জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা ১৩৩

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা ১৩৩
সম্পাদকীয়,
আগের সপ্তাহে ছোটোবেলা প্রকাশ পায়নি। অনেকে বলেছে ছোটোবেলার লিঙ্ক দাও। ছোটোবেলার লিঙ্ক কই। আমি বলেছি, দাঁড়াও ছোটোরা রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন করবে তবে না লিখবে। পঁচিশে বৈশাখ থেকে এক সপ্তাহ আমরা রবি স্মরণে মেতে উঠি স্কুলে স্কুলে পাড়ায় পাড়ায় ঘরে ঘরে। স্কুলে তো গ্রীষ্মের ছুটি কবেই পড়ে গেছে। তাই বলে রবীন্দ্র জয়ন্তীতে নাচ গান করব না তা কখনো হয়? এবারের ছোটোবেলা  প্রবাহনীলের ছড়ায়, ভানুপ্রিয়ার কবিতায়, সমাদৃতা আর স্নেহার কথায় নেচে গেয়ে উঠেছে। রবি ঠাকুরকে স্মরণ করে রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন শুধু যে স্কুলে স্কুলে হয় তা তো নয়। সব আঁকার স্কুলে স্কুলে রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি আঁকা চলছে তা তো ছোটোবেলার দপ্তরে রুদ্রাংশ, অবন্তিকা, জয়দীপ, অনুশ্রুতি, সঙ্গীতার আঁকা আসা থেকেই বুঝতে পেরেছি। সত্যি এও এক উৎসব বটে।  নাচের গানের আঁকার স্কুলে, পাড়ায় পাড়ায় সবাই রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন করছে। শ্রীপর্ণা আবার এ নিয়ে একটা দারুণ গল্প লিখেছে। সত্যি যদি সেই গল্প সত্যি  হতো কি মজাই না হতো। গরমে হাঁসফাঁস করতে করতেও পঁচিশে বৈশাখ পালনে বাঙালির আলান্তি নেই, এটাই অনেকটা স্বস্তির। দোলনচাঁপা আন্টিও তোমাদের সঙ্গ দিতে রবীন্দ্র জয়ন্তী নিয়ে লিখেছে। তবে গরমে স্বস্তি পেতে ঠান্ডা পেলে কে ছাড়ে বলো? প্রচ্ছদের ছবিতে দুই বন্ধু ঠান্ডা পেপসি খাবে বলে একটা পেপসি নিয়েই দুজনে কাড়াকাড়ি করছে। কি মজাই না লাগলো আমার ছবিটা দেখে। নিজের ছোটোবেলায় ফিরে গেলাম। ঋপণ আঙ্কেলকে ছবিটি পাঠানোর জন্য তোমাদের হয়ে ধন্যবাদ দিলাম। রবিঠাকুরের লেখা গান নাটক গল্প উপন্যাসের ডালি নিয়ে কথা শুরু করলে পাতার পর পাতা লেগে যাবে। রবীন্দ্র জয়ন্তী পালনে আমাদের ছোটোবেলাও এবার তাই অফুরন্ত। তবুও প্রতিবারের মতো শ্রীকান্ত আঙ্কেলের ধারাবাহিক উপন্যাস, বাসবদত্তা আণ্টির ধারাবাহিক ভ্রমণ আছে কিন্তু। আর আছে সব্যসাচী আঙ্কেলের মূল্যবান পাঠ প্রতিক্রিয়া। এবারের সংখ্যায় তোমাদের বন্ধুদের কলম তুলি নেচে গেয়ে উঠেছে। তাই আমি চাই তোমাদের পাঠ প্রতিক্রিয়াও আসুক হুড়মুড় করে ছোটোবেলার দপ্তরে।  - মৌসুমী ঘোষ।

আমার রবি, অমর রবি 
শৌর্য্য পাল
সপ্তম শ্রেণি, নর্থ পয়েন্ট ইংলিশ একাডেমি, মালদা

সহজ পাঠের সহজ ছড়া 
লিখতে বসেন যিনি
লম্বা দাড়ি চওড়া গোঁফে
আমরা তাঁকেই চিনি

ছোট্ট থেকে পড়ছি রবির
কবিতা গান ছড়া
'রবিবার' আর 'প্রশ্ন' সে তো
 কবির হাতেই গড়া

'তালগাছ'টার মতোই তিনি
সটান ছিলেন জানি
বিশ্বকবি নাম দিয়ে তাই 
আমরা তাঁকে মানি

খেলা করতে যখন বেরোই 
বিকেল বেলার দিকে
'বিচিত্র সাধ' মাথায় ঘোরে
রোদটুকু হয় ফিকে

সন্ধ্যা রাতে প্রদীপ ভাসে
সুরের নদী দিয়ে
রবি ঠাকুর গান লিখে যান
সব কিছুকে নিয়ে

ভানু যেমন সিংহ সেজে
আকাশ করে আলো 
'ভানুসিংহ' নামটি তেমন 
 কলমে জমকালো।।

সঙ্গীতা রানা
নবম শ্রেণি, কেশপুর গার্লস হাই স্কুল, কেশপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

স্কুলের নাম পঁচিশে বৈশাখ

শ্রীপর্ণা ঘোষ
নবম শ্রেণি, জওহর নবোদয় বিদ্যালয়, পশ্চিম মেদিনীপুর

আমি ২৫ শে বৈশাখে তৈরি হয়ে ২৫ শে বৈশাখে যাচ্ছি। দ্বিতীয় ২৫ শে বৈশাখ হল আমাদের স্কুলের নাম। আজ আমাদের স্কুলের জন্মদিনের সঙ্গে সঙ্গে স্কুলের নামকরণ যার প্রেরণায় তাঁরও জন্মদিন। আজ আমাদের অনেক কাজ - প্রতিবারের মতো গোটা স্কুল সাজানো। স্কুলের নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটা ক্লাসঘর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এক একটা নাটকের থিমে সাজানো হয়। এ বছর আমাদের ক্লাসঘরটাকে তাসের দেশ নাটকের থিমে সাজাতে হবে। আর আমাদের বন্ধুরা বিভিন্ন তাসের মতো সাজবে। যেমন রিয়া হয়েছে রানী। শ্যাম হয়েছে রুইতন। রাম চিরিতন। আর সুমিত গোলাম। আজ প্রতিটা ক্লাসের রোল নং ২৫ -এর সবচেয়ে বেশি সম্মান। কারণ স্কুলের নিয়ম অনুযায়ী ২৫ শে বৈশাখ প্রতিটা ক্লাসের রোল ২৫ কে রবীন্দ্রনাথ সাজতে হবে। 
এসবের সঙ্গে অনুষ্ঠান তো আছেই। কবিগুরুর কবিতা আবৃত্তি, গান, গল্পপাঠ, নাটক সবই অনুষ্ঠিত হয়। এবার তোমরা তো আমায় জিজ্ঞেস করবেই, আমি অনুষ্ঠানে কী করছি? 
আমি কিছুই করছি না। কারণ আমি অন্যদের মতো ভালো নাচ বা গান জানি না। রবীন্দ্র শিক্ষা বিষয়তে তো আমি খুব খারাপ ফল করেছি। আর সেদিন জয়িতা মিসের বকার পর থেকে তো আমায় আর কেউ কিছু করতেও বলে না। 
আসলে আমাদের স্কুলে বাংলা, ইংরাজি, অঙ্ক, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোলের সঙ্গে আরো একটা বিশেষ বিষয় পড়তে হয়। তা হল 'রবীন্দ্র শিক্ষা'। এতে শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথের লেখা পড়ান হয় ও তা নিয়ে বিশ্লেষণ বা চর্চা করা হয়। অন্য কোনো স্কুলে এই বিষয়টির কোনো গুরুত্ব না থাকলেও আমাদের স্কুলে  এই বিষয়টিতে ভাল ফল করা বা না করা আমাদের সম্মানের সঙ্গে জড়িত। এই বিষয়টিতে আমি খুব একটা ভাল নই। রবি ঠাকুরের লেখা কবিতাগুলোর সঠিক সারমর্ম আমি বলতে পারি না। আমি এক রকম ভাবে ভাবি কিন্তু বন্ধুরা বা শিক্ষিকারা অন্যরকম ভাবে ভাবে। 
সেদিন একটা কবিতা থেকে জয়িতা ম্যাম 'ধরনী' শব্দটির অর্থ জিজ্ঞেস করায় আমি বললাম, 'মা'। সেই শুনে বন্ধুরা মুখ টিপে হাসছিল। জয়িতা ম্যাম বললেন, এখানে 'ধরনী' মানে 'পৃথিবী'। তুমি এই বিদ্যালয়ে পড়ে এইটুকুও জানো না। তাহলে তুমি কীকরে কবিগুরুর কবিতা পাঠ করবে, তা না বুঝে, ভাবলেশহীন ভাবে?
আমাদের ক্লাসের অনেকেই খুব ভালো কবিতা আবৃত্তি করে। তবে তাদের মধ্যে সেরা সেঁজুতি। ভালো আবৃত্তি করার জন্য সেঁজুতির খুব নাম। এ বছরও ও আবৃত্তি করবে। 
হঠাৎ আমাদের ক্লাসের এক বন্ধু ছুটে এসে সবাইকে বলল, সেঁজুতির খুব শরীর খারাপ। ও আজ স্কুলে আসতে পারবে না।
সেই শুনে আমরা সবাই খুব অবাক হয়ে গেলাম ও  চিন্তায় পড়ে গেলাম। আলো ম্যাম বললেন, তাহলে তার জায়গায় কে পড়বে, অনুষ্ঠান সূচী তো তৈরি? তোমাদের মধ্যেই কাউকে বলতে হবে। 
সবাই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। কারণ প্রায় সবাই কিছু না কিছু করছে। তাছাড়া ওর মতো কবিতা কেই বা বলতে পারবে? তখন আলো ম্যাম আমাকে বললেন, তুই তো কিছু করছিস না, তুই বরং ওর কবিতাটা বলিস। 
আলো ম্যামের কথা শুনে ক্লাসের সবাই অবাক হয়ে গেল। আমিও আশা করিনি যে আমাকে কবিতা বলতে হবে। তবু আলো ম্যামের নির্দেশ মতো ম্যামের কাছ থেকে কবিতাটা নিয়ে নিলাম, যেটা সেঁজুতি পড়বে বলেছিল। কাগজটা খুলে দেখলাম, কবিতাটার নাম মূল্যপ্রাপ্তি। খুব শক্ত কবিতা, আশা করি পড়ে নিলে আমি বলতে পারব।
তারপর সব ঠিকঠাকই চলছিল। গোটা স্কুল সাজানো হয়ে গেলে প্রোগ্রামের জন্য সবাই তৈরি হয়ে নিচ্ছিল। আমিও কবিতাটা দেখে দেখে ভালোই রপ্ত করে ফেললাম।
এই সময় আমার ডাক পড়ল মঞ্চে, প্রদীপে তেল ঢালতে। আমি কবিতা লেখা পাতাটা একটা বেঞ্চে রেখে মঞ্চে গেলাম তেল ঢালতে। তেল ঢালার পর প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল। আমি আমার কবিতা লেখা পাতাটা আনতে গিয়ে দেখি, পাতাটা বেঞ্চের ওপর নেই। বেঞ্চের নিচে, এদিকে ওদিকে কোত্থাও খুঁজে পেলাম না পাতাটা। এবার আমি কী করি? অনুষ্ঠান তো শুরু হয়ে গেছে। ভয়ে আমার ঘাম দিতে শুরু করল। আমার তো অত শক্ত কবিতা এত অল্প সময়ে মুখস্থ হয়নি। দেখে দেখে যাও বা বলতে পারতাম, এখন কে রক্ষা করবে আমায়? তাহলে কি জয়িতা ম্যাম ঠিকই বলেছিলেন, আমি কবিগুরুর কবিতা বলার যোগ্য নই? 
আমাকে কাঁদো কাঁদো দেখে রবীন্দ্রনাথ অর্থাৎ কোনো দাদা, যে রবীন্দ্রনাথ সেজেছে, এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল কী হয়েছে?
আমি বললাম, আমি যে কবিতাটা পাঠ করব সেই কবিতা লেখা পাতাটা খুঁজে পাচ্ছি না। 
রবীন্দ্রনাথ দাদা বলল, খাতা দেখে গান আর পাতা দেখে কবিতা পাঠ করা ঠিক নয়। 
আমি বললাম, কিন্তু আলো ম্যাম বলেছেন। কারণ সেঁজুতির ঐ কবিতাটা পড়ার কথা ছিল। ও আসেনি, তাই ওর জায়গায় আমাকে পড়তে বলা হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ দাদা হেসে বলল, কেউ কারো কবিতা কক্ষনো বলতে পারেনা। সেঁজুতি যেটা ভাল বলতে পারে সেটা বলবে আর তুমি যেটা ভাল পারো তুমি সেটাই বলবে। যাও তুমি যেটা জানো সেটাই বলো তোমার মতো করে।
তারপর রবীন্দ্রনাথ দাদা চলে গেল। মাইকে আমার নাম ডাকলে আমি খোলা মঞ্চে এগিয়ে গেলাম। আমার তখন মনে পড়ছিল সেই কবিতাটা, যেটা আমার মা আমাকে বলত।
আমি মাইকে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করলাম, 
"মনে করো, যেন বিদেশ ঘুরে
মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে..."
জানিনা সেদিন আলো ম্যাম কী মনে করেছিলেন অথবা জয়িতা ম্যাম। কিন্তু সেদিন শ্রোতা সকলের মুখে এক অফুরন্ত আনন্দ দেখেছিলাম। আর তাদের সেই আনন্দে 'ধরনী' আর 'মা' কে একাকার হতে দেখেছিলাম।


রবির দিন
ভানুপ্রিয়া মাহাত
দশম শ্রেণী, জওহর নবোদয় বিদ্যালয়, পশ্চিম মেদিনীপুর


ক্যালেন্ডারে উড়ছে পাতা আজ, 
পঁচিশে বৈশাখ ।
অন্যরকম বইছে হাওয়া আজ,
সাজছে চারপাশ ।

ধুলো পড়া হারমোনিয়াম-এ আজ,
বাজছে নতুন নতুন সুর ।
মনে মনে ভাবছে খোকা আজ,
অন্যরকম লাগছে রোদ্দুর।

মা পরেছে নকশি শাড়ি আজ,
তার টকটকে লাল পাড় ।
বাবা পরেছে ধুতি - পাঞ্জাবি আজ,
লাগছে কী চমৎকার।

দিদি হঠাৎ গাইছে গান, কী হয়েছে তার!
কেন বা সবাই এমন করছে ব্যবহার?
কী হচ্ছে তার বাড়িতে, খোকা হতবাক, 
এমন সময় মনে হল, ঠাম্মাকে দরকার । 

ঠাম্মা বলে, শোনো খোকা আজ
স্পেশাল দিন।
বিশ্বকবি, কবিগুরু - আজ
তার যে জন্মদিন।

বোঝেনা খোকা কে যে উনি?
কী বা তার পরিচয়?
ভেসে আসা গান শুনে শুনে আজ
বাড়ে শুধু তার হৃদয়ের সঞ্চয়।

অবন্তিকা সিংহ 
নবম শ্রেণি, জি এস এস গার্লস হাইস্কুল, কলকাতা

আমাদের স্কুলে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন
সমাদৃতা হালদার
দশম শ্রেণী, পাঠভবন, কোলকাতা

গত ৯ই মে আমাদের স্কুল, 'পাঠভবনে' অনুষ্ঠিত হয়ে গেল রবীন্দ্রজয়ন্তী। ২রা মে থেকে হঠাৎ যখন গরমের ছুটি পড়ে গেল, ভাবছিলাম তাহলে কি এবার রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন হবে না! আবার এটাও ভাবছিলাম, যা গরম পড়েছে, তাতে গরমের ছুটি পড়ে ভালই হয়েছে। বাপ্ রে, কি অস্বস্তি আর কি গা জ্বালা করা রোদ্দুর! তাই মনে মনে খুশিই হয়েছিলাম। আমাদের ক্লাস যেহেতু ১১.৪০ থেকে ৪.৩০টে, তাই দুপুরের রোদে স্কুলে যেতে গিয়ে বড্ডো ক্লান্ত হয়ে যেতাম। যেদিন টুং করে স্কুল ছুটির বিজ্ঞপ্তি মায়ের মোবাইলে এসে গেল, মনে হয়েছিল, নিশ্চয়ই স্কুল থেকে। মা তখন রান্নাঘরে বাবার টিফিন গোছাচ্ছিল, মাকে বলতে মোবাইলটা খুলে দিল। দেখলাম স্কুল থেকে মেসেজ পাঠিয়েছে যে ২রা মে থেকে গরমের ছুটি। মাকে বলতে মা বললো, 'তাহলে তোদের রিহার্সালের কি হবে!' আমিও ভাবতে বসে গেলাম, তাইতো! তাহলে কি আবার অন লাইনে অনুষ্ঠান হবে! মানে, যেমনটা কোভিডের সময়ে হয়েছিল! যখন এই চিন্তা করছিলাম, তখন বাবা বললো "আরে না না...তোরা যারা অনুষ্ঠানে থাকছিস তাদেরকে তো যেতেই হবে। ঘাবড়াস না, অনুষ্ঠান ঠিকই হবে। অনেকে যাবে। এবার দ্যাখ, রবীন্দ্রজয়ন্তী পালনের সাথে তোদের পাঠভবনের যোগ তো আজকের নয়, বহুদিন ধরেই।" সত্যি, আমাদের স্কুলের নামকরণের সাথে শান্তিনিকেতনের পাঠভবনের সম্পর্ক আছে। বহুদিন ধরে চলে আসা সেই ধারা কোনদিন একেবারে বন্ধ হয় নি। তাছাড়া এবার তো আর সেই কোভিডের ভয় নেই। তাই অনুষ্ঠান ঠিকই হবে। 

ইতিমধ্যে রিহার্সাল পর্ব শেষের দিকে। মিসেরা আর স্যারেরা চূড়ান্ত তালিকা তৈরী করে ফেললেন। আমাদের জন্য লালপেড়ে সাদা শাড়ি আর ছেলেদের জন্য সাদা পাজামা পাঞ্জাবী। এটা অবশ্য প্রথম থেকেই চলে আসছে। আমাদের স্কুলে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালনে নাচ হয় না। কেবলমাত্র গান, কথা আর আবৃত্তির আয়োজন থাকে। নাচের আয়োজন করা হয় বসন্ত উৎসবকে ঘিরে। এটাই স্কুলের প্রচলিত রীতি বলতে পারি। তবে যাই বলো, গান যতখানি ভালবাসি, তার চাইতে একটু বেশিই ভালবাসি নাচ করতে। যদিও আমি ছোটবেলায় গান করতেই বেশি ভালবাসতাম। সিক্স সেভেনে নন্দিতা মিসের কাছে রবীন্দ্রজয়ন্তীর রিহার্সাল করতাম। এছাড়া জী বাংলায় অদিতি মুন্সীর কীর্তন গানগুলো আমার খুব ভালো লাগে। মিস একদিন গানের ক্লাসে আমায় একটা গান করতে বললেন, তখন "আমার মুক্তি আলোয় আলোয়" গানটা গাইলাম। আমি তখন কোথাও গান শিখি না। ক্লাস সিক্সে বসে কয়েক মাস গান শিখে ছেড়ে দিয়েছি। এটাকে অবশ্য তোমরা আলসেমিই বলবে। ক্লাস নাইনে বসে আবার কয়েক মাস তালিম নিয়েছি। কিন্তু সেটাও ক্লাস টেনের পড়াশুনোর ব্যস্ততায় আপাতত বন্ধ। যাইহোক, গান শুনে মিস আমায় স্কুলের রবীন্দ্রজয়ন্তীতে গাইবার জন্য বলতে রাজি হয়ে গেলাম। কিন্তু রিহার্সালে যেতে গিয়ে রোদের চোখরাঙানি দেখে আর তো ইচ্ছেই করছে না। এদিকে দেবাংশু স্যার পই পই করে বলেছেন যে গানের রিহার্সালে কেউ কামাই করবে না। সপ্তর্ষি স্যার তো আবৃত্তি দারুণ করেন। বন্ধুদেরও সেইভাবে করতে বলেছেন। তবে তাদের মধ্যে আবার দেবাশিস স্যারের আবৃত্তিটাই বেশি ভাল লাগে। তবে সব স্যারেরাই খুব অনুপ্রাণিত করেন আমাদের এইসব কাজকর্মে। পড়াশুনোর বাইরে এসবে নিজেকে যুক্ত রাখতে পেরে সত্যিই ভাল লাগে। আমার পছন্দের জিনিসটাই হলো নাচ আর গান। তাই এসব অনুষ্ঠানে থাকতে আমার বেশ লাগে। 

মোটামুটি ঘড়িতে যখন ঠিক ৯.৩০টা, পৌঁছে গেলাম স্কুলে। অনেকেই এসে গেছে তখন। দিদিরাও আছে। তাদের রিহার্সাল আমি দেখি নি। তারাও শাড়ি পরে সুন্দর করে দাঁড়িয়ে। সপ্তর্ষি স্যার আমাকে একটা জায়গায় দাঁড়াতে বললেন। মিসেরাও গোল করে দাঁড়িয়ে। ঘরের মাঝখানে একটা চেয়ারের ওপর রবি ঠাকুরের একটা বড়ো ফটো রাখা। আর সামনে একটা বড়ো প্রদীপ। টিচার ইন চার্জ, ভারতী মিস এসে রবির ফটোয় মালা পড়ালেন আর তারপর প্রদীপ জ্বালিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করলেন। এরপর তিনি মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে একটা লম্বা বক্তৃতা দিলেন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। শুনলাম। অনেক অজানা কথা জানলাম।

তারপর বড়ো দিদিরা পর পর কবিতা আবৃত্তি করলো। তিন চার জন আবার গানও গাইলো। আমরা বন্ধুরা মিলে একটা কোরাস গান গাইলাম। নন্দিতা মিস আর সপ্তর্ষি স্যার গান করলেন। সপ্তর্ষি স্যার রবি ঠাকুরকে নিয়ে একটা পাঠও পড়ে শোনালেন। গম গম করে উঠলো স্কুল প্রাঙ্গণ। তাঁর জীবনী আর কাজকর্ম নিয়ে যত শুনি ততই অবাক লাগে। তবে প্রচণ্ড গরমে বেশ কয়েকজনই আসতে পারে নি। প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে অনুষ্ঠান চললো। শেষ হবার পর পার্থদার কাছ থেকে কেক, মিষ্টি খেলাম। বন্ধুদের সাথে কথা বলছি, এমন সময় দেখি বাবা রাস্তার ওপারে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে। তারপর আর কি! বাড়ি ফেরার পালা। হারমোনিয়ামের সুর আর সপ্তর্ষি স্যারের কথা, দুটোই ভীষণ ভালো হয়েছিল।

জয়দীপ সাহা
সপ্তম শ্রেণী, সোদপুর হাই স্কুল, উত্তর ২৪ পরগণা

ঠাঁই

প্রবাহনীল দাস
নবম শ্রেণি, বিদ্যাসাগর শিশু নিকেতন, পশ্চিম মেদিনীপুর

গানে বা গল্প কথায়,
ঠাকুরের কলম হয়ে –
নিদারুণ মর্ম ব্যথায়,
লাগে যা মলম হয়ে,
হুল্লোড়, খুশির মাঝে
আমাদের উদ্দীপনা
যেভাবে প্রকাশ করি,
সেও তাঁর সৃষ্টি কণা,
কৈশোর এ মনোবীণ
তোলে সুর পদ্য হয়ে,
থেকে যায় তাঁর কাছে ঋণ
অপরিশোধ্য হয়ে।
রবীন্দ্র ভাবনা বাঁচে
শহরে, গঞ্জে, গাঁয়ে।
বর চাই তোমার কাছে,
দিয়ো ঠাঁই ঠাকুর-পায়ে।

রুদ্রাংশ দাস
অষ্টম শ্রেণি, সোদপুর চন্দ্রচূড় বিদ্যাপীঠ, উত্তর ২৪ পরগণা

রবীন্দ্র জয়ন্তী
স্নেহা দাস
নবম শ্রেণি, জওহর নবোদয় বিদ্যালয়, পশ্চিম মেদিনীপুর

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আমাদের বিদ্যালয়ে প্রতি বছর বৈশাখ মাসের ২৫ তারিখে রবীন্দ্র জয়ন্তী পালিত হয়। সংস্কৃতি, সাহিত্য ও কবিতার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মহান কাজের কথা স্মরণ করে  এই দিনটি সারা বিশ্বে পালিত হয়। 
আমাদের বিদ্যালয়ে প্রতিবারের মতো এবারও তার জন্মদিন উপলক্ষে তার কবিতা, নৃত্য, নাট্য ও গানের আয়োজন করা হয়। সন্ধ্যা ৬টায় আমাদের স্কুলে অনুষ্ঠান শুরু হয়। রবীন্দ্রজয়ন্তী পালনের জন্য  সকাল থেকেই বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলতে থাকে। ছাত্র-ছাত্রীদের নৃত্য, সংগীত প্রভৃতির অভ্যাস এবং স্কুল ও মঞ্চের সজ্জা প্রভৃতি। 
অনুষ্ঠানের প্রথমেই আমাদের অধ্যক্ষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করেন। ঠিক তখনই বিভিন্ন শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরা একটি সমবেত সঙ্গীত পরিবেশন করে। এরপর সমস্ত শিক্ষক শিক্ষিকা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিকৃতিতে পুষ্প অর্পণ করেন।এরপর আমাদের অধ্যক্ষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনী অনুসরণ করে ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশ্যে একটি বক্তব্য রাখেন। দুই ছাত্র ছাত্রী একে একে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুটি  কবিতা আবৃত্তি করে। শিক্ষার্থীদের দ্বারা একটি রবীন্দ্রনৃত্য পরিবেশিত হয়। এরপর অষ্টম শ্রেণির ছাত্ররা একটি সংগীত পরিবেশন করে। সবশেষে আমাদের  বিদ্যালয়ের মিউজিক ম্যাম এর অসাধারণ কবিতা আবৃত্তির দ্বারা অনুষ্ঠান শেষ হয়।
অনুশ্রুতি মন্ডল
তৃতীয় শ্রেণি, নাকপুরা প্রাইমারী স্কুল, পশ্চিম মেদিনীপুর


ধারাবাহিক উপন্যাস
লাচুঙের নেকড়ে
পর্ব ১২

শ্রীকান্ত অধিকারী

 কখন রামসি খেয়ালে ওর মামাদের কাছ থেকে চলে এসে যেখানে ওই বৃদ্ধা বাড়ির মালকিন বেতের চেয়ারে শুয়েছিল ঠিক তার বিপরীত দিকের ফাঁকা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাতের পাহাড় দেখছিল। আর ভাবছিল ওই কুতুবুদ্দিন নামে লোকটার কথা। কুতুবউদ্দিন আইবক নামে একজন দিল্লির রাজা ছিলেন। কিন্তু তার সঙ্গে এই ভদ্রলোকের কোনো মিল সে খুজেঁ পায় না। বরঞ্চ চেহেরা দেখলেই হাসি আসে। কথা শুনলে তো আরো।  
-- হেইডা আমি ঠিক কইতে পারব না। আমার আব্বা যদি কইতে পারে তো পারবে। উনাকেই জিগাইবেন। বলেই কুতুবউদ্দিন উঠে রুমের দিকে চলে যান। মনে হল মুক্তি যুদ্ধের কথা বিশেষ বলতে চান না। ছোটমামা বেশ জোরেই বলে, ঠিক আছে কুতুববাবু কাল ভোরে দেখা হচ্ছে। 
কুতুববাবু অন্ধকারে দ্রুত মিলিয়ে গেলে রামসির দিকে চেয়ে ছোটমামা বলে, কী রে কি বুঝলি? 
- লোকটা এমন করে উঠে পালালো কেন? ওদের ওখানের খবর তুমিই বা জানলে কী করে?  
- ওরে খ্যাপা চুয়াডাঙা আগে আমাদের নদীয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিল।দেখছিস না কথাগুলো অনেকটা আমাদের মত বলে, দু’একটা বাদ দিলে প্রায় একই রকম। আর ওদের ইতিহাস তো সারা বাংলা দেশের ইতিহাস। সে তো একটু আধটু পড়াশুনা করলে বা কান খুলে রাখলেই জানা যায়। কিন্তু আমি জানতে চাইছিলাম মুক্তি যুদ্ধের অজানা কথা। কত অজানা কথা আছে রে। সব কী বইয়ে লেখা আছে! না বাইরের লোকে জানে। জানালেই ও জানাতে পারত। কিন্তু জানি না বলে চলে গেল। 
- মামা দেখোগে অত খবরাখবর জানেই না। আমরা আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের 
কতটুকু জানি। গোটা দশেক স্বাধীনতা সংগ্রামীর নাম বলতে গিয়ে জিভ আটকে যাবে।  
- এটাই তো বড়ো দুঃখের রে। নিজেদের ইতিহাস জানার আগ্রহ এখন কারো মধ্যে তেমন দেখি না!
আরো একটা মজার ঘটনা জড়িয়ে আছে চুয়াডাঙার সঙ্গে। আমাদের লেখক শরৎচন্দ্রের সঙ্গে চুয়ডাঙার কাশিপুরের জমিদারবাড়িরও ভালো সম্পর্ক ছিল। সে সময় এই গাঙ্গেয় সমভূমি মানেই জল জঙ্গল। আর রাজা জমিদারদের শিকার। সেই শিকার করতে শরৎচন্দ্র জমিদারের সঙ্গী ছিলেন। শুধু তাই নয় নদীয়ার নবাবেরাও এই জঙ্গলাকীর্ণ এলাকায় শিকারে আসত। আহা এখানে এই লাচুঙে যদি কাশিপুরের জমিদারের মত একখান জমিদার সঙ্গে থাকত রে। তা হলে এ জীবনে শিকারের শখটাও মিটে যেত। 
- এখানে কী শিকার করতে? চমরী?   
 - সে না হয় চমরীর বদলে রেডপাণ্ডা কিংবা নেকড়েও হতে পারে। 
নেকড়ের কথা উঠতেই হঠাৎ রামসির চোখ বাইরে দিকে চলে যায়। বৃষ্টি ধরে গেছে। মেঘলা ধোঁয়াটে ভাবটা আর নেই। অদুরে একটা উঁচু স্থান থেকে হয়তো কোনো পাহাড়ে টিমটিমে আলো দিবদিব করছে। 
রামসিকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে গ্যাটসো ও প্রান্তে কিছুটা দূর থেকেই বলে, ও লাচুঙ মনাস্ট্রি। চিন্তা মত করো। কাল যায়েঙ্গে। –ভাবছিল, রামসি এই উন্মুক্ত অনাবিল রহস্যে ঘেরা প্রকৃতির মাঝে এই কথাগুলোই ভাবছিল। মনাস্ট্রির কথা। 
-আমাদের ওখানে কি এই ধরনের কোনো মনাস্ট্রি আছে? কে জানে! যদি থাকে তাই বা কে খবর রাখে? তারপর  নিজেই নিজের প্রশ্নের উত্তর দেয় — মনাস্ট্রি মানে তো বৌদ্ধ ধর্ম। ওই ধর্মের মানুষ কি আমাদের ওখানে আছে। কই সে রকম তো দেখা যায় না। তবে কোলকাতায় রাস্তায় এক বার অনেক বৌদ্ধ ভিক্ষু দেখেছিল। মাসীর বাড়ি বেড়াতে গিয়ে দেখেছিল মেদিনীপুর শহরেও একটা বৌদ্ধ বিহার। ইতিহাসে তাম্রলিপ্তের কথা পড়েছে। তাম্রলিপ্ত মানে তো পুরোনো মেদিনীপুর! আর কোথায় আছে এই ধরণের মনাস্ট্রি ফিরে গিয়ে খোঁজ নেবে। তবে ছোটমামাকে জিজ্ঞাসা করলে ঠিক বলে দেবে। যতই হোক ইতিহাসের অধ্যাপক তো। রামসি মনটা খুশিতে ভরে ওঠে। কিন্তু সে বেশিক্ষণ খুশিতে থাকতে পারে না। হঠাৎ সেই ভয়ঙ্কর লোকটা ওর সামনে ফ্যাসফেসে গলায় হেসে ওঠে, -- জঙ্গল দেখে ভয় লাগছে? বাচ্চু!
এখানে তার পরিচিত বলতে একমাত্র মামাই জেগে আছে। বাকীরা ঘরের ভেতরে। তাই হঠাৎ অপরিচিত একজন ওর কাঁধে হাত দিয়ে টানলে ভয় পাওয়ারই কথা। আবার সে যদি হয় ওর ভালো না লাগা মানুষ। 
রামসি কোনো কথা বলতে পারে না। শুধু ফ্যাকাসে মুখে তাকিয়ে থাকে। 
- ঘুমিয়ে পড়ো গে খোকা। নইলে বাঘে ধরবে। নেকড়ে বাঘ। লোকটা আবার বলে, ওই যে পাহাড়ের  নীচে জঙ্গল, সেখান থেকে হালুম করে লাফ মেরে খপ করে ঘাড়ে ধরে তুলে নিয়ে চলে যাবে। তোমার মা-বাবা এমন কি ঐ লাল্টু মামাও খুঁজে পাবে না। বলেই শব্দহীন বিদঘুটে হাসি হাসতে থাকে। গোঁফ-দাঁড়ির ফাঁকে ছোট ছোট চোখদুটো শুধু বেরিয়ে আসে। 
 তারপরেই হঠাৎ কিছু অন্ধকারে ফেলে দিয়ে জোরালো হিসহিসিয়ে বলে – স্নেক! সঙ্গে সঙ্গে একটা তীক্ষ্ণ আলো এসে কাঠের পাটাতনে ঠিকরে পড়ে। সেকেন্ডের মধ্যে বিদ্যুৎ চমকের মতো একবার চমকেই আলোটা হারিয়ে যায়। আবার ঘন অন্ধকার রামসিকে চেপে ধরে। কিন্তু এইটুকু সময়ের মধ্যেই রামসি যা দেখার দেখে নেয়। একটা সাপ! সোনালি রঙের ছোট, এক হাতের মতো। লাফিয়ে লাফিয়ে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। সামনের লোকটা তখনো দাঁত বের করে বুল ডগের মত ফ্যাস ফ্যাস করেই চলে।  
মুখ দিয়ে কোনো শব্দ ফোটার আগেই একটা ধাতব কিছু উড়ে এসে সাপটার গায়ে লাগে। তৎক্ষণাৎ দু’দিক থেকে জোরালো দু'টো আলোর রশ্মি ছিটকে পড়ে ঠিক রামসির পায়ের কাছে।  
- মক ভাইপার! পাহাড়ি সাপ।গ্যাটসো চাপা স্বরে বলে।  
- অন্যদিকে ছোটমামার হাতে টর্চ। তখনো জ্বলছে। 
আর কেউ দেখল না, অন্ধকারের ভেতর থেকে একটা পিস্তল তাক করে ছিল লোকটার দিকে। অন্ধকারে সেই লোকটাকে দেখা গেল না, আর সেই পিস্তলটাকেও।লাচুঙের পাহাড়ি এক হোমের বারান্দায় স্তম্ভিত হয়ে ক্ষণিকের জন্য সবকিছু থেমে রইল। হয়তো লাচুং চুও।  
( ক্রমশ)

ধারাবাহিক ভ্রমণ
মহাবালেশ্বরের পথে
বাসবদত্তা কদম

তৃতীয় পর্ব

ট্যাক্সি ছুটল পাহাড়ি রাস্তা ধরে। শহর এলাকা ছাড়াতেই, কি নির্জন! কি নির্জন! রীতিমতো ভয় লাগবে একা হলে। পাহাড় আর জঙ্গল। মাঝে মাঝে দু-একখানা তালাবন্ধ বিশাল বিশাল বাড়ি। বাড়ি নয় বাংলো বলাই ভালো। এভাবে যাচ্ছি- প্রথম যেখানে থামলো সে ট্যাক্সি, সে জায়গার নাম এলফিন্সটোন পয়েন্ট। এই একই নামে বম্বেতে একখানা স্টেশনও দেখেছি মনে পড়ল। 
পাহাড়কে যেন ধাপে ধাপে কেটেছে কেউ। ঝুম চাষ দেখেছ পাহাড়ে, তেমন অনেকটা কিন্তু ঠিক তেমন নয় কিছুতেই। কি অপূর্ব দক্ষতায় কোটি কোটি বছর ধরে প্রকৃতি নিজের হাতে সাজিয়েছে সে পাহাড়কে। ছবি দিলাম। ছবিতে কিছুই ধরতে পারিনি হয়ত, তবু যেটুকু পারি। চোখ প্রকৃতিকে যেভাবে দেখতে পায়, ক্যামেরা কিছুতেই তাকে সেভাবে ধরতে পারে না। 
ভূ-বিজ্ঞানীদের মতে- এসব পাহাড়ের রূপ এমন নাকি হয়েছিল লাভা উদগিরণের ফলে। 
এই পাহাড়গুলো ছিল সব জ্যান্ত আগ্নেয়গিরি। 
সেখান থেকে মাঝে মাঝেই নেমে আসত গরম লাভার স্রোত। বার বার। সে অবশ্য কয়েক কোটি বছর আগের কথা। 
আর তারপর আগ্নেয়গিরি ঠান্ডা হলে কয়েক কোটি বছরের ঠান্ডা হাওয়া ধীরে ধীরে জমিয়ে দিয়েছে তাকে। 
কে বলতে পারে! কিভাবে হয়েছিল এমন ডিসাইন? আমরা শুধু দেখে উপভোগ করতে পারি তার সৌন্দর্য্য। 
ওখানেই কাছেই আরেকটি পাহাড় আছে যাকে বলা হয় লোটাস পয়েন্ট। প্রকৃতির হাতের দক্ষতায় সে এক বিশাল না ফোটা পদ্ম ফুল।
রাস্তায় আরেকবার দাঁড়াল ট্যাক্সি। নাম মারজোড়ি পয়েন্ট। 
এরপর যেখানে গেলাম সে জায়গার নাম আর্থার পয়েন্ট। একে বলা যায় মহাবালেশ্বরের সব থেকে ভালো ভিউ পয়েন্ট। এখান থেকে মহাবালেশ্বরকে দেখা যায় সব থেকে ভালো। একদিকে সবুজ পাহাড়, অন্যদিকে সাবিত্রী নদীর সোঁতা। সে নদী শুকিয়ে গিয়েছে। এখানকারই একটি ঝর্ণা থেকে সাবিত্রী নদীর জন্ম। 
শোনা যায়, এই সাবিত্রী নদীতেই এক নৌকো দুর্ঘটনায় মারা গেছিলেন আর্থার সাহেবের স্ত্রী আর ছোট্ট মেয়ে। আর্থার এখানেই বাড়ি বানিয়েছিলেন। পাহাড়ের ওপর বসে নাকি নদীর দিকে তাকিয়ে থাকতেন। সম্ভবত সেই আর্থার পয়েন্টটি এখন নেই, ভেঙে গেছে। তবু আশেপাশের জায়গারও একই নাম। অপূর্ব সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করা যায় এখান থেকে। এটি সমুদ্রতল থেকে ১৪৭০ মিটার উপরে। 
এর থেকে উঁচু একটিমাত্র জায়গা সেটি এখানকার সানসেট পয়েন্ট। এখান থেকেই নাকি সূর্য ওঠা এবং অস্ত যাওয়া দুই’ই খুব ভালো দেখতে পাওয়া যায়।   
এর পরের দিন দেখলাম কেট পয়েন্ট, বীণা লেক, কৃষ্ণাবাই মন্দির,  সব একে একে দেখলাম বাকি দু-দিনে।
কেট পয়েন্ট যাবার আগেই সামনের দেখালেন ড্রাইভার দাদা। দেখি এক বিশাল হাতি পাহাড়ের মধ্যে। মুলোর মত দাঁত, কুলোর মত কান সবই আছে। এ কি লাভায় জমে যাওয়া কোনো হাতি? না! পাহাড় নিজেকে হাতিরূপ দিয়েছে। সব সেই লাভা যুগের সময় ঘটে যাওয়া ঘটনা। এ পয়েন্টের নাম এলিফ্যান্ট পয়েন্টও বটে আবার নিডল পয়েন্টও বটে। কে যে কবে কোন নাম দিয়েছেন তা খুব একটা কেউই বলতে পারেন না। তবে এলিফ্যান্টের মুন্ডুখানা এত স্পষ্ট যে এলিফ্যান্ট পয়েন্ট নামখানা বেশ মানায় এই জায়গাকে। 
আমার মত মানুষেরা সার বেঁধে দাঁড়িয়ে তার ফটো তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। (ক্রমশ)

স্মরণীয় দিবস
রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী 
(২৫শে বৈশাখ)
কলমে - দোলনচাঁপা তেওয়ারী

১২৬৮সালের ২৫শে বৈশাখ, কলকাতার  বিখ্যাত জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে রবীন্দ্রনাথ জন্মগ্রহণ করেন। তাই বাঙালির কাছে পঁচিশে বৈশাখ দিনটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন।
১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান রবীন্দ্রনাথ।
অতুলনীয় সাহিত্য কীর্তি ও  বহুমুখী প্রতিভার জন্য তিনি তাঁর জীবদ্দশাতেই পৃথিবী বিখ্যাত হয়েছিলেন।
পঁচিশে বৈশাখ, এই দিনটি বাঙালি জাতির কাছে অত্যন্ত খুশির দিন। পঁচিশে বৈশাখ রবীন্দ্রনাথ জন্মগ্রহণ করেছিলেন, এই জন্য এই দিনটি রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী নামেও বিখ্যাত। বাঙ্গালীদের কাছে আজ, এই দিনটি মানেই একটি উৎসবের দিন।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা এবং বাংলাদেশ ছাড়াও পৃথিবীর যেখানে যেখানে বাঙালি জাতি আছে তাদের প্রত্যেকের কাছে এই দিনটি একটি উৎসবের দিন। পশ্চিমবঙ্গে এই দিনটি রাষ্ট্রীয় ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়।
এই দিনটি বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পালিত হয় যেমন রবীন্দ্র সঙ্গীত, রবীন্দ্রনাথের কবিতা, রবীন্দ্র নাট্যাভিনয়, নৃত্যনাট্য, রবীন্দ্র রচনা পাঠ ও আলোচনা সভা ইত্যাদি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দিনটি পালিত হয়ে আসছে।
পশ্চিমবঙ্গে রবীন্দ্রজয়ন্তীর প্রধান অনুষ্ঠানগুলি আয়োজিত হয় কলকাতায় অবস্থিত রবীন্দ্র জন্মস্থান জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি, রবীন্দ্রসদন ও রবীন্দ্রনাথের তৈরি শান্তিনিকেতনে।
এমনকি আমাদের পাশের রাষ্ট্র বাংলাদেশেও বিভিন্ন ছোট- বড় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রবীন্দ্র জয়ন্তী পালিত হয়। এছাড়াও শিলাইদহ কুঠিবাড়ি ঘিরেও একটি অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। ছোট-বড় প্রায় সকল প্রকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের জন্ম -জয়ন্তী বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পালন করা হয়।
রেডিও টেলিভিশনে সারাদিনব্যাপী প্রচার করা হয় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান। এমনকি ছোট- বড় সব ধরনের পত্র -পত্রিকাতেই রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এক বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করা হয়। স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে রবীন্দ্র বিষয়ক প্রদর্শনী ও বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান যেমন বিতর্ক, চিত্রাঙ্কন ইত্যাদি প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় এই দিন।
রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেও রবীন্দ্রজয়ন্তী পালিত হতো ঘটা করে এবং সাড়ম্বরে। এই দিবসটি পালনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি বাঙালির ভাষা ও সাহিত্য শিক্ষা এবং সাংস্কৃতিক মন ও মানসিকতা বিকাশে রবীন্দ্রনাথের অবদান অনস্বীকার্য। বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
পাঠ প্রতিক্রিয়া
( ১৩২ তম ছোটোবেলা সংখ্যাটি পড়ে সিউড়ির সব্যসাচী ধর যা লিখলেন)

জ্বলদর্চির ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা ১৩২ পড়লাম।অবশ্য প্রতি সপ্তাহেই পড়ি। রবিবারে  বেশ কয়েকটি পত্রিকা নিয়ে থাকি। আর অপেক্ষা করি অনলাইন পত্রিকা জ্বলদর্চির ছোটোবেলা সংখ্যার জন্য। এই পত্রিকার ধারাবাহিক রচনার উপর যেমন একটা টান থাকে তেমনি নিত্যনতুন কিছু সাহিত্যসৌরভ ও দৃষ্টিনন্দন কিছু উপস্থাপনা এ পত্রিকার স্বাভাবিক গুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর সঙ্গে থাকে সাম্প্রতিক বিষয়ের উপর আলোকপাত। 
  ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা  ১৩২ বিশেষত্ব নিয়েই উপস্থিত হয়েছে। প্রথমেই সুদীপ পাত্রর অনন্য সাধারণ ফটোগ্রাফি বিস্ময়ে হতবাক করে তোলে। কী চমৎকার ছবি তোলার হাত ! 
   মন ভালো করা সম্পাদকীয় লেখেন মৌসুমী ঘোষ। ছোটোদের জন্য এমন সাবলীল বাংলা লেখা এখন দুর্লভ। আসলে সেই অর্থে ছোটদের জন্য পত্রিকা আছে অনেক। সেখানে কিন্তু ছোটোদের জন্য সুললিত ভাষ্যের বড় অভাব। মৌসুমীর কাছে সে প্রীতিভাষ্য প্রতি সপ্তাহে শিখে নেওয়া যায়। 
   শ্রীকান্ত অধিকারীর ধারাবাহিক উপন্যাস --'লাচুঙের নেকড়ে' দেখতে দেখতে ১১ পর্বে চলে এলো। জমে উঠেছে এ থ্রিলার। রামসির কাঁধটা কেন বাংলাদেশী  লোকটি চেপে ধরলো তা জানার জন্য এক সপ্তাহ অপেক্ষা করতেই হবে। এ পর্বে ছোটমামার বাতিকগ্রস্ত দিকটি যেমন ফুটে উঠেছে তেমনি গ্যাটসোর জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য চিত্ত ভাবনাহীন জীবনদর্শন এবারে পাওয়া গেল। 
একই সঙ্গে বাংলার মধ্যযুগীয় ইতিহাসকেও লেখক তুলে এনেছেন এ পর্বে। 
  ভগবান বুদ্ধদেবের জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে অসাধারণ এক ছবি এঁকেছে অভিজিৎ ভঞ্জ। তেমনি আর একটি নয়নমনোহর জলরঙের ছবি উপহার দিয়েছে শ্রেয়া বিষয়ী। 
   কবিপক্ষে কিশোর রাহুল পাত্রর 'প্রাণের রবি' অসাধারণ কবিতাটি পড়ে মনে পড়ছে কিশোর কবি  সুকান্ত ভট্টাচার্যের রবীন্দ্রনাথের প্রতি কবিতাটি। তাঁর লেখায় 'কত সুখ কত দুঃখ' -- এ বয়সে অনুভব করেছে রাহুল। এ অনুভব নিয়েই কলম চলুক। 
   গৌরাঙ্গ দাসের অনুগল্প হলুদ টিয়া ' তোতা সাহিত্যে' আর একটি সংযোজন। তোতা নিয়ে কত গল্প যে লেখা যায়! পক্ষীসমাজেও রঙের সমস্যা আছে! আবার একাত্মতার রূপকধর্মীতা  গল্পে অন্য বার্তা নিয়ে এসেছে। 'সমাজচুতো' কি ইচ্ছে করেই লেখা? 
    দোলনচাঁপা তেওয়ারী দে নিয়মিত লেখেন সমকালীন/ পালনীয় /স্মরনীয় দিবসগুলি নিয়ে। এবারে রেডক্রস ডে ( ৮ই মে) নিয়ে চমৎকার বার্তা দিয়েছেন। " আমরা যাই করি না কেন হৃদয় থেকে করবো" এ কথা সবকিছুতে মনে রাখা দরকার। তথ্য ও ইতিহাসে লেখাটি মনে দাগ কেটে যায়। 
     বাসবদত্তা কদমের ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনি--" মহাবালেশ্বর পথে" আরম্ভ হয়েছে। এখন সলতে পাকানো চলছে , গন্তব্যে পৌঁছতে দেরী আছে। তবে বর্ণনা অতি সুন্দর। শ্রীকান্ত এবং বাসবদত্তা দুজনে ভারতের দু প্রান্তে আমাদেরকে ছুটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আর সে গাড়ির রিমোট  সম্পাদক মৌসুমী ঘোষের হাতে। 
   আবার সাতদিন। সামনের রবিবার। অপেক্ষা।

Post a Comment

1 Comments