জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা-৭৫/প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ৭৫

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

 সর্বশাস্ত্রপারগ আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল বলেছেন: “বিবেকানন্দ বয়সে আমার চেয়ে কিছু বড় হলেও আমি তাঁর এক ক্লাস ওপরে পড়তাম। বিবেকানন্দ ছিলেন নিঃসন্দেহে প্রতিভাসম্পন্ন যুবক, মুক্তস্বভাব, বেপরোয়া, মিশুক, সামাজিক সম্মিলনের প্রাণস্বরূপ এবং সুকণ্ঠ গায়ক। তিনি হিউমের সংশয়বাদ ও হার্বার্ট স্পেন্সারের অজ্ঞেয়বাদের সঙ্গে পরাচিত হন, ফলে তাঁর অবিশ্বাস ক্রমে স্থিতিশীল দার্শনিক সংশয়ে রূপান্তরিত হল। তাঁর আত্মা হয়ে উঠল অশান্ত, এলো জীবনে নীরসতা, ভক্তিমিশ্রিত প্রার্থনীয় মন যেন আর তৃপ্তি লাভ করত না তখন। সুতরাং এক মানসিক ক্লান্তিতে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল তাঁর সমগ্র জীবন। কিন্তু তাই ব'লে সঙ্গীতের প্রতি আকর্ষণ এতটুকু শিথিল হয়নি এবং জীবনের সেই সংঘাতের মুহূর্তে একমাত্র সঙ্গীতই উজ্জীবিত রাখত তাঁকে এবং সঙ্গীত-সাধনার মধ্যেই খুঁজে পেতেন তিনি তাঁর অপার্থিব, অলৌকিক ও অতীন্দ্রিয় সত্যের অনুভূতি, -- যা তাঁর সমগ্র চেতনাকে করত প্রদীপ্ত এবং করত অশ্রুসিক্ত তাঁর দুটি চক্ষুকে।”( সঙ্গীতপ্রতিভায় স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ, শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ )
 প্রমথনাথ বসুর লেখা থেকে জানা যাচ্ছে : “প্রবেশিকা-শ্রেণীতে পাঠের সময় হইতেই তিনি ( বিবেকানন্দ ) রীতিমত গীতবাদ্যের চর্চা আরম্ভ করেন। সুপ্রসিদ্ধ সঙ্গীতবিশারদ্ আহম্মদ খাঁর শিষ্য বেণী গুপ্ত নামে একজন উস্তাদের নিকট তিনি সঙ্গীতশাস্ত্র ও সঙ্গীতবিদ্যা কিছুদিন শিক্ষা করিয়াছিলেন। উস্তাদ আহম্মদ খাঁ কণ্ঠ ও যন্ত্র উভয়বিধ সঙ্গীতেই পারদর্শী ছিলেন। বিশ্বনাথবাবু বাল্যাবধি পুত্রের সঙ্গীতপ্রিয়তা লক্ষ্য করিয়াছিলেন এবং উপযুক্ত শিক্ষা না পাইলে উহাতে সম্যক্-অধিকার জন্মে না জানিয়া ইচ্ছা করিয়াছিলেন যে, নরেন্দ্র উস্তাদের নিকট হইতে রাগ-রাগিণী যেন শিক্ষা করেন ও তাল-লয় সম্বন্ধে বিধিমত উপদেশ প্রাপ্ত হন। তদনুসারে নরেন্দ্র চারি-পাঁচ বৎসর ধরিয়া ঐ উস্তাদের নিকট সঙ্গীত শিক্ষা করিয়াছিলেন। তিনি বাজাইতেও বেশ শিখিয়াছিলেন, কিন্তু কণ্ঠসঙ্গীতেই তাঁহার বিশেষ অনুরাগ ও দক্ষতা প্রকাশ পাইয়াছিল। যেখানে যাইতেন সেখানেই গান গাহিতে অনুরুদ্ধ হইতেন এবং সকলেই তাঁহাকে উস্তাদের ন্যায় খাতির-যত্ন করিত এবং সঙ্গীতসম্বন্ধে তাঁহাকে একজন ‘অথরিটি’ (প্রমাণস্বরূপ ) বলিয়া গণ্য করিত। প্রাচ্য-সঙ্গীতের সঙ্গে পাশ্চাত্য-সঙ্গীতের তুলনা দ্বারা তিনি সঙ্গীতবিদ্যা সম্বন্ধে অনেক নূতন তথ্য সংগ্রহ করিয়াছিলেন এবং উক্ত শাস্ত্রের একজন অভিজ্ঞ সমালোচক হইয়া দাঁড়াইয়াছিলেন। এমন কি, কোন দরিদ্র সঙ্গীতপুস্তক প্রকাশককে তাঁহার পুস্তক-বিক্রয়ের সুবিধা হইবে বলিয়া তিনি একজনকে ‘ভারতীয়-সঙ্গীততত্ত্ব’-সম্বন্ধে একটি প্রকাণ্ড মুখবন্ধ লিখিয়া দিয়াছিলেন এবং শেষে নিজেও কয়েকটি সুন্দর সুন্দর সঙ্গীত রচনা করিয়াছিলেন। সঙ্গীতগুরু তাঁহার প্রতিভা-দর্শনে মুগ্ধ হইয়া অন্যান্য শিষ্য অপেক্ষা তাঁহাকে অনেক অধিক বিষয় শিক্ষা দিয়াছিলেন এবং তাঁহার দ্বারা নিজের মুখোজ্জ্বল হইবে জানিয়া তাঁহাকে শিখাইবার জন্য প্রাণপণ যত্ন করিতেন। নরেন্দ্র তাঁহার নিকট অনেক হিন্দী, উর্দু এবং ফার্সী গানও শিখিয়াছিলেন।” ( সঙ্গীতপ্রতিভায় স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ, শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ )
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
এবার আমরা শ্রীম-কথিত ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’ গ্রন্থটির শরণাপন্ন হব। কথামৃতে বর্ণনা অনুযায়ী --“ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ অধরের বাটীর বৈঠকখানায় ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন। বৈঠকখানা দ্বিতলের উপর। শ্রীযুক্ত নরেন্দ্র, মুখুজ্জে ভ্রাতৃদ্বয়, ভবনাথ, মাস্টার, চুনিলাল, হাজরা প্রভৃতি তাঁর কাছে বসিয়া আছেন। বেলা ৩টা হইবে। আজ শনিবার, ২২শে ভাদ্র, ১২৯১; ৬ই সেপ্টেম্বর, ১৮৮৪। কৃষ্ণা প্রতিপদ তিথি। 
 ভক্তেরা প্রণাম করিতেছেন। মাস্টার প্রণাম করিলে পর, ঠাকুর অধরকে বলিতেছেন, ‘নিতাই ডাক্তার আসবে না?’
 শ্রীযুক্ত নরেন্দ্র গান গাইবেন, তাহার আয়োজন হইতেছে। তানপুরা বাঁধিতে গিয়া তার ছিঁড়িয়া গেল। ঠাকুর বলিতেছেন, ওরে কি করলি। নরেন্দ্র বাঁয়া তবলা বাঁধিতেছেন। ঠাকুর , তোর বাঁয়া যেন গালে চড় মারছে।
 কীর্তনাঙ্গের গান সম্বন্ধে কথা হইতেছে। নরেন্দ্র বলিতেছেন, ‘কীর্তনে তাল সম্ এ-সব নাই -- তাই অত Popular -- লোকে ভালবাসে।’
 শ্রীরামকৃষ্ণ -- সে কি বললি! করুণ বলে তাই অত -- লোকে ভালবাসে।
 নরেন্দ্র গান গাইতেছেন:
 গান-- সুন্দর তোমার নাম দীনশরণ হে।
 গান- যাবে কি হে দিন আমার বিফলে চলিয়ে।/ আছি নাথ দিবানিশি আশাপথ নিরখিয়ে।।
 শ্রীরামকৃষ্ণ ( হাজরার প্রতি, সহাস্যে ) -- প্রথম এই গান করে।
 নরেন্দ্র আরও দুই-একটি গান করবার পর বৈষ্ণবচরণ গান গাইতেছেন:
 চিনিব কেমনে হে তোমায় ( হরি )/ ওহে বঙ্কুরায়, ভুলে আছ মথুরায়।/ হাতিচড়া জোড়াপরা, ভুলেছ কি ধেনুচরা, / ব্রজের মাখন চুরি করা, মনে কিছু হয়।
 শ্রীরামকৃষ্ণ --‘হরি হরি বল রে বীণে’ ওইটে একবার হোক না।
 বৈষ্ণবচরণ গাইতেছেন:
 হরি হরি বল রে বীণে!/ শ্রীহরির চরণ বিনে পরম তত্ত্ব আর পাবিনে।।...
গান শুনিতে শুনিতে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবাবিষ্ট হইয়া বলিতেছেন -- আহা! আহা! হরি হরি বল! 
 এই কথা বলিতে বলিতে ঠাকুর সমাধিস্থ হইলেন। ভক্তেরা চতুর্দিকে বসিয়া আছেন ও দর্শন করিতেছেন। ঘর লোকে পরিপূর্ণ হইয়াছে।
 কীর্তনিয়া ওই গান সমাপ্ত করিয়া নূতন গান ধরিলেন।
কীর্তনিয়া যখন আখর দিচ্ছেন, “হরিপ্রেমের বন্যে ভেসে যায়,” ঠাকুর দণ্ডায়মান হইয়া নৃত্য করিতে লাগিলেন।আবার বসিয়া বাহু প্রসারিত করিয়া আখর দিতেছেন। -- ( একবার হরি বল রে )...
 সেই অপূর্ব নৃত্য দেখিয়া নরেন্দ্র প্রভৃতি ভক্তেরা আর স্থির থাকিতে পারিলেন না, সকলেই ঠাকুরের সঙ্গে নাচিতে লাগিলেন। ...
 ভক্তসঙ্গে অনেকক্ষণ নৃত্যের পর ঠাকুর আবার আসন গ্রহণ করিয়াছেন। এখনও ভাবাবেশ। সেই অবস্থায় নরেন্দ্রকে বলিতেছেন -- সেই গানটি -- ‘আমায় দে মা পাগল করে।’
 ঠাকুরের আজ্ঞা পাইয়া নরেন্দ্র গান গাইতেছেন:
 আমায় দে মা পাগল করে ( ব্রহ্মময়ী )/ আর কাজ নাই জ্ঞানবিচারে।।...
 শ্রীরামকৃষ্ণ -- আর ওইটি ‘চিদানন্দ সিন্ধুনীরে’।
 নরেন্দ্র গাইতেছেন:
 চিদানন্দ সিন্ধুনীরে প্রেমানন্দের লহরী।/ মহাভাব রাসলীলা কি মাধুরী মরি মরি।।...
 শ্রীরামকৃষ্ণ ( নরেন্দ্রর প্রতি ) -- আর ‘চিদাকাশে’? -- না, ওটা বড় লম্বা, না? আচ্ছা, একটু আস্তে আস্তে!
 নরেন্দ্র গাইতেছেন: চিদাকাশে হল পূর্ণ প্রেমচন্দ্রোদয় হে।/ উথলিল প্রেমসিন্ধু কি আনন্দময় হে।।
 শ্রীরামকৃষ্ণ -- আর ওইটে --‘হরিরস মদিরা?’
 নরেন্দ্র -- হরিরস মদিরা পিয়ে মম মানস মাত রে।/ লুটায়ে অবনীতল, হরি হরি বলি কাঁদ রে।।
 ঠাকুর আখর দিতেছেন: প্রেমে মত্ত হয়ে, হরি হরি বলি কাঁদ রে।/ ভাবে মত্ত হয়ে, হরি হরি বলে কাঁদ রে।।”
 ( শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত, শ্রীম-কথিত, অখণ্ড, উদ্বোধন কার্যালয় )
 শ্রীরামকৃষ্ণ ও নরেন্দ্রনাথের ভিতর এক অদ্ভুত সাঙ্গীতিক ভাবের খেলা, ভাব সম্মিলন ঘটত অহরহ, যা আধ্যাত্মিকতার ইতিহাসে এক সবিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা।




Post a Comment

0 Comments