জ্বলদর্চি

আমেরিকার আদিম মানুষের খোঁজে-৯/ মলয় সরকার

আমেরিকার আদিম মানুষের খোঁজে 

মলয় সরকার

পর্ব- ৯(নবম পর্ব)


আমরা এখানে আসার আগে অনুভব করলাম পেটে ছুঁচো ডন মারছে। সামনে দেখলাম একটি রেস্তোঁরা,, নাম Old Martina’s Restaurant । এর গঠনও সেই মাটির তৈরী গ্রাম্য ভাবের, যদিও বাকী আদব কায়দা সবই বর্তমান আমেরিকান সমাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। আর হবে না-ই বা কেন? দিবারাত্র এখানে প্রচুর মানুষ আসেন তো। 
দূরে দেখা যাচ্ছে সু-ঊচ্চ পাহাড়ের সারি (The Taos mountains (Sangre de Cristo range of the Rocky Mountains))যার মাথায় রয়েছে জমাট সাদা বরফের টুপি। এ ছাড়া পাহাড়ের গায়ে ছড়ানো বরফের হাল্কা চাদর।রাস্তার দুপাশে রুক্ষতার প্রতিমূর্তি নিষ্পত্র উদবাহু বৃক্ষের সারি।সবুজ যেন উধাও হয়েছে চারিদিক থেকে। কাছেই দেখলাম রাস্তার ধারে একটি দোকান, নাম Chimayo Trading। এখানে বিক্রী হচ্ছে এখানকার নাভাহো অধিবাসীদের তৈরি নানা ধরণের হস্ত শিল্প, মাটির কাজ,কার্পেট ,নানা ধরণের গহনা, আঁকা ছবি ইত্যাদি বহু জিনিস। দেখে সত্যি মন ভরে যায় যে, এনারা এত সুন্দর শিল্পী, যার সঙ্গে এখানকার মাটির ছোঁয়া লেগে রয়েছে।এখানে যে মেলা বসে সেখানে বিক্রী হয় হরিণের চামড়া, মহিষের চামড়া, নানা ধরণের গাছের বীজ, লবণ, ম্যাকাও পাখীর পালক, তামা , বাঁশি, ঢোলক ধরণের ড্রাম, ইত্যাদি। 
হঠাৎ চোখে পড়ল, আমাদের সামনে একটি কাঠের খুঁটি ঘেরা জায়গা এবং তার গায়ে লাগানো একটি বোর্ড যাতে লেখা রয়েছে Welcome to Taos Pueblo. পিছনে কিন্তু ঘন নীল আকাশের গায়ে একেবারে ছবির মত, পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের সারি।
আমরা এই আদিম মানুষদের জায়গায় ঢোকার আগে গাড়ি একজায়গায় রেখে টিকিট কেটে তবে গ্রামে ঢুকতে পারলাম। সুন্দর ছিমছাম একটি গ্রাম এবং তার মেঠো ঘর, তবে পরিচ্ছন্ন। অনেকে ঘরের সামনের অংশে দোকান করেছেন ও খুব সাধারণ জিনিসপত্র বিক্রী করছেন।রাস্তা একেবারে মেঠো রাস্তা। সামনের ঘর গুলোতে দেখলাম, অনেক বাড়িতেই নীচের থেকে দোতলায় যাওয়ার  বা দোতলা থেকে তিনতলা যাওয়ার জন্য কাঠের মই লাগানো রয়েছে বাইরের দিক থেকে। বুঝলাম, এনাদের ঘরের ভিতর দিয়ে সিঁড়ির বোধ হয় ব্যবস্থা নেই, কিংবা অন্য কোন ব্যাপারও হতে পারে।আগে অনেক জায়গাতেই বাইরে থেকে ছাদ দিয়ে ঘরে ঢোকার ব্যবস্থা থাকত।কারণ, ভিতরে ঢুকে মইটা ভিতরে নিয়ে নিলে তারা সুরক্ষিত থাকত। বাইরের শত্রুর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করার চেষ্টা হত।এখন ঘরে জানালা দরজা আছে তবে সংখ্যায় কম। সমস্ত বাড়িগুলোই জোড়া অর্থাৎ দেখলে মনে হয় একটিই বাড়ী যা টানা চলেছে একটি দেওয়াল নিয়ে।
বাড়িগুলির সামনে একটি করে কাঠের চালা আছে যার তলায় রয়ছে বিশাল বড় বড় মাটির ডোম ধরণের একটি জিনিস। তাতে একটি ছোট দরজাও আছে। শুনলাম, এটি নাকি ওভেন। রুটি , কেক ইত্যাদি তৈরী হয় এটিতে।তবে অনেক বাড়ির সামনে একটি করে, ফলে মনে হল এটি হয়ত যৌথ, যার যখন প্রয়োজন হয়, সে তখন ব্যবহার করে।
কোন কোন জায়গায় লেখা রয়েছে , Restricted Area, Do not enter, অর্থাৎ সেখানে প্রবেশ নিষেধ।তবে মানুষগুলো , যাঁদের সঙ্গে দেখা হল, সবাই বেশ ভদ্র বলেই মনে হল।পাশ দিয়ে তির তির করে বয়ে চলেছে চকচকে পরিষ্কার জলের এক ঝরণা ধরণের নদী।এটির উৎপত্তি ব্লু লেক থেকে।(বলা হয়,The Sacred Blue Lake, intrinsically linked to the Pueblo’s culture, is the source of a stream that flows through the settlement) এই নদীর জলই নাকি এনাদের ব্যবহার্য জল।আমরা দেখলাম দু একটি ছোট ছেলে এর জলে ছিপ দিয়ে মাছ ধরছে।এই নদীর উপর বরফের চাদর জমে শীতের সময়ে, যদিও তখন ভিতরের প্রবাহ একেবারে বন্ধ হয় না। এখন নদী বয়ে চলেছে আপন ছন্দে এই সমস্ত আদিবাসীদের মতই পরিচ্ছন্ন মনে সভ্য সমাজের থেকে অনেক দূরে আপন মনে গাছ গাছালির পাশ দিয়ে।এই নদীই যেন আমার কাছে এই সমস্ত মানুষের প্রতিচ্ছবি হয়ে ধরা দিল।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
এই নদীটি সমস্ত বসতিকে দুভাগে ভাগ করেছে, উত্তরের দিকের ঘরকে বলা হয় Hlauuma আর দক্ষিণের দিককে বলে Hlaukwima। 
পাশেই রয়েছে একটি চার্চ। যার নাম San Geronimo, বা St. Jerome Chapel।এর ভিতরে ঢুকে ছবি তোলায় নানা বিধিনিষেধ। তাই বাইরে থেকেই ছবি নিতে হল।এর মূল গেটটি সাদা রঙে রঙ করা। এর মূল চার্চটি আমেরিকা ও মেক্সিকোর যুদ্ধে আমেরিকান সেনারা ১৮৪৭ সালে ধ্বংস করে দেয়।পরে আবার ১৮৫০ সালে এটি নূতন করে নির্মাণ করা হয়।সেণ্ট জেরোম ছিলেন একজন পুয়েব্লো ধর্মযাজক। তাঁর নামেই এটির নামকরণ হয়। এখানে সবাই প্রায় ক্যাথলিক। প্রকৃতপক্ষে এদের নিজস্ব যে ধর্ম ছিল বা পালনীয় আচারবিধি ছিল, সমস্ত মিলে মিশে এখন এক জগাখিচুড়িতে পরিণত হয়েছে।তবু এরাই এখনও অনেক আদিম সংস্কৃতিই ধারণ করে বহন করে চলেছে আজ পর্যন্ত।
এই চার্চ তৈরী ও খ্রীষ্ট ধর্ম প্রচার নিয়ে এই সমস্ত আদিবাসীদের সঙ্গে স্প্যানিশদের সুদীর্ঘ লড়াই হয়েছে। বার বার এই চার্চ ধ্বংস করা হয়েছে। পরে ধীরে ধীরে আমেরিকা ও স্প্যানিশদের লড়াইয়ের পর স্প্যানিশরা হিয়াদালগোর ১৮৪৬ সালের চুক্তি অনুযায়ী, যখন নিউ মেক্সিকো আমেরিকার অন্তর্ভুক্তি হয়, তারপর থেকেই কিছু অবস্থার উন্নতি হয়।
বর্তমানে যে চার্চ রয়েছে, সেটিরই মাথার দু’পাশে দুটি বেল টাওয়ার বা ঘণ্টা ঘর আছে।গেটের সোজাসুজি রয়েছে চার্চের প্রধান দরজা।

আপাততঃ আমেরিকার এই অঞ্চলেই রয়েছে সর্ববৃহৎ প্রাচীন আদিবাসীদের বসতি।এনারা মনে করেন স্মরণাতীত কাল থেকে চলে আসছে ওনাদের এই বসতি। বর্তমানের তরুণ প্রজন্ম কিছু কিছু যদিও পুয়েব্লো সংস্কৃতির বাইরে আসার চেষ্টা করছেন, তবু প্রধান গ্রামটি এখনও সেই ধারাই বহন করে চলেছে আগের মতই। এমন কি ওনারা বৈদ্যুতিক আলো, কলের জল ইত্যাদি অনেক কিছুই ব্যবহার করতে অস্বীকার করেন।
এখানে, যদিও এটি আমেরিকার মধ্যেই, তবু  এনাদের নিজস্ব প্রধান, নিজস্ব নিয়মকানুন, নিজস্ব প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সমস্ত আছে। আমেরিকার নিয়ম কানুন এখানে চলে না। আসলে এটি আমেরিকার ভিতরে আরেকটি স্বাধীন রাষ্ট্রের মতই স্বাধীনতা ভোগ করে। এখানে কিছু করতে গেলে, আমেরিকার সরকারকেও এনাদের প্রধানের সাথে আলোচনা করেই করতে হবে।
জায়গাটিকে National Historic Landmark (1960) অনুযায়ী স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে,। আমরা এখানে বেশ অনেকখানিই ঘুরলাম, যদিও পর্যটকদের ভীড় খুব বেশি ছিল না।তবে অনেক বাড়িতেই , হাব ভাব দেখে বুঝলাম,তাদের বাড়ির ছেলেমেয়েরা বাইরে কাজকর্ম করে, গাড়ী চালায়, এবং বাইরের সাথে মোটামুটি ভালই যোগাযোগ রাখে।
এখানে থেকে বেরোনোর মুখে বা এখানে ঢোকার মুখেই দেখলাম বিশাল একটি ঘেরা জায়গা, সেটি এখানকার কবরস্থান বা Cemetery.। এখানে প্রায় পাকাপাকি কবর নেই। যা আছে তা হল শুধু, নিছক কিছু কাঠের ক্রশ মাটিতে পোঁতা । সেগুলি সুদৃশ্য বা কারুকাজ সম্বলিত এমনও নয়।দুটি সাধারণ কাঠের বার দিয়ে একটি ক্রশ করে মাটিতে পোঁতা, বেশি বড় বা উঁচুও নয়।এরকম ক্রশে জায়গাটা ভর্তি। প্রিয়জনকে সমাধিস্থ করে সেখানে একটি ক্রশ পোঁতা হয়েছে।এই জায়গাটি এনাদের অত্যন্ত স্পর্শকাতর জায়গা। এখানে সম্মান জানানোই নিয়ম।

আজকে যতই এদের আমরা আমেরিকার সঙ্গে যুক্ত বা সভ্য জগতের সঙ্গে ঘেঁসাঘেঁসি দেখি, আজ থেকে মাত্র দেড়শ বছর আগেও কিন্তু ব্যাপারটা এরকম ছিল না। এদের উপর যে ধরণের অত্যাচার ও নির্বিচার হত্যা কি এদের ছেলে মেয়েদের ধরে নিয়ে গিয়ে দাস দাসী বানানো ইত্যাদি হয়েছে সেই করুণ ইতিহাস হয়ত এরা অনেকেই আজ মনে করতে পারে না।
যে সমস্ত ইউরোপিয়ানরা এখানে এসেছিলেন, তাঁরা দেখলেন যে, এখানে মানুষেরা তাঁদের হিসাবে সভ্য ও খ্রীষ্টান নন। কাজেই তাঁরা ধরেই নিলেন যে, ঈশ্বরের মহান দায়িত্ব তাঁদের উপর ন্যস্ত , যে, যে কোন ভাবেই এদের খ্রীষ্টান করে সভ্য করে তুলতে হবে। কাজেই তাঁরা জোর করে এদের উপর নিজেদের পক্ষে আইন তৈরী করে, বল প্রয়োগ করে এই ‘মহান’ কার্যে ব্রতী হলেন।ফলে ষোড়শ থেকে উনবিংশ শতাব্দী , এই তিন শ’ বছরের মধ্যে সেই সমস্ত আদিবাসীদের সংখ্যা প্রচণ্ড ভাবে কমতে আরম্ভ করল।কারণ হিসাবে বলা হয়, এই সমস্ত নবাগতরা বিভিন্ন ধরণের মারণ অসুখ এদের মধ্যে ছড়িয়েছিলেন। যার প্রতিরোধ ক্ষমতা এদের মধ্যে ছিল না।হিসাব বলছে ১৮০০ সালে যে জনসংখ্যা ছিল ছয় লক্ষ, ১৮৯০ সালে তা এসে দাঁড়ায় মাত্র আড়াই লক্ষে।এর মধ্যে চিকেন পক্স, হাম, ইত্যাদিগুলিই বেশি ক্ষতি করেছিল।
একে অনেকে জীবাণুঘটিত যুদ্ধের ফল বলেছেন। আসলে এই রোগগুলির মারণ জীবাণু এই সমস্ত আদিবাসীদের অজ্ঞানতার ফলে ভালমানুষীর ছলনায় তাদের মধ্যে ইচ্ছাকৃত ভাবে ছড়ানো হয়েছিল। সাহায্যের নাম করে জীবাণুভর্তি কম্বল বিতরণের ফলে বহুমানুষ এই সমস্ত রোগে আক্রান্ত হন। এ ছাড়া বিভিন্ন অনৈতিক অসমযুদ্ধেও অনেকে মারা যান।
বিভিন্ন জায়গায় জোর করে এঁদের রিজার্ভেশনে রাখা হয়েছিল, যেখানে উপযুক্ত খাদ্য পানীয়, বস্ত্রের যোগান ছিল না। তার ফলেও অনেকে মারা যান।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছিল Wounded Knee Massacre এ ১৮৯০ সালে।আদিবাসীদের Ghost dance নামে এক সামাজিক উৎসবে , তাদের ভুলিয়ে ছলনা করে নিরপরাধ তিন শ’ শিশু বৃদ্ধ, মহিলাদের আমেরিকান সৈন্যরা হত্যা করে।
রিও ডি গ্রাণ্ডি নদী সেই সমস্ত প্রাচীন অত্যাচারের নীরব সাক্ষী। বহু দুর্ভাগ্য, অত্যাচার ,কষ্ট, স্বজনহারানোর পর ১লা জুন ১৮৬৮তে যখন গোত্রপতিদের সঙ্গে স্বাক্ষর দিতে হল,যে,” এখন থেকে আগামী দিনগুলোতে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর প্রদানকারী পক্ষগুলোর মধ্যেকার যাবতীয় যুদ্ধবিগ্রহ শেষ হয়ে গেল” এবং তাতে স্বাক্ষর দিলেন বারবোন্সিতো, আর্মিজো, ডেল্গাদিতো, ম্যানুয়ালিতো,হেরেরো গ্রাণ্ডি এবং আরও সাতজন গোত্রনেতা, তাঁরা নিজেদের জন্য শান্তিতে বসবাস করার জন্য নিজেদের পরিচিত , আলবুকার্ক থেকে পর্বতের মাথা দেখতে পেয়ে আনন্দে নেচে উঠলেন।
পরবর্তী কালে অনেকে লেখাপড়া শিখে এই সমাজ থেকে বেরিয়ে এসে মূলস্রোতের সঙ্গে মিশে গেছেন। এছাড়াও আর একটি ব্যাপার হয়েছিল। তাহল, এঁদের ভিতর বিভিন্ন গোষ্ঠী দ্বন্দ্বের যুদ্ধে অনেককে ধরে নিয়ে গিয়ে বন্দী করে রাখা হত। ফলে সেখানেও রক্তসংমিশ্রণের একটা ব্যাপার ঘটেছিল।
তবু আজ খুব অল্প কয়েকটি জায়গাতেই নিছক এই আদিবাসী মানুষদের দেখা যায়, যদিও তাঁরা অনেকেই এখন সভ্য জগতের কাছাকাছি এসে গেছেন। 
(ডি ব্রাউনের Bury My Heart At Wounded Knee” বইটি দ্রষ্টব্য)
সঙ্গে থাকুন বাকী যাত্রাপথে—
ক্রমশঃ-

Post a Comment

1 Comments

  1. ভালোই লাগছে, খেটেখুটে লেখা।

    ReplyDelete