জ্বলদর্চি

দেশান্তরী -১৯/হিল্লোল রায়


দেশান্তরী -১৯

হিল্লোল রায় 

এ জীবনে মমশুরু হোক সর্বোত্তম

এখন রাত একটা দশ। দমদম থেকে মুম্বাই এসে পৌঁছাই রাত ১২-৩৫ মিনিট। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। এখনও ভারতবর্ষের মধ্যে রয়েছি। এখন AI 747জাম্বো বিমানে মুম্বাই শহর ছাড়ব। যখন ডাইরী লিখছি তখন রাত ১-২০। একটুও মন খারাপ হচ্ছে না বা ঘাবড়ে যাচ্ছি না।

মনে হচ্ছে শিয়ালদা-বনগাঁ লাইন  ট্রেণে চলাফেরা করার চেয়েও প্লেনে যাওয়া-আসা অনেক সহহজ এবং সুশৃঙ্খলবদ্ধ। যাই হোকদেশে থাকতে হাবড়া ও বি ই কলেজের হোস্টেলজীবন -এই ছিল আমার সবচেয়ে বেশী দৌড়ঝাঁপ ও যাওয়া-আসার ঘাঁটি। ভারতবর্ষের কোথাও দেখিনি যদিও দেখবারজানবার অনেক কিছুই ছিল।

বি ই কলেজ জীবন শেষ হতে না হতেই আমি যে একজন এত দূরের যাত্রী হব সেটা নিজে প্লেনের মধ্যে বসে ভাবতে পারছি না। যাই হোক প্লেনের মধ্যে থেকে যতদূর সম্ভব মুম্বাই শহরটাকে দেখে নিচ্ছি।

প্লেন এর মধ্যে থেকে বিশেষ কিছুই বোঝা যায় না। চারদিকে শুধুই আলোর মালানিঝুম নিশুতি রাত এই দৃশ্যটাকে আরও সুমধুর করে তুলেছে। আমার প্লেন এখনি ছাড়বে। প্রথম পৌঁছাব কুয়েত সময় ১১-৫৬ মিনিট। মুম্বাই বন্দরে প্লেন নিজস্ব গতি নিতে শুরু করল ভারতীয় সময় রাত ১-৩০ মিঃ নাগাদ। প্লেনের মধ্যে শানাইয়ের সুর শুনছি। সকরুণ ধ্বনি...

-ভারতবর্ষ-কে ভুলে যেও না। দুঃখ কষ্ট থাকলেও এদেশে এসো। এদেশ যে তোমার জন্মভূমি।

কি আশ্চর্যআমার মন এত শক্ত ও কঠোর যে কোনো বাধাই মানছে না বা দমিত হচ্ছে না। অনেকেই এখন নিদ্রামগ্ন ভারতীয় সময় রাত ২টো। জাম্বো ৭৪৭ ভারতবর্ষের মাটিকে স্নেহচুম্বন জানিয়ে উপরে উঠছে। প্লেনের গর্জনকারী শব্দ সদম্ভে জানিয়ে দিচ্ছে...

-তুমি এবার ভারতবর্ষের মাটি ছাড়তে যাচ্ছ।

রাত্রের অন্ধকারে বাইরের দৃশ্য খুব একটা নতুনত্ব ও বিশেষত্ব চোখে পড়ছে না। তাই যেহেতু আমার চোখে মুখে এখনও ক্লান্তির ছাপ রয়েছে এবং ঘুমের অভাব ছিলসেটা তাই ঠিক করে সূর্যিমামার আলোমাখা মুখখানা দেখেই চোখ খুলব।

সত্যি কথা বলতে কি ঘুম এসেও আসছে না আর তার সংগে প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলীর সামঞ্জস্য মনের মধ্যে একটা মোহাচ্ছন্ন পরিবেশ সৃষ্টি করেছে -ভীষণ ভালই লাগছে। আমেরিকার পথে পাড়ি দেওয়ার ব্যাপার খুবই স্বাভাবিক লাগছে।

এখন প্লেন চলছে নিজস্ব গতিবেগ নিয়ে। ভেতরে বসে বিশেষ কিছুই টের পাচ্ছি না। মাঝে মাঝে গলা ভিজিয়ে নিচ্ছি কোকা-কোলা ও বরফ জল মিশিয়ে ঠান্ডা করে। বেশ ফুরফুরে লাগছে। এই মাত্র কাজুবাদামের প্যাকেট এসে গেল। কাঠ বাদাম খাচ্ছি। হাবড়ায় থাকতে কাজুবাদাম খেয়েছি-নতুনত্ব কিছুই পাচ্ছি না।

বাইরের তাপমাত্রা ১৪ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড অর্থাৎ ৭৭ ডিগ্রী ফারেনহাইট। মুম্বাই ছেড়ে যতই পশ্চিমের দিকে যাচ্ছিঠান্ডার তীব্রতা কিন্তু বেশী বৃ্দ্ধি পাচ্ছে। যখন মুম্বাই ছেড়েছিলাম তখনও বেশ গরম লাগছিল। গায়ের কোট খুলে সীটে বসেছিলাম।

কিন্তু মুম্বাই ছাড়ার ঘন্টাখানেক পরেই শীতের তীব্রতা অনুভব করছি। এয়ার হোস্টেসকে ডেকে কম্বল আনিয়ে নিয়ে বার দুয়েক কোকাকোলা ও কাজুবাদামের সৎ্কার করে ডাইরী লেখার উৎসাহকে দ্বিগুণ করে নিলাম।

জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇

স্থানীয় সময় রাত ৩টেয় কুয়ে বিমানবন্দরে পৌঁছালাম

এখনকার বর্ণনা কুয়েত বিমানবন্দরে অবস্থানরত আমার প্লেনের মধ্যে বসেই লিখছি। আকার ও আয়তনে কুয়েত বিমানবন্দর বেশ বড়। এখান থেকে যা দেখছি যেটুকু আঁচ করছি তাতে মনে হ্য় আমাদের দমদম বিমানবন্দরের চেয়ে কুয়েত অনেক বড় আকার-আয়তন ও পরিস্কার পরিচ্ছন্নতায় খুব পরিপাটি

কিছু যাত্রি কুয়েত বিমানবন্দরে নেমে গিয়েছেসংখ্যায় তারা ৫০ জনের মতই হবে। কুয়েত বিমানবন্দরে আমরা একঘন্টা হল্ট করব। তারপর আবার যাত্রা শুরু হবে রাত ৪টে(এখানকার স্থানীয় সময়নাগাদ। যাত্রীরা এখনও অনেকেই নিদ্রামগ্ন। আবার রসিক পাগলপরিবেশপ্রেমিক যারা তারা দুচারবার চোখ রগড়াতে রগড়াতে কুয়েত বিমানবন্দরকে পর্য্যবেক্ষণ করছে।

আমার এ পর্যন্ত যাত্রা নির্বিঘ্নেই হয়েছে। মানসিক কিংবা শারীরিক উত্তেজনা কিছুই বৃ্দ্ধি পায় নি। সমস্তই স্বাভাবিকভাবে কাজ করেছে। তবে প্লেনের মধ্যে এসে বেশ কিছু পরিমাণ জলের “ইনপুট'” হওয়াতে দুবার ইউরিন্যালে ছুটেছিসেটা অবশ্য কোন ভয়ে বা উত্তেজনার জন্য নয়একমাত্র স্বাভাবিক কারণেই। আবার চোখের পাতা জুড়ে আসছে। মনে হচ্ছে একটু ঘুমিয়ে নিই। জুতোটা পায়ে থাকায় বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল বিশেষ করে সীট এ বসে ঘুমানোর চেষ্টা করায়। কিন্তু পরে দেখলাম পায়ে মোজা থাকা সত্ত্বেও বেশ শীত লাগছে। তবুও ঘুমাতে হবে চিন্তা থাকায় জুতোটা না পরেই বসে আছি।

ওই রে তরী দিল খুলে !

কুয়েতের পর রোমের পথে

এবার রোমের পথে যাত্রা শুরু। কুয়েত থেকে রোমের দূরত্ব ২৩২৫ মাইল কিংবা ৩১০০ কি.মিটার। এই পথ আমরা পরিক্রম করব ৫ ১/২ ঘন্টায়। কুয়েত সময় এখন রাত ৪টা। আমাদের প্লেন একঘন্টা বিশ্রাম নিয়ে ও নতুন কিছু যাত্রীকে গ্রহণ করে কয়েক মুহূর্ত্তের মধ্যেই কুয়েত বিমানবন্দরের মাটির স্পর্শ ত্যাগ করে উড়তে শুরু করবে। এখনো কুয়েত বিমানবন্দরের মায়া কাটাতে পারি নি।

কোমরের বেল্ট বেঁধে নিয়েছি। এখন প্রচন্ড ঝাঁকুনি হচ্ছে। পারিপার্শ্বিক যাত্রীরা অনেকে নাক ডাকতে শুরু করেছেন। দূরে সারি সারি আলোর তীব্রতা অনেক পরিমাণে বৃ্দ্ধি পেয়েছে। কুয়েত বিমানবন্দরকে মনে মনে বিদায় জানিয়ে আকাশে উঠে গিয়েছি। এবার একটানা সাড়ে পাঁচঘন্টার যাত্রা শুরু হল রোমের পথে। প্লেনের গোঁ গোঁ আওয়াজটা বেশ কানে লাগছে কারণ কান কটকট শুরু করেছে। শীতের তীব্রতা যেন ক্রমশই বাড়ছে। অন্ধকারে কেবলমাত্র দূর অন্তের আলোছাড়া আর কিছুই এখন দেখতে পাচ্ছি না। কাজেই তাদের বর্ণনা দেওয়ার চেষ্টা করা বাতুলতা মাত্র। কম্বল মুড়ি দিয়ে জড়সড় হয়ে সীটে বসে আছি বাইরের দৃশ্য দেখবার জন্য। যাত্রা নির্বিঘ্নেই হোক এই প্রার্থনা ভগবানের কাছে জানিয়ে দিলাম। আপাততঃ আবার ঘুম দেওয়ার চেষ্টা করছি। কারণ চোখের পাতা কিছুতেই খুলে রাখতে পারছি না। কুয়েত ছেড়ে দিলাম ৪-২০ রাত।

এর মধ্যে বেশ একটা ঘুম দিয়ে নিলাম। প্রথম প্রথম ঘুম আসছিল না কিন্তু তারপর হঠাৎ কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। মুখের টফিটা কখন খেয়ে ফেলেছি কে জানেজানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাবার চেষ্টা করলাম।

নীচের দিকে তাকালে মনে হয় নীল ঘাসের আস্তরণকুয়াশা আবরণে ঢাকা। দেখতে দেখতে সময় যতই কাটছেরাত ফুরিয়ে দিন চলে আসছে। সূ্র্যিমামার আবির্ভাব বেশ বুঝতে পারছি । নীচের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে যেন চারিদিকে পাহাড় বরফে ঢাকা। তার উপর সূর্যের আলো পড়েও মাঝে মাঝে কুয়াশায় ঢাকা থাকায় খুব সুন্দর লাগছে। এখন আমরা মেঘের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। আকাশের বিভিন্ন রং রামধনুর সৃষ্টি করেছে। মন খুব উদাস উদাস লাগছেকিন্তু ভীষণ ভাল লাগছে। মানসিক কোনই ভয় বা কষ্ট আমার হচ্ছে না।

মাটি থেকে এখন ঠিক কতটা উপরে আছি বলতে পারব না। কারণ নীচের দিকে তাকালেই মনে হয় ফু্ট পঞ্চাশ উপরে আছি কিন্তু তাতো নয়। দিনের আলো ক্রমশই প্রকট হয়ে উঠছে। চোখ রগড়াতে রগড়াতেই এয়ার হোষ্টেস এসে “এক্সকিউজ মি” বলে ঘুমটাকে তাড়িয়ে দিল। ভালই হল ঘুম ভাঙতেই হাতের কাছে পেলাম ফ্রুট জুস সম্ভবতঃ কমলালেবু। এখন এয়ার হোষ্টেসদের মধ্যে হুড়োহুড়ি চলছে ব্রেকফাস্ট সার্ভ করার জন্য। নিজেকে বেশ “হিরো” “হিরো” লাগছে। আমি প্লেনের সিটে বসে যা অর্ডার করছি মুহূর্তের মধ্যে সেগুলো হাসিমুখেই চলে আসছে।

জানি না কোথাকার কোন বাদশা হয়ে গেলাম কি নাঅন্ততঃ মুহূর্ত্তের জন্যেও তো ভাবখানা তাই মনে হচ্ছে। এতক্ষণ ঠান্ডাটা উপলব্ধি করতে পারছিলাম না। জানলার বাইরে তাকাতেই এয়ার হোষ্টেস এসে আমার গায়ে দেওয়া সিল্কের নীল রঙের র‍্যাপারখানা ভাঁজ করে গুছিয়ে বাঙ্কের উপর তুলে দিল। যাককাজটা আমাকে করতে হল না। হাতের আঙুলগুলো এখন বেশ ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে তবুও ভয় পাওয়ার কোনই কারণ নেই ঠান্ডার ব্যাপারে। প্লেনের ভেতরকার পরিবেশ এতই সুন্দর ও মনোরম তার উপর সীটে বসে ফরমাস আদায় করা-নিজেকে বাদশা বলে ভাবতে ইচ্ছা করে। এখন জানলার বাইরের ছবি আরও পরিষ্কারস্বচ্ছ হয়ে উঠেছে। বাইরের দিকে তাকালে মনে হচ্ছে কোনো ধুনুরী যেন তুলো ধুনো করে সমস্ত যায়গায় বিছিয়ে রেকেছে। শীতপ্রবণ দেশ তো। হয়তো -লেপ-তোষক বানাবে। বাইরের এই মোহময় ও মনোরম পরিবেশ মনকে এমন সুন্দরভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছে তা বলার নয়। এই ভাব প্রকাশের ভাষা আমার নেইনেই অন্যের সংগে এই আনন্দোচ্ছ্বাসের অংশীদার হওয়া।

ভারতবর্ষ ত্যাগ করার আগে যে কষ্ট হবে মনে হচ্ছিল তার কিছুই তো টের পাচ্ছি না। দিগন্তবিস্তৃত নিঃস্তব্ধ পরিবেশ যেটা আমার একান্ত প্রার্থিতসেটা সত্যি আজ পাচ্ছি। আমার বাঁদিকের সীটে জাপানীজ(R.R.Hejeebu, Lafayette Neal, Grand Rapids, Michigan 49503, USA) ভদ্রলোকের সংগে দু-চারটে কথাবার্ত্তাও হয়েছে এবং হচ্ছে। আগেই বলে রাখছি ভদ্রলোক দুজন আমার এই যাত্রাপথের বিবরণী চেয়েছেন এবং ডাইরীর (একখানাশেষ দিকে নিজের হাতে তারঠিকানাও লিখে দিয়েছেন।

বাংলা ভাষায় ডাইরী লিখছি দেখে উৎসাহী গলায় আমাকে জিজ্ঞাসা করলেনঃ “মে আই এ্যাস্ক হোয়াট ল্যাংগুয়েজ ইস দিস?”

আমিও গর্বের সংগে জবাব দিলাম, ”দিস ইজ মাই মাদার টাং-বেংগলী।

-হা মেনি এ্যালফাবেটস আর ইন ইয়োর মাদার টাংপ্রশ্ন করলেন তিনি।

-ফিফটি টু এ্যালফাবেট ।”-আমি হাসতে হাসতে বললাম।

-ও মাই গড!

তিনি হেসে উঠলেন। আমাদের গল্প বেশ জমে উঠেছে।

আমার পাশে ডান দিকে -এর সিটে বসে গল্প শুনছিলেন তিন জন যাত্রী

) Elizabeth Mesfin

P O Box 955,

Addis Ababa, Ethiopia;

2)Kenji Inoue, 3-12-15

Shirokane Minato-KU,

Tokyo, Japan 108 ,

Home Phone: 03441-5678;

3)Mr. Wesley Waage,

President of Rotary Club and Fergus Falls Community College,

1039 West Summit,

Fergus Falls, Minnesota 56537, USA

ক্রমশঃ

Post a Comment

2 Comments

  1. চমৎকার স্বাদ

    ReplyDelete
  2. Then what happened, as if the aircraft has suddenly stopped!

    ReplyDelete