জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে -১ /বিজন সাহা


ভোলগা নদীর খোঁজে -১  

বিজন সাহা

শুরুর শুরু

বিজন দা, একটু কথা ছিল। কখন কথা বলা যায় জানাবেন।

অরূপের মেসেজ পেলাম। দেখি ওর গোটা দুই মিসকল এসেছিল ইতিমধ্যে। অরূপ, আমার জুনিয়র বন্ধু, ছোট ভাই। কিছু দিন আগে জানতে পারি যে ও ১৯৮৭ সালে মস্কো এসেছিল। এর আগে আসলে জানা হয়নি। আমার ছাত্রজীবনেই ও মস্কো আসে। প্রস্তুতি পর্ব শেষ করে থাকতে শুরু করে গণ মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর ব্লকে। সেখানে আমরা পদার্থবিদ্যা, গণিত ও রসায়নের ছাত্ররা থাকতাম। ওর সাথে দেখা হত নীচে, আন্ডারগ্রাউন্ডে, আমাদের কমন বাথরুমে। মুখ ভরা দাড়ি আর রবীন্দ্র সঙ্গীত। কথা বার্তা হয়েছে বলে মনে হয় না। তবে কয়েক বছর পর বাংলাদেশের সৌমিত্র আর টিটু যখন ওর সাথে এক রুমে থাকতে শুরু করে তখন আমাদের আলাপ হয়, হয় বন্ধুত্ব। এটা ১৯৯২ – ১৯৯৩ এর কথা। তারপর থেকেই আমাদের যোগাযোগ বিভিন্ন ভাবে। 

কি অরূপ, কোন জরুরি কথা ছিল?
আসলে আমার এক পরিচিত ভদ্রলোক রাশিয়া আসতে চাইছেন। উনি সাংবাদিক। ভোলগা আর গঙ্গা নিয়ে একটা বই লিখবেন। তাই চাইছেন ভোলগা তীরের শহরগুলো ঘুরে যেতে।
ভাল তো, চলে যাও।
না না, আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। যদি আপনি পারেন তাহলে ভাল হয়। আপনি তো ছবি তুলতে ভালোবাসেন, উনিও ছবি তুলেন। তাই আমি ওনাকে আপনার কথা বলেছি। 
সেটা বুঝলাম, তবে আমি যেতে পারব কিনা জানি না। কাজকর্ম আছে। তবে ওনার যদি প্ল্যান দরকার হয়, সেটা আমি কমবেশি করে দিতে পারব।
তাহলে আপনি কবে সময় দিতে পারবেন বলুন। তিন জনে একসাথে কথা বলে ঠিক করা যাবে কিভাবে কী করা।
যেকোনো দিন মস্কো সময় দুপুর তিনটায়।
আচ্ছা, আমি দিলীপ বাবুর সাথে কথা বলে আপনাকে জানাব।
আচ্ছা। 

কয়েকদিন পরে অরূপ ফোন করল। ঠিক হল আমাদের গ্রুপ মিটিং-এর। অরূপ আমাদের পরিচয় করিয়ে দিল। 

কথা শুরু হল।
- দিলীপ বাবু আপনি যদি বলেন ঠিক কি আপনার দরকার তাহলে আমার পক্ষে সুবিধা হবে প্ল্যান করতে।
- বিজন দা, আপনি আমাকে নাম ধরেই ডাকবেন আর তুমি করে বলবেন।
আমি হাফ ছেড়ে বাচলাম। কেননা বাবু বলা একেবারেই ভুলে গেছি। বললাম
- ঠিক আছে, তুমিও আমাকে নাম ধরে আর তুমি বলেই ডাকতে পার। তাহলে আলাপে সুবিধা হবে।
উনি এখনও পর্যন্ত কখনও নাম ধরে ডাকেন, কখনও বিজন দা, কখনও তুমি, কখনও আপনি।

- আমি চাইছি ভোলগা আর গঙ্গার উপরে একটা প্রামাণ্য বই লিখতে। ভোলগা আর গঙ্গা – উভয়ে নিজ নিজ দেশের প্রধান নদী। সেখানে বিভিন্ন সময়ে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন জনপদ, গড়ে উঠেছে কল কারখানা, শিল্প। আমি সেসব জায়গার মানুষের সাথে কথা বলতে চাই। তাদের জীবন সম্পর্কে জানতে চাই।
- ঠিক আছে। আমরা চেষ্টা করব বিভিন্ন শহরে মানুষের সাথে কথা বলতে।
- কিন্তু আমি চাইছি সেই সমস্ত মানুষের সাথে কথা বলতে যারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে কোন এক পেশায় কাজ করে। যেমন জেলেদের সাথে, যারা গুন টেনে খেত তাদের সাথে।

আমার মনে হল উনি রুশ ক্ল্যাসিক সাহিত্য পড়ে এদেশ সম্পর্কে ধারণা পেয়েছেন। সত্তর বছরের সোভিয়েত শাসনে যে সব কিছু একেবারেই বদলে গেছে সেটা ঠিক বুঝতে পারছেন না। এরপরে গত তিরিশ বছরের পুঁজিবাদী শাসন ব্যাবস্থা। তাই বললাম
- তুমি ঠিক যা চাইছ সেটা পাওয়া কতটুকু সম্ভব আমি জানি না। কারণ বিগত কয়েক দশকে এদের জীবনযাত্রা একদম বদলে গেছে। যদি আমাদের সব দেশে এক পেশার লোকজন কমবেশি এক এক জায়গায় থাকে এখানে সবাই থাকে মিলে মিশে। একই বিল্ডিঙে দেখা যাবে কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষক, পুলিশ, আমলা বিভিন্ন পেশার লোকজন পাশাপাশি বাস করছে। তাই তোমার চাহিদামত জনগোষ্ঠী খুঁজে পাওয়া কষ্ট। তবে ভাবতে হবে। দেখতে হবে কিভাবে কি করা যায়।
- আপনি তো যাচ্ছেন আমার সাথে?
- সম্ভাবনা কম। এসময় আমি সাধারণত পাহাড় আর সাগর এলাকায় যাই। আপাতত কোন কথা দিচ্ছি না। তবে চেষ্টা করবে কাউকে খুঁজে বের করতে যে তোমাকে ঠিক ঠাক গাইড করতে পারবে। আমি চেষ্টা করব আগামী দু এক সপ্তাহের মধ্যে কম বেশি একটা প্ল্যান তৈরি করার আর এখানে কারও সাথে কথা বলার। কারণ যতদূর বুঝতে পারছি যে যাবে তাকে ড্রাইভ করতে হবে, ইংরেজি জানতে হবে, আর এসব শহর সম্পর্কে কমবেশি ভালো জ্ঞান থাকতে হবে। আমি চেষ্টা করব আমার ফটোগ্রাফার বন্ধুদের কাউকে রাজী করাতে, তাতে তার জন্যেও জার্নিটা ইন্টারেস্টিং হবে।

প্রথমেই আমার মনে হল দেমিদের কথা। ও দুবনার হলেও ঐ মুহূর্তে ভ্লাদিভোস্তকে ছিল। ওর সাথে কথা বলে জানতে হবে ও সময় দেবে কিনা আর দিলে কিসের বিনিময়ে। ও ইংরেজি বলে, খুব স্মার্ট। তাই ওর হাতে দিলীপকে তুলে দিলে আমার কোন টেনশন থাকবে না। আর এত লম্বা জার্নিতে নিরপত্তা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাছাড়া যদি হঠাৎ আমি নিজেই যাই, তাহলে ওর সাথে আমার অসুবিধা হবে না।  
আমার ধারণা ছিল যে জার্নি শুরু হবে নিঝনি নভগোরাদ থেকে। সোভিয়েত আমলে এটা গোর্কি  নামে পরিচিত ছিল। এখানেই জন্ম আলেক্সেই পেশকভ বা মাক্সিম গোর্কির। সোভিয়েত আমলে তাঁর নামেই এই শহরের নামকরণ করা হয়। এ ব্যাপারে আমরা পরে বলব। এরপর যাব কাজান, উলিয়ানভস্ক, সামারা, সারাতভ, ভোলগাগ্রাদ আর সব শেষে আস্ত্রাখান। কারণ ভোলগার তীরে এ সবই শিল্পপ্রধান শহর। তবে দিলীপ জানাল ওর ইচ্ছে তভের হয়ে যাওয়া। গত বছরের শুরুতে করোনা থেকে সেরে উঠে আমি যখন হাসপাতাল থেকে ফিরছিলাম দেমিদের সাথে তখন প্ল্যান করেছিলাম সময় করে ওর সাথে ভোলগার উৎস ভেরখোভিয়ে ভোলগায় যাব। দেমিদ বলল মস্কো থেকে সকালে রওনা হলে আমরা একদিনে সে জায়গা হয়ে তভের চলে আসতে পারব। তাই সেভাবেই প্ল্যান করে পাঠালাম দিলীপকে। প্ল্যান হল যে ভোলগার উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত সমস্ত শহরগুলোয় আমরা যাব। আমি মোটামুটি দুই সপ্তাহের এক প্ল্যান করলাম, দিলীপ বলল মনে হয় ২০ থেকে ২১ দিন লাগবে। যাহোক, এসব কথা হচ্ছিল টেলিফোনে। আমি তখনও ঠিক করিনি নিজে যাব কিনা, তবে না যাবার কারণের চেয়ে যাবার কারণ ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল। সবচেয়ে বড় কথা, বুঝতে পারলাম এখন না গেলে আর কখনই যাওয়া হবে না। সব সময়ই হাতে কোন না কোন কাজ থাকবে। 

আমি দেমিদের সাথে যোগাযোগ করলাম। ও ঠিক কথা দিল না। তাছাড়া কিসের বিনিময়ে ও যাবে সেটাও জানাল না। আমার ধারণা ছিল হয়তো শ’ পাঁচেক ডলার দিলেই হবে। কয়েকদিন পরে ও জানাল যে কার শেয়ারিং থেকে গাড়ি নিতে দিন প্রতি এক থেকে দেড় হাজার রুবল লাগবে, প্লাস বেনজিনে যাবে হাজার পঁচিশ। ও আসলে ১০০ কিলোমিটার যেতে কতটুকু বেনজিন লাগবে সেটা জানাল আর আমাদের কতটুকু পথ যেতে হবে সেটাও কমবেশি হিসাব করে জানাল। দেখা গেল প্রায় সাত হাজার কিলোমিটার যেতে এর চেয়ে কমে হবে না। আর ও নিজে চাইল এক হাজার ডলার। এর বাইরে আছে হোটেল বা বাসা ভাড়া আর খাবার। ঠিক হল আমরা থাকব বাসায়, কেননা করোনাকালে হোটেলে থাকতে গেলে সমস্যা হতে পারে বিশেষ করে দেমিদ যেহেতু ভ্যাকসিন নেবে না ঠিক করেছে। ও ভ্লাদিভোস্তকের কাজ সেরে দুবনা আসতে পারবে আগস্টের ২০ তারিখের পরে। তাই আমাদের যাত্রা শুরু হবে ২৩ – ২৪ তারিখের দিকে। পয়লা সেপ্টেম্বর আমার ক্লাস শুরু হবে। সহকর্মী মাক্সিমের সাথে কথা হল। ও বলল কোন সমস্যা হবে না। আমি নিশ্চিন্ত মনে যেতে পারি।  

জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇



Post a Comment

0 Comments