জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে -৭১/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে
রোশেনারা খান

 পর্ব ৭১

খান সাহেবকে ডাক্তারের নিয়ে যাওয়া দিনদিন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওনার ওই সকাল দশটা থেকে বিকেল পাঁচটা  পর্যন্ত থাকতে খুব কষ্ট হয়। তাছাড়া ওনার ভয়, আমি ওনাকে কলকাতায় নার্সিংহোমে ভরতি করে দেব। ওনাকে বোঝালাম, আমি ডাঃ দাসকে অনুরোধ করব কিছু একটা করতে, যাতে তোমাকে সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকতে না হয়। এসব বলে বুঝিয়ে ওনাকে রাজি করিয়েছি। কলকাতা আসার পথে তা ও বললেন, তোমার কথা ডাক্তার শুনবেন কেন?

     আগেই বলেছি ডাঃ দাসের সঙ্গে এখন আমাদের সম্পর্ক পারিবারিক বন্ধুর মত। প্রথমে গিয়ে ওনাকে একবার দেখাতে হয়। উনি দেখার পর টেস্টগুলো দেন। প্রথম বার দেখানোর সময়ই আমি ওনাকে বললাম খান সাহেবের সারাদিন থাকতে কষ্ট হয়। উনি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, থাকার দরকার নেই, ব্লাড দিয়ে চলে যান। বিকেলে রিপোর্ট পেলে ফোনে আপনার সঙ্গে কথা বলে নেব। প্রেসক্রিপশন মেল করে দেওয়া হবে এবং কুরিয়ারও করে দেওয়া হবে। আপনি অ্যাড্রেসটা লিখে দিয়ে যাবেন। ডাক্তারের কথায় আমি আমার চোখে জল এসে গেল। ভাবলাম আমাদের দেশের সব ডাক্তার যদি এরকম সহানুভূতিশীল হতেন! তারপর থেকে এরকমটাই হতে  থাকল। সেদিন ৩ টের মধ্যে মেদিনীপুর পৌঁছে উইমেন্স কলেজেও গেলাম  রানীর কাছে বাড়ির চাবি নিতে। আমাদের এত তাড়াতাড়ি ফিরতে দেখে একটু অবাক হল, জিজ্ঞেস করল, মেসো ঠিক আছে? –হ্যাঁ, গাড়িতে বসে আছে।

      অক্টোবরে একদিন অম্বিকেশ মহাপাত্রের ফোন পেলাম। বললেন, জাস্টিস অশোক গাঙ্গুলির থেকে আপনার নাম্বার পেয়েছি। তারপর বললেন,‘আমরা আক্রান্ত’ সংগঠন থেকে আমরা ইসরত জাহানদের মত অত্যাচারিত মহিলাদের নিরাপত্যার দাবিতে ১৩ অক্টোবর একটি সভার আয়োজন করছি। সভাটি অনুষ্ঠিত হবে হাওড়ার যোগেশচন্দ্র গার্লস স্কুলের অডিটোরিয়ামে। ওই সভায় আপনার উপস্থিতি চাইছি। এই সভা থেকে সমাজের বিশিষ্ট নাগরিকদের  স্বাক্ষর করা একটি আবেদনপত্র প্রকাশ করা হবে। তাতে সই করেছেন অশোক গাঙ্গুলি, তরুণ মজুমদার, ওয়াসিম কাপুর, নবনীতা দেবসেন প্রমুখ ২৬ জন বিশিষ্ট নাগরিক। যার মূল বক্তব্য হল, সংবিধান ও আইন, আদালতকে মান্যতা দিতে হবে। আমি এই সভায় যোগ দিয়েছিলাম। অশোক গাঙ্গুলি ও তরুণ মজুমদার অসুস্থতার কারণে এই সভায় যোগ দিতে পারেননি। আমি ছাড়াও তনভির নাসরিন, মন্দাক্রান্তা সেন ও আরও অনেকে সভায় যোগ দিলেও যার জন্য এই সভার আয়োজন সেই ইসরত জাহান আসি আসি করেও এখনও এসে পৌঁছাননি। সভা যখন শেষের মুখে তখন শুনলাম ইসরত জাহান এসেছেন, কিন্তু অডিটোরিয়ামের ভিতরে আসবেন না। বাইরে বেরিয়ে দেখলাম সন্ধ্যার অন্ধকারে আপাদমস্তক বোরখায় ঢেকে একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁকে চেনার কোনও উপায় নেই। তিনি ভয় পাচ্ছেন, তিনি চান না তাঁর এখানে আসার খবর কেউ জানুক। তাঁর জলের, লাইটের লাইন কেটে দেওয়া হয়েছে। মিডিয়ার লোক দেখা করতে এলে, তাঁকে আটকে রেখে  অন্য মহিলাকে তাদের সামনে হাজির করছে।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
এর কয়েকদিন পরে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ব বিদ্যালয়ের আমন্ত্রনে ১৭ অক্টোবর সসিওলজির ক্লাস নিতে গেলাম। একেবারে নতুন অভিজ্ঞতা। যে মেয়েটি কলেজে পড়ার সুযোগ পায় নি সামাজিক পিড়নের (বাল্যবিবাহ)কারণে, আজ সে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্পেশাল ক্লাস নিতে এসেছে ছাত্রীদের। কখন যে একঘণ্টা সময়  ফুরিয়ে গেল টেরই পেলাম না। খুব ভাল ফিটব্যাক পেয়েছিলাম। এখানে আসতে পেরে আরও ভাল লাগল, অনেকদিন পর বন্ধু বাসবী ও অরুনাভ বাবুর সঙ্গে দেখা হয়ে। ক্যান্টিনে কিছুটা সময় কাটিয়ে বেরিয়ে এলাম। এখানেও আমার সঙ্গি চন্দ্রিমা। বেশ কিছুটা সময় অন্য জগতে কাটিয়ে আবার নির্মম বাস্তবে ফিরলাম, বাড়িতে অসুস্থ স্বামীকে রেখে আসেছি, আমার আপনার চেয়ে আপন জনেরা মাটির  বিছানায় ঘুমিয়ে আছে। যদি একটু বিছানা পেতে দিতে পারতাম!     

     ২২ আগস্ট (২০১৭)সুপ্রিম কোর্ট তাৎক্ষণিক তিন তালাককে অসাংবিধানিক ও অবৈধ ঘোষণা করে এবং কেন্দ্রিয় সরকারকে নতুন আইন তৈরির নির্দেশ দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ল কমিশন মুসলিম ব্যক্তিগত আইনে  নারীর বৈষম্যমূলক অধিকারসহ ১৬ টি প্রশ্নের উত্তর জনগণের কাছে চাওয়া হয়। এবং এই বছরই ২৮ ডিসেম্বর তাৎক্ষনিক তালাক রদের বিলটি লোকসভায় পাশ করিয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু রাজ্যসভায় বিলটি আটকে যায়।

      এদিকে খান সাহেবের শরীর ঠিক যাচ্ছে না। ক্রিয়েটিনিন কমছে না। তাই নভেম্বরে আবার চেকআপে নিয়ে যেতে ডাক্তার বললেন, মেডিসিনে আর হবে না। ডায়ালিসিস শুরু করতে হবে,তাতে উনি ভাল থাকবেন। এই ভয়টা উনি সব সময়ই পান। তাই প্রত্যেকবার আসার সময় বলেন, এবার ডাক্তার ডায়ালিসিসের কথা বলবেন। সেটাই সত্যি হল। কলকাতার ল্যান্সডাউন মার্কেটে পুনম নার্সিংহমে এক সপ্তাহ ভর্তি থাকতে হবে। কয়েকটা ডেটও দিলেন। বাড়ি ফিরে এসে উনি  বললেন, ডায়ালিসিস করাব না। আমরা সবাই বোঝাচ্ছি, কিন্তু উনি বুঝতে  নারাজ। যদিও রাজি হলেন, যাওয়ার দিন আবার বেঁকে বসলেন। ড্রাইভার এসে গেছে, সঙ্গে যাওয়ার আমার ভাই এসেছে, সে ও বোঝাচ্ছে। কিন্তু ওনার এক কথা, মেডিসিনেই যতদিন চলে চলুক, ডায়ালিসিস করাব না। ড্রাইভারকে টাকা দিয়ে ফিরিয়ে দাও। আমি বললাম, তুমি এভাবে কষ্ট পাবে, আমি সহ্য করতে পারব না। জবাবে উনি বললেন, আমার চিকিৎসা করতে গিয়ে তুমি ভিখারি হয়ে যাবে, আমিও এটা মেনে নিতে পারব না।

     আমি রেগে গেলাম, বকলাম, শেষে যখন অসহায়ের মত কাঁদতে শুরু করলাম, তখন উনি রাজি হলেন। সম্ভবত ৩ ডিসেম্বর ওনাকে কলকাতা নিয়ে যায়। নার্সিংহোমে ভর্তির পর, ভাই গাড়ি নিয়ে চলে গেল। আমাকে তো থাকতেই হবে।আমি না থাকলে উনি খুবই অসহায় বোধ করেন। এখানে হাতে ডায়ালিসিসের  চ্যানেল করা হবে। আপাতত ঘাড়ে চ্যানেল করে সপ্তাহে ২দিন ডায়ালিসিস হবে।  মেদিনীপুরে স্পন্দন নার্সিংহোমে কথা বলে এসেছি।

    আমি ছিলাম ওসমান মল্লিকের বাড়িতে। ওর সঙ্গে পরিচয় তিন তালাক   বাতিল আন্দোলনের সুত্রে। আমি রক্তের সম্পর্কের থেকে হৃদয়ের সম্পর্কে বেশি বিশ্বাস রাখি। ওসমানের সঙ্গে আমার হৃদয়ের সম্পর্ক। এক সপ্তাহ ওদের ফ্ল্যাটে থাকা খাওয়া সব করেছি। চন্দ্রিমাও আমার কাছে এসে থেকেছে। আমাকে একটা রুম ছেড়ে দিয়েছিল। ও এবং ওর স্ত্রী, দুজনেই স্কুল শিক্ষক। ওর স্ত্রী ও ছেলে  অরণ্য দুজনেই খুব মিশুকে। ওদের বাড়িতে রাখী নামে একটি মেয়ে থাকি,  অরণ্যকে দেখার জন্য। রাখী মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসবে বলে তাকে পড়ানোর জন্য  ওসমান একজন গৃহ শিক্ষক রেখেছে দেখে খুব ভাল লাগল (তবে মেয়েটি এই সুযোগ  কাজে লাগাতে পারেনি। ওকে বাড়িতে রেখে ওসমানরা দেশেরবাড়ি  গিয়েছিল। সেই সুযোগে মেয়েটি একটি ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে নেয়)।

    খান সাহেবের সঙ্গে সন্ধ্যা ৫ টার আগে দেখা করতে দেয় না। আজ চন্দ্রিমা এসেছে। ও আসার পরেই বেরিয়ে পড়লাম। যেহেতু ওর সঙ্গে গাড়ি ছিল, তাই ও বলল, দক্ষিণেশ্বর গেলে হত। আমি আপত্তি করিনি। ৫টা পর্যন্ত সময়টা তো কাটাতে হবে?  

   দক্ষিণেশ্বর থেকে একটি রেস্টুরেন্টে সামান্য খাবার খেয়ে নার্সিংহোমে পৌঁছে ঘড়ির কাঁটায় চোখ রেখে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ৫টা বাজতে সিঁড়ি দিয়েই ওপরে গেলাম ওনার সঙ্গে দেখা করতে। কী দেখব? ঘাড়ে গলার কাছে আর বাম হাতের নিচের ভাগে মোটা মোটা দুটো সুচ ফোটানো আছে। আমাকে দেখে একটু হাসল।এ হাসিতে কত ব্যথা লুকনো রয়েছে, সেতো আমি জানি। কিছু প্রয়োজনীয় কথা হল। পায়ে হাতে কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে দিলাম। চন্দ্রিমাও একবার দেখে গেল। সময় ফুরিয়ে যেতে আমরা ওসমানের বাড়ি ফিরে এলাম। আমাদের ছেড়ে দিয়ে গাড়ি মেদিনীপুর ফিরে গেল। কাল সকাল ১০টা নাগাদ আবার আসবে। চন্দ্রিমার তুলনা চন্দ্রিমা নিজেই।ও আমার জন্য যা করে তা আমার সহোদরা বোন বা মেয়েও এতখানি করতে পারত কি না আমার সন্দেহ হয়। পরদিন গাড়ি আসতে আমরা আবার বেরিয়ে পড়লাম। ভিক্টোরিয়াতে কিছুক্ষণ কাটিয়ে নার্সিংহোমে গেলাম। ভিক্টোরিয়াতে যখন বসেছিলাম বেশ কিছুটা দূরে দেখলাম, দুটি ছেলেমেয়ে চুম্বনরত অবস্থায় সেলফি তুলছে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। অবাক হলাম তখন যখন মেয়েটি বোরখায় মুখ ঢেকে আমার সামনে দিয়ে চলে গেল।      চন্দ্রিমা ফিরে গেল। সন্ধ্যায় কমল বাবুর আসার কথা ছিল, উনি এসে খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করে আমাকে ওসমানের ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিয়ে গেলেন। প্রথম দিনও উনি আমাকে নার্সিংহোম থেকে ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিয়ে গেছলেন। খান সাহেবের সঙ্গে ওনার আলাপ ছিল।

                                                                                  ওসমান ৯ ডিসেম্বর একটি প্রেস কনফারেন্স রেখেছে। ওইদিন চন্দ্রিমা আবার আসবে। ওকে আমার একখানা শাড়ি নিয়ে আসতে বললাম। আগের দিন রাতে ওসমান তনভির আর ওর স্বামী সুমনকে ডিনারে নিমন্ত্রণ করেছিল। আসল উদ্দেশ্য আগামিকালের প্রেস কনফারেন্সের বিষয়ে আলোচনা করা। সুমন ভট্টাচার্যকে অনেক আগেথেকেই চিনতাম। দুহাজার সালের একে বারে শুরুতে একদিন সন্ধ্যায় উষসী  চক্রবর্তী(অভিনেত্রী ও সাংবাদিক) ফোন করে বলল, দিদি, আমার এক বন্ধু  একটি সাপ্তাহিক ট্যাবলয়েড প্রকাশ করতে চলেছে, আপনি যদি লেখেন। আমি কয়েকটি সংখ্যায় লিখে ছিলাম। আমার অসুবিধা হল, আমি কাগজটি পেতাম না। ওরা কয়েকটি সংখ্যা বাই পোষ্টে পাঠিয়েছিল। সবগুলি আমি পাইনি। জানি না কোন অজ্ঞাত কারণে কাগজটি বন্ধ হয়ে যায়, কাগজটির নাম ছিল ‘এখনই’ এবং সম্পাদক ছিল এই সুমন ভট্টাচার্য। পরে ওরসঙ্গে দেখা হয়েছিল (২০০৬) রবীন্দ্রসদন চত্বরে ‘নয়া জামানা’ আয়োজিত রাখি বন্ধন অনুষ্ঠানে। আলাপ করিয়ে দিয়েছিল ‘নতুন গতি’ পত্রিকার সাংবাদিক সুবিদ।
    ৯ ডিসেম্বরের প্রেস কনফারেন্সে  ওসমান সাহিত্যিক আবুল বাসারকে অমন্ত্রণ করেছিল। ওসমান ওনার বাড়িতে গেলে, বলেছিলান, আমি রোশেনারার বইয়ের ভুমিকা লিখে দেব বলেছিলাম, কিন্তু দিতে পারিনি। কী করে ওনার সামনে গিয়ে দাঁড়াব? কনফেরেন্সে উনি এলে ওনাকে স্বাভাবিক করার জন্য আমিই কাছে গিয়ে কথা বলি। বক্তব্য রাখার সময় উনি তনভিরের ও আমার নাম করে  বার বার বলতে থাকলেন, তনভির আর রোশেনারার নাম ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে। সেই সময় আমাদের আন্দোলনকে সমর্থন করলেও, পরে সুবিধা বুঝে এই আন্দোলনের বিপক্ষে বলা শুরু করেন। ইদানীং একাজ ব্যক্তিগত স্বার্থে অনেক কবি  সাহিত্যিককেই করতে দেখা যাচ্ছে। যেটা সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেতে খুবই ক্ষতি কারক, অপমান জনক।

     এইদিন মালদা ও মুর্শিদাবাদের ২জন প্রতিবাদী মুসলিম মহিলা যোগ দিয়ে  ছিলেন। যোগ দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্সির অধ্যাপক মইদুল ইসলাম।ও কলকাতা বিটি কলেজের প্রিন্সিপাল(আমার পরিচিত) মাকসুদা খাতুনের ছেলে। 

                                        ক্রমশ



Post a Comment

0 Comments