জ্বলদর্চি

বাগদি চরিত (সপ্তম পর্ব) /শ্রীজিৎ জানা

বাগদি চরিত ( সপ্তম পর্ব)

শ্রীজিৎ  জানা


লোখা তন্ময় হয়ে শুনতে থাকে আগেকার দিনের কথা। কালসাবার কথা। তার জাতের কথা। কখন তাদের পাশটিতে জগা এসে বসেছে দুজনেই খেয়াল করেনি। পোষ্য গুলোর কথা প্রায় ভুলেই গেছে ভগীরথ। এক পেট করে ঘাস খেয়ে বাবলা তলার দিকে দল বেঁধে হাঁটা দিয়েছে অবলা প্রাণীর দল। সূর্য মাথা ছাড়িয়ে ঈষৎ হেলছে পশ্চিমে। তার তেজের ধার তখনো প্রখর। জগার জিজ্ঞাসায় তাদের সম্বিৎ ফেরে,
—কি গো লোখাদ্দো ঘর যাবে নি? ভগী খুড়া তমার ছাগল গুলানের যে পেট ফেটে যাবে গ! তমরা দেখেঠি গল্পের তোড়ে খিদা তিষ্টাও ভুলে গেছ।
ভগীরথ পিছন ফিরে জগাকে একবার দেখে। সেই মুহুর্তে জগার কথায় কোন উত্তর না দিয়ে লোখার চোখে চোখ রাখে। আর জিজ্ঞেস  করে বসে,
—-তা জগার কথা এখন থাউ। তার আগে  মোকে বল দিখি তুই দাদাকে মন্দির চালা কত্তে কেন বাধা দিয়েচু?
—-অ,থাইলে তমার কানেও কথাটা তুলেচে! 
—- কানে তুলা টুলা নয়।আসলে তোর সঙে মোর একটু মাখামাখি আছে জেনেই হয়তো খুদা কথাটা মোকে শুনিছে, আর কি। তবে আমি কুনু উত্তর করিনি।
—--শুনেইছ যখন, বল দিখি খুড়া  কথাটা কি মোর অনাজ্জ বলা হইচে? ভিটার অংশ ত পাঁচ ভাইয়ের,থাইলে কুনু কিছু কত্তে হলে পাঁচজনকেই ত সমুজতে হবে,না কি?
—-অন্যদের কথা তুই বলবি ক্যানে? তোকে না জানালে তুই বল। তাবাদে মানুষ আর কদ্দিনের বল্ দিখি।ভিটামাটি লিয়ে কে কুথা যাবে? উসব লিয়ে অত মাথা গরম করিসিনি।
—মাথা গরম লয় থুড়া।যাই বল বাগদির মত এত কুঁদুলা জাত আর নাই।
—-সব জাতেই খ্যাকা-কুঁদুল লেগে আছে রে। তবে কিনা ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই। কিন্তু ধম্ম পথে থাক,সব ঠিক হয়ে যাবে, দেখবি!
জগা আর থেমে থাকতে পারে না। এইসব কথার মাঝখানে তারও মুখ যেন নিসপিস করতে থাকে কিছু বলার জন্য। ভাল কথার সংসর্গে আরো দুটো ভালো কথা যেন কোথা থেকে বেরিয়ে আসে। জগা বলে,
—একশ পারসেন সত্তি, ভাইয়ের মতো শত্তুরু কার কেউ হবেনি। আমি মুখ্যুসুখ্যু মানুষ। তবু বোলবো ভগী খুড়ার কথাটা ঠিক, ধম্ম পথে থাকলে ভগমান একদিন বিচার করবেই।
—-তুই থাম। আর তোখে উনানে বাতাস দিতে হবে নি। ইদিকে তুই জীব হত্যা করে যা পাপ করুঠু তার কি হবে বল দিখি।
আচমকা ভগীরথের মুখে এই কথা শুনে জগার মুখখানা মরা লেধুস মাছের মতো হয়ে যায়। হাঁ করে ভগীরথের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আর কোন রা কাড়ে না। ভগীরথকে অন্যদের মতো সেও যথেষ্ট মান্য করে।

জগা দলবেরা। ঢোলের সকলে বলে জগা শিকারী। জগার বাপ শত্রুঘ্ন দলবেরা ছিল এলাকার নামকরা মেছাল। পাড়াগাঁর সবাই তাকে ডাকত শত্রুঘন বলে।গায়ে তার সারাক্ষণ আঁশ গন্ধ লেগেই থাকত।  কোমরে ঝুলত খালুই। ঘাড়ে একটা কোন না কোন মাছ ধরার জাল থাকবেই।জমিজমা কিছু নাই তার। শুধু এক চুকরা ভিটাই সম্বল। আর সম্পত্তি বলতে নানা ধরনের মাছ ধরার সাজসরঞ্জাম। বড় ছোট মাঝারি সাইজের কটা হাঁড়ি পাতিল। শত্রুঘন একরাতে একটা বাচাড়ি জাল বুনে ফেলতে পারত। অনেকে বাচাড়ি জালকে চেনে খেয়া জাল কিম্বা পাশ জাল নামে। শত্রঘনের ঝুপড়ি ঘরের চারদিকে মাছ ধরার জাল ঝোলানো থাকে। ছাঁকনি জাল চারখানা,খেয়া জাল ভারী কাঁঠি, হাল্কা কাঁঠি মিলে তিন খানা,কলি জাল,চাবি জাল,সারেঙ জাল,গাঁতিজাল আরো কতরকম জাল তার ঘরে মজুত। তার উপরে ঘুনি,মুগরি,ঝেপা,পাং,হালুক নামের বাঁশকাঠি দিয়ে তৈরী সব মাছ ধরার যন্ত্র ঝোলানো থাকে শত্রুঘনের ঝিটেবেড়ার দেওয়ালে। এইসব তার সংসারের অতি মূল্যবান সম্পত্তি। কত পরিশ্রম,কত যত্ন লেগে আছে তার এই সব সম্পদে। প্রতিটা মাছধরা যন্ত্রের গায়ে তার মায়া লেগে আছে।লোকে তার জালের,ঘুনি-মুগরির কত প্রশংসা করে। শত্রুঘনের হাতের কাজ যেন দক্ষ শিল্পীর মতো। জলের মীনশস্যেরা ম তার অপূর্ব শিল্প কর্মের মোহটানে ছুটে আসে মনে হয়। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেই তারা নিজের থেকেই থরা দেয় শত্রুঘনের মস্যশিকারের ফাঁদে।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
জগা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে এইসব সামগ্রী। তার বাপ যেমন মাছ শিকারে পটু ছিল,সে তেমনি মাছ আর পাখি দুটোই ধরতে পারে। জাগা তার প্রাপ্ত সম্পত্তির বৃদ্ধি করতে পারেনি। তবে বাপের শৈল্পিক গুণের প্রভাবে শিল্পকে সে বাঁচিয়ে রেখেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার নতুন উদ্ভাবনী কর্মকান্ড আশেপাশের সকলকে বিস্মিত করে। শিলাবতী আর কালসাবার খালবিল সারাবছর তার হাতে অর্থ তুলে দেয়। সামান্য জমিতে ভাগে ধান চাষ করে সে। তাতেই কষ্টেসৃষ্টে তার দিন চলে যায়। কালসাবার খালবিল জগার কাছে পয়মন্ত জলাশয়। শিলাবতী তার সংসারের সুখদাত্রী জননী।  জগার  মনের মধ্যে কোন উচ্চাশা কোন কালেই নেই। তার এই ঝুপড়ি ঘর,ডেবরির আঁশটে শরীরের আদর, রোগা প্যাটকা চেহারার ছেলেপুলে নিয়ে যে হতশ্রী দিন গুজরান তাকেই অদৃষ্ট বলে মেনে নিয়েছে সে। কোন না পাওয়াতে তার হতাশা বোধ নেই। আক্ষেপ নেই। তবে যেদিন সে মাছ ধরতে ব্যর্থ হয়,যে রাত তাকে খালি ফাঁদ হতে ফিরিয়ে দেয়,একমাত্র সেই দিনই জগা নিজের ভাগ্যকে আর উপরওয়ালাকে গুচ্ছের খিস্তিখাস্তা করে।
—-বানচোেত ভগমান আজগে মুখ তুলে তাকালোনি। শালা জগা বাগদির ভাগ্যে কুম্ভরাশ,থাকিস থাকিস যাস যাস।
এই কথাটাও জগার নিজের নয়। ছোট থেকেই বাপের মুখে শুনত বলেই বোধহয় নিজের মুখে আপনা থেকেই যুগিয়ে যায়। সংসার তার ছোট। বউ ডেবরি আর দুই ছেলে তার। যেমন হাঁড়ির তেমন সরা। জগার মতোই ডেবরিও মাছ ধরায় সিদ্ধহস্ত।  দলবেরা পাড়ার মেইয়ারা ডেবরিকে হিংসা করে। পাড়ার পুরুষমানুষরা কথায় কথায় ডেবরির তুলনা দেয় নিজেরদের বউদের,
—--দ্যাখ না জগার বউকে। পাঁকজল ঘেঁটে মাছ ধরে একটা সংসার টানেঠে। আর তরা কি করুঠু? অই তিনবেলা থালা থালা কেড়ে রাজ্জের মেইয়া জুটিয়ে পরচচ্চা করুঠু আর নিখি-উকুন ঠেনে মচ্চু!
ডেবরির নাম করলেই ঝাঁ ঝাঁ করে উঠে সব বউয়ের দল।
—-উ ত এঁশাপেঁতি মেইয়া। বাগদি ঘরের বউড়িঝিউড়ি বলে কি পাছার কাপড় তুলে খালবিলে মাছ ধরে ঘুরব। অর কি লিবে! কথায় বলে নি পুঁঠিমাছের লাফানি,বাগদি মেইয়ার হাঁপানি। অর  যেদি মাছই ধরব তবে তমার ঘরের কাজগুলান কে করবে? তমাদের কাকবল রেঁদে দিবে কে, শুনি?
তবে আর একটা বিষয়ে ডেবরি পড়ার অনেকের কাছেই খাতির পায়। দলবেরা পাড়ার প্রায় ঘরেই হাঁস চাষ আছে। ভিটার ধারের পুকুরে খালে সারাদিন পাল পাল হাঁসে টপাটপ ডুব দেয়। তাদের বিরামহীন ডুব সাঁতারে আর  গেঁড়ি, মাছ ধরার উৎপাত চিৎকারে দলবেরা পাড়া সরগরম থাকে। হাঁসেরা নাগাড়ে ডুবে পাঁক গুলিয়ে জলকে নোংরা একাকার করে দেয়। চারদিকে প্যাচ প্যাচ করে নোংরা পায়খানা ছড়ায়। বর্ষার সময় ঘর দুয়ার জলকাদায় চটকে একসা করে দেয়। এইসব সয়ে গ্যাছে এই পাড়ার সকলের। হাঁসেরা এমনই পোষ মেনেছে যে হাঁসছাড়ের কপাট খোলা মাত্রই পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা। বিকেলে যেই না আয় চই চই চই বলে পুকুর পাড় থেকে বউয়েরা ডাক দেয় অম্নি হাঁসেরদের দল নিজেদের ঘর চিনে ঢুকে পড়ে। আশে পাশের গ্রাম থেকে হাঁস কিনতে আসে লোকজন। ভাগীরথ পুরের ফকির পাড়া থেকে হাঁসডিম কিনতে আসে সালেমা বিবি,। দলবেরা পাড়ার খুব আপনজন হয়ে গেছে সে। তবে ধান চাষের সিজিনে এই হাঁস নিয়ে তুমুল বিবাদ বাঁধে। বীজ তলা হাঁসের পাল লম্বা ঠোঁটে করে ঘেঁটে দেয়। সেই নিয়ে নিজেরা নিজেরা ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়ে। তখন রাগে বীজতলায় ভাতে বিষ মাখিয়ে কলাপাতায় করে দিয়ে রাখে। হাঁসেরা খেয়েই লটকে পড়ে। তবে জান থাকতে থাকতে ডেবরির কাছে আনলে সেই হাঁসের বাঁচা নিশ্চিত। সেই সময় ডেবরির শত্তুরও গলার সুর নরম করে হাঁক পাড়ে,
—অ নাস বউ ঘরে আছ?
কেউ ডাকে,
—অ ডেবরি নাস দি সাড়া দাওনি ক্যানে?
ডেবরিকে দলবেরা পাড়ার বউড়িঝিউড়িরা রসিকতা করে বলে নার্স। যদিও তার ওই বিশেষ দক্ষতা সকলকে তাজ্জব করে দেয়। যেই বিষখেকো হাঁস ডেবরির কাছে আনে,সে অম্নি প্রস্তুত হয়ে পড়ে। নরম ধারালো তলতা বাঁশের চঁচ দিয়ে হাঁসের পাকস্থলী কেটে দ্রুত সব খাদ্য বের করে দেয়। তারপর  সুতো দিয়ে খাদ্যথলি আর উপরের চামড়া সেলাই করে দুর্বা ঘাসের রস ছিঁচে কাটা স্থানে লাগায়। দু'দিন জলে না নামতে দেবার ডাক্তারি পরামর্শ দেয় ডেবরি। তার অব্যর্থ অপারেশনের জাদুতে বিষখেকো মৃতপ্রায় হাঁস বেঁচে যায়। বিনিময়ে নার্সের ফিস বাবদ ডেবরি এক একটা সার্জারি পিছু দুটো হাঁস ডিম পায়। জগা এই কাজের জন্য ডেবরিকে নিয়ে মনে মনে বেশ গর্ব করে।

Post a Comment

1 Comments