জ্বলদর্চি

স্মৃতিপটে সমরেশ মজুমদার /সন্দীপ দত্ত

স্মৃতিপটে সমরেশ মজুমদার
সন্দীপ দত্ত


কিছু প্রশ্নের উত্তর যেমন মেলে না,কিছু স্মৃতি মলিন হয়না কখনও। আমার সাহিত‍্যজীবনের একেবারে গোড়ার দিকে যখন আমি ক্লাস ওয়ানে পড়ি,সাহিত‍্যিক সমরেশ মজুমদার নামটা তখন থেকেই আমার চেনা। তাঁর লেখনীধারার সাথে পরিচিত। সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বেড়ে ওঠার সুবাদে বাড়িতে প্রচুর বইপত্র আসতো। বাবা নিজহাতে নিয়ে আসতেন নানান পত্রপত্রিকা। সেগুলোর পাতা ওল্টাতাম যখন তখন। মনে আছে,বাবার খুব কাছের বন্ধু অনিল ঘড়াই একদিন এসেছেন আমাদের কোয়ার্টারে। বাবা কাজের ভীষণ ব‍্যস্ততাকে সামলে সন্ধেবেলা কাঁথি বীরেন্দ্র শাসমল হলে আয়োজিত বইমেলায় গেছি অনিলকাকু আর বাবার সাথে। প্রচন্ড ভিড়ের কারণে অনিলকাকু আমায় কোলে তুলে নিয়েছেন। কথাপ্রসঙ্গে সমরেশ মজুমদার নামটা কানে আসতেই আমার কী বায়না চাপলো,সমরেশ মজুমদারের লেখা বই নেবো। বাবা তখন কিনলেন 'সাতকাহন'। আজ ভাবলে নিজেরই অবাক লাগে,সে বই আমি পড়া শুরু করলাম ক্লাস ওয়ানেই। একাধিকবার পড়া 'সাতকিহন' সেই শুরু। দীপাবলির জেদ আর জীবনভর লড়াই সেই বয়েসেই চমকে দিয়েছিল আমাকে। আমার তখন কাঁথির 'তীরভূমি'দৈনিক সংবাদপত্রের রবিবারের পাতায় 'পিসীর বাড়ি'গল্পটি সদ‍্য সদ‍্য প্রকাশিত হয়েছে।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
অনেকেই শুনে আশ্চর্য হবেন,আমির সাহিত‍্যপাঠের সূচনাই সুনীল-শীর্ষেন্দু-সমরেশ(মজুমদার)-দিব‍্যেন্দুকে পড়ে। আমি যখন রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র-বঙ্কিম পড়তে শুরু করি,ততদিনে সুনীলের 'পূর্ব-পশ্চিম',শীর্ষেন্দুর 'মানবজমিন',সুব্রত মুখোপাধ‍্যায়ের 'রসিক',আবুল বাশারের 'ফুলবউ',দিব‍্যেন্দুর দু'একটা লেখা একবার করে পড়া হয়ে গেছে।
        সমরেশ মজুমদারের বিপুল সাহিত‍্যসমভারের যেটা মূল বৈশিষ্ট্য,তা হলো একটি প্লটকে তিনি একাধিকবার ব‍্যবহার করতেন না। তাই 'সাতকাহন'যেমন স্বতন্ত্র,'অগ্নিরথ'ও ততোটাই। কিংবা 'জ‍্যোৎস্নায় বর্ষার মেঘ','কালবেলা'বা 'সিংহবাহিনী'র মতো উপন‍্যাসগুলো। সমাজ দেখার চোখ ছিল তাঁর অসাধারণ। আর সেকারণেই বোধহয় অতো মগ্নতা। লেখালেখিতে যখন খুবই ব‍্যস্ত তিনি,এমনও সময় পার করেছেন,যখন আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধবরা তাঁর মেয়ে কোন্ ক্লাসে পড়ছে জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তর দিতে পারেননি। জাতসাহিত‍্যিকদের ধর্মই বোধহয় তাই।
       একই বাড়ির দুটো বউয়ের দুটো ভিন্ন রাজনৈতিক পার্টিতে নাম লেখানোর পর বাড়ির পরিবেশ কেমন হয়,এই প্লটের উপর সমরেশের দারুণ একটা গল্প আমি পড়েছিলাম ক্লাস সিক্সে পড়াকালীন। 'কেউ বোঝে না' অসম্ভব সুন্দর একটি কিশোর রচনা,যা মনে থেকে যাবে বহুদিন। 'শান্তিজল' গল্পটি পড়তে গিয়ে ভারাক্রান্ত হয়ে গিয়েছিল মনটা। 'চোখের জলে শ‍্যাওলা পড়ে না',কষ্ট কষ্ট সুখ',মেঘ ছিল'বৃষ্টিও' কিংবা 'চন্দন বনে বসন্ত','বৃষ্টিতে ভেজার বয়স','কলকাতায় নবকুমার' পড়েছিলাম মাধ‍্যমিকের পরে পরেই। 'এক জীবনে অনেক জীবন'নামক স্মৃতিচারণামূলক রচনাটা পড়েছি একাধিকবার। 'আত্মীয়স্বজন'উপন‍্যাসে তিনি যে অবগুন্ঠনের কথা বলতে চেয়েছেন,'অবগুন্ঠন'উপন‍্যাসটিতে রয়েছে তারই অন‍্য একটি দিক। যেখানে কোভিড পরিস্থিতি গ্রাস করেছে মানুষের মনকে। 'স্বপ্নের বাগান' বইতে নয়,প্রথম দেখি সিরিয়াল হিসেবে টেলিভিশনের পর্দাতেই। পাঠক ও দর্শকদের জন‍্য এরকম কতো যে মণিমুক্তো রেখে গেছেন সমরেশ।
        খুব ছোট থেকেই সাহিত‍্যকেন্দ্রিক নানা অনুষ্ঠানে যেতে হয়েছে আমাকে। কখনও বাবার সাথে গেছি,কখনও এককভাবে। সেই সুবাদেই সান্নিধ‍্য পেয়েছি অনেক গুণীজনের। সামনে থেকে দেখা ও কথা বলার সুযোগ ঘটেছে নবনীতা দেবসেন,তপন বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়,ভগীরথ মিশ্র,কৃষ্ণা বসু,প্রেমেন্দ্র মিত্রের ছেলে মৃন্ময় মিত্র প্রমুখদের সঙ্গে। সমরেশ মজুমদারের সাথেও কথা হয়েছে। উনি সদ‍্য সমাপ্ত গল্প/উপন‍্যাসের পান্ডুলিপি প্রেসে না দিয়ে কিছুদিন ফেলে রাখার কথা বলতেন। এতে নাকি রচনার উৎকর্ষ আরও বাড়ানো যায়।
       আত্মকথন লেখার বয়স এখনও হয়নি আমার। সময় তো নয়ই। যদি ভবিষ‍্যতে লেখার ইচ্ছে হয়,তখন বিস্তারিতভাবে বলবো সব।
          মানিক-তারাশঙ্কর-বিভুতিভূষণ-সতীনাথের পর আধুনিক বাংলা কথাসাহিত‍্যের প্রধান চার মহারথী ছিলেন সুনীল-শীর্ষেন্দু-সমরেশ আর দিব‍্যেন্দু। ২০১২ সালে আমরা সুনীলকে হারিয়ে ফেলেছি। ২০১৯ সালে হারিয়েছি দিব‍্যেন্দুকে। এ বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে হারালাম সমরেশকে। জানি,সাহিত‍্য চলমান। তবু দুশ্চিন্তা হয় মাঝেমধ‍্যেই। আজকের প্রচেত গুপ্ত,তিলোত্তমা মজুমদার,উল্লাস মল্লিক,স্মরণজিৎ চক্রবর্তী কিংবা রবিশঙ্কর বল,রামকুমার মুখোপাধ‍্যায়ের দিকে সাহিত‍্যপিপাসু পাঠকেরা তাকিয়ে থাকবেন। এরাও যথেষ্ট শক্তিশালী। আর  গর্বের শীর্ষেন্দু তো আছেনই। আমি এদের প্রত‍্যেকের লেখাই পড়ি। নিয়মিতই পড়ি। 
          সমরেশ মজুমদারের রেখে যাওয়া সৃষ্টিসম্পদ নিয়ে গবেষক'রা এগিয়ে আসুন,বরেণ‍্য এই কথাসাহিত‍্যিককে আরও বেশি করে পড়ুন,জানুন-----পরিশেষে আমার সকল প্রিয় পাঠকদের কাছে এটুকুই অনুরোধ রাখবো আমি।#

Post a Comment

0 Comments