জ্বলদর্চি

বাগদি চরিত (নবম পর্ব)/শ্রীজিৎ জানা

বাগদি চরিত  ( নবম পর্ব)

শ্রীজিৎ জানা


ভগীরথ খুড়ার কথাটা লোখার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। টুকরো টাকরা কথাতেই লোখার মন বড় উতলা হয়। শিঙাকুলের কাঁটায় আটকে পড়া ছোট্ট হলদেগুঁড়ি পাখির মতো মনটা তার ঝটপটায়। মন্দির তৈরী করতে সে  তো বাধা দিতে চায়নি। নায্য  কথাই  বলতে চেয়েছে। পাঁচ ভাইয়ের ভিটে। সবার মন তো সমান নয়। সে মেনে নিলেও অন্য ভাইয়েরা মানবে কেন। আজ না হোক কাল এই নিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে বিবাদ বাধবেই। কিন্তু আবার  ওই যুক্তিটাও তো ফেলে দেওয়ার মতো নয়। বাকি তিন ভাইয়ের মত -অমতের বিষয়ে  তার বলার অধিকার কতটুকু। ছোট বেলায় শিলাই পাড়ে খয়রা গাছের তলায় সাতভাই পাখিদের দেখিয়ে লোখাকে তার বাপ বলত,
—--দেখ রে লখি, অ্যাদের বলে সাতভেয়া পাথি। সাতজনেই মিলেমিশে থাকে সারাখন। কাউচাকাউচি কল্লেও এক সঙে থাকে। তরাও অদের মত একসঙে থাকবি, বুইলু। 
কিন্তু তারা একসাথে থাকতে পারেনি। লোখা নিজেকে নিজেই দোষারোপ করে। সেদিন ওইভাবে রাগান্বিত না হলেই সে পারত। লোখার স্থির বিশ্বাস শুধু  ভগীরথ খুড়া নয় গ্রামের অনেকের কানেই তার দাদা বৌদি কথাটা তুলেছে। মন্দির তৈরীতে সে বাধা দিয়েছে। বৌদিকে লোখা ভালমতো জানে। ইনিয়েবিনিয়ে তিলকে তাল করে কান ভারী করতে পাড়ায় তার জুড়ি নেই। দাদাও তার কম যায় না। বাড়িতে তার  সবদিন কেউ না কেউ জন্ডিস,রিকেট,হাওয়া লাগা, ল'য়ে ছুঁয়ার রোগ নিয়ে হাজির হয়। খুদা কথায় কথায় তার মনসা মন্দিরের প্রসঙ্গ তাদের কাছে তুলবেই। এইসব সাতপাঁচ যত ভাবতে থাকে মনটা ততই তার ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। পাঁচ দশটা গ্রামে ঘুরে বেড়ায় সে। হরিবাসরে,শীতলামঙ্গল পালায় তার বাঁশি শুনে বিভোর হয়ে যায় লোকজন। অনেক সময় গায়েনকে ভুলে তার বাঁশির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠে গানের আসর। গুনমুগ্ধ শ্রোতারা দশ বিশ টাকা পুরস্কার তার জামায় সেপটিফিন গেঁথে ঝুলিয়ে দ্যায়। গানের গলাও তার নেহাত মন্দ নয়। বাঁশি ফুঁকার মাঝে মাঝে তাকে গানের ধুয়াও দিতে হয়। 
মাঠের আল ধরে আনমনেই হাঁটা দ্যায় লোখা। মাথার ভিতর এইসব কথা থেকে থেকে হুল ফোটায়। ভাবে আজ সন্ধ্যায় খোলঘরে নিশ্চই এই কথা উঠবে। রাধাবল্লভপুর থেকে আসে গৌর দাস। শীতলামঙ্গল পালাগান আর নামসংকীর্তন দলের অধিকারী সে। গৌর দাস জাতে বৈষ্ণব। দলের সবাই তাকে শ্রদ্ধা ভক্তি করে। আহা রে,কি প্রাণ জুড়ানো তার গানের গলা।শীতলামঙ্গল গানের আসরে গৌর দাস যখন একবার বিরাট রাজা,একবার রানী সুদেষ্ণার চরিত্রে সংলাপ বলে গোটা আসর মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনে। দুই চরিত্রের জন্য দু'রকম গলায় সে সংলাপ বলে।  ছেলে হারানো সুদেষ্ণার বুকফাটা কান্না যখন গৌরদাস কাঁদে, আসরে মেয়েদের চোখ ছাপিয়ে কান্না নামে। বাঁশি বাজানোর ফাঁকে লোখা হাঁকরে তাকিয়ে শুনে। তারও চোখ ছলছল করে।
 ধানখাল থেকে আসে হরিপদ। সে ডাইনের খোল বাদক। বাঁয়ে বাজায় ঢোলের আনন্দ। হরিপদের হাত জলের মতো চলে। আনন্দের বাজনা অঙ্কের হিসেবে। হরিবাসরে বাবরি চুল ঝাঁকিয়ে দুজনে যখন বাঘঝাঁপ দ্যায় আসর গমগম করে। মুখে কথা বলে আর আঙুলে তার বোল তুলে। হরিধ্বনিতে বাসর মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। আনন্দ-হরিপদ জুড়ি তাদের দলের মেইন আকর্ষণ।  এদের কাছে আজ নিশ্চই তার কথা উঠবেই। আনন্দ লোখার গ্রামের লোক। তার সম্বন্ধে আনন্দ অনেকটাই জানে। হরিপদ তার জাতভাই হলেও, সে দূরের গ্রামের। কাঁসাই পেরিয়ে আসে। সবাই তাকে হয়তো ভুল বুঝবে। লোখার আত্মসম্মানে লাগবে। কিন্তু তার ভিতরে একধরনের পাগলামো কাজ করে। কোন অন্যায় চোখের সামনে দেখতে পারে না। গর্জে উঠে। এর জন্য কতবার তাকে ঝামেলায় পড়তে হয়েছে। ময়না তাকে পই পই করে নিষেধ করে, 
—বাইরের কুঁদুল ঘরকে ডেকে এনো নি, তুমি। কত কথা শুনতে হয় পাড়ার লোকের কাছে—তুমি সেটা জান?
অথচ লোখা কিছুতেই নিজেকে সামলে রাখতে পারে না। বলে,
—তুই মেইয়া মানুষ, ঠিকই বোলচু। কিন্তু আমি ত  চুপ থাকতে পারিনি। তাবাদে খগেন মাস্টারের কাছে অন্য কথা শুনেছিলম,জানু। বাগদিকে বগ্গখত্তিয় বলে,শুনুনু। খত্তিয়রা রাজার জাত!খত্তিয়দের গায়ে ভগমান রাজরক্ত দিছে। রাজার মতো দাপট হবে তাদের। মুখ বুজে সইবেনি তারা কিছু। পয়োজনে লড়াই করবে শত্তুর সঙে। জান দিবে তবু মান হারাবেনি।
—-সেই লিয়ে কি কিছু হলে মোদের জাতের লোকেরা আগে লাঠি তাড়া লিয়ে এগি যায়।
—-নিশ্চই। বাগদিরা ছাড়া কারা যাবে? কায়েত বামুন মাহিষ্যরা ত পঁদে মুতা জাত। গন্ডগোল দেখলেই সবার আগে সটকে পড়বে।
—-অরাই চালাক, বুইলে ত। তমাদের এগি দিয়ে অরা পিছনে থাকে। মাথা ফাটে তমাদের। আর শেষকালে নিজেদের আখেরটা অরা গুছি ল্যায়।
—-লিউ না অরা। কি হবে তাতে! বাগদি যদিন বাঁচবে এম্নি করেই বাঁচবে। অভাবের কাছে মাথা নুয়াবে, অন্যায়ের কাছে নয়। বাপ বোলতো বাগদির একটা হাড় বেশি। আর সব জাতের দু'শ ছটা কিন্তু মোদের দু'শ সাতটা। মোদের মুখ চলে বেশি,হাতও চলে বেশি। খাইও বেশি,খাটিও বেশি।
—তমার সঙে কথায় কেউ পারবেনি। খগেন মাস্টারের সঙে থেকে থেকে চাট্টি কথাই শিকেচ শুদু।
ময়না তর্ক আর বাড়ায় না।  স্বামীকে তার বদলানো যে যাবে না, ময়না তা ভালো করেই জানে।

শিলাবতীর পাড়ে হিজলের বন। কালসাবার মাঠকে সামনে রেখে সূর্য লুকোচ্ছে হিজল বনের আড়ালে। দিনের শেষ আলোটুকু ছড়িয়ে দিচ্ছে মাঠময়। পাকা কুমড়োর মতো রোদের রঙ। কৃষ্ণচূড়া গাছের মাথায়,আকাশমণি গাছের চিকন পাতায় রোদের আভা খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। ডোবরি বিলের জলে  বিকেলে যেন কারা হলুদ গোলা জল ঢেলে দেয়। সোনার মতো তার জল ঝিলমিলিয়ে ওঠে। অমন নরম রোদের আঁকিবুকি, ডোবরি বিলের সাজগোজ,কালসাবার রোদরাঙা রূপ লোখা তন্ময় হয়ে দেখে। মাঠের পশ্চিমে ডগরা আর কারফার পাড়া পেরোলেই গঙ্গতলার ঘাট। ঘাটের উত্তর পাড়ে বুড়াই হানার চর। ঘাটতলা পেরিয়ে কয়েক পা এগোলেই হিজলতলার ছায়া। বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ মাসে হিজলের মাথা ভরে থাকে থোকা থোকা বেগুনি ফুলে। হিজল ফুলের গন্ধে ভরে থাকে চারপাশ। শিলাই পাড়ের এই হিজল তলা লোখাকে বড্ড টানে। গাছ তলায় বসে বিকেলের আলোর লুকোচুরি দেখে। কালসাবার মাঠ ঝাঁপিয়ে বয়ে আসে দখিনের বাতাস। শীতল বাতাসের আদর দু'চোখের পাতায় ঘুম নামিয়ে আনে।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
এখন তেমন কাজ থাকে না লোখার। কালসাবার মাঠে দু'বার ধান ছাড়া আর কিছুই হয় না। ভিটের গায়ে যেটুকু কালা জমি, তাতে তিল আর বাদাম হয় এই সময়ে।  মাঠে বিলের ধারে জমিতে অনেকেই শলাধঞ্চা বুনে দেয়।  কদিনেই পাট গাছের মতো ঢ্যাঙা হয়ে মাথা দোলায় ধঞ্চার বন। বর্ষা নামার আগে শলাধঞ্চা কেটে শুকনো করে ঢোলের মেয়ে বউরা। ধঞ্চাকাঠির  আঁটি বেঁধে তুলে রাখে রান্নাচালার পাড়নে।  গোয়াল ঘরের চালায়। ঘরের পিছনে ঝিটচালের আড়ালে। ঝড়বাদলার দিনে শলাধঞ্চায় জ্বালানির সুরাহা হয়।লোখা তেমন চাষবাস করে না। বাপের জমির পাঁচ অংশ। আগে তিন ভাইয়ের জমি চাষ করত লোখা। সেই নিয়েও খুদার সঙ্গে ঝগড়া বাঁধে।লোখা সবার সথে মিলেমিশে থাকতে চায়। মেজ সেজ সান  তিনজনের জমি আগে লোখা চাষ করত। তাদের অংশের জমি চাষ করলেও ভাগ দিয়ে দিত সে। তাদের ভাগের ধান মজুত করে রেখে দিত কোরইয়ে। মেজর ধানে চাল তৈরী করে দিয়ে আসত।মেজ দাদা অভিরাম বিডিও অফিসে চাকুরী করে। ঘাটালে বাড়ি করে থাকে। লোখার মা বেঁচে থাকতে সে গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। আগে ভাড়া বাড়িতে থাকলেও এখন জায়গা কিনে বাড়ি করেছে। লোখার সেইদিনের কথা মনে পড়লে চোখের পাতা ভারী হয়ে ওঠে। তখন বাড়িতে রোজগেরে বলতে তার মেজ দাদাই ছিল।খুদা অনেক আগে থেকেই ভিন হয়ে যায়। লোখার মা মেজ ছেলেকে অনেক করে আটকাতে চায়। অভিরাম মায়ের কোন কথাই কানে তোলে না। বিশেষ করে অভিরামের বউ। শ্বাশুড়ির মুখের উপরে সাফ জানিয়ে দ্যায়,
—-এই বেগদা পাড়ায় থাকলে মোদের ছেলেমেয়েরা মানুষ হবে নি। তাছাড়া সবার হাঁড়ি তমার মেজ ছেলে একা টানতে যাবে কেন!
—--তুমিও ত ওই জাতেরই মেইছ্যানা বৌমা। এই পাড়ায় মোর ছ্যানারা কি লেখাপড়া শিখেনি!
—--এক জাতের হলেও ঢের তফাৎ আছে। তমাদের এখিনের মত এত পচলাপচলি,কাউচান মোর বাপের ঘরে হয়নি। তমার ছেলে ঘরে দুটা ভাল লোকজন ডাকতেও ভয় পায়।
লোখা দেখত তার মায়ের সাথে বৌদির তর্কাতর্কি হলে তার দাদা পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকত। লোখা বুঝতে পারত তার দাদাও গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে চায়। শরীর থেকে গ্রামের গন্ধ মুছে ফেলতে চায়। লোখা জানে একা তার দাদা নয়, তাদের জাতের অনেকেরই মনে এই ব্যাধি বাসা বাঁধছে। নীচু জাতের অপবাদকে ঝেড়ে ফেলে দিতে চায় তারা। শহরের উঁচু জাতির লোকজনদের সাথে মিলেমিশে নিজেকে উচ্চস্থানে নিয়ে যেতে চায়।  দাদাকে লোখা ভয় করে,শ্রদ্ধা করে। মুখের উপরে কিছু বলতে পারে না। শুধু অনুভব করে এই স্বজাতকে হীন ভেবে তার কৌলিন্য মুছে ফেলার রোগ ক্রমে বাড়ছে,আরো বাড়বে। শিক্ষিত বলে যারা জাহির করে তারাই এই ভয়ঙ্কর রোগের স্বীকার হচ্ছে দ্রুত। লোখা এই ভয়ানক রোগ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখবে বলে মনে মনে পণ করে।
অনেক পরে কথায় কথায় লোখা  একবার খগেন মাস্টারকে জিগ্যেস করেছিল,
—-মাস্টার তুমি অত পড়াশুনা কল্লে, চাকরি কর। থাইলে তুমি কেন মোদের দাদাদের মত গ্রাম ছেড়ে গ্যালেনি। ডুবাহাজা গ্রামে পড়ে রইলে। তমার মত বকা হাবা লোক জম্মে দেখলম নি!
—-তুই কি বলতে চাউঠু জানি রে। কিন্তু সবাই তোর দাদাদের মত হবে, সেটা ভাববিই বা ক্যানে! তবে মোদের জাতের ছ্যানাদের মধ্যে গ্রামছাড়া রোগ সত্যিই দেখা যাইঠে রে। বাগদির ছ্যানা চাকরি পেলেই বামুন সাজতে চায়। সাজাটা দোষের নয় জানু,শুধু কষ্ট হয় যখন নিজের জাতকে,স্বজাতির লোককে না চেনার ভান করে। লোকের সামনে নিজের জাতের পরিচয় দিতে লোজ্জা পায়। কিন্তু  নিম গাছের গড়ায় মধু ঢাললে নিম ত তিতাই হবে মিঠা ত হবে নি।
—-- আচ্ছা মাস্টার,কেন আমরা নিজেদের জাতকে লিয়ে গব্ব কত্তে পারিনি,বলতে পার?
—--জাতটার ঐতিহ্য সম্বন্ধে কেউ কিছু জানেনি রে। শুদু বাইরের আচার-বিচার দেখে ছোট জাত বলে বেড়ায় সকলে। আর তাতে মোদের জাতের কিছু নামধারী শিক্ষিত লোক আছে,তোর দাদাদের মতো, তারা আস্কারা দেয়। আর তাদের কি দোষ দুব! মোর এক কলেজের প্রফেসর। বীরভূমে বাড়ি। নাম প্রশান্ত বাগদি। জাতেও বাগদি। কিন্তু নামের সাথে বাগদি পদবী তার আত্মসম্মানে লাগছিল। তিনি নাকি সমাজে হেয় হচ্ছিলেন পদে পদে। তাই কোর্টে বাগদি পদবি বদলে বাগচি করে নেন। এবার বুজ রে লোখা এই জাতকে সম্মান করবে কে বা কারা?


Post a Comment

0 Comments