জ্বলদর্চি

মঙ্গলচণ্ডী পূজা /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ৭৩
মঙ্গলচণ্ডী পূজা

ভাস্করব্রত পতি

নিজের সন্তানের মঙ্গলচিন্তায় অস্থির জননীর মাঙ্গলিক ভাবনার বহিঃপ্রকাশ যেভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে তা হল মঙ্গলচণ্ডী বা জয়মঙ্গলবারের ব্রত পালন। এই লৌকিক উৎসবটির মুখ্য উদ্দেশ্য সন্তানের মঙ্গলচিন্তা। আর এজন্য বেছে নেওয়া হয়েছে মঙ্গলবার কে। এই উৎসব পালন করলে সন্তানের মঙ্গলের পাশাপাশি কুপুত্রও সুপুত্র হয়। সেইসাথে মৃত পুত্রও পুনর্জীবিত হয় বলে বিশ্বাস।

জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রতি মঙ্গলবার এটি পালনের জন্য নির্ধারিত। সারাজীবন ধরে পালন করলেও ক্ষতি নেই। ব্রতীদের সারাদিন উপবাস থাকতে হয়। এতে প্রয়োজন হয় ১৭ টি করে কাঁঠাল পাতা, আমপাতা, বেলপাতা, তুলসীপাতা, ধান, যব, দূর্বা, এবং ১ টি করে চাঁপা কলা, গোটা সুপুরি এবং বিভিন্ন ধরনের ফল। ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় 'ব্রতপিডিয়া' তে উল্লেখ করেছেন, "জ্যৈষ্ঠমাসের প্রতি মঙ্গলবারে কুমারী ও এয়োস্ত্রীরা সংসারের মঙ্গলকামনায় স্মরণ করেন মা মঙ্গল চণ্ডীকে। মায়েরা এইদিন কাঁঠালপাতায় দুব্বোঘাস, ধান, যব ও মুগকলাই রেখে খিলি বানিয়ে মা চন্ডীকে নিবেদন করেন ও পরে কলার মধ্যে সেই ধান যব পুরে 'গদ' গিলে খান। আমলা বাটা আর হলুদ দিয়ে স্নান করানো হয় মা'কে এবং পাঁচটি ফল দান করতে হয়"। 

পুজোর শেষে ব্রতকথা শোনা অতি আবশ্যকীয় উপচার। এরপর ব্রতীকে পুকুরঘাটে গিয়ে বাটায় রাখা ধানের খোসা ছাড়িয়ে চাল বের করে ১৭ টি চাল, যবের খোসা ছাড়িয়ে নিয়ে ১৭ টি যব এবং ১৭ টি তুলসী পাতা ও ১ টি কলা ছাড়িয়ে মেখে তিনভাগ করে নিতে হয়। সেই ভাগগুলি তিন বারে গিলে খেতে হয়। এক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হয় যে খাওয়ার সময় যেন এই মণ্ডগুলি যেন দাঁতে না লাগে। এরপর তিনবার এক চুমুক করে জল খেয়ে পুজোর বাকি সব অতিরিক্ত সামগ্রী পুকুরের জলে বিসর্জন করে দিতে হয়। 
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
কলা গাছের পাতার সামনের সবুজ কচি অংশের উপর সিঁদুর দিয়ে দুটি পুতুল আঁকা হয়। এটি হল লক্ষ্মী এবং নারায়ণ। এবার কলার পাতার সামনে মাটি বা পেতল বা তামার তৈরি ঘটস্থাপন করা হয়। সেই ঘটে পাঁচটি সিঁদুরের ফোঁটা দিতে হবে। এর সাথে লাগবে বেলপাতা, সুপারি, পান এবং দূর্বা। Seasonal ফল একটি করে দিতে হয়। এছাড়াও দেওয়া হয় একপোয়া বা পাঁচ ছটাক চিঁড়ে, চিনি এবং কলা। এই নৈবেদ্য পঞ্চ দেবতার উপলক্ষে দেওয়া হয়। পূজার শেষে মঙ্গলচণ্ডীর পাঁচালি পড়া হয়। এটি পালনের ফলে নির্ধনের ধন হয়। রোগী নীরোগ হয়, বন্ধ্যা মহিলার সন্তান হয়। আগুন ও সাপ থেকে কোনো বিপদের সম্মুখীন হতে হয়না বলে মানুষের বিশ্বাস। 

সধবা নারীরা একত্রিত হয়ে দেবী চণ্ডীর কাছে অর্ঘ দান করেন। আর চণ্ডীর ঘটকে সামনে রেখে ব্রতকথা শোনে মন দিয়ে। যখন ব্রতকথা শোনান কোনো একজন ব্রতিনী, তখন অন্যান্য ব্রতীনীরা ১ টি গোটা সুপুরি হাতে নিয়ে ব্রতকথা মন দিয়ে শোনেন। সেসময় ছড়া কেটে বলা হয় -- 
"আটকাঠি, আটমুঠি, সোনার চণ্ডী রূপোর বাটি 
কেন মা চণ্ডী এতক্ষণ।
হাসতে খেলতে, মন পুরে হাট বসাতে,
রোগ নিরোগ করতে, অপুত্রের পুত্র দিতে, নিৰ্ধনীকে ধন দিতে,
দক্ষিণে পড়েছেন মা, তাই জন্য এত রা।
পুত্র দণ্ডী ভো চণ্ডী, উদ্ধার কর মা মঙ্গলচণ্ডী"। 

বৈশাখ মাসের প্রতি মঙ্গলবারে মা মঙ্গলচণ্ডীর পূজা করে থাকেন অনেকেই। আবার অনেকে জ্যৈষ্ঠ মাসে আম কাঁঠাল দিয়ে পুরোহিত ডেকে পূজা করান সপ্তাহে একদিন। এর ফলে অমঙ্গল দূরীভূত হয়। পরিবারের মঙ্গল হয়। আসলে স্বামী, পুত্ৰ, কন্যা নিয়ে সুখে থাকার জন্য এবং সকলের মঙ্গলের জন্য মঙ্গলচণ্ডীর ব্রত করা হয়। আর মঙ্গলচণ্ডী হলেন দেবী দুর্গার আরেক রূপ। 

যে ব্রত কাহিনীর (সূত্র -- আশুতোষ মজুমদার) সন্ধান পাওয়া যায় তা এরকম -- "এক দেশে এক সদাগর আর এক বেণে বাস করতো। সদাগরের সাত ছেলে ছিল, আর বেণের সাত মেয়ে ছিল। একদিন মা মঙ্গলচণ্ডী এক বুড়ী বামনীর বেশ ধরে বেণের বাড়ি ছলতে গেলেন। গিয়ে বল্লেন, “ওমা, দুটি ভিক্ষে দাওগো।” বেণে বউ তাড়াতাড়ি সিদে সাজিয়ে ভিক্ষে দিতে এল। বামনী জিজ্ঞেস করেন, “তোমার কয় ছেলে, কয় মেয়ে মা”? বেণে বউ বল্লে, “আমার সাত মেয়ে মা, ছেলে নেই”। বামনী বল্লেন, “আমি ছেলে আঁটকুড়োর মুখ দেখি না, আর মেয়ে আঁটকুড়োর ভিক্ষে নিই না"। এই বলে, বামনী চলে যাচ্ছিলেন, বেণে বউ কেঁদে পায়ে পড়ে বলে, “যাতে ছেলে হয়, তার একটা উপায় কর মা”। বামনী একটি ফুল দিয়ে বল্লেন, “এই ফুল ধুয়ে জল খেলে তোমার ছেলে হবে, তাঁর নাম রেখো জয়দেব”। এই বলে বুড়ী চলে গেলেন। তারপর সদাগরের বাড়ি গিয়ে ভিক্ষে চাইলেন। 
সদাগর বউ সিদে সাজিয়ে ভিক্ষে দিতে এল। বামনী জিজ্ঞেস কল্লেন, “কয় ছেলে, কয় মেয়ে মা তোমার"? সদাগর বউ বল্লে, “সাত ছেলে মা, আমার মেয়ে নেই”। 
বামনী বল্লেন, “ওরে বাবা, আমি মেয়ে আঁটকুড়োর মুখ দেখি না, আর ছেলে আঁটকুড়োর ভিক্ষে নিই না”। এই বলে বানী চলে যাচ্ছিলেন, তখন তাড়াতাড়ি সদাগর বউ, সিদে মাটিতে রেখে, ছুটে গিয়ে বামনীর পা দুটো জড়িয়ে ধরে কেঁদে বল্লে, “মা, আমার উপায় কর, আমি বড় দুঃখী, আমার যাতে একটি মেয়ে হয়, তাই কর মা”। 
তখন বামনী বল্লেন, “তুমি এই ফুলটা ধুয়ে জল খেয়ো, তাহলেই তোমার একটি মেয়ে হবে, সেই মেয়েটির নাম জয়াবতী রেখো”। এই বলে ফুলটি দিয়ে চলে গেলেন।
ওদিকে দুজনেই পোয়াতি হল, দুজনেরই ছেলে মেয়ে হল। তাঁরা জয়দেব, জয়াবতী নাম রাখল। জয়াবতী ফুল তোলে, মা মঙ্গলচণ্ডীর পূজো করে । জয়দেব হেসে খেলে বেড়ায়। জয়দেবের পায়রা একদিন উড়তে উড়তে জয়াবতীদের বাড়ির দিকে গেল। তাই দেখে, জয়দেব তাঁর পেছনে পেছনে ছুটতে ছুটতে গেল। জয়াবতীদের বাড়ির কাছে এসে দেখে যে, জয়াবতী কয়েকটি ছোট ছোট মেয়েদের নিয়ে বাগানে, এক গাছতলায় মাটির বালির নৈবেদ্য সাজিয়ে ফুল দিয়ে সব পূজো কচ্ছে, আর তাঁর পায়রাটা জয়াবতীর কোলের উপর বসে আছে।জয়দেব দৌড়ে গিয়ে জয়াবতীকে বলে, “দাও, আমার পায়রা দাও, কেন তুমি একে ধরেছ"?
জয়াবতী ফ্যালকা মুখী হয়ে জয়দেবকে বল্লে, “আমি ত তোমার পায়রা ধরিনি — ও উড়ে এসে আপনি বসেছে, আর আমি এ পায়রা দেবো না”। 
জয়দেবের রাগ হয়ে গেল। সে বল্লে, “পায়রা না দিলে এসব দূর করে ফেলে দেব”। 
জয়াবতী বলে, “সে কি! এ যে আমরা জয় মঙ্গলবারের ব্রত কচ্ছি”। 
জয়দেব বল্লে, “তাই বুঝি ধুলো দিয়ে? এ ব্রত করলে কি হয়”? জয়াবতী বলে, “যে এ ব্রত করে তাঁর কখনও দুঃখ থাকে না, জলে ডোবে না, আগুনে পোড়ে না, খাড়ায় কাটে না, হারালে পায়, মরে গেলে বেঁচে ওঠে”। 
জয়দেব শুনে একটু হাসলে, তারপর বলে, “আচ্ছা, ব্রতের ফল এরপর বুঝবো, এখন আমার পায়রা দেবে কিনা বল”। 
আর সব মেয়েরা জয়দেবকে ভয় করতো। তাঁরা জয়াবতীকে বুঝিয়ে বল্লে। তখন জয়াবতী পায়রাকে উড়িয়ে দিলে। জয়দেব কট্‌মট্ করে চাইতে চাইতে বাড়ির দিকে চলে গেল।
এর পর দুই তিন বৎসর কেটে গেছে। জয়দেব ও জয়াবতী বড় হয়েছে। একদিন জয়দেব মাকে বল্লে, “মা ! আমি জয়াবতীকে বিয়ে করবো”। 
মা মঙ্গলচণ্ডী সদাগরকে স্বপ্নে বল্লেন, “তুই ওই বেণেদের ছেলের সঙ্গে তোর মেয়ের বিয়ে দে, নইলে তোর মেয়ে মরে যাবে”। 
সদাগর ভয়ে ভয়ে জয়দেবের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়ে অনেক ধনদৌলত, গয়না, জিনিসপত্র দিয়ে মেয়ে পাঠিয়ে দিলে। 
পথে যেতে যেতে জয়াবতীর মনে পড়লো, আজ মঙ্গলবার। অমনি তাড়াতাড়ি মঙ্গলবারের কথা মনে মনে বলে নমস্কার কল্লে। জয়দেব জিজ্ঞেস কল্লে, “তুমি বিড় বিড় করে কি বল্লে”? জয়াবতী বল্লে, “আজ মঙ্গলচণ্ডীর পূজো কিনা, তাই মনে মনে পূজো করে নমস্কার কল্লেম”। 
জয়দেব জিজ্ঞেস কল্লে, “ও পূজো কল্লে কি হয়”? জয়াবতী বল্লে, “কেন, মনে নেই, একবার বলেছিলুম যে, জলে ডোবো না, আগুনে পোড়ে না, খাড়ায় কাটে না, হারালে পায়, মরে গেলে বেঁচে ওঠে”। 
খানিক দূরে গিয়ে জয়দেব বল্লে, “দেখ, এখানে বড় চোরের ভয়। তুমি গয়নাগাঁটি সব খুলে ফেল”। এই বলে গয়নাগাঁটি সব খুলে নিয়ে একটা পুঁটুলী করে কাছের একটা নদীতে ফেলে দিলে। দিতেই একটা বোয়াল মাছে সেই পুটুলী গিলে ফেল্লে। 
বরকনে আসতেই পাড়ার সবাই বরণ করে তুলে, মেয়েকে দেখে বলে, “মাগো ! মেয়েকে গয়নাগাঁটি কিছুই দেয়নি”। 
তারপর বউভাতের সময় সেই রাঘব বোয়াল মাছ ধরা পড়লো। মাছ কেউ কুটতে পারলে না। শেষকালে জয়দেব বল্লে, “জয়াবতী মাছ কুটবে”। সকলে হেসে উঠলো। জয়াবতী মা মঙ্গলচণ্ডীকে স্মরণ করে মাছ কুট্‌তে গেল। যেমন বঁটি মাছের গায়ে ঠেকালে, অমনি মাছ কেটে খান খান হয়ে গেল, আর সেই গয়নার পুঁটুলী তাঁর কোলে এসে পড়লো। 
জয়াবতী সেই পুঁটুলী নিরে ঘরে গিয়ে হাত পা ধুয়ে তাঁর সেই হীরেমুক্তোর গয়না পরে এসে, মাছ কুটতে বসলো। তাই না দেখে সবাই অবাক্ হয়ে গেল। জয়দেব মুখ টিপে হাসতে লাগলো।
সবাই বল্লে, “এত রান্না রাঁধবে কে”? জয়দেব বল্লে, “জয়াবতী রাঁধবে”! জয়াবতী মা মঙ্গলচণ্ডীকে স্মরণ করে রাঁধতে গেল। মা মঙ্গলচণ্ডী এসে সমস্ত রেঁধে দিয়ে গেলেন। সবাই খেয়ে খুব সুখ্যাতি করলে।
তারপর জয়দেবের একটি ছেলে হল। একদিন ছেলেকে শুইয়ে জয়াবতী কাজে গেছে, জয়দেব এসে ছেলেকে নিয়ে গিয়ে কুমোরের পৌণে ফেলে দিয়ে চলে এল। সেদিন কুমোরদের পৌণ কিছুতেই জ্বলে না৷ শেষকালে মঙ্গলচণ্ডী এসে ছেলে তুলে নিয়ে জয়াবতীকে দিয়ে এলেন।
আর একদিন জয়দেব ছেলেকে নিয়ে গিয়ে পুকুরে সিঁড়ির তলায় ঘাড় গুঁজে পুঁতে দিয়ে এল। মা মঙ্গলচণ্ডী ছেলেকে বাঁচিয়ে জয়াবতীর কোলে দিয়ে এলেন, আর বলে দিলেন, “ছেলেকে সামলে রাখিস্”। 
তারপর আর একদিন জয়দেব ছেলেকে একখানা কাটারি দিয়ে কাট্‌ছিল, এমন সময় জয়াবতী এসে পড়লো। জয়াবতী এসে বল্লে, “তোমার এততেও বিশ্বাস হল না”? তখন জয়দেব বলে, “হ্যাঁ! এইবার আমার বিশ্বাস হয়েছে"। তারপর জয়াবতীর আরো ছেলে মেয়ে হল। শ্বশুর শাশুড়ী নাতি নাতনীর মুখ দেখে স্বর্গে গেল। 
জয়দেব জয়াবতী খুব সুখে স্বাচ্ছন্দে ঘরকন্না করতে লাগলো। ছেলেমেয়েদের সেই ব্রতের কথা বলে দিয়ে প্রচার কর্তে বলে দিল। তারপর স্বর্গ থেকে পুষ্পক রথ এল। জয়দেব জয়াবতী দুজনে চড়ে স্বর্গে চলে গেল। সেই অবধি জয় মঙ্গলবারের ব্রতকথা পৃথিবীতে প্রচার হল।

Post a Comment

0 Comments