জ্বলদর্চি

বিস্মৃতপ্রায় কবি রাজলক্ষ্মী দেবী /নির্মল বর্মন

বিস্মৃতপ্রায় কবি রাজলক্ষ্মী দেবী

নির্মল বর্মন


           "যতক্ষণ দু' গোলাপ থাকে,
           ততক্ষণ ভালোবাসা তোমার দুয়ারে
                   সানাই বাজাবে।
            কিন্তু যেই ঝরে যাবে ফুল
           চলে যাবে ভালোবাসা  বিদেশী বাউল"
               
               (রাজলক্ষী দেবী-----ভালোবাসা বিদেশী বাউল)
         
ভালোবাসা বিদেশী বাউলের কবি রাজলক্ষ্মী দেবী অধুনা বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় ২৩ শে মে ১৯২৭ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ময়মনসিং জেলার বিদ্যাময়ী বিদ্যালয় থেকে ফাইনাল পাশ করে আনন্দমোহন কলেজ থেকে দর্শন শাস্ত্রে সাম্মানিক স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেছিলেন। পারিবারিক ও মানসিক চাপের জন্য রেগুলার না পড়ে প্রাইভেটে দর্শনশাস্ত্রে এম. এ পরীক্ষা প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান দখল করেছিলেন। সম্পূর্ণ নিজস্ব ক্ষমতায় ও দক্ষতায় ভারতের পুনে শহরে দীর্ঘকাল অধ্যাপনা করেছেন। বর্তমানে তিনি প্রয়াত।

কবি রাজলক্ষ্মী দেবী' র ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের "দেশ" পত্রিকায় প্রথম কবিতা 'মহাসাধক' প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বাংলার কাব্যজগতে আলোড়ন সৃষ্টি ও কবির  আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। কবি দুচোখে চাক্ষুস করা আত্ম পীড়িত নির্জনতা ও  ভালোবাসা, তাঁর কবিতার মূল বিষয়বস্তু হিসাবে তুলে ধরবার চেষ্টা করেছেন। একাকীত্বে  মানুষের জটিল যন্ত্রণায় হৃদয় ছিন্নভিন্ন , কবিতায় কবি উপলব্ধি করেছিলেন।

কবি রাজলক্ষ্মী দেবীর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ গুলি হলঃ-
      "হেমন্তের দিন"- ১৯৫৭ ; "ভাব ভাব কদমের ফুল" ১৯৬৭ ; "এই আলোকে এই আঁধারে" ১৯৭০ ; "রক্ত অলক্তক" ; "আয়না" ; " নিভৃত অংশীদার" ইত্যাদি।

কবি রাজলক্ষ্মী দেবী'র ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত "এখনকার কবিতা" কবি বিষ্ণু দে সম্পাদিত 'একালের কবিতা' সংকলনে প্রকাশিত হয়েছিল। কবিতাটি বাংলার সারস্বত সমাজে ও পাঠক কুলের মধ্যে অভূতপূর্ব সাড়া ফেলেছিল--উদাহরণ
     "হাসির ভিখারী আমি---- নুয়ে পড়া ক্লান্ত মন নিয়ে
   তাই ছুটে ছুটে আসি। কত কথা বলি যে বানিয়ে
  কোমল- আঙুলে ছুঁই-----কালো চুলে দুই ঠোঁট গুঁজে
মৃত্যুকে দুহাতে বুঝি। স্নান করি চুমোর সবুজে
           তোমার হাসিতে বাঁচি"
কবি রাজলক্ষ্মী দেবী সহজ সরল সাবলীল মন ও মানসিকতা নিয়ে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে কবিতা রচনা করেছিলেন। তাঁর "ভালোবাসা এক নির্জনতা"কবিতাটি ২০০৪ সালে কবি অজিত বাইরে সম্পাদিত "দুই বাংলার শ্রেষ্ঠ লেখকদের ১৫০ বছরের প্রেমের কবিতা" কাব্য সংকলনে স্থান লাভ করেছিল---
কবিতাটি পাঠকের দরবারে বহু পঠিত ও আলোচিত হয়েছিল, কয়েকটি পংক্তি প্রণিধানযোগ্য---
      "ভালোবাসা এক নির্জনতা----তা বুঝি জানো না!
    বিস্তীর্ণ আকাশে শুধু একটি তারা'র প্রস্তাবনা
   এ রজ্জু টানানো আছে এক পার থেকে অন্য পারে
   অপ্রেম আঁধার হতে প্রেমের গরিষ্ঠ অন্ধকারে।
  ----------------------------------------------------------------------
  ভালোবাসা এক মানবতা মাত্র এক দরিদ্রতা
একাকীত্ব থেকে অন্য একাকিত্বে উত্তরণ প্রথা"।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
কবি রাজলক্ষ্মী দেবী'র"মন্দির" কবিতা প্রতিনিধিস্থানীয়। এই কবিতায় আদিবাসী, জঙ্গল ও মাটি মাকে প্রকৃত পুজা কিভাবে দেবেন তা বর্ণনা করেছেন--
 "শোনো, আদিবাসী,---আমি আসন্ন সন্ধ্যায় এই মন্দিরে এসেছি।
বিচিত্র দ্বীপের কেন্দ্রে উপনীত হয়ে গেছি নারিকেল - গুবাক পেরিয়ে।
কবে আমি দিগন্তের কার আহ্বানে দুঃসাহসী ভেলায় ভেসেছি,
দীর্ঘকাল কাটিয়েছি বরফের স্তূপে, ঘূর্ণি ,তুফান এড়িয়ে।
অবশেষে মন্দিরে এসেছি"।
----------------------------------------+-+--------------------------
আচ্ছন্ন সন্ধ্যায় ধূপধূমায়িত অন্ধকারে, তুমি আদিবাসী,
অদৃষ্টের ছায়া থেকে দৃষ্টির গোচরে এলে, প্রান্তরে শোনাও
সুতীক্ষ্ণ ছুরিকা,---+- আর দুই চোখে খেলা করে ভয়ানক হাসি।
তোমার পূজায় আমি কোন উপহার দিতে পারি,--- বলে দাও"।
কবি রাজলক্ষী দেবী কবিতায় তীক্ষ্ণ ব্যক্তিস্বতন্ত্রবোধ বিরাজমান। তাঁর কবিতাকে কবি নিজেই মনে করেন 'প্রবাহিনী নদী'র মতো। রাজলক্ষ্মী দেবী ছাপোষা আটপৌরে সংসারী মানুষের মত রুচিশীল ভাবনা ---  "সন্তানেরা" কবিতায় সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন---
 
 "সন্তানেরা শাল সেগুনের চারা, এখনো বাড়েনি।
এখনো রোদ্দুরে ক্লিষ্ট, বৃষ্টিতে নড়বড়ে হয়ে মুখে
চেয়ে থাকে। পোকা- কাটা উচ্ছন্নের সৃষ্টির অসুখে
           করুণ অপেক্ষা রাখে"।
কবি রাজলক্ষ্মী দেবী সাম্প্রতিক কবিতায় কবিদের রুচিবোধ সম্পর্কে তাঁর অভিমত প্রণিধানযোগ্য ---
         "এক চক্ষু শুধু বিস্মৃতির দিক দিয়েই আসে না ।বিকৃতির দিক দিয়েও আসে । কোনো গুণী ঈশ্বর- সকাশে প্রার্থনা জানিয়ে ছিলেন, 'অরসিককে রস পরিবেশন করবার ভাগ্য আমায় দিয়ে না'। আমরা, যারা কবিতাকে ভালোবেসেছি, তারা কি এই মিনতি করব কাব্যলোকের তেত্রিশ কোটিকে,' রসকে অরসিকের ভোগের জন্য নামিয়ো না'।"

Post a Comment

0 Comments