বিজ্ঞানের বনফুল
দেবশ্রী পণ্ডা
বনফুল পেশায় ছিলেন ডাক্তার আর নেশায় সাহিত্যিক। কাজেই তিনি বিজ্ঞানকে সাহিত্যের প্রকরণে নানা রূপে কাজে লাগিয়েছেন।
বৃত্তিসূত্রে চিকিৎসক হওয়ার জন্য বৈজ্ঞানিক অন্বীক্ষা তাঁর মজ্জাগত। অনুবীক্ষণ যন্ত্রের তলায় চারিদিকে বহমান অদৃশ্য জীবনলোকের এক অর্ন্তলীন নির্ভুল পরিচয় প্রতিদিন আহরণ করেন চিকিৎসক বলাইচাঁদ। এই সমাজটাই যেন একটা বড় হাসপাতাল। বলাইচাঁদের অভিজ্ঞতাও অনেকটা তাই।
‘‘তীক্ষ্ম মননশীলতাও নানারূপ পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে নানাভাবে মানব চরিত্রকে যাচাই করেছেন। এই কাজে তিনি বিজ্ঞান ও সাহিত্যকে বিষয় ও আঙ্গিককে নানাভাবে কাজে লাগিয়েছেন। বৈজ্ঞানিকের অদম্য কৌতূহল নিয়ে তিনি বিচিত্র মানবজীবন, পাখি, রাজনৈতিক আন্দোলন এবং ইতিহাসকে পর্যবেক্ষণ করেছেন আর সাহিত্যিকের সরস দৃষ্টি নিয়ে তাকে রসাল করে তুলেছেন।’’১
বনফুলের সাহিত্য সাধনার মর্মলোকে যে বিজ্ঞান ভাবনার স্রোত প্রবাহিত হয়েছে তা শুধুমাত্রই বিজ্ঞান চেতনা নির্ভর নিরীক্ষণ-জাত মনোভাবনার ফসল নয়। ডাক্তারি অভিজ্ঞতা-জাত বিজ্ঞান ভাবনা সমাজ, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, মনস্তাত্ত্বিকতা ও নানা প্রেক্ষাপটের সঙ্গে নিবিড় ভাবে সম্পৃক্ত হয়ে যেন একে অপরকে বিশ্লেষিত করেছে। তাঁর চিকিৎসা- সংক্রান্ত গল্পগুলি কখনই শুধুমাত্র তথ্যধর্মী হয়ে ওঠেনি।
বিজ্ঞান নির্ভর কাহিনীর বয়ন গল্পগুলির অভ্যন্তরে যে সূক্ষ্ম মননজাত অনুভূতির রসমাধুর্য নির্মাণ করেছে- তাতে গল্পগুলিকে বাংলা সাহিত্যের রসাস্বদনের ক্ষেত্রে হয়ে উঠেছে দ্বিতীয় রহিত। বৈজ্ঞানিক সত্যের দ্বারা সাহিত্যের সত্যকে অতিক্রম করে তার একান্ত বাস্তব বা অনাবৃত রূপের প্রতিষ্ঠা করেননি বনফুল। বরং গল্পের শেষে গাল্পিক রসই প্রাধান্য পেয়েছে। আমাদের মানব- অভ্যন্তরের বিভিন্ন দিককে উন্মোচিত করেছে।
বনফুল পেশায় চিকিৎসক ছিলেন। কিন্তু আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি তাঁর অন্তরাত্মাকে কখনও কলুষিত করতে পারেনি। সেই জন্যই হয়ত সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে নিজের জীবনের অর্থেও প্রয়োজনীয়তাকে পূর্ণ করতে হয়েছে। আবার অর্থের জন্যও তিনি সাহিত্যের সাধনায় রত ছিলেন না। বরং উল্টোটাই হয়েছে সাহিত্য চর্চার জন্য তিনি সেরকম ভাবে ল্যাবরেটরিতে মন দেননি। তবে তাঁর রচিত সৃষ্টি থেকে যখন উপার্জন করেছেন তখন তাঁর ভালোই লেগেছে। পরোপকারী মনোবৃত্তি তাঁর উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। চিকিৎসা ব্যবস্থাটাই পরোপকার নির্ভর, বনফুল সে ব্যাপারে পূর্ণ অনুগামী।
বিজ্ঞান চেতনা শিক্ষা নির্ভর। অথবা বলা যায় বিজ্ঞান নির্ভর শিক্ষা মানুষের অ ন্ত্রের অন্তরের দীর্ঘ-লালিত কুসংস্কারের বেড়াজালকে অতিক্রম করে নব জীবনের শুভ সূচনাকে স্থাপন করে। ব্যক্তিগত জীবনে বনফুল বিচিত্র ধরণের রোগীর সংস্পর্শে এসেছেন। যাদের অধিকাংশই অশিক্ষা ও অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে ছিলেন। তাদের উত্তরণের পথ প্রদর্শক হিসাবে বনফুলের নিরলস প্রচেষ্টা ছিল।
বনফুলের বিজ্ঞানদৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে সমাজের বহুমাত্রিক দৃষ্টিকোন তার একই গল্পতে সমান্তরাল ভাবে জায়গা করে নিয়েছে। ফলে গল্পগুলি বহুমুখীনতার মাধুর্য্যে রস সমৃদ্ধ হয়েছে। তাই বনফুলের গল্পের শ্রেণী বিভাজনের ক্ষেত্রে গল্পগুলিকে কোন নির্দিষ্ট শ্রেণীর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। বনফুলের বিজ্ঞানধর্মী রচনাগুলির দ্বারা স্বাধীনতাত্তোর ভারতবর্ষেও চিকিৎসা পরিকাঠামোর কঙ্কালসার দেহাবয়বটুকু প্রকাশিত হয়নি, সমাজ-অর্থনীতির বৈষম্যময় ব্যবস্থার রূপটিও প্রকাশিত হয়েছে। স্বাধীনতাত্তোর ভারতবর্ষের স্বপ্নিল বর্ণময় ভবিষ্যতের আশা পদদলিত হয়েছে পদে পদে। শিক্ষার অগ্রগতি, সু-চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং উন্নততর জীবনযাপনের জন্য উন্নত মানসিকতা এবং পরিকাঠামোর সুনির্মাণ অধরাই থেকে গেছে। ব্যক্তি বনফুলের এ নিয়ে আক্ষেপ ছিল।
বহু কষ্টার্জিত স্বাধীনতা তৎকালীন রাজনৈতিক নেতা-নেতৃদেও স্বার্থপরতা আর স্বজন পোষণের আঁতুড় ঘর হয়ে উঠেছিল। এ নিয়ে তাঁর ক্ষোভ তিনি ‘মর্জিমহলে’ প্রকাশ করেছেন।
বনফুলের গল্পে টাইফয়েড, যক্ষ্মা, রিকেট ইত্যাদি রোগের শিশুদের উপর প্রতিফলনের চিত্র দেখা যায়, যা তৎকালীন মানুষের জীবন যাপনের বিভিন্ন অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস ও অজ্ঞানতাকে চিহ্নিত করে। শিক্ষা-স্বাস্থ্য-অর্থনীতি এগুলো হল সমাজ নির্মাণের স্তম্ভ সেগুলোর অভাবই আমাদের জীবনে এত বৈষম্যেও সৃষ্টি করছে। বনফুল নানা গল্পের মাধ্যমে তারই চিত্র প্রতিফলনের চেষ্টা করেছেন।
মননশীল ব্যক্তিই সভ্যতা ও সংস্কৃতির যথার্থ দিশারী এবং পথ প্রদর্শক হন। নিজ চরিত্রবল ও আত্ম বিশ্বাসের দৃঢ় প্রত্যয়ের উপর নির্ভর করে সামাজিক সমস্ত রকমের অমানিষার দূরীকরণে নিজের কর্মজীবনের একাংশকে নিয়োজিত করেন। নিরন্তর সংগ্রামী আত্মার জীবনব্যাপী ত্যাগর সু-ফলের দ্বারা উন্নতির সোপানে উত্তীর্ণ হয় পরবর্তী প্রজন্ম তথা সভ্যতা।
বিজ্ঞানের জগতে আইজাক নিউটনের (১৬৪২-১৭২৭) আবির্ভাব (Newtonean Mechanistc Era) হিসাবে পরিচিত। বিজ্ঞানের জগতে নিউটনের প্রভাব সারা বিশ্বব্যাপী পরিব্যাপ্ত হয়ে উঠেছিল।
ইংলন্ডে শিল্প বিপ্লবের সূচনা ঘটেছিল ১৭৬০ খ্রীঃ। শিল্প বিপ্লব পরবর্তী মানব সভ্যতার জীবনাবরণে যন্ত্র বিজ্ঞানের ব্যবহার অনস্বীকার্য। মানব সভ্যতার নিয়ত প্রবহমান অভ্যাসের অনেকখানি বিজ্ঞানের উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। বিজ্ঞান যেমন মানবজীবনে নিজের প্রভাব বিস্তার করেছে ঠিক তেমনি শিল্প সাহিত্য চিত্রকলার মধ্যে ব্যাপকতর পরিবর্তনের অনুঘটক হিসাবে কাজ করেছে। সভ্যতার এই আমূল পরিবর্তনের ধারক ও বাহক হল বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠা সভ্যতা তার সনাতনী ধারার পরীপন্থী হয়ে ক্রমশ দিক পরিবর্তন করেছে। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সোনার কাঠির স্পর্শে সভ্যতা নব নির্মিতি লাভ করেছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল বিজ্ঞানের এই সমৃদ্ধি সর্বস্তরের মানুষের জীবন যাত্রার মধ্যে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। বর্তমান কাল অবধিও তার বিস্তৃত রূপায়ণ হয়ে উঠেনি, আমাদেও সমাজ জীবনের।
চিকিৎসক বনফুল তা মর্মে মর্মে অনুভব করতেন। সেইজন্য তার গল্পে বারংবার প্রতিফলিত হয়েছে গ্রামীণ স্বাস্থব্যবস্থার হত দরিদ্র রূপ ও নিপীড়িত আত্মার আর্তধ্বনি।
তৎকালীন সময়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ধারায় অনেক রোগেরই আধুনিক-চিকিৎসা বা সুলভ চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়নি। প্রাচীন পন্থা এবং নব-চিকিৎসা পদ্ধতির সংযোগে চিকিৎসাব্যবস্থার ক্রম উন্নতি সাধিত হয়েছে নিরন্তর পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে।
চিকিৎসা-বিজ্ঞানের এই যুগ বদলের প্রেক্ষাপটটি বাংলা সাহিত্যের অনেক স্রষ্টার সৃষ্টিকর্মে স্থান পেয়েছে। বনফুল সেরকমই একজন স্রষ্টা। চিকিৎসক বনফুলের হাত ধরে তৎকালীন চিকিৎসা পদ্ধতির রূপচিত্রের সঙ্গে যেমন পাঠকের প্রত্যক্ষ সংযোগ ঘটে, ঠিক তেমনি প্রচলিত বিভিন্ন রোগের সঙ্গেও পরিচয় ঘটে।
বনফুলের বিজ্ঞান ধর্মী রচনাগুলি শুধু নীরস চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্যের বর্ণনায় পূর্ণ নয়। বিজ্ঞান ভাবনাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে, সমাজ, মনস্তাত্ত্বিকতা, হাস্যরস ট্রাজেডি ভাবনা, বিচিত্র জীবন অভিজ্ঞতা ইত্যাদি।
বনফুল হলেন আনন্দবাদী শিল্পী। সুস্থ জীবনের কল্পনা তিনিই করতে পারেন যিনি জীবনমুখী মানুষ। যে কোনো প্রেক্ষাপটেই তিনি জীবনের রস মাধুর্যকে আস্বাদন করেন সুগভীর জীবন রসায়নের অনুভবে। সেইজন্য বিজ্ঞানের মত কঠিন বিষয়ও তাঁর নিজ প্রকাশভঙ্গি ও শৈলীর গুণে পাঠকের দরবারে সরস-রসাস্বাদনের নির্মাণ শৈলী লাভ করে। অনুভবের এই বিস্তৃত রূপ চিত্রণের ক্ষেত্রে বনফুল বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয় রহিত।
তৎকালীন সময়ে চিকিৎসা ব্যবস্থা এত উন্নত ছিল না। বিভিন্ন রোগের সঠিক ঔষধও বের হয়নি। তাই টিবি, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড এই সব অসুখগুলির চিকিৎসাও ছিল খুব ব্যয় সাপেক্ষ। অর্থনৈতিক বৈষম্য সমাজ ও ব্যক্তি দুই পক্ষকেই এক ঘূর্ণাবর্তে নিক্ষিপ্ত করেছিল। ধীরে ধীরে সমাজ এই অসহায় পরিস্থিতি থেকে উন্নত জীবনমানের সোপানে উত্তীর্ণ হয়েছে। কিন্তু তা কতখানি? তৎকালীন পরিস্থিতিতে সমাজ ব্যবস্থার বিশ্লেষণে বনফুলের গল্পগুলি যতখানি প্রাসঙ্গিক ছিল বর্তমান ভারতবর্ষের সামাজিক প্রেক্ষাপটেও গল্পগুলি ততখানি প্রাসঙ্গিক। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পারস্পরিক অঙ্গীকৃত। গ্রামীণ স্বাস্থ্য (Rural health) ব্যবস্থার কঙ্কালসার রূপ আমাদের দেশের বিজ্ঞান মনস্কতার অসচেতন রূপটিকে প্রকাশ করে। বিজ্ঞানের হার হয়েছে কুসংস্কার ও শিক্ষাহীনতার যূপকাষ্ঠে।
বনফুলের নিরীক্ষণী দৃষ্টিভঙ্গি নানা বিষয়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়ে একই আধারে বহুমাত্রিকতার সৃষ্টি করেছে। কবি ঈশ্বর গুপ্ত সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন,
‘‘কবির কবিত্ব বুঝিয়া লাভ আছে সন্দেহ নাই, কিন্তু কবিত্ব অপেক্ষা কবিকে বুঝিতে পারিলে আরও লাভ।’’২
রবীন্দ্রনাথও স্বীকার করেছেন,- দান্তের কাব্যে দান্তের জীবন জড়িত হইয়া আছে, উভয়কে একত্র পাঠ করিলে জীবন ও কাব্যের মর্যাদা বেশি করিয়া দেখা যায়।
বনফুলের ক্ষেত্রে ও একই কথা প্রযোজ্য। বিজ্ঞানী বনফুলের সাহিত্য সৃষ্টির পরতে পরতে আছে ব্যক্তি অভিজ্ঞতার বিচিত্র উদ্ভাস। বনফুলের বিজ্ঞানচেতনা পাঠকের কাছে অনুভববেদ্য হয়ে ওঠে সমাজ বিশ্লেষণের নব আঙ্গিকে। বিজ্ঞানকে কেন্দ্র করে রচিত বিচিত্র প্রকৃতির গল্প পাঠকের চেতনার জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বিজ্ঞানের সঙ্গে নানাবিধ বিষষের সম্পৃক্তিতে বা সমন্বয়ে রচিত ছোটগল্পগুলি বাংলা সাহিত্যের দরবারে পাঠকের চিন্তার জগতকে নব নির্মাণ করেছে।
গ্রন্থসূত্র:
১. বনফুলের ছোটগল্প, সরোজ মোহন মিত্র, পৃ. ১০
২. বনফুলের ছোটগল্প, ড. সরোজ মোহন মিত্র, পৃ. ৫৫
0 Comments