জ্বলদর্চি

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৫ / সালেহা খাতুন

শব্দে গাঁথা মণি-মালা  :  ৫  /  সালেহা খাতুন 

খোকনের মাসি মিরুজা ছিল আমার সহপাঠী বন্ধু। পাড়াতে প্রায় সবার সাথেই একটা আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকে। সম্পর্কে ও আমার পিসি। মিরুজার মামার বাড়ি আর আমার বাবার মামার বাড়ি একই জায়গায়। হাওড়ার তেহট্ট বাসুদেবপুর। প্রচলিত নাম বুদুল। 

দাদিমার মুখে শুনেছি তিনি সাহাপুর থেকে তেহট্ট বাসুদেবপুর প্রায় ১৫ কিলোমিটার পথ প্রতিদিন পায়ে হেঁটেই যেতেন। আমি দাদিমার বাপের বাড়ি নকাকার সঙ্গে সাইকেলে করে প্রথম যাই খুব ছোটো বয়সে। আলতাফদার বিয়েতে। আলতাফদা বাবার মামাতো ভাইয়ের ছেলে। নকাকার হাত ধরে একটা বড়ো মাঠ পেরিয়ে বরযাত্রী গিয়েছিলাম। সেই মাঠ মাঝে মাঝে হানা দেয় স্মৃতিতে।

 আমার দাদিমা ছিলেন তাঁর ভাইদের একমাত্র বোন। দাদিমার ভাইদের মধ্যে সেজো দাদা, ছোটো দাদা আর মেজো দাদাকে দেখেছি। কলকাতার টি-বোর্ডে তাঁরা কাজ করতেন। তাঁদের ভাইবোনের মধ্যেকার সুসম্পর্ক সেই ছোটো বয়সেই মনে দাগ কেটেছিল। তাঁরা আসতেন আর আমাদের শৈশব রূপকথায় ভরে যেত।
 বাবার ছোটো মামিমার সঙ্গে আমার বেশ ভাবছিল। তিনি শেখাতেন সুখী দাম্পত্যের নানান দিক। ৯২ বছর বেঁচে ছিলেন তিনি। দাদিমার বাপের বাড়িতে আমাদের পুরো পরিবারের এখনও যথেষ্ট কদর আছে। 

 দাদিমা খুব বুদ্ধিমতী মহিলা ছিলেন। আমার দাদাজী অর্থাৎ ঠাকুরদা লেহাজদ্দিন ১৯৬৬ সালে মারা গিয়েছিলেন আর দাদিমা বেঁচে ছিলেন ১৯৮২-র ডিসেম্বর পর্যন্ত। ছেলেদের কাছে যথেষ্ট যত্নে ছিলেন। আমার ছোটোবেলায় তাঁর চুল বেঁধে দেওয়া, রাতে বাথরুমে নিয়ে যাওয়া, তাঁর সঙ্গে ঘুমানো, ঘুরে বেড়ানো এই সমস্ত দায়িত্ব ছিল আমার। খেলার সময় ভাইকে ঠিকঠাক লক্ষ না রাখলে তিনি আমাকে তিরস্কার করে বলতেন “সালেহার শূলব্যথা”।

 দাদিমা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার জন্য পাঁচবার শাড়ি চেঞ্জ করতেন আর আমি তাঁর ছাড়া শাড়িগুলো পরে ঘুরে বেড়াতাম। দাদিমার অক্ষর পরিচয় ছিল না । আরবী দোওয়া দরুদ পড়তেও তিনি হিমসিম খেতেন কিন্তু প্রখর বাস্তব বুদ্ধি ছিল তাঁর। বিপদ মুক্তির দোওয়া ‘ইউনুস’ তিনি পড়তেন নিজস্ব ভঙ্গিতে।  “ ইন্নি মেরে কুন্তু কুন্তু মেরে জ্বালেমিন”।

 তিনি ছিলেন দানশীলা মহিলা। নিজের সংসারযাত্রা নির্বাহের সঙ্গে সঙ্গে বহু পরিবারকে লালন করতেন। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেও দানধ্যান করতেন। পাড়ার ছেলেমেয়েদের আরবী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা ভেবে এলাকার লোকজন একটি মাদ্রাসা নির্মাণের কথা ভাবলে দাদিমা তাঁর হাতের বাতানা ( বাউটি ) জোড়া দান করে দেন সেই গৃহ নির্মাণের জন্য। আমারও আরবী শিক্ষা মূলত কায়দা আমপারা  পড়া এবং কোরআন শরীফ পড়া শুরু হয় ঐ  মাদ্রাসাতেই। 
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
দাদিমা অত্যন্ত স্বাধীনচেতা ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে কৌশলীও বটে। নিজের কন্যাদের তিনি  সূক্ষ্মভাবে বুঝিয়ে গিয়েছিলেন তিনি চলে যাওয়ার পর তাঁর কন্যাদের( সুফিয়া,  মালেকা, আনোয়ারা ) কোন ভাই কাকে দেখবেন। ছোটো ছেলেকে গৃহী করার আগেই তিনি পরলোক গমন করলেও মেজো ছেলে অর্থাৎ আমার বাবার হাতে দায়িত্ব দিয়ে যান ছোটো ছেলেকে গৃহী করার এবং তাঁর গৃহ নির্মাণের। বাবা অক্ষরে অক্ষরে তা পালন করেছিলেন।

 পাড়াতে একদিন জোরে মাইক বাজানোয় দাদিমার ব্রেন স্ট্রোক হয়ে যায় এবং তিনি তিন দিনের মধ্যে মারা যান। সব কিছু সহ্য করতে পারলেও শব্দ সহ্য করার ক্ষমতা তাঁর মতো আমারও নেই। দাদিমা নীরব হয়ে যান ১৯ ডিসেম্বর, ১৯৮২। আমি তখন ক্লাস ফোর-এ পড়ি।
 স্কুলের প্রথম দিন দাদিমার কোলে চড়েই গিয়েছিলাম। স্কুলে  অনেক সহপাঠী বন্ধুকে পাই। ওদের মধ্যে মিরুজা অন্যতম। মিরুজার সঙ্গে ক্লাস টু থেকে ক্লাস এইট পর্যন্ত একসঙ্গে পড়াশোনা করেছি। আমি যখন ইলেভেনে পড়ি ওর বিয়ে হয়ে যায়। ওর প্রথম সন্তানের জন্মানোর সময় ওর পাশেই ছিলাম। ছাত্রাবস্থায় একসঙ্গে জল আনা, কোরআন শরীফ খতম করা, ওদের মাটির তৈরি দোতলায় গ্রীষ্মযাপন কেমন স্বপ্নের মতো মনে হয়। বহুদিন ওর সঙ্গে দেখা হয়নি। তবে আজও ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে ওকে দেখি।
 প্রাইমারি স্কুলে ভালো বেঞ্চে বসার জন্য আমাদের লাইন পড়তো। ও আমার জন্য জায়গা রাখতো। ঝুনু , রীনা এদের সাথেও বন্ধুত্ব ছিল। চন্দনার সঙ্গে এখনো দেখা হয়। মাসুদের সঙ্গেও বন্ধুত্ব অটুট আছে। বাড়ির কাছে স্কুল হলেও স্কুলের কাছে যেহেতু মাসুদের বাড়ি অর্ধেক দিন টিফিনে ওর মায়ের সঙ্গে আমরা ভাত খেতে বসে যেতাম। এখন মেপে রান্না মেপে খাওয়ার অভ্যাসের কাছে সেদিনগুলো যেন অলীক স্বপ্ন বলে মনে হয়।
 মা পুরোপুরি লক্ষ রাখতে পারছিলেন  না বলে ইয়াকুব মাস্টারমশাইয়ের কাছে ক্লাস থ্রিতে বেশ কিছুদিন টিউশন পড়েছিলাম। স্কুলে বন্ধুরা মিলে বহু রকম খেলাধুলা করতাম। তবে মোসলেম মাস্টারমশাই আমাদের ঘুঁটি  খেলার জন্য একবার টিফিনের পর ক্লাসে ঢুকতে দেননি। জানালা দিয়ে ব্যাগ বের করে দিয়েছিলেন। খুব কড়া ছিলেন। তাঁর ভয়েই আমরা পড়াশোনা করতাম। আর যে পড়া পারতো তাকে দিয়ে যে পড়া করেনি তার কান ধরে পাড়ার একটা নির্দিষ্ট অঞ্চল পর্যন্ত ঘুরিয়ে আনাতেন। সহপাঠী বন্ধুদের কান ধরে ঘোরাতে নিজেরই লজ্জা করতো।

আর হেডমাস্টামশাই ওয়াজেদ সাহেব প্রাইমারিতেই আমাদের রামায়ণ মহাভারতের গল্প শুনিয়ে ভারতীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয়  করিয়ে দিয়েছিলেন। রামায়ণ মহাভারত বৃহত্তর পড়াশোনার ক্ষেত্রে পরবর্তীকালে চর্চা করলেও সেই শৈশবের রোপিত বীজই কার্যকরী হয়ে ওঠে।

(ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments