জ্বলদর্চি

বিস্মৃতপ্রায় কবি আল মাহমুদ /নির্মল বর্মন

বিস্মৃতপ্রায় কবি আল মাহমুদ

নির্মল বর্মন

     "  আমি থাকবো না
       এর চেয়ে আনন্দের সংবাদ
      আর কি হতে পারে
     পৃথিবীটা তো না থাকারই জায়গা"
                     আল মাহমুদ 

 
কবি মীর আব্দুস শুকুর আল মাহমুদ ১১ই জুলাই ১৯৩৬ সালে অধুনা বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। কবি, উপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক ,ছোটগল্পকার, শিশু সাহিত্যিক এবং সাংবাদিক আল মাহমুদ ১৯৭১এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সম্মুখ সমরে অংশগ্রহণ করে আপামর জনসাধারণকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি থানার সাধনা হাই স্কুলে পড়াশোনা করেন, পরে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড হাইস্কুলে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করেছিলেন। পঞ্চাশের দশকের বিশ শতকে জীবনানন্দ অনুসারী বাংলাদেশের সুমহান কবি ছিলেন আল মাহমুদ। স্বভাব ধর্মে রোমান্টিক মনোবৃত্তি সম্পন্ন কবি প্রেম ও প্রকৃতি বিনির্মাণে পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। "দৈনিক মিল্লাত" পত্রিকায় প্রুফ রিডার হিসাবে যথেষ্ট মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। ঢাকার ইবনে সিনা হাসপাতালের বিরাশি বছর বয়সে ১৫ই ফেব্রুয়ারি ২০১৯ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

বাংলাদেশের জন্মগ্রহণ পড়াশোনা ও কর্মজীবন করলেও কলকাতা ও কলকাতার পত্রপত্রিকায় তিনি কবিতা লিখে সুনাম অর্জন করতে পেরেছিলেন। সেই সঙ্গে ঢাকার শিল্পকলা একাডেমী গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের সহপরিচালক ছিলেন। দীর্ঘদিন সহ পরিচালক থাকার পরে পরিচালকের পথ গ্রহণ করেছিলেন। আঠারো বছর বয়স থেকে সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। কবি আল মাহমুদ বাংলাদেশের 'দৈনিক কবিকন্ঠ' পত্রিকার সম্পাদনাও করতেন। কলকাতার 'নতুন সাহিত্য' ;  'চতুষ্কোণ' ;  'ময়ূখ'; 'কৃত্তিবাস' ও বুদ্ধদেব বসুর কবিতা পত্রিকায় লেখালেখি করে সুনাম অর্জন করেছিলেন।

           কবি আল মাহমুদ মহোদয়ের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ গুলি হল -
       'লোক - লোকান্তর' ১৯৭০ ; 'কালের কলম' ১৯৭৩ ; 'সোনালী কাবিন' ১৯৭৩ ; 'আল মাহমুদের কবিতা' ১৯৭৭; 'মায়াবীপর্দা দূলে ওঠা' ১৯৭৬ ;  'অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না' ১৯৮০,'বখতিয়ারের ঘোড়া' ১৯৮৪ ; 'আরব্য রজনীর রাজহাঁস' ১৯৮৬ ; 'প্রহরান্তের পাশ ফেরা' ১৯৮৭ ; 'এক চক্ষু হরিণ' ১৯৮৯ ; 'মিথ্যাবাদী রাখাল' ১৯৯৩ ; 'টেমপ্লেট'; 'প্রেমের কবিতা সংগ্রহ' ;  'প্রেম ও ভালোবাসার কবিতা'; 'প্রেম প্রকৃতির দ্রোহ আর প্রার্থনা কবিতা' ; 'উড়াল কাব্য' ; "কবিতা সংগ্রহ" ; " কবিতা সংগ্রহ" -১ ; 
         কবি আল মাহমুদের  'রাত'কবিতায় অনুভূতির শাখায় ভর করা ও ইন্দ্রিয় ঘনত্বের পরিচয় রয়েছে , দৃষ্টান্ত স্বরূপ-----
          "তীক্ষ্ণ চোখে অন্ধকার খুঁড়ে
            আমি তাই খুঁজি শুধু কোথা আছে ঘুমের আফিম
            আদিম ক্লান্তিতে যেটা আমার শরীর বেয়ে নামে
            অথবা এলিয়ে দেয় বিছানায় নিবিড় আরামে
            শিথিল দেহের তাপে ভরে ওঠে ঘুমের জাজিম"
            
                       নাম ডাক সম্পন্ন "কৃত্তিবাস" পত্রিকায় কবি আল মাহমুদ তাঁর 'প্রতিকৃতি' কবিতায় কবি স্মৃতিচারণা করেছেন----
        " চোখে তার রক্ত নেই, তার মুখ ধূসর ধূমল
           সূর্যের আহ্নিক রঙে প্রতিদিন জ্বলে তার চুল,
            তবু সে পাথর নয়, কভু তার চোখে নামে জল 
            আকাশেই দৃষ্টি মেখে হয়ে থাকে নিমেষ বিভুল"।
কবি আল মাহমুদের কবিতায় ভোর রোদের সোনালী শিশির বিন্দু  'আবালবৃদ্ধবণিতা'কে আকৃষ্ট করে, যেমন--
         "কখনো ভোরের রোদে শিশিরের রেণু মেখে পায়
         সে পুরুষ হেঁটে যায় কুয়াশায় দেহ যায় ঢেকে,
           আবার দুপুরে দেখি ঘুমিয়েছি প্রাচীর ছায়ায়
          কী জানি কী স্বপ্ন নিয়ে কঠিন পাথরে মাথা রেখে--
           সে এক অবাক লোক মুখ তার ধূসর ধূমল,
           কোনো নারী কোনোদিন তার তরে মাখেনি কাজল"
কবি আল মাহমুদের কাছে তাই তিমির হয়ে উঠে তীর্থ , ফলতঃ 'তিমিরতীর্থ' কবিতা প্রকাশ কাল ১৩৬৪, ২৫ শে বৈশাখ, কৃত্তিবাস পত্রিকায় সোনালী  ভাবনায় ভাবিত কবি। কবিতার  কয়েকটি পংক্তি গ্রহণযোগ্য--
          "একদিন হেঁটে হেঁটে সেই ব্রতচারী
         চলে এলো অন্ধকার রাতের মন্দিরে
        এ রাতের অধিষ্ঠাত্রী পাথরের নারী
      যেখানে বেদির পরে আদিম তিমিরে
     সেখানে নীরবে এসে দাঁড়ালো সে ছেলে
    জন্ম যার ধুলো ওড়া আলোর শহরে
    সোনার বাটিতে কিছু গন্ধধূপ জ্বেলে
   বলল সে, ঠাঁই দাও রাতের ঘরে"।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
কবি প্রেমের বিষয়ে অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তার তেরোশো পঁয়ষট্টি সালে প্রকাশিত 'কৃত্তিবাস' পত্রিকায় 'তাসের দেশ' কবিতাকে নিছক প্রেমেরই ভাবনায় মশগুল। তাসের রূপকে জীবন প্রেমের স্বরূপ কবি উপলব্ধি করেছেন এভাবে-----
        "যখন জীবনে শুধু অর্থহীন লাল হরতন
        একে একে জমা হল, বলো একী অসম্ভব বোঝা
       মুক্ত হয়ে হাঁটবার বন্ধ হলো সব পথ  খোঁজা
         এদিকে তুমিও এলে ঈশকার মতন"।
কবি আল মাহমুদ 'লোক - লোকান্তর' কবিতায় অস্তিত্বের ভাবনা খুঁজেছেন জীবনানন্দীয় স্টাইলে--
            "আমার চেতনা যেন একটি সাদা সত্যিকার পাখি
            বসে আছে সবুজ অরণ্যে এক চন্দনের ডালে;
            মাথার উপরে নীচে বনচারী বাতাসের তালে
          দোলে বন্য প্রাণলতা , সুগন্ধ পরাগে মাখামাখি
          হয়ে আছে ঠোঁট তার"।     
     কবি আল মামুদ বিস্তর লেখালেখির জন্য "জয় বাংলা পুরস্কার" ১৯৭২ ; " হুমায়ুন কবীর স্মৃতি পুরস্কার"১৯৭২ ; "জীবনানন্দ স্মৃতি পুরস্কার" ১৯৭২ ; "ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার" ১৯৮৬; " ভানুসিংহ সম্মাননা পদক" ; "একুশে পদক" ও "বাংলা একাডেমী সাহিত্য" পুরস্কার লাভ করেছিলেন। তাঁর কবিতায় চিত্রকল্প, বিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি, দৃঢ়তা ও  জীবনের গন্তব্য, তাতে নেই সংশয় ও শঙ্কা পরিষ্কারভাবে উপলব্ধ হয়েছে। সমালোচক অধ্যাপক শিব নারায়ণ রায় বলেন----
  "সমকালীন যে দুজন বাঙালি কবি দুর্দান্ত মৌলিকতা এবং বহমানতা আমাকে বারবার আকৃষ্ট করেছে তাদের মধ্যে একজন হলেন বাংলাদেশের আল মাহমুদ অন্যজন পশ্চিমবঙ্গের শক্তি চট্টোপাধ্যায়"। কবি আল মাহমুদ সম্পর্কে সর্বশেষ প্রযোজনা অধ্যাপক ড. রাজীব হুমায়ুনের মতে-----
        "তিনি চল্লিশের পরবর্তী কবিদের মধ্যে অন্যতম মৌলিক কবি, নতুন কবি"।

Post a Comment

1 Comments

  1. AnonymousJune 01, 2023

    ভালো লাগলো। অনেক কিছু জানতে পারি এভাবে চলতে থাকুক।

    ReplyDelete