জ্বলদর্চি

শবযাত্রার পয়সা কুড়োতুম তিন ভাই /মলয় রায়চৌধুরী

আমার জীবনের ঘটনা -১১


শবযাত্রার পয়সা কুড়োতুম তিন ভাই

মলয় রায়চৌধুরী


ঠাকুর্দা মারা যেতে, ঠাকুমা উত্তরপাড়ার বসতবাড়িতে, যা অবহেলায় খণ্ডহরের চেহারা নিয়েছিল,  থাকতে চলে গেলে, পরিবারের আর্থিক ভার পুরোপুরি এসে পড়েছিল বাবার কাঁধে । ঠাকুমা ছেলেদের আর তাদের বোউদের বলে দিয়ে যান যে আমার মা সংসারটাকে সামলাবেন । যেকোনো কারণেই হোক মেজজেঠা, নকাকা আর বিশেখুড়োর স্বভাব আর আচরণ এমন হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে আমরা শৈশবে শুনতুম যে এঁরা কিছুটা অপ্রকৃতিস্হ, আধপাগল । দোকানের কাজে তাঁদের তেমন আগ্রহ ছিল না ; তাঁরা প্রকৃতই শিল্পীচরিত্রের বিপন্ন বিস্ময়ে আক্রান্ত অস্বাভাবিকতা পেয়েছিলেন । মেজজেঠা ঘুম থেকে উঠতেন দুপুরবেলা, তারপর জলখাবার খেতেন, কোনো দোকান থেকে লুচি আলুর তরকারি কিনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে, কখনও চুল আঁচড়াতেন না, বাড়ি ফিরে দাঁত মেজে স্নান করে বিকেলের দিকে দোকানে পৌঁছোতেন, এবং একটা ফোটোর সামনে বসে তাকে মাসখানেকে আঁকা অপূর্ব  ছবিতে দাঁড় করাতেন । নকাকা অনেক ভোরে উঠতেন, সবাইকে, শিশুদেরও ‘আপনি’ সম্বোধন করতেন, স্ত্রীর সঙ্গে বিশেষ কথা বলতেন না, জুতো পরার অভ্যাস ছিল না, কোরা ধুতি পরতেন, নিজের ধুতি-শার্ট নিজেই কাচতেন, কোনো এক ফাঁকে দোকানে গিয়ে বাড়িতে করার জন্য বাবার কাছ থেকে ‘কাজ’ চেয়ে আনতেন । ছোটোকাকা মাঝরাতে নিজের ঘরে ছোটোকাকিমার নানা আঙ্গিকের পোশাকহীন ফোটো তুলতেন আর দোকানে গিয়ে বাবাকে সাহায্য করার নাম করে ডার্করুমে ঢুকে সেই ‘অপ্সরা’ ফোটোগুলো প্রিন্ট করে নিতেন । উনি যখন উত্তরপাড়ায় পাকাপাকি চলে গেলেন তখন তাড়াহুড়োয় অ্যালবামগুলো নিয়ে যেতে ভুলে যান । আমি আর পিসতুতো দাদা সেগুলো আবিষ্কার করেছিলুম । ছোটোকাকিমার শাড়ির আড়ালে যে একজন ভেনাস লুকিয়ে, তা টের পাইনি কখনও । 

জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
বিহারের ভূমিকম্পে ভাড়ার চালাবাড়ি ধ্বসে পড়ার পর বড়জেঠা ঠাকুমার আর বড়জেঠিমার গয়নাগাটি বেচে ইমলিতলা নামে একটি নিম্নবর্গ ও গরিব শিয়া মুসলমান অধ্যুষিত পাড়ায় বাড়ি কেনেন । তখন নিম্নবর্গের লোকেদের বলা হতো অস্পৃশ্য, আর সেকারণেই দুসাধ-মুসহর-কাহার-ডোম-চামার পরিবার অধ্যুষিত ঘিঞ্জি নিচুচালা-বস্তির সস্তা এলাকায় বাড়ি কেনা সহজ হয়। তেঁতুলগাছটা দাদার জন্মের সময়ে ছিল, আমি দেখিনি, কেননা তেঁতুলগাছটা কেটে সেই জায়গায় জলের কল আর গ্যাসবাতির থাম বসিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার । পাটনার অন্যান্য বাঙালিরা ইমলিতলাকে বলতেন ছোটোলোকদের পাড়া । সেকারণে আমাদের পরিবারের সদস্যদের ওপর ওই ‘ছোটোলোক’ ছাপ্পা পড়ে গিয়েছিল । পাটনার শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান বাঙালিরা ইমলিতলার গুয়ে ভাসা সরু গলির ভেতরে ঢুকে দিনের বেলাতেও আমাদের বাড়ি আসতেন না । বড়জেঠা যেতেন তাদের বাড়ি, সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য । আমি যখন স্কুলে ঢুকলুম তখন স্কুলের বন্ধুরাও ইমলিতলা শুনে আমাদের বাড়ি আসতে চাইত না ; অনেকে নাম শুনেই ভয় পেত, অঞ্চলের কুখ্যাত নিবাসীদের কাজকর্মের দরুন । মেজদা, যাকে শিশু অবস্হায় এক বেশ্যার কাছ থেকে বড়জেঠা কিনেছিলেন, পাড়ার চাপ এড়াতে না পেরে পুলিশের নথিতে গুণ্ডা হয়ে গিয়েছিল, মাদকের দরুন আর বড়োজেঠিমার বশীকরণের বিভূতি খেয়ে কম বয়সে মারা গিয়েছিল ।

     মলিতলার গাঁজা-চরসখোররা কেউই বিশ্বাস করতে চায়নি যে ধবধবে শাদা শুয়োর হয় আর তার মাংস খেতে দিশি কালো শুয়োরের চেয়ে ভালো, ওরা ভেবেছিল আমি ইয়ার্কি করছি, “হাঃ হাঃ হমনিকে বুড়বক সমঝ লইল কা ববুয়া” । আমি তাই আর ওদের ভুল ভাঙাইনি যে সূর্য পৃথিবীর চারিদিকে ঘোরে না ; জানি ওদের নাতিরা স্কুলে যেতে আরম্ভ করলে পাকা ভুরু কুঁচকে বসে থাকবে ।   ইমলিতলার গঞ্জেড়িদের জমায়েতে ইঁদুর পুড়িয়ে খাওয়া হতো ; বমি করে ফেলব আঁচ করে,  একটুকরো মুখে দিয়ে চেখেছিলুম,  সোঁদা গন্ধ।  দাদা খেয়ে দেখেছিল, তাড়ি দিয়ে ।

ইমলিতলার বাড়িতে একটা ফোটো ছিল বড়ো জ্যাঠাইমার, দুহাতে ব্লাউজ দুদিকে মেলে আছেন, টপলেস দেখিয়ে, কেননা ওনার মাপের মাই আর কারোর ছিল না বাড়িতে, পাড়াতে শুধু কালুটুয়ার চাচির ছিল, তামাটে, জেঠিমার মতন গোলাপি-ফর্সা নয় । কে তুলেছিল জানি না, হয়তো বাবা, হয়তো কোনও কাকা, হয়তো মেজ-জ্যাঠা । ফোটোটা যদি সঙ্গে থাকতো তাহলে নন্দনতাত্ত্বিক আবু সয়ীদ আইয়ুবকে দেখাতে পারতুম, “এই দেখুন স্যার, আমার বড়োজেঠিমা” । বুঝতে পারতেন আমি কেমনধারা পরিবারের প্রডাক্ট ।

ইমলিতলায় আমরা তিন ভাই, দাদা-মেজদা-আমি গোলা রোড ধরে কোনো শবযাত্রার ‘রাম নাম সৎ হ্যায়’ ধ্বনি শুনলেই কুকুরের মতন উৎকর্ন কানে শুনে নিয়ে দৌড় লাগাতুম, তা সন্ধ্যার পড়াশুনায় হারিকেনের চারপাসে বসে থাকলেও । শবযাত্রার যিনি কর্তা তিনি কোঁচড় থেকে খই আর তামার পয়সা ছুঁড়তেন আর পাড়ার ছেলেরা সেগুলো কুড়োবার জন্য কাড়াকাড়ি করত । আমরা তিন ভাই পয়সা কুড়োতে এমন দক্ষ হয়ে গিয়েছিলুম যে কাউকে ঘেঁসতে দিতুম না । ধনী বাড়ির শব হলে একানি, দুয়ানি এমনকি আধলাও পাওয়া যেতো । দাদা পয়সাগুলো দিয়ে আলুকাবলি খেতো । মেজদা সেগুলো দিয়ে গর্তে ফেলার জুয়া খেলতো । আমি পয়সাগুলোর বদলে বড়োজেঠিমার মায়ের কাছ থেকে রুপোর টাকা নিতুম, চৌষট্টি পয়সায় একটা টাকা। বড়োজেঠিমার মা প্রতি বছর তীর্থ করতে যেতেন পাটনা হয়ে ; ভিকিরিদের বিলোবার জন্য পয়সা-একানি-দুয়ানি নিতেন । আমার কাছে এখনও আছে ওনার দেয়া বেশ কিছু রুপোর টাকা । উনি আমাদের জন্য খেজুর গুড়ের মুড়কি, গোলাপ জাম, জামরুল আনতেন ।

শ্রদ্ধা ও স্মরণ 👇



Post a Comment

0 Comments