জ্বলদর্চি

বাগদি চরিত (অষ্টম পর্ব) /শ্রীজিৎ জানা

বাগদি চরিত ( অষ্টম পর্ব)

শ্রীজিৎ জানা

পাপ পূণ্যের প্রশ্ন জগার কাছে অবান্তর। ভগীরথ খুড়ার কথার খোঁচা তাকে বিচলিত করে না। জগা মনে করে মাছ ধরা তার জাত পেশা। পাখ মারা তার জাতের রক্তে আছে। মাছ ধরে হাটে বেচে দু'পয়সা আয় করে সে। পাখ মেরে ছেলেপুলের পাতে দু'টুকরো মাংসের জোগান দিতে পারে। নইলে বাজার থেকে মাংস কেনার তার মুরোদ কোথায়। বাগদির পাতে মাছ মাংস যদি না থাকে তবে সে বাগদি কিসের। জগা তেমনটাই মনে করে। ভগীরথ হরিভক্ত মানুষ। গলায় তার তুলসীর মালা। হরিনাম করে। নিরামিষ খায়। পাখ মারার কথাটা ভগীরথ তাকে অনেক বারই বলেছে। ভগীরথ খুড়ার মুখে কথাগুলো কখনো মোলায়েম মনে হয়নি। বেশ রুষ্ট ধরণের। খগেন মাস্টারও নিষেধ করে। ভগীরথ খুড়া তাকে বলে পাপের কথা। খগেন মাস্টার বলে অপরাধের কথা। জগা এসব নিয়ে যখনই একটু ভাবতে গ্যাছে, অথৈ জলে সে তলিয়ে গ্যাছে।  বেশি ভাবতে পারে না সে। ভাবতে চায় না। যত ভাবনা তার পাখ মারার নিত্য নতুন ফাঁদ তৈরি নিয়ে। শিলাবতীর ঘোলাটে জলের গর্ভ থেকে মীনশস্য ধরা নিয়ে। তবে সেদিন চ্যাতলা বাজারের ঘটনাটা চেপে রাখতে পারেনি। ডেবরিকে এসে শোনায়। ডেবরি বাজারে মাছ বেচে। জগা মাছের হাঁড়ি পৌঁছে দিয়ে আসে। সেদিনও বাজারে হাঁড়ি পৌঁছে ফিরছিল। মাঝে ঝাঁপু মন্ডলের চা দোকানে চা খেতে ঢোকে। জগাকে দেখেই বীরেন পাত্র চোখ নাচিয়ে জিগ্যেস করে,
— কি রে জগা আজ কটা ডাঁক মারলু? আজগে তোর বউ কি মাছ নিয়ে বসছে বাজারে?
জগা তার সরল মনে উত্তর দেয়। সে শিলাবতীর জলের ঘূর্ণি  বোঝে। মাছেদের ঘাই মারার ধরণধারণ বোঝে। কিন্তু মানুষের কথার মারপ্যাঁচ বোঝে না।
—-আজ মাচ লিয়ে বসে নি।  বিলের গেঁড়ি আর প্যাটারি লিয়ে বসচে।
—-প্যাটারি কিরে?
—--অ তমরা ত প্যাটারি কি জান নি। আ গো ঝিনুককে মোদের জাতে বলে প্যাটারি। চিছুনও বলে।
—-বোলু কি রে। থাইলে কালসাবার ত আর  কিছুই বাদ রাখলি নি!
 কথার পিঠে  কথা চাপিয়ে চা দোকানি ঝাঁপু হেসে হেসে বলে,
—তা ঠিক বলেচ পাতরদা। অকে ভয় পায় কালসাবার পাখরা। অর বউকে মাছ রা।
বীরেন পাত্র আবার মুখ খোলে,
—--জগার ঘরে ত মাচ মাংসের কুনুিদিনও ছাড়ান নাই। রাজাদেরও ত এমন ভাগ্য হয় নি রে জগা।
পাশেই চা খাচ্ছিল ভগীরথখুড়া। এতক্ষণ চুপ করে সবার কথা শুনছিল সে।  খানিকটা বিরক্তির স্বরে এবার সেও কথা জুড়ে দেয়,
—--অর কি লিবে বল দিখি। অর কাছে পেট সাতকুল আর মাগ মধুসূদন। কুনু পাখিকে উ বাদ দিল নি। রাক্কস কুথাকার।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
কথাটা শেষ হওয়া মাত্রই চা দোকানের সবাই হেসে উঠে। প্রথমটা না বুঝেই জগাও দেখাদেখি দাঁত বের করে। তবে এবার ভগী খুড়ার কথাটা তার ভাল লাগেনি। বাকিদের কথাকে সে গায়ে মাখে না। তারা জাতে মাহিষ্য। দুলে- বাগদিকে কথায় কথায় তুচ্ছতাচ্ছিল্য তো করেই। কিন্তু ভগী খুড়া তো তার নিজের জাতের লোক। অন্য জাতের লোকের কাছে ভগী খুড়া তাকে অসম্মান করাতে পারল! জগার গায়ে শিঙি মাছের মতো ফুটতে থাকে সবার হাসিমস্করা। 
বাজার থেকে ডেবরি ফিরে আসা মাত্রই জগা ভগী খুড়ার কথাটা বলে। ডেবরি গেঁড়ি চিছুনের হাঁড়িটা দুয়ারে ফেলে দিয়েই চিৎকার ফেলে দেয়।
—- খুড়া বলে কি সে মাথার ঠাকুর। একটা জ্ঞানমান লোক হয়ে কুথায় কী বলতে হয় সে জানেনি। আর তুমিও ম্যা-মেইয়া! মুখ বুজে শুনে লিলে!
—তোখে বলাটাই মোর মুখ্যামি হইচে। বাপের বয়সি লোক একটা,তাখে কি আর বোলবো!
—-বোলবো মানে! তুমি মাচ ধর,ডাঁক,বগলা মার তাতে তার কী? তুমি মেরে খেলেই পাপ হয়ঠে? আর সে যে ছাগল চরিয়ে বড় করে করঙার হাতে বিচে দেয়ঠে তাতে পাপ হয়নি? আর বীরেন পাতর ত সাধূ পুুরুষ! পার্টি করে বলে ধরাকে সরা মনে করে।  বাজারে ভূতা সদ্দারের জায়গাকে জোর করে দখল করে ঘর বসিছে। সেটা পাপ লয়। বেশি সাউকারি মারায়ঠে। চালুনির পঁদ ঝরঝর করে চালুনি ছুঁচের বিচার করে! মোর কাছে বল্লে নি কাপড় খুলে ল্যাংটা করে দিতম।
ডেবরি ঝাউঝাউ করে গালাগালি করে। তবে কথাগুলো ফেলে দেওয়ার মত নয়। জগা ভাবে তার মুখে কেন এসব কথা জোগায় না।  আর এলেও ডেবরির মতো সদর্পে বলতে সে পারত কিনা সন্দেহ। ডেবরির দড় শুধু মুখে নয়,কাজেও আছে।বাজারে মাছ বিক্রি করতে গেলে  মুখে একটু সটরবটর করতে হয়। এমনিতে ডেবরি রায়দের দুগ্গা পুকুরের জলের মতো শান্ত। মনটা কাঁচপারা জলের মতো স্বচ্ছ।  কিন্তু রেগে গেলে চন্দ্রবোড়া।  ফোঁসফোঁস করে আর আড়ে ফুলতে থাকে। পাড়ার কেউ ঠাট্টা তামাশা করে ডেবরিকে রাগাতে চাইলে জগা তাদের সাবধান করে।
—অকে বেশি রাগাও নি। ঠাটা কত্তে কত্তে বোটকিরা হই যাবে। উ ঠাটা বুজেনি। রেগে গেলে ডেবরি তিনতৌড়ির মা কালী!

তবে জগার মনে রাগ তাত সেইভাবে নেই। ভাদ্র আশ্বিনের আকাশের মতো মন মেজাজ, এই মেঘ তো এই রোদ। ভগীরথের কথা তার মন থেকে কর্পূরের মতো উবে যায়। জগা আবার পাখ ধরার তোড়জোড় করে। শিলাবতীর বাঁধে সারাবছর সে ডাঁককল আড়ে। ডাঁকপাখি বেশি পড়লে বিক্রি করে দেয়। অনেকেই ডাঁকের মাংস খেতে পছন্দ করে। পাছে সবাই জেনে যায়, তাই লুকিয়ে কেনে। জগা মুখ টিপে হেসে বলে,
—-পেটে ত খাবে লোজ্জা কিসে!
নদীর উত্তর পাড়ের মাহিষ্যদের অনেকেই ডাঁক  জগার কাছ থেকে কেনে। বদ্যি বামুনও রান্না করা ডাঁকের ঝোল খেয়েছে জগার ঘরে। জগা ছাড়া কেউ সেকথা জানে না। বদ্যি বামুন জগাদের কুলপুরোহিত। পই পই করে জগাকে সাবধান করে দিয়েছে,
—-বুইলি জগা কাউকে ইসব বোলবিনি। যত হোক বামুন ত। লোকে জানলে নিন্দা মন্দ কত্তে ছাড়বেনি।
—-তুমি কি ভাব ঠাকুর! জগা কিছুই বুজেনি। মোর পেট থিকে কিছু বেরাবেনি। তাবাদে বামুন বলে কি লোভ থাকতে নাই। মোর কাছে একটাই নীতি আগে আত্মাকে সন্তুষ্টু কর,থাইলে দেবতাও সন্তুষ্ট হবে।
মাঝে মাঝে জগা এরকম বিজ্ঞের মতো কথা বলে। আর   বোরো জল মাঠে আসলেই তার আয়নাকল আড়া শুরু হয়ে যায়। বক ধরার মোক্ষম ফাঁদ আয়নাকল। বাঁশকাঠির তৈরী আয়নাকলে একবার বক আটকালে বাঁচার কোন সাধ্য নেই তার। মাঠে জল লাগার পর আজকাল পাওয়ার ট্রিলারে হাল হয়। লাঙল বলদের চল কবেই উঠে গেছে। জগা তখন বক ধরার অন্য উপায় প্রয়োগ করে। পুঁটি মাছের পেটে দানা বিষ পুরে মাঠের আলে ছড়িয়ে দিয়ে আসে। তাকে খেয়ে এক দুটো বক তো লটকে যায় অনায়াসে। মরা বকের পেট থেকে বিষ ভর্তি পুঁটিমাছ বের করে দেয়। তারপর কাটকুট করে রান্না করে। 
জগা আরো দুটো পাখি মারতে ওস্তাদ। আগে জগা কাঁটাবেতের ফাঁস বানাত। সেই কাঁটাফাঁস দু'চার হাত ছাড়া ছাড়া দড়িতে বাঁধত। তারপর সেই দড়ি এগাছ ওগাছ করে বেঁধে ঝুলিয়ে দিত। যেই না রাতে বাদুড় উড়ে যেত ওইদিকে, অম্নি কাঁটাফাঁসে আটকে ঝটপট করত। যত ঝটটপটানি  তত বাদুড় বাবাজিরা বেত কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত অবস্থায়  আধমরা হয়ে পড়ত। জগার শিকারী চোখ জানে কোন দিক দিয়ে বাদুড়ের দল রাতে যাতায়াত করে। বাদুড় মাংসের খদ্দের নাকি অনেক। জগা বলে,
—-বাদুড় মাংসের টেসই আলাদা। যে খায় নি, সে বুজবেনি।
তবে আরেকটা পাখির মাংস জগা ছাড়া কেউ খায় না। কালসাবার মাঠে রাতে  শামুকখোল পাখি নামে। গাঁয়ের লোকেরা বলে শামখোল। এই পাখি ধরার কৌশল জগা ছাড়া কেউ জানে না। সাধে কি ঢোল জগাকে শিকারী বলে। সন্ধ্যা নামলেই জগা শামখোল শিকারের প্রস্তুতি নেয়। তবে শামখোল একা শিকার করা যায় না। বড় ছেলেকে সঙ্গে নেয় জগা। ছেলের হাতে থাকে তিন ব্যাটারির টর্চ লাইট। জগার হাতে থাকে গেঁটে বাঁশের পাকানো লাঠি। মাঝ মাঠে বাপ ছেলে মিলে শামখোল শিকারে অনেক রাত অব্দি ঘুরে। রাতের আবছা আলোয় শামখোল দেখলেই জগার বেটা সুদন পাখির চোখে টর্চের আলো ফেলে। চোখে আলো পড়া মাত্রই শামখোল ঠায় বসে পড়ে। আর অম্নি জগা পিছন দিক দিয়ে পা টিপে টিপে গিয়ে পাখির উপর সজোরে  লাঠির ঘা বসায়। এক ঘায়েই শামখোলের ভবলীলা শেষ হয়ে যায়। তবে সবসময় জগা এই কৌশলে সফল হয় না। মাঝেমাঝে অনেক নাকানিচুাবানী খেতে হয় তাকে। পাখির চোখে সোজাসুজি আলো না ফেলতে পারলেই শিকার যায় ফস্কে। গাল খায় সুদন।
—দুর মেড়া! কুনু  মুরাদ নাই তোর। ঠিক করে আলোটাও চোখে মাত্তে পারুনু। হাত থরথর করে দুলেঠে কেনে। হাতে কি তোর কুষ্টিবেদ্দা হইচে।
কিন্তু যেইবার সফল হয়, জগার চোখ ফূর্তিতে  রাতেও ঝলসে উঠে। সুদনের উদ্দেশ্যে জগা বলে উঠে,
—ছাবাস! এই না হলে জগা বাগদির বেটা!
সুদনও পিটপিট করে হাসে। অভ্যাসমত শামখোলের পা দুটাকে বেঁধে নেয় ব্যানা ঘাস দিয়ে। তারপর লাঠির ডগে ঝুলিয়ে কাঁধে নিয়ে হাঁটা দেয় ঘরের দিকে। জগা পিছন পিছন টর্চের আলো ফেলে ছেলেকে সামনের পথ দেখায়।



Post a Comment

0 Comments