে লক্ষ্মণগন্ডীর মতো ঘিরে রেখেছে রূপনারায়ণ। ঘাটাল যেন জলকন্যা,জলপরী। বন্যায় ডুবে, জলে তলিয়ে তার সুখদুখ মাখা ঘরকন্না। মন্দিরের সামনের খাল দিয়ে জাহাজ স্টীমার বয়ে যাওয়ার মিথকে তাই নিছক গালগল্প বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না কোনমতেই। মায়ের নামেই স্থানীয়রা এই খালের নাম দিয়েছেন বাটুলবুড়ি খাল।
প্রায় চার পাঁচশ বছরের প্রাচীন বাটুলবুড়ি মন্দির। সেই মন্দিরের পূজকরা হলেন কেঠিয়া নদী তীরের পন্ডিত বংশ। জাতিতে তারা বাগদি। ব্রাহ্মণরা এই মন্দিরে ঢুকতে পায় শুধুমাত্র দুর্গাপূজার সময়। আর্য-অনার্যের দ্বন্দ্বে নিজেদের জাতকৌলিন্যকে রক্ষার লড়াই যেন এখানে প্রকট হয়ে ফুটে ওঠে। ঘাটালের যত্রতত্র এই যুদ্ধের চিহ্ন চোখে পড়বে। কেঠে নদীর ক্ষীণ স্রোতের মতো সেকালের একটা জাতির গৌরব আজও প্রবহমান। অন্ত্যজ শ্রেণী বলে পরিচিত যারা তাদের লৌকিক দেবদেবীর পূজার অধিকারকে  একপ্রকার কেড়ে নিয়েছে  উচ্চ ব্রাহ্মণ জাতি। তাতে অন্যান্য কুলীন জাতিদের মদত ও পশ্রয় ছিল পূর্ণ মাত্রায়। রাজাদের ভুজুংভাজুং দিয়ে, মগজ ধোলাই করে ব্রাহ্মণরা তাদের এই একচেটিয়া প্রভূত্ব কায়েম করেছে।  সেন রাজবংশের আমল থেকেই তাদের মসীহা রূপ সমাজে চরম আকার নিয়েছিল। রাজা জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় মন্দির নির্মিত হয়েছ যত্রতত্র। সেই মন্দিরে নিজেদের বংশানুক্রমিক যজনযাজন করার স্বত্ত্ব আদায়ের মতো গূঢ় কৌশলে করছে তারা। অন্ত্যজরা এই ফন্দীর  কাছে পরাজিত হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় ঘাটাল জনপদে সেই লড়াইয়ে সামান্য হলেও প্রতিবহত করতে পেরেছে অন্ত্যজরা। আজও বাগদি,ডোম,তাঁতি জাতিরা তাদের পূজার অধিকার ব্রাহ্মনের হাতে তুলে দেয়নি। হয়তো এর পেছনে রয়েছে সেই মহাভারতের যুগ থেকে চলে আসা লড়াইয়ের ইতিহাস। অনেকে মনে করেন আজকের ঘাটালের পার্শ্ববর্তী অঞ্চল একসময় বগডিহি নামে পরিচিত ছিল। পান্ডবদের অজ্ঞাতবাস যাপনের আত্মগোপন কালের একটা সময় কেটেছে এই অঞ্চলে। বগডিহিতে ছিল মহাভারতে বর্ণিত বকরাক্ষসের আধিপত্য ।  অনুমান বকডিহি থেকেই বাগদি শব্দের উদ্ভব। সেক্ষেত্রে বকরাক্ষসকে বাগদিদের রাজা ধরা যায়। আর সেই বকরাক্ষসকে বধ করেন মধ্যমপাণ্ডব ভীম। একটা জাতির শক্তিস্তম্ভকে অত্যাচারী রাক্ষস দেগে তাকে হত্যাকরার চক্রান্ত উচ্চশ্রেণীর চিরকালীন অভ্যাস। পরবর্তীতে প্রচারিত হল যিনি পূজা পান তিনি মহাভারতের ভীম ।  আসলে এখানেও চক্রান্ত কাজ করেছে। শিবায়ন কাব্যে উল্লিখিত  শিব ঠাকুরের অনুচর কৃষক ভীম ঠাকুর পূজিত হন কৃষির দেবতা রূপে। আশ্বর্য গায়েগতরে খাটা দিন মজুর বাগদি নয়,পূজা পান উচ্চবিত্ত কৃষক। কৃষিক্ষেত্রের মালিক মাহিষ্যদের হাত ধরেই ভীম পূজার প্রচলন। আর ঘাটাল অঞ্চলেই এই দেবতার পূজা মূলত অধিক হয়ে থাকে। ধর্মঠাকুরের পূজাও এই অঞ্চলে বেশি হয়ে থাকে।  ধর্মমঙ্গলের ময়নাগড় তো অবিভক্ত মেদিনীপুরেই অবস্থিত।ধর্মপূজা মূলত ডোম সম্প্রদায়ের মানুষরা করে থাকলেও বাগদি এবং তাঁতিরা ধর্মঠাকুরের পূজা করে।ভারতবর্ষের আধ্যাত্ম চর্চায় নিরাকার পূজার ভাবধারাকে আদিমযুগ থেকে বহন করে নিয়ে চলেছে অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষজন। বৃক্ষকে,শিলাপাথরকে দেবতা জ্ঞানে পূজাঅর্চনা করার ধারণা প্রকৃতই তাদের। 
বাটুলবুড়ি দেবী স্বর্ণাবয়বে প্রাপ্ত হলেও পরে তা প্রস্তরখন্ডে পূজিতা হন। বিগ্রহ স্থাপনের কিছুদিন  পরেই জনৈক লোভী সাধু বিশেষ উপায়ে মায়ের স্বর্ণরূপ হরণ করেন। অনেকে বলেন মায়াবলে এই অসাধ্যসাধন নাকি তিনি করেছিলেন। দেবী ভীষণ জাগ্রতা। দূরদূরান্তের ভক্তপ্রাণ মানুষজন দেবীর থানে  মানত করেন। তাদের সবার  মনোবাঞ্ছা পূরণ করেন দেবী। নানা উপাচারে তারা পূজা নিয়ে আসেন নিত্যদিন। ছাগ বলি হয় দেবী মন্দিরে। পূজক পন্ডিতরাই স্বহস্তে ছাগ বলি করে। সেকালে জঙ্গলাকীর্ণ মন্দির চত্বরে অনেকেই দেবীর বাহন বাঘের দর্শন করেছেন। মন্দির চত্বরে বিষধর সাপ ঘুরে বেড়ায় আজও। আরো এক আশ্চর্যের কাহিনী প্রচারিত মন্দিরকে নিয়ে। প্রেমচাঁদ পন্ডিতদের পূর্বপুরুষ নিত্যপূজার বেলপাতা  তুলতে গেলে প্রায় দিনই হাতে কাঁটা ফুটে যেত। রক্তপাত ঘটত। মায়ের কাছে এই কষ্টের কথা জানায় । অলৌকিক ভাবে পরের দিন দেখা যায় সেই বেলগাছ থেকে বেলকাঁটা উধাও হয়ে গ্যাছে। এখনো মন্দিরের পেছনে কাঁটাবিহীন বেলগাছ বর্তমান।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
ঘাটালের বুকে কতবার ভয়ঙ্কর বন্যা তার ধ্বংসলীলা চালিয়েছে। উঁচু উঁচু ভিটেবাস্তু ডুবিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে বিধ্বংসী শিলাই। কিন্তু মাঠের মধ্যবর্তী মাতৃমন্দিরকে আজ অব্দি একবিন্দু বন্যার জল স্পর্শ করতে পারেনি। লোকে বলে মন্দিরটির নাকি একটি জাহাজের উপর অবস্থান। জলস্তর বাড়ার সাথে সাথে মন্দির উপরে উঠে যায়। কত না অলৌকিকত্ব ছড়িয়ে রয়েছে বাটুলবুড়ি দেবীকে নিয়ে। শুধু  মশরপুরের বাগদি জাতির পন্ডিতরা পূজা করে না,ঘাটাল জনপদ ও তার পার্শ্ববর্তী অনেক গ্রামের পন্ডিত পদবীধারী বাগদিরা পূজা করে। সোনাখালির পন্ডিতরা পূজা করে ধর্ম ঠাকুরের, সুপার পন্ডিতরা পূজা করে শীতলার,মনসুকার পন্ডিতরা পূজা করে ধর্ম ঠাকুরের। একইভাবে ঝলকার ও নাড়াজোলের পন্ডিতরা ধর্মঠাকুরের পূজা করে।
আরতির ছোটবেলা কেটেছে বাটুলবুড়ি মন্দিরের থানে। ঘর থেকে কয়েক পা গেলেই মন্দির। এক ছুটে চলে যেত তারা সব ভাইবোন মিলে। পুজো দিতে আসা,বরকনে প্রণাম করতে আসা, মানত শোধ করতে আসা পাঁঠাবলি দিতে আসা কত কি জাঁকজমক লেগে থাকত প্রতিদিন। সবচেয়ে আরতির ভয় লাগত পাঁঠা বলির সময়। কোনদিন তার বাবা জেঠু কিংবা তার কাকা পুজোর মাঝেই রক্ততিলক কেটে নিত কপালে। চিৎকার করে হাঁক দিত– জয় মা, মাগো ও ও ও। সজোরে ঢাক বেজে উঠত তখন। মানতকারীদের সবার হাত তখন কপালে।তার পর কাতান হাতে এক কোপে পাঁঠাটার গলা ধড় থেকে নামিয়ে দিত। সাথে সাথেই মাটির সরায় রক্ত ধরে মায়ের প্রতিমার সামনে রাখা হত। কাটা মন্ডুটাও কলাপাতার উপরে মায়ের মূর্তির দিকে রাখা থাকত। বড় হয়ে গেলে আরতির আর ভয় পায়নি। তবে সামনে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য সে দেখতে পারত না। কিন্তু অনুভব করত সেই মুহূর্তে মন্দিরের ভিতর-বাহিরে ক্যামন যেন অলৌকিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। গায়ে কাঁটা দিত তার। আজও দ্যায়। কথায় কথায় অজান্তেই মায়ের নামে প্রণামের ভঙ্গিতে হাত কপাল ছোঁয় বারবার। এরকম নিজস্ব অনুভূতির গল্প আপনা থেকেই সে বলে।  জয়রামের নিরুদ্দেশ হওয়ার পর থেকে গল্প বলার ঝোঁকটা তার বেড়ে যায়। একাকীত্বের যন্ত্রণা ভুলে আরতি তার বাপের বাড়ির গৌরবকে তুলে ধরতে চায়। কথায় কথায় বলে,
—--আমি যে সে ঘরের ঝিউড়ি নয় জান ত! পন্ডিত বংশের ঝিউড়ি। মোর বাপঠাকুরদারা মা বাটুলবুড়ির পুজা করে। ওষুদ দ্যায়।
জয়রাম বিয়ের প্রথম প্রথম আরতির সঙ্গে এই নিয়ে ইয়ার্কি মেরে বলত,
—-পন্ডিত বংশ নাকি হঁপা। আরে অরা হল মুখ্যু পন্ডিত। পাঁঠা খাওয়া বেগদা-বামুন।
নতুন বউ বলে আরতি চুপ থাকবে কেন! কোন মেয়েই থাকে না,যদি কথা উঠে তার বাপের বাড়ি নিয়ে। তবে নতুন বউ বলে তখন আরতির  গলার স্বর অনেকটাই নীচু থাকত।
—বেগদা-বামুন হলেও তারা বামুন। আসলি বামুনরা ত পাঁঠা মুরুগ পাতে পড়তে দেয়নি। আর তমরা ত মেছা বাগদি। ঠাগমা শোলক কেটে বোলতো- বাগদি দাদা / মাছ দেখলেই চোখে কাদা। ঘরের এঁদালে ক্যাঁদালে আঁশজাল,ঝেপা মুগরি ঘুনি ঝুলে থাকবেই। আর গায়ে পাঁক আর এঁশা গন্ধ ছাড়বে। কুনু বাচবিচার নাই। কুনু সব্যসাব্য নাই।  মোর বাপের ঘরকে কি তেমন পেইচ!
জয়রাম হয়তো রাগানোর খেলাটাকে আরো জমাটি করতে পারত। কিন্তু সেখানেই ইতি টেনে দ্যায়। নতুন বউকে বেশি খ্যাপানো বোকার কাজ। জয়রাম ততটা বোকাহাঁদা নয়। সংসার থেকে উড়ুউড়ু মনকে তার বাপ বিয়ের দড়িতে আরতির খুঁটে বেঁধে দিয়েছে। মন তখনো তার বৈরাগ্যের অতলে ডুব দ্যায় নি। শরীরের অন্দরে মনের বাস। শরীরেরও নিজস্ব সাড়া আছে। তাপ উত্তাপ আছে। পুরুষের সেই আদিম তপ্ত দাবানলের সামনে ভিন্ন এক অবয়বের আকর্ষণ চিরকালীন। দুজনে পুড়ে ছাই না হওয়া পর্যন্ত আগুন তার তান্ডব অব্যাহত রাখে। সেই সহনীয় আগুনের অনির্বচনীয় আঁচে পুড়ে চলেছে নারী*পুরুষ। জয়রাম সেই অগ্নিকুন্ডের সাক্ষাৎ পেয়েছে সেই প্রথম। এখন তার পুড়তেই বেশি আনন্দ। তারপর যখন আর পোড়াবার কিছু থাকে না তখন আগুন স্তিমিত হয়ে যায়। জয়রামের ভিতরের আগুনটাও তেমন।ছেলে হওয়ার পর থেকেই তার সংসারের প্রতি টান কমতে  থাকে। অবশেষে সে গৃহত্যাগী হয়। 
আরতি  বাপের বাড়িতে থাকে। জয়রামের নিরুদ্দেশ হওয়ার বছর দুয়েকের মাথায় বলা-কওয়া করেই আরতিকে তার বাপ সঙ্গে নিয়ে যায়। সিঁথির সিঁদুর সে মোছেনি। হাতের শাঁখাপলা আজও তার এয়ো চিহ্ন হয়ে শোভা পায়। স্বামী ফিরে আসার অপেক্ষা হয়তো সে করে। নারী জীবনের এই চাওয়া টুকুর ভিতর কোনভাবেই কোন সংশয় থাকতে পারে না। কিন্তু আরতি সেকথা কক্ষনো প্রকাশ করে না। উল্টে জয়রামের গৃহত্যাগকে সে সমর্থন করে। বলে,
—-মানুষটা কি কম পুন্যমান বল দিখি। ছ্যানাবউ ফেলি রেখে নিমাই পন্ডিতের মত ঠাকুরের নাম লিয়ে সে চলে গেছে। যাউ। ভাল থাউ। ভালো রাখু ভগমান তাখে। তাখে ত বলতে হবে এগদিন যে আমি তাখে কুনু সময় বাধা দিইনি। বাপ বলে, ভগমানের চোক আছে/ যে যার পূণ্য সে তার কাছে।
পাড়ার জা-জাউলিরা আরতিকে উসকে জানতে চায়। এই জানতে চাওয়ার ভিতর কোন সমবেদনার পরশটুকু যে নেই আরতি তা বোঝে। উল্টে তার স্বামীর ঘরছাড়ার পর একটা মেয়ের দিনযাপনের দুঃখকথা শোনার মধ্যে তারা আনন্দ খোঁজে। এরকম ক্ষেত্রে মেয়েদের অনুসন্ধিৎসু চরিত্র চিরকালের।গ্রাম্য মেয়েবউদের আঁচলা ভরা এইটুকু আনন্দেই যেন পরম তৃপ্তি। আরতি সব জেনেও তাই তাদের কৌতুহল মেটাতে পিছুপা হয় না।

Post a Comment

1 Comments

  1. সৃজিৎ বাবু
    দারুন লিখছেন , শুধু একটি তথ্যে আমার একটু ভিন্ন-মত আছে
    ভীমের আরাধনা মনেহয় আমাদের এলাকার জেলে-সম্প্রদায় ই করে আসছেন
    বেশ কিছু প্রজন্ম ধরে 👌

    লেখা ও গল্প বেশ সুন্দর

    Prosad Pathak

    ReplyDelete