জ্বলদর্চি

কালের অতল তলে কলোরাডো -৪/চিত্রা ভট্টাচার্য্য

কালের অতল তলে কলোরাডো -৪ 
  
চিত্রা ভট্টাচার্য্য        

কলোরাডোর পথে 

   ''পথের শেষ কোথায় ,কী আছে শেষে ! '' নীরবে মনের মাঝে  প্রশ্ন রেখে যাচ্ছিলো অন্তহীন পথে চলার ডাক।  লাল কাঁকড়ের  রাঙ্গা ধুলো উড়িয়ে দুই পাহাড়ের বুকে ঝড় তুলে অসীমের আনন্দ ধারায় মসৃণ কালো রাস্তায় পিক আপট্রাক টি  অন্যান্য বিশাল বড়ো গাড়ি গুলোর সাথে পাল্লা দিয়ে অবিরাম ছুটছে তার  নির্দিষ্ট গতিতে। পারভীন মিঠে গলায় গুনগুনিয়ে গাইছে  Take Me Home, Country Roads ..to the place.i belong.....John Denver এর  সেই বিখ্যাত রোমান্টিক গান। পৃথিবীখ্যাত গায়ক হয়তো সে সময়  কলোরাডোর এই পথে নিরুদ্দেশের পথিক হয়েছিলেন। ইয়মের মাউথঅর্গান ও  ঠিক সুরে সংগত মিলিয়ে বেজে উঠেছে। উদাসী পথের টানে ঘর ছাড়া পথিক যেমন পাগল হয়ে ছুটে মরে, তেমনি বুঝি একসময় ক্লান্ত মন কে ঘরের নিভৃত কোণের নিরালায় আসন খানি পেতে শান্তিতে বসতে ও সস্নেহের  ইশারায় ডাকে।                                                                                                                 ভাগ্যের অন্বেষণে বিদেশে চাকরিতে এসে বহুদিন ধরে ঘরে ফেরা হয়নি এই প্রবাসী ছেলে মেয়েদের। ওদের কথোপকথনে  শুনতে পাচ্ছিলাম দিশেহারা মনে ঘরের নিভৃত কোণটিতে ফেরার তীব্র বাসনা। বিশেষ করে পাভলোর সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে ইয়মের পোল্যান্ডের গ্রামের সেই ছোট্ট কাঠের বাড়ি ,মা,অসুস্থ বোন বাবা ব্রাইসের সবুজ ফসলে ভরা ভুট্টার চাষের  ক্ষেতের দৃশ্যটি চোখের পাতায় ভেসে ওঠে।  ইয়াম ,পারভীন কে যত দেখছি তত বিদেশিনী দের সম্বন্ধে ভ্রান্ত ধারণা পাল্টে যাচ্ছে। এমন মানসিকতার সাহসী পদক্ষেপ ,সাবলীল চলা ,ঘরে বাইরে পরিশ্রম ,ও কর্ম দক্ষতা বিস্মিত করে।  এক অদ্ভুত বাতাবরণের সৃষ্টি হলো এই  অন্তবিহীন অজানা পথে।      আমার শ্রবণেন্দ্রিয় ওদের কণ্ঠ নিঃসৃত সুরেলা গানের স্রোতে ভাসলেও চোখ ছিল জানালার বাইরে। রুক্ষ পাথুরে জমির ওপর-- মাইলের পর মাইল এক ভাবে দ্বিপ্রহরের উজ্জ্বল নীলাম্বরী  আকাশ টাকে উদ্ধত মাথা তুলে ঢেকে দিয়ে এগিয়ে চলা আদিগন্ত বিস্তৃত তামাটে বর্ণের রুক্ষ মরু পাহাড়ি সাম্রাজ্যের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে অন্য কাজে মন দেওয়া আমার পক্ষে তখন অসম্ভব। নিরন্তর জপ করে  চলেছি '' কঠিনেরে ভালোবাসিলাম ,সে কখনো করে না বঞ্চনা ''। কোলের ওপর অভ্যাস মত খোলা ছিল কোনো এক ভূগোলবিদের কলোরাডো নদীর ওপর বিস্তর তথ্য সমৃদ্ধ আলোচনা। ছাপা ছবিতে , কালির আঁচড়ে মুদ্রিত সেখানে দেখেছিলাম কলোরাডোর জন্মের উৎস তারই বর্ণনার রোমহর্ষক ইতিবৃত্ত।  

বহু কোটি কোটি বছর  আগে রকি মাউন্টেন ন্যাশানাল পার্কের পাথুরে পাহাড়  লা -পাউড্রেপাস নামক পর্বত মালার গিরি শৃঙ্গ থেকে কলোরাডো নদীর উৎপত্তি  শুরু হয়েছিলো। এই হ্রদ টির উচ্চতা প্রায় 9000 ফুট। নদীর উৎসমুখ থেকে পাহাড়ের  দুই পাড়ে তামাটে হরিদ্রাভ নানা বর্ণের মাটি চারদিকে   ছড়িয়ে আছে। পাথুরে মরুভূমির অপার ধুধু  শূন্যতা তারই মাঝে টলটলে নীল জলের ধারা বুকে নিয়ে   গিরিখাদের নীচে বয়ে যাওয়া কলোরাডো নদী টি  ২,৩৩৪ কিলোমিটার পথ ভ্রমণের পর কর্টেজ সাগরে মিশে  গিয়েছে। আদি অনন্ত কাল ধরে উদ্দাম নদীর গতি টি যে অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে গিয়েছে, একবার ও পিছনে ঘুরে তাকায়নি সেই অঞ্চল টিকে ক্রমশঃ ক্ষয় করে নীচের দিকে নত করে নমনীয় ও প্রভাবিত করে ফেলেছিল।                                                                                                                       
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
গিরি খাদ খন্দরে ভরা ,তামাটে রক্তবর্ণের পাহাড়ের গা বেয়ে ঝর্ণার পাথুরে জমি ভিজিয়ে নদীর থিরথিরে  নিঃশব্দে গড়িয়ে চলা দেখে ,বন জঙ্গলের অকৃত্রিম সাজে সজ্জিত প্রকৃতির লীলা ভূমি ইউটার পথ শেষ হলো । অতনু ম্যাপে চোখ রাখতেই ব্রতীন বলে এসে গিয়েছি আরিজোনা তে। এখান থেকেই কলোরাডো নদী তার স্বয়ং সৃষ্টি অশ্বক্ষুরের আকৃতির দ্বীপ টি পেরিয়ে ' আপন হারা মাতোয়ারা' বেগে বয়ে যাচ্ছিলো দক্ষিণে। চারদিকে উজ্জ্বল রোদের আলোয় ধূসর পাহাড় , ঝিরঝিরে ঠান্ডা হাওয়া বইছে। ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৭০০ ফুট উঁচুতে এক গিরি  খাদের ওপর আমরা পাথুরে গড়ানে পথে স্বল্প বিরতিতে গ্র্যান্ডক্যানিওনের ধারে কয়েক পা মাত্র ফেলেছি , কাছেই  আলাপ হলো ন্যাশানাল জিওগ্রাফি চ্যানেলের ফটোগ্রাফার ভার্জিনিয়ার ভৌগলিক পলসন সাহেবের সাথে,--মিশুকে সাহেব  কলোরাডো নিয়ে নানা প্রশ্ন  জমে উঠেছিলো ,সাহেব কে পেয়ে নিমেষে গল্পে মত্ত হয়ে উঠলো ব্রতীন ,অতনুর দল। আমি নির্বাক শ্রোতা।                                                                                                                         খাদের নীচে তাকিয়ে দেখি স্বচ্ছ জলরাশি গিরিখাদের খুব গভীরে নীচুস্থান দিয়ে উঁচুনীচু পথ পেরিয়ে আঁকাবাঁকা হয়ে বেশ কয়েক মাইল পার হয়ে চলেছে। কলোরাডোর শুকনো ধারা এখানে দুই গেরুয়া পাহাড়ের ফাটলের মাঝে কিছুটা যেন সজীবতা পেয়েছে। পলসন সাহেব বললেন , ইউটার শেষ প্রান্তে এ নদীর দেখা হলো লেক পাওয়েলের সাথে। মনে হবে দুই সখীর মিলনের পর গভীর অনুরাগে দুজনেই প্রাণের আবেগে থরথরিয়ে কেঁপে এবড়ো খেবড়ো পাথর ডিঙিয়ে কখনো বা তার তল দিয়েই এগিয়ে চলেছিল সাগর সঙ্গমের অভিসারে। আচমকা পরিবর্তনের স্রোতে ভেসে অসংখ্য বাঁক নিয়ে সে তখন খলখলিয়ে হেসে ছলাৎছল শব্দে মুখরিত। সদ্য কুমারীত্বের গন্ডি পেরিয়ে তার চঞ্চল ধারা নিয়ে নতুন পথের  ঠিকানায়  শাখা প্রসারিত করেছিল মেক্সিকোর পথে।                                                                                                                     কিন্তু ভাগ্য বিরূপ ! এখানে তার স্বাভাবিক চলার স্রোতে প্রথম বাঁধা  দিয়েছিলো প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ সন্তান এই মানব সভ্যতার অগ্রগতি। কৃষির ফলন আর বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ানোর প্রয়াসে মানুষ তার আপন স্বার্থসিদ্ধির জন্য নদীর চলার গতিপথে বাঁধা হানলো। তার উদ্দাম চলায় বাঁধা দিলে সে উদ্ধত রোষে মিশেছিল ইউটা আরিজোনার বর্ডারে এন্টিলোপ আইল্যান্ডে এবং সৃষ্টি করে ছিল  বিশ্বখ্যাত দর্শনীয় স্থান গ্রান্ডক্যানিয়নের। সময়ের সাথে নদীটি  ছোট ছোট meanders এবং গিরিখাত গুলোর গঠন করে আপন বেগে দুর্বার গতিতে ভেঙে চুরে গুড়িয়ে নিজের পথ পরিবর্তন করে চলার শুরু করে। ক্রমশঃ ঐ খাত গুলো আকারে বৃদ্ধি পেতে থাকে। এর উৎস থেকেই প্রথমে মাত্র ১.,৫কিমি দূরে বেশ কয়েক বছর ধরে এক অগভীর গ্র্যান্ডক্যানিয়ন তৈরী হয়েছিল। এখানেও উন্মত্ত নদীর পাগল পারা রূপ আপন কক্ষ পথ থেকে সরে গিয়ে সম্পূর্ণ পাথুরে মরুভুমির অঞ্চলের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। সাহেব যেন  জিওগ্রাফি ক্লাসের লেকচারার , আমরা মুগ্ধ শ্রোতা। আমার নোটবুকে  পেন্সিল চলছিল দ্রুত।                                                                                                    পৃথিবী সৃষ্টির লগ্নে সেই আদি থেকে আদিতর যুগ আগেই কলোরাডো নদীটি অঙ্গাঙ্গিক ভাবে জড়িয়ে আছে  মার্কিনী আবেগ ,সভ্যতা সংস্কৃতি , শিল্প সাহিত্য চর্চার সাথে। তার উন্মত্ত প্রবাহের চলার সাথে তাল মিলিয়ে এই মহাদেশের নদীর সংলগ্ন অপরূপ প্রাকৃতিক পাহাড় গুলো ধীরে ধীরে জেগে উঠেছিলো। আমেরিকার পশ্চিমাঞ্চল আরিজোনা, নেভাদা ,ক্যালিফোর্নিয়ার মত রাজ্য গুলো এই নদীর জল ধারা ছাড়া সম্পূর্ণ অচল। প্রখরা দীর্ঘ্যতম নদীটি  তিলেতিলে পরিবর্তনের স্রোতে ভেসে নব সৃষ্টির উল্লাসে উন্মত্ত আবেগে মেতেছিল। কলোরাডো নদীটির খাল কেটে স্যালটন সিঙ্কে জল ঢুকিয়ে তৈরী হয়েছিল স্যালটন হ্রদ। এবং সেই সময়ে ক্যালিফোর্নিয়ার কলোরাডো শুস্ক মরুভূমির প্রাণ হয়ে উঠেছিল স্যালটন নদী টি ও। পরে এই শাখা নদী প্লাবিত হয়ে আরো বিশাল নদী তে পরিণত হয়। স্যালটন সিঙ্ক যা ছিল ছোট্ট একটি ডোবা তা ক্রমশ জলে টইটুম্বুর এক ভরা লেক হয়ে ওঠে। সভ্যতার উন্নতির সাথে প্রকৃতির স্বাভাবিক বিকাশ এক অর্থে চরম বিপর্যস্থ ও বিঘ্নিত হতে থাকে।                                                                                                                                                      কলোরাডো নদীর অববাহিকা 246,000 বর্গ মাইল। দক্ষিণ পশ্চিম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং উত্তরপশ্চিম মেক্সিকোয়  অবস্থিত  এ নদীর বিশালত্বের তুলনা নেই। এটি উত্তর আমেরিকার কলোরাডো,ইউটা,  আরিজোনা ,নেভাদা ,ক্যালিফোর্নিয়া ,বাহা ক্যালিফোর্নিয়া এবং সোনারোরা রাজ্যের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এবং এই সাতটি রাজ্যের চার কোটি মানুষ যে নদীর জলধারার ওপর  নির্ভর শীল ছিল সে নদী আজ শুষ্ক প্রায়। বিশ্বের প্রায় সর্বত্র জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তনের ফলে এবং বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে যেন এক লহমায় অঞ্জলি ভরে সব জল পান করে নিয়েছিল অহংকারী তৃষিত সূর্য। গ্রীষ্মের আগুন ঝরানো আকাশে গৈরিক দ্বিপ্রহরে দাবানল জ্বলেছিল, বন বনান্তর থেকে আগুন ছড়িয়ে পরে পাহাড়ে পর্বতে। নদী শুকিয়ে জলের পরিমান যত কমে যাচ্ছে সেখানেই দেখা দিয়েছে চরম জলের সংকট । পরিবেশবিদ দের মতে বিগত ১২০০ বছরে এই প্রথমবার এত বড়ো খরার স্বীকার হতে হচ্ছে মার্কিনী যুক্ত রাষ্ট্র কে।                                                                                                                                           আদি আমেরিকানবাসী  মানুষেরা এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে এবং চাষ আবাদ থেকে শুরু করে ব্যাবসার ও পর্যটন শিল্পের প্রসার ঘটায়। কিন্তু  ধীরে ধীরে পলি জমে  নদীর নাব্যতা কমে আসায় বন্যা দেখা দিলে কলোরাডো নদীর  আশে পাশের পাহাড়ি অঞ্চল উপত্যকা ভেসে যায়।বন্যা কে রুখতে নদীতে বাঁধ দেওয়া হয়। এবং বিশ্বে ক্রমাগত উষ্ণায়ণে ভয়াবহ খরায় ,তাপ প্রবাহের বৃদ্ধির ফলে নদী শুকিয়ে আজ ধ্বংসের  রূপ নেয় । এ ছাড়াও পরিবেশবিদরা বলেন রকি মাউন্টেনের পূর্ব প্রান্তে শীতে বরফ ঝরার পরিমান ক্রমশ কমে যাচ্ছে যার ফলে নদীতে জল প্রবাহের যথেষ্ট ঘাটতি দেখা যাচ্ছে । পাহাড় ধোয়া জলের শব্দে প্রাণোচ্ছল হয়ে থাকতো যে নদী ,যেখানে মাছের চাষ হতো ,মাছেরা অবিরত খেলে বেড়াতো ,পরিযায়ী পাখিদের ভীড়ে আকাশ বাতাস মুখরিত হতো সে নদী এখন শুকিয়ে জল যেমন বিষাক্ত হয়েছে তেমনি বায়ুমণ্ডল দূষিত হয়ে পরিবেশ নষ্ট করে দিচ্ছে। মৃত প্রায় নদীর সরে যাওয়া বিভিন্ন স্থানে পাথুরে মরুভুমি জেগে উঠছে। জল  নিঃশেষিত  নদীর বিষাক্ত ধুলো উড়ে পরিবেশ ও বাতাস কে দুষিত করছে।                   
   শুনছিলাম এক জীবন্ত নদীর বিস্মৃত প্রায় মরণের কাহিনী। তিনি গভীর আক্ষেপে বলেছিলেন '' মানুষ নিজের বুদ্ধি ,অধ্যাবসায়ের জোরে জীবন ধারণের অপরিহার্য্য অঙ্গ যে নদী কে একদিন পুণ্য সলিলা প্রবাহিনী করে ,এক প্রাণবন্ত  স্রোতস্বীনি তে পরিণত করেছিল ; সেই স্বার্থানেষী বুদ্ধিজীবি মানুষের হাতেই  অবক্ষয় সয়ে সে নদী আজ মৃত্যু মুখে পতিত,মরণাপন্ন। বর্তমানের কলোরাডো পলির ওপর পলি জমে নাব্য তা হারিয়ে শুকনো দূষিত এক নদী। সেখানে ক্ষীণ স্রোতের  জলের বুকে মাছেরা সাঁতরে বেড়ায় না ,পরিযায়ী পাখিরা ও আজ আর উড়ে আসে না। আমেরিকার আদিবাসী  যাযাবর শিকার সংগ্রহ কারীদের ছোটছোট দল গুলোর সাথে শুরু করে স্থানীয় আমেরিকানরা কমপক্ষে ৮০০০বছর ধরে কলোরাডো নদীর অববাহিকায় বসতি স্থাপন করেছিল। ২০০০ থেকে ১০০০ বছর আগে ও জলবিভাজিকা টি ছিল বৃহৎ কৃষি সভ্যতার আবাস ভূমি। কিন্তু  এখন লবনাক্ত জলে  চাষ  আবাদ সম্ভব হয় না। নদীর ধারের জঙ্গলে আশ্রিত বন্য প্রাণীর পক্ষে ও এই দূষিত লবনাক্ত জলা ভূমির ধারে থাকা অসম্ভব। এক সময়ের উচ্ছল প্রাণবন্ত নদী এখন পরিত্যক্ত এক শীর্ণা জলধারা।                                             পলসন সাহেবের কাছে এই বিশাল কলোরাডো নদীর ক্রমশ বিলুপ্ত হওয়ার দুঃখ জনক কাহিনী খুব মন দিয়ে শুনছিলাম। অবশ্যই এ আলোচনা শেষ করতে মন চাইছিল না কিন্তু সময় সীমিত। মাঝপথে ইতি টেনে ওনার থেকে বিদায় নিয়ে চলেছি আগামী গন্তব্যে।                                                                                                   ভারাক্রান্ত মন নিয়ে অজানার আহ্বানে এগিয়ে চলেছি  নতুন পথের সন্ধানে ।  দূর থেকে দেখা যায় রাবিট ভ্যালি। ইয়মের ধারণা এখানে সাদা ধূসর নানা রঙের ও আকারের রাবিট দেখতে পাবে। অতনু ওর ভুল ভেঙে দিয়ে বলে আসলে এই  ভ্যালির পাথর গুলো সাদা ও  ধূসর রঙের অনেকটা  রাবিটের মত দেখতে। উত্তর পশ্চিম মেসা কাউন্টি তে কলোরাডোর নদীর ধার ধরে পাকা রাস্তায় চলেছি। ড্রাইভিং সিট থেকে মুখ ঘুরিয়ে সানগ্লাস কপালের ওপর তুলে চোখের সামনে পড়া চুলগুলো আঙ্গুল দিয়ে সরিয়ে নিয়ে ব্রতীন  রাস্তার সবুজ সাইন বোর্ডের দিকে তাকায় বলে আর দেরী নেই প্রায় এসে গিয়েছি। আর দশ মিনিটের মধ্যেই  ঢুকবো প্রকৃতির অনুপম সৌন্দর্যের মায়ায় সাজানো আমেরিকা যুক্ত রাষ্ট্রের অন্যতম রাজ্য কলোরাডো তে। বন্ধু গন, আমরা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৪হাজার ফুটের ওপরে পৌঁছেছি কারণ এই রাজ্যটি রকি পাহাড়ে অবস্থিত।                                                                                                   অনেক ক্ষণ ধরে সীটে গা এলিয়ে পারভীন আপন মনে আখরোট , কিসমিস ,ভাজা কাজুর প্যাকেটের সদ্গতি তে মন দিয়েছিল। এবার চট করে সোজা হয়ে বসে বলে , এখানের জিওলজিক্যাল জরিপে দেখা গেছে কলোরাডো কে সেন্টেনিয়াল স্টেট বলা হয়েছে। আমেরিকার স্বাধীনতার যখন একশত বছর পূর্ণ হলো সেই ১৮৭৬ সালে তখন ই কলোরাডো রাজ্য হিসেবে পরিচিতি পায়। ৪১৭টি শহর ,নগর নিয়ে পাহাড়ে ঘিরে আছে এই অনুপম সুন্দর রাজ্য টি। ১৪হাজার ফুটের ওপরে ৫৮টি পর্বত শৃঙ্গে সুসজ্জিত রয়েছে যার মধ্যে দেখা যায়  আল্পাইন পর্বত মালা ,বহু উঁচু নীচু সমভূমি অঞ্চল, বিশাল বালির টিলা যুক্ত মরুভুমি এবং সুগভীর গিরিখাত। প্রকৃতি দেবীর নিপুন হাতের ছোঁয়ায়  তিলতিল সৌন্দর্যে গড়ে তোলা সাজানো রাজ্য টি।  অতনুর মাথায় ভারী দুষ্টু বুদ্ধি !  বলে , কিসমিস ,কাজু আখরোট বাদাম চিবিয়ে ভূগোল বই টা পুরো মুখস্থ করেছে পারভীন। বিন্দু মাত্র দেরী না করে পারভীনের উত্তর  '',আমার সোসিওলজির পেপারে ইতিহাস ভূগোল জানা অত্যন্ত জরুরি। সব সময় আপডেট থাকতে হয়, অবশ্য তোর মত ফাঁকি বাজের মোটা মাথায় সেতো দেখছি মোটেই ঢুকবেনা। '' দুইবন্ধুর এমন মিষ্টি মধুর বাক্যালাপের ঝগড়ায় আমাদের যাত্রাপথ বেশ উপভোগ্য হয়ে ওঠে ।                                 
যে দিকে তাকাই দৃঢ় চেতা অচলায়তন রক্তিম পাথরের রকিপর্বত মালা অতন্দ্র প্রহরীর মত কলোরাডো রাজ্যটিকে চতুর্দিকে ঘিরে দুইহাতে অভিভাবকের মত প্রদক্ষিণ করে রেখেছে। প্রকৃতির নিপুন তুলির টানে সাজানো রাজ্য টি বছরের বিভিন্ন সময়ে ঋতু পরিবর্তনের সাথে রঙ মিলিয়ে অপরূপা হয়ে আছে ।  কালের রথচক্র থেকে এখোনো তুষারাবৃত শীত সম্পূর্ণ  বিদায় নেয় নি। যদিও কাঙ্খিত বসন্ত দরজায় দাঁড়িয়ে কড়া নেড়েই চলেছে।    তাকে  স্বাগত জানাতে ঘর ছাড়া প্রকৃতি প্রেমিক পথিকের দল কলোরাডোর পথে রঙিন উত্তরীয় উড়িয়ে সঘন আনন্দে মেতেছে। রুক্ষ কঠিন তামাটে পাহাড়ের  সাথে  ফিকে গাঢ় হরেক  রকম  সবুজ      বনানীর অবাধ ছোঁয়ায় ,অঢেল প্রাণের স্পন্দনে গড়ে ওঠা  এই রাজ্য টির পর্বত  মালার গা  ঘেঁষে    সর্পিল  পাহাড়ি পথ বেয়ে  ডেনভার এস্পেন, ডিলন , বেন্ড ব্রাইচ  ক্যানিয়ন আর্চ ,ন্যাশানাল  পার্ক      ইত্যাদি  প্রায়  ৭২টি  সমৃদ্ধ ময় শহর নিয়ে নানা প্রাকৃতিক  আশ্চর্য্যে ভরা দৃশ্য  দিয়ে  গড়ে ওঠা এই    বিপুল ঐতিহ্যশালী  রাজ্যটি সর্বত্র  এক  প্রাচীনত্বের স্বাক্ষর  বহন করে  আধুনিক পৃথিবীর দরবারে      নিজেকে স্বমহিমায় সগৌরবে প্রতিষ্ঠিত করে উন্নত সভ্যতার জয় পতাকা রকির শ্বেতশুভ্র পর্বত শৃঙ্গের মাথায় উড়িয়ে চলেছে। পাশ দিয়ে নিরবধি ঝিরঝিরিয়ে বয়ে চলেছে   মার্কিনদের এককালের অহংকার     আজ  বিগত যৌবনা উদাসিনী  'কালের অতল তলে '' তলিয়ে যাওয়া সেই নদী ''কলোরাডো।    
 ( ক্রমশঃ)


Post a Comment

0 Comments