জ্বলদর্চি

আমেরিকার আদিম মানুষের খোঁজে-৭/ মলয় সরকার

আমেরিকার আদিম মানুষের খোঁজে 

মলয় সরকার

পর্ব-৭ (সপ্তম পর্ব)

আমরা পরদিন সকাল সকাল বেরোলাম।ধূ ধূ চারিদিক। কোথাও কোথাও পড়ে আছে সাদা নুনের মত বরফের আস্তরণ।রাস্তাতেও দেখছি পড়ে আছে হাল্কা বরফের চাদর।মাঝে মাঝে গাড়ি থামিয়ে ,নিচ্ছি কুড়িয়ে সেই বরফের কুচি আর মেতে উঠছি শিশুসুলভ খেলায়। বয়সটা কমে যাচ্ছে অনেক। 

একসময় পৌঁছে গেলাম একটি মাটির ঘরের চার্চের কাছে।।বিশাল জায়গা জুড়ে রয়েছে তার চৌহদ্দি।নাম Sanctuario De Chimayo।এই আপাতঃ শান্ত নির্জন রোমান ক্যাথলিক মাটির চার্চে যে প্রতি বছর প্রায় তিন লক্ষ দর্শক আসেন। আসলে এই জায়গাটির নাম চিমায়ো।

একটি আর্চ ধরণের মাটির গেটের মধ্যে দিয়ে ঢুকে সামনেই দেখি দুপাশে দুই স্তম্ভওয়ালা এবং মাঝে একটি ত্রিকোণাকার ঢালু ছাদের অপেক্ষাকৃত নীচু দ্বিতল ঘর। সবটাই মাটির।আসলে দুপাশে দুই স্তম্ভগুলো চার্চের প্রথামাফিক ভাবে ঘণ্টা নিয়ে দাঁড়িয়ে Bell Tower। যাদের মাথাগুলো ছুঁচালো আকৃতির।
পিছনের পটভূমিকায় আধা রুক্ষ পাহাড়ের( Sangre de Cristo Mountains) সারি চার পাশে বেশ রুক্ষতার একটা সন্যাসী ছাপ। গাছে সবুজের অভাব। পাতা প্রায় সব ঝরে গেছে, কেবল অল্প কিছু চিরহরিৎ গাছ ছাড়া। তারাই আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে বনানীর সৌন্দর্য কে রক্ষা করার।
লোকজন প্রায় দেখতেই পেলাম না। চার্চের প্রার্থনা কক্ষটিও বন্ধ। সামনে দিয়েই রয়েছে উপরে ওঠার জন্য একটি অস্থায়ী কাঠের মই।পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে কুলকুল করে একটি বন্ধুবান্ধব হীন একাকী ঝরণা। চারিদিকে পড়ে রয়েছে অজস্র ঝরাপাতার দল।সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে চারিদিকে। সামনেই রয়েছে একটি গোলাকার মাথা ঢাকা মঞ্চ। দেখে মনে হল প্রয়োজনে সেখানে গান বা প্রার্থনা হয়। আর তাকে ঘিরে গোল করে বেশ অনেক সিমেন্টের বেঞ্চ, যেখানে শ্রোতা বা প্রার্থনাকারীরা বসতে পারবেন।

এ ছাড়া আর এক পাশে রয়েছে বেদীর উপর মা মেরীর যীশুকে কোলে নিয়ে এক মূর্তি যার চারিদিকে সাজানো কিছু ফুল গাছ দিয়ে।আর এক পাশে বিশাল বাগানের মত ফাঁকা ঘেরা জায়গা।

এর দরজা গুলি সমস্ত অপটু মিস্ত্রীর হাতের কাঠের কাঁচা কাজ। প্রধান  গেটটি তো মনে হচ্ছে এখনই ভেঙ্গে পড়বে। কিন্তু মানুষের বিশ্বাস এখানে খুব । পাশের একটি ঘরে পবিত্র ধূলি সংগ্রহ করার জায়গা রয়েছে। আমরাও নিলাম সেই পবিত্র ধূলা অমৃত লাভের আশায় কিংবা অন্য কিছুর আশায়, নিজেরাই ঠিক জানি না। 
এ ছাড়া একটি বিচিত্র জিনিস দেখলাম। অনেক পরিত্যক্ত ক্রাচ ( পায়ের সমস্যা থাকলে যা ব্যবহৃত হয়) রয়েছে জমা। যাদের নাকি পায়ের সমস্যা সেরে গেছে তারা এই ক্রাচ জমা দিয়ে প্রভুকে শ্রদ্ধা জানিয়ে গেছে। এছাড়াও রয়েছে ব্যবহৃত হুইল চেয়ার, বেতের হাঁটার লাঠি, সবই একই উদ্দেশ্যে।মানুষের ভক্তিতে বোধ হয় অনেক কিছুই সম্ভব।অর্থাৎ মানত এবং তা পূর্ণ হওয়ার প্রার্থনা, সেই সঙ্গে, প্রার্থনা পূরণের পর পূজা, এটা বোধ হয় সারা বিশ্বে একভাবেই প্রচলিত।


এই চার্চটি নির্মিত হয় ১৮১৬ খ্রীষ্টাব্দে।এটি ১৯৭০ সালে National Historic Landmark হিসাবে স্বীকৃত হয়। তার আগে এটি ব্যক্তিগত মালিকানাতেই ছিল।আমাদের এখানের বাবা তারকনাথের বা বাবা বৈদ্যনাথের মাথায় জল ঢালতে যাবার মত বহু দূর দেশ থেকে (প্রায়১৫০ কিমি) লোকে পায়ে হেঁটে প্রার্থনা জানাতে আসে, বিশেষ করে গুড ফ্রাইডের সময়ে।যাঁরা আসতে পারেন না তাঁদের জন্য ভক্তের নিয়ে যান পবিত্র ধূলা।শুনলে আশ্চর্য লাগবে, বছরে প্রায় ২৫-৩০ টন ধূলা লাগে এখানে) তথ্যটা কতটা সত্যি, জানি না)। তার ব্যবস্থাও রাখতে হয় চার্চ কর্তৃপক্ষকে। ভিতরে ধূলা নেওয়ার জন্য একটি গর্ত আছে।

যাই হোক,দেখলাম, ঢোকার মুখেই চার্চের সামনে একটি কাঠের ক্রশ পোঁতা আছে। তার সামনে একটি জাঁতার পাথর কেন রাখা আছে ঠিক বুঝলাম না। পিছনের পাহাড়ের মাথায়ও রয়েছে একটি ক্রশ, যেটিকেও খুব শ্রদ্ধা জানান ভক্তেরা।

এর ভিতরে একটি রঙীন চিত্রিত দেওয়ালের মাঝে রয়েছে ক্রুশবিদ্ধ যীশুর মূর্তি।এ ছাড়া ভিতরে রয়েছে বেশ কিছু ছবি ,তবে গঠন বৈচিত্র কিছু নেই।
এখানকার স্থানীয় তেওয়া (Tewa) আদিবাসীরা বিশ্বাস করে এখানে আগে এক ঊষ্ণ প্রস্রবণ ছিল। যা শুকিয়ে গিয়ে এই ধুলিকে পবিত্র করেছে।

যাই হোক এই পবিত্র স্থানের ধূলি মাথায় নিয়ে এগোলাম পরের রাস্তায়।

ভাবতে ভাবতে চলছিলাম এইসব আদিবাসী উপজাতিদের কথা। আজকের উগ্র সভ্যতার চাপে পড়ে স্বাভাবিক প্রকৃতির বন্য প্রাণীরাও যেমন সরতে সরতে কোণ ঠাসা হয়ে একসময় হারিয়ে গেছে অনেকেই চিরকালের জন্য, এইসব আদিবাসী উপজাতি প্রকৃতির সন্তানেরাও তাই।একসময় নিজের দেশে নিজেদের রাজ্যে তারা নিজেদের মত ছিল সুখে শান্তিতে। তাদের এত আধুনিক উপকরণ ছিল না এত সভ্যতা ছিল না। তারা বেড়ে উঠছিল একেবারেই বন্য লতাপাতার মত নিজের আনন্দে। কিন্তু লোভী সভ্যমানুষের আগ্রাসন নীতির কাছে তারা ধীরে ধীরে হার মানতে বাধ্য হল।

কি ভাবে যে ব্রিটিশ, স্পেনীয় ও উপনিবেশবাদীরা নিজেদের লোভের সীমা বাড়াতে এদের নিরপরাধ নিষ্পাপ ভীতু বুকের উপর নির্বিচারে নির্মমভাবে স্টীম রোলার চালিয়ে কুকুর বিড়ালের চেয়েও নির্লজ্জভাবে হত্যা করেছে কিংবা তাড়িয়ে তাদের জমি দখল করেছে ভাবলে বা এ নিয়ে পড়াশোনা করলে বর্তমান সভ্য ইউরোপীয় ও আমেরিকানদের সম্বন্ধে ঘৃণায় মন ভরে ওঠে। যারা প্রাণের ভয়ে এদের কাছে বশ্যতা স্বীকার করেছিল, তাদের এরা তাড়িয়ে, বাঘকে খাঁচায় পোরার মত, ওদের নির্দিষ্ট করা জায়গায় নিয়ে গিয়ে থাকতে বাধ্য করেছে।তাতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, খাদ্যের অভাব ইত্যাদির ফলেও হারিয়ে গেছে আরও বহু মানুষ। হত্যালীলায় শিশু নারী কাউকেই তারা রেহাই দেয় নি নির্মমভাবে। এতে মদত জুগিয়েছিলেন সেকালের রাষ্ট্রীয় সরকারও। 
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, আজ সেই আমেরিকানরাই, অতীতের সেই আদিবাসীদের থাকার জায়গা, খাদ্যাখাদ্য, তাদের ব্যবহার্য জিনিসকে নিজেদের ইতিহাসের সামগ্রী বলে দাবী করে সারা পৃথিবীকে দেখাচ্ছে। এমন কি, যাদের তারা কোণঠাসা করে একটি ছোট জায়গায় থাকতে বাধ্য করেছে, সেখানে অনেক সময়েই সহজে বাইরের কাউকে যেতে দেওয়া হয় না , কিংবা নানা বিধিনিষেধ। আদিম বাসিন্দাদের তাড়ানোর ব্যাপারে তারা, এমন কি, আইনও তৈরী করেছিল, নিজেদের পক্ষ সমর্থন করে, সেটি হল The Indian Removal Act of 1830 । 

(The Indian Removal Act Of 1830 authorized the American government to force Indian tribes to move from east of the Mississippi River to the west on the American frontier, especially to Indian Territory which became Oklahoma. As American settlers expanded their settlement onto the Great Plains and the Western United States and Canada, the nomadic and semi-nomadic Indian tribes of those regions were forced to relocate to reservations).

আসলে, এখন বর্তমান সভ্য উন্নত আমেরিকায় যারা বসবাস করছে, তাদের কেউ তো এখানকার আদি বাসিন্দা নয়। সবাই বিভিন্ন কারণে সেই “স্বর্ণসন্ধান”এর (Gold Rush)দিন থেকে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে এখানে এসেছে সহজে অর্থ উপার্জন করে বড়লোক হতে। তারাই বংশানুক্রমে রয়ে গেছে এখানে। আর তারা মাঝে মাঝে নিজে দেশের কথা মনে করে যখন নতুন শহর রাস্তা ঘাটের নাম দেয়, তখন, নিজের দেশের নামে মিলিয়ে জায়গার নাম রাখে আর নস্ট্যালজিয়ায় ভোগে। তবু অনেকেই ফিরে যেতে পারে নি নিজের দেশে। দেশের আসল অধিবাসী ওরাই, যাদের এরা তাড়িয়ে দিয়েছে । অর্থাৎ নিউ মেক্সিকোর এই যে ২৩ টি পুয়েব্লো বা উপজাতি , নাভাহো, আপাচে, ক্রীক,পালুতে ইত্যাদি এরাই আসল আমেরিকার অধিবাসী।এ ছাড়াও অবশ্য বিভিন্ন জায়গায় আরও কিছু রয়েছে।

আমরা এদেরই দেখার জন্য ঘুরে বেরাচ্ছি শহর থেকে শহরে, রাস্তায় রাস্তায়।আর এদের দেখতে গেলে , তাদের ধর্ম , বিশ্বাস, খাদ্যাখাদ্য সব কিছুই দেখার বা বোঝার প্রয়োজন, বলে আমার মনে হয়েছে। তাই খুঁটিয়ে দেখছি, এই সমস্ত, নিছক মাটির চার্চ, দেবতার জায়গা ইত্যাদি।অনেকে ভাববেন, এই সব মাটির চার্চের মত তুচ্ছাতিতুচ্ছ জিনিস, এর আর কি দেখার আছে! হ্যাঁ, এগুলো অবশ্য অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে, বিদেশী স্প্যানিশ বা বর্তমান আমেরিকানদের হাতে পড়ে বা খ্রীষ্টীয় ধর্মযাজকদের সংস্পর্শে, তবু যেটুকু প্রাচীন রয়ে যাওয়া চিহ্ন খুঁজে পাই তারই সন্ধানে চলেছি এই পথে পথে।
                                                                                                                                
এর পর আমরা যে চার্চটি পেলাম রাস্তার পাশে, তা হল San Jose de Gracia Church।এটিও National Historic Importance বলে স্বীকৃতি পেয়েছে ১৯৭০ সালে।এর প্রকৃত নাম Church of Santo Tomas Del Rio de Las Trampas,
এটি প্রথম তৈরী হয়েছিল ১৭৬০-১৭৭৬ সালের মধ্যে।এটি সেই সময়ের স্প্যানিশদেরই তৈরী। তবে স্প্যানিশরা একটা জিনিস করেছিল, তা হল সেই পুরানো পুয়েব্লা সংস্কৃতিকে পুরো জলাঞ্জলি দেয় নি।তাকে আত্মস্থ করে অনেকটা সেই রকম ভাব রেখেছিল, যার লক্ষণ আমরা দেখতে পাই এই সমস্ত চার্চ গুলিতে। এটিও মাটির তৈরী এবং অবশ্যই আমাদের দেখা বা চেনা সাধারণ চার্চের মত নয়।এর দুপাশে দুটি এগিয়ে আসা দেওয়ালের উপরে ৩৪ ফুট উঁচুতে রয়েছে দুপাশে দুটি ক্রশ। সামনে একটি মাটির দেওয়াল দিয়ে ঘেরা চৌহদ্দি এবং মাটির দেওয়ালের মাঝে মোটা কাঠের দরজাই এর প্রবেশ পথ।তবে এটি বোধ হয় ইঁটেরই তৈরী এবং তার উপর মাটির প্লাস্টার করা।
একতলা ঘরের মাথার উপরে কাঠের একটি ব্যালকনি।তার পিছনে দোতলায় আর একটি ঘর রয়েছে.৩০ মি লম্বা এবং ১৬ মি চওড়া এই চার্চটির যথারীতি দেওয়ালের পাশ দিয়ে কড়িবরগার কাঠ বেরিয়ে রয়েছে।

বলা হয়, ১৭৫১ সালে ১২ টি স্প্যানিশ পরিবার এখানে আশ্রয় নেয়, যারা পরবর্তী কালে ৬৩টি পরিবারে বিভক্ত হয়ে বৃদ্ধি পায়। সেই সময় তারা একটি চার্চের প্রয়োজন অনুভব করায় এটির জন্ম হয় ১৭৭৬ সালে। পরবর্তী কালে অবশ্য এর অনেক সংযোজন হয়।

এর ছাদে পাঁচ ছটি টানা লম্বা কাঠের বরগার ফাঁকে সুন্দর ভাবে নানা ছবি আঁকা।সামনের ঢোকার দরজাটি বেশ চওড়া ও তাতে কিছু কারুকাজ করা, যেটি করেছেন Nicolas Apodaca।

সঙ্গে থাকুন পরের পর্বের জন্য–

ক্রমশঃ-

Post a Comment

0 Comments