জ্বলদর্চি

বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক হীরেন্দ্রনাথ দত্ত /নির্মল বর্মন

বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক হীরেন্দ্রনাথ দত্ত 
 
নির্মল বর্মন 

অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য দর্শন বিজ্ঞান ও ধর্মশাস্ত্রে সুপন্ডিত ছিলেন। বিশেষ করে প্রাচ্য পাশ্চাত্য দর্শনের তুলনামূলক সমালোচনায় তাঁর মৌলিক প্রতিভা প্রশংসনীয়। পাশ্চাত্য দর্শন , ইতিহাস ও সাহিত্য বিষয়ে সুগভীর জ্ঞানের অধিকারী বিশিষ্ট সুদার্শনিক ও সু- পন্ডিত  এবং "পন্থা ও ব্রহ্মবিদ্যা" পত্রিকার সম্পাদক সম্মানীয় অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রাবন্ধিক হিসেবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর কৃতিত্বের দাবি রেখেছেন।
প্রাবন্ধিক হীরেন্দ্রনাথ দত্ত ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতার হাটখোলায় ১৮৬৮ সালের ১৬ই জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজ অধুনা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে বি.এল পাস করেন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য  বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করে এম.এ পাশ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন।( বর্তমানে লেকচারার পদে পরিবর্তন ঘটিয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে)!প্রাবন্ধিক, আইনজীবী, চিন্তাশীল ও বিশিষ্ট দার্শনিক পন্ডিত ১৯৪২ সালে ১৬ই সেপ্টেম্বর ৭৪ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
🍂

প্রাবন্ধিক হীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্বাধীনতা আন্দোলনে অসাধারন ব্যক্তিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। ১৯৯৪ থেকে ১৯২০ কংগ্রেসের সব সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে আপামোর জনসাধারণকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। প্রাবন্ধিক হীরেন্দ্রনাথ দত্ত রাজনীতিতে মডারেট দলভুক্ত ছিলেন বলেই জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। ১৯১৫ সালে হোমরুল আন্দোলনে বাংলায় অ্যানি বেশান্তের প্রধান সহকারী হিসেবে সুনাম অর্জন করেছিলেন। অধ্যাপক দত্ত মদনমোহন মালব্যের সঙ্গে হিন্দু মহাসভা প্রতিষ্ঠা করে ছিলেন। পরে রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করে অহিংস মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন না বলেই কংগ্রেস ত্যাগ করেন। ব্রিটিশের শাসন শোষণ বন্ধ করার জন্য স্বদেশী শিল্প প্রসারে "বঙ্গলক্ষী কটন মিল" ; " ন্যাশনাল ব্যাংক" ও "হিন্দুস্থান ইন্সুরেন্স" স্থাপনে যথেষ্ট সাহায্য সহযোগিতা করেছিলেন।
প্রাবন্ধিক হীরেন্দ্রনাথ দত্তের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ গুলি হল ঃ-- "গীতায় ঈশ্বরবাদ" ১৯০৫ ; "উপনিষদ- ব্রহ্মতত্ত্ব"১৯১১; "জগদগুরুর আবির্ভাব" ; ১৯১৬; "নারীর নির্বাচন অধিকার" ; "অবতারতত্ত্ব"; " "বেদান্ত পরিচয়"; "বুদ্ধদেবের নাস্তিকতা" ; "যাঞ্জবল্কের অদ্বৈতবাদ"; "প্রেমধর্ম"; "বুদ্ধি ও বোধি"; "রাসলীলা"; "সাংখ্য পরিচয়"; "দার্শনিক বঙ্কিমচন্দ্র"; "উপনিষদ ----জড় ও জীবতত্ত্ব" ; "কর্মবাদ ও জন্মান্তরবাদ"; এছাড়াও প্রাবন্ধিক হীরেন্দ্রনাথ দত্ত কালিদাসের "মেঘদূত" এর  বঙ্গানুবাদ করে বাংলা সাহিত্যে সুনাম অর্জন করেছিলেন।
প্রাবন্ধিক হীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রথম গদ্য গ্রন্থ "গীতায় ঈশ্বরবাদ"বাংলা সাহিত্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। কৃষ্ণ তত্ত্বের অভিনবত্ব প্রদর্শন করেছিলেন এই গ্রন্থে। প্রাবন্ধিকের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল গীতার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদন করে পাঠক কূলে আলোড়ন সৃষ্টি করা। তা খানিকটা সাফল্য লাভ করেছিল। ন্যায়,বৈশেষিক , সাংখ্য , যোগ , মীমাংসা ও বেদান্ত এই ষড়দর্শনের সু বিস্তৃত আলোচনা করে সেই নিরিখে গীতার মূল থিমগুলোকে বিশ্লেষণ করেছেন।
প্রাবন্ধিক ও  অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ দত্ত উপনিষদের সমালোচনা করে পান্ডিত্য ও মননশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। "উপনিষদ-  ব্রহ্মতত্ত্ব" গ্রন্থে ঈশ্বরের ঐশ্চর্য ও মাধুর্য রূপের সমন্বয় সাধন করে ভক্তবৃন্দকে সন্তুষ্ট করতে পেরেছিলেন। "বুদ্ধদেবের নাস্তিকতা" প্রবন্ধে বৌদ্ধ ধর্মের নিরাকার তত্ত্বের স্বরূপ সম্মানের সহিত বিশ্লেষণ করে সুনাম অর্জন করেছিলেন।
অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ দত্ত দার্শনিক ও গবেষণামূলক প্রবন্ধের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের "জগত্তারিণী 
স্বর্ণপদক", "বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের রামপ্রাণ স্বর্ণপদক" এবং কাশী হতে "বেদান্তরত্ন" উপাধি লাভ করেছিলেন।
    প্রাবন্ধিক ও অধ্যাপক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সুগভীর পাণ্ডিত্য ও বহু অধ্যায়ন জনিত অভিজ্ঞতা অর্জন করে বক্তব্য বিষয়কে যুক্তি ও তথ্যে সুসজ্জিত করে প্রাচীন শাস্ত্রাদী থেকে দৃষ্টান্ত চয়ন করে আবেগ - উচ্ছ্বাসবর্জিত যুক্তিধর্মী গদ্যে সাজিয়ে পাঠকের হৃদয়গ্রাহী করে তুলতে পেরেছিলেন বলেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব ছিলেন , যদিও আজ প্রায় বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিকের তালিকাভুক্ত হতে চলেছেন। প্রাবন্ধিক হীরেন্দ্রনাথ দত্ত দার্শনিক ও নৈয়ায়িক তত্ত্বকে পাঠক দরবারে সহজ ঋদ্ধ করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। সুতরাং মননশীল দৃষ্টিভঙ্গি , যুক্তিনিষ্ঠ ভাবনায় প্রাচ্য-পাশ্চাতের দার্শনিক দিকগুলি তাঁর প্রবন্ধ সাহিত্যে আজও জীবন্ত হয়ে জ্বলন্ত অবস্থায় স্থান লাভ করেছেন।

Post a Comment

0 Comments