সবুজ দ্বীপ আন্দামান
চতুর্থ পর্ব
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী
(পূর্ব প্রকাশিতের পরবর্তী অংশ)
গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিনসেন্ট ম্যাকাউলে ও তাঁর সহযোগীরা আবার আদি মানবের সন্তান দলের আফ্রিকা থেকে এশিয়া মহাদেশে যাত্রার বাৎসরিক গতিবেগ নির্ণয় করেছেন যা তাদের মতে বাৎসরিক ০.৪ কিলোমিটার থেকে ৭ কিলোমিটার। জেনোগ্রাফিক প্রোজেক্ট দলের নেতা স্পেন্সার ওয়েলের মতে আদি গোষ্ঠী আফ্রিকা থেকে পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল অতিক্রম করে দক্ষিণ বা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় আসে। তাদের এই অভিযাত্রা শুরু হয় এক লক্ষ বছর আগে। তার কুড়ি হাজার বৎসর পরে দ্বিতীয় দল যাত্রা করে। তাদের চাপে প্রথম দলের বংশধরেরা স্থানচ্যুত হয়। দ্বিতীয় দলটি হিন্দুকুশ পার্বত্য অঞ্চল, পাঞ্জাবের সমতল অঞ্চলের মধ্য দিয়ে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্য দ্বিতীয় দলটির পরে আরো কয়েকটি দল পরবর্তীকালে আফ্রিকা থেকে এশিয়া যাত্রা করে।
ভারতের হায়দ্রাবাদে অবস্থিত 'দি সেন্টার ফর সেলুলার এন্ড মলিকিউলার বায়োলজি' গবেষণাগারের গবেষকেরা খুব সম্প্রতি মাইট্রোকনড্রিয়াল ডিএনএ পরীক্ষা করে প্রমাণ করেছেন আদি মানবের সন্তান দল পূর্ব আফ্রিকা থেকে যাত্রা শুরু করে লোহিত সাগরীয় অঞ্চল হয়ে পরিশেষে ভারতের পশ্চিম উপকূলে পৌঁছায় এবং সেখান থেকে দক্ষিণ পূর্ব উপকূল হয়ে আন্দামানের দিকে আসে। এই সংস্থার ডিরেক্টর ডঃ লালাজি সিংয়ের মতে আন্দামানের চার নেগ্রিটো আদিম জনজাতি আফ্রিকা থেকে আগত ও আদি মানবের সরাসরি বংশধর। তাদের পূর্বপুরুষেরা দেড় লক্ষ বছর আগে পূর্ব আফ্রিকায় বাস করত। এই গবেষকদের মতে বঙ্গোপসাগরের বুকে ভেসে থাকা দ্বীপমালায় নিকোবরীদের পূর্বপুরুষেরা ১৮ হাজার বছর আগে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মঙ্গোলয়েড গোষ্ঠী থেকে এসেছে। তারা আরো বলেছেন আদি মানবের সন্তান দল আফ্রিকা থেকে যাত্রা করে নীলনদ অতিক্রম করে সিনাই উপদ্বীপকে পিছনে ফেলে আরো উত্তরে গিয়ে মধ্য এশিয়ায় প্রবেশ করে। সব গবেষণার মূল কথা একটাই আন্দামানের আদিম জনজাতি জারোয়া ও আরও তিনটি নেগ্রিটো আদিম জনজাতি আফ্রিকা থেকে আগত।
বর্তমানে আমরা যখন আন্দামানের নেগ্রিটো মানুষদের বিতর্কিত আদি পরিচয় সম্পর্কিত বিষয়ের শেষ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার চেষ্টা করছি তখনই আবার কিছু নতুন মতবাদ, চিন্তা-ভাবনা আকৃষ্ট করে। বিশেষজ্ঞ ও মানব বিজ্ঞানীরা আজও আন্দামানের নেগ্রিটোদের আদি পরিচয় বিষয়ে বিভিন্ন মত ও ব্যাখ্যা দিয়ে চলেছেন।
২০০৯ সালে ভারতের এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় নৃতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ভি,এস, সহায় বলেছেন যমজ দ্বীপগুলি যেমন মালয়েশিয়া-ফিলিপাইন্স, আন্দামান ও নিকোবর, পাপুয়া ও নিউগিনি, অস্ট্রেলিয়া ও তাসমানিয়া এমনই এলাকা যেখানে মানবজাতির বিবর্তন হয়ে সেখান থেকে মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। বিশিষ্ট জার্মান জীববিজ্ঞানী আর্নেস্ট হেকল্ মতবাদ প্রকাশ করে বলেছেন আন্দামানের চার নেগ্রিটো জনজাতি যথা গ্রেট আন্দামানিজ, ওঙ্গি, জারোয়া ও সেন্টিনেলিজদের দৈহিক গঠন দেখে প্রমাণ হয় মানব জাতির বিবর্তন নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল থেকে হয়েছে।
আন্দামানের জারোয়া ও সেন্টিনেলিজ যারা এখনো সত্যিকারে প্রস্তর যুগের মানুষ বিশেষ করে সেন্টিনেলিজ দের আধুনিক জগতের জীবনযাত্রা স্পর্শ করেনি, বহির্জগতের রক্তের মিশ্রণ বা Racial mixture হয়নি। সর্বপ্রথম মানব সংস্কৃতির চিহ্ন আন্দামান ও দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপগুলিতে, এমনকি তাসমানিয়াতেও পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে অনেক আদিম জনজাতি বা প্রাচীন জাতি অবলুপ্ত হয়েছে বা অবলুপ্তির পথে গেছে। গবেষণায় প্রাপ্ত আরো বিষয়বস্তুকে ভিত্তি করে বিশেষজ্ঞগণ দাবি করেন যে ডারউইনের বিবর্তনবাদের এক হারানো যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া গেছে। সেকালের মতে বিবর্তনের পথে মানুষ ও বানরের মাঝে Phecanthropus জাতীয় এপ্ ম্যান ছিল। তিনি বলেছেন নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের মানব জাতির দেহের ঘন আচ্ছাদিত চুল বিনষ্ট হয়ে যায়। এপম্যানেরা সেই সব অঞ্চলে বাস করত। এপম্যানদের প্রজাতি গোরিলা ও শিম্পাঞ্জিকে আফ্রিকায়, ওরাংওটাং ও গিব্বনদের মালয়েশিয়ায় দেখা যায়।
এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ভি, এস, সহায় গবেষণা করে আরও দাবি করেছেন যখন সেন্টিনেলিজ ও জারোয়াদের দৈহিক গঠন পরীক্ষা করা হয় দেখা যায় তাদের চামড়া লোমহীন ও মসৃণ, যা প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য হয়েছে। এইসব প্রমাণ করে আন্দামান ও নিকোবর এলাকার আদিম মানুষেরা আদি মানবের বংশধর। মানবজাতির বিবর্তনের পথ ধরে লক্ষ বছর ধরে তারা এখানেই আছেন এবং তারা কিন্তু আফ্রিকা থেকে আসেনি।
মানব বিজ্ঞানীরা 'কালচারাল এনথ্রপলজি' অনুসারে আবিষ্কার করেছেন আন্দামানের চার নেগ্রিটো আদিম জনজাতির আচার-আচরণের সঙ্গে ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জের এইটা (Aeta) এবং মালয় উপদ্বীপের সেমাং উপজাতির আচার-আচরণের অনেক মিল আছে। এইভাবে বিভিন্ন মতবাদের জালে জড়িয়ে আছে আন্দামানের আদিম জনজাতির আগমনের এবং তাদের বিবর্তনের ব্যাপার।
প্রত্নতাত্ত্বিক বিষয় সম্পর্কিত মতবাদ অনুযায়ী আন্দামান দ্বীপের বিভিন্ন অংশে নেগ্রিটো আদিম জনজাতি মানুষদের ব্যবহৃত 'Kitchen midden heap' আছে যা স্থানীয় মানুষের ভাষায় C.P.Tigri কে খনন করে আদিম জনজাতির অতীত ইতিহাস জানা গেছে। জানা গেছে তাদের অবস্থান সম্পর্কিত বিষয়কে। এক শতাব্দীর আগে আজকের পোর্ট ব্লেয়ারের কাছাকাছি Bamboo flat নামে এক জায়গায় আদিম জনজাতি নেগ্রিটো মানুষদের ব্যবহৃত সি,পি,টিগ্রী খনন করে গবেষণা করেন এল ল্যাপিক। 1952 সালে এনথ্রোপলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার শ্রী বি,কে, চ্যাটার্জী আন্দামানের দ্বীপের একটি টিগরি খনন করে গবেষণা করেন। কাছাকাছি সময়ে নৃতাত্ত্বিক গবেষক পি,সি, দত্ত আন্দামানের এক টিগরি নিয়ে গবেষণা করেন। এই টিগরি থেকে শেল, রান্নার মাটির বাসনের ভাঙ্গা অংশ, পশুর হাড় এবং পুরাতন অস্ত্র (যেগুলি হাড়, শেল ও পাথর থেকে বানানো) পাওয়া গেছে। টিগরি গুলিতে এই সমস্ত জিনিস স্তরে স্তরে সাজানো অবস্থায় ছিল। সবচেয়ে বেশি তথ্য পাওয়া গেছে মধ্য আন্দামানের 'বিহাইভ' দ্বীপের টিগরি থেকে। এইখানে যে সমস্ত পাথরের অস্ত্র-গুলি পাওয়া গেছে তার সাথে ইন্দনেশিয়া অঞ্চলের পাথরের অস্ত্রের মিল আছে। এইগুলি খনন করে যে সমস্ত জন্তুর হাড় পাওয়া গেছে তাদের প্রজাতি এখনো বেঁচে আছে বলে অনুমান করা হয়। অনেকের মতে তাই এইগুলি অতি দূর অতীতের নয় বরং কাছাকাছি সময়ের। মধ্য প্রস্তর যুগের সাংস্কৃতিক জীবনে আন্দামানের আদিম জনজাতি মাটির বাসনপত্র ব্যবহার করত। এই সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী গ্রেট আন্দামানিজেরা আজ আর মাটির বাসনপত্র ব্যবহার করে না। এইরকম বাসনের ব্যবহার সমসাময়িক যুগে সেলেবস্-এর 'টোয়ালে' মানুষদের মধ্যে ছিল। সবকিছু ব্যাখ্যা করে মানব বিজ্ঞানীরা মনে করেন এই সংস্কৃতি খ্রিস্টের জন্মের কিছু আগে আন্দামানের আদিম জনগণের কাছে আসে। প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য তাই প্রমাণ করে আদিম জনজাতি জারোয়া বা অন্যান্য তিনটি শ্রেণীর মানবগোষ্ঠী অন্তত আড়াই হাজার বছর আগে ছিল।
পরবর্তী অংশ পঞ্চম পর্বে
0 Comments