জ্বলদর্চি

কালিম্পং ডায়েরি /পর্ব-৩/সুমিত্রা মাহাত

কালিম্পং ডায়েরি
পর্ব-৩
সুমিত্রা মাহাত

লোকাল ট্রেনে যাতায়াত করতে আমি বরাবরই খুব পছন্দ করি। এতে ভ্রমণ বৈচিত্র্যপূর্ণ হয় , টাইমপাশের মলিমশলা সবসময় মজুত থাকে । আজকের অভিজ্ঞতা খুবই রোমাঞ্চকর। প্রতি সীটে জানালার ধারে একজন বসে আছে । কিছুটা ভয় করছে পৌঁছতে রাত্রি হয়ে যাবে । বগি শূন্য হয়ে যাবার ভয়ে মহিলা কামরাতে উঠিনি। এখানেও খুব একটা সুবিধে হবে বলে মনে হচ্ছে না । মহিলা বলতে সর্বসাকুল্যে তিনজন (আমি সহ) । বাকি দুজন কোথায় নেমে পড়ে ঠিক নেই। আমি দরজার সামনে প্রথম সীটে , জানালার ধারে একা রাজত্ব করছি । পেঁটরা-পেঁটরি সীটে তুলে দিয়েছি । 
খড়গপুর পেরোনোর পর রেললাইনের দুধারে, বিঘার পর বিঘা ফুলের চাদর নজর কাড়ে না এমন মানুষ নেই । সিজ্ন অনুযায়ী চাদরের রং বদলায় । কলকাতা বেশিরভাগ সকালে যাই বলে ঢলঢলে পাতার ফাঁকে উচ্চশীর পদ্মের বাহার দেখে অভ্যস্ত। এখন একটা বিচিত্র দৃশ্যপট তৈরি হয়েছে । চটুল বাতাসের ধাক্কায় চারিদিকে উল্টানো পদ্মপাতার সারি । বাতাসের গতিবিধি ভালো ঠেকছে না , ক্রমে ফুঁসে,ফুঁসে উঠছে। প্রায় ঘন্টা খানেক এভাবে চলল । বিভিন্ন স্টেশনে দু-একজন ওঠানামা করে । মনে হচ্ছে যেন নামছে বেশি , উঠছে কম । হঠাৎ একটা স্টেশনে জনা দশ-বারো চ্যাংড়া ছেলে উঠে পড়ে । তারা চিৎকার - চেঁচামেচি শুরু করে দেয় । অদ্ভুত তাদের চুলের ছাঁট ও পোশাক। কোনও স্টেশনে ট্রেন একটু থামলেই তারা হৈ-হৈ করে নেমে গিয়ে, ট্রেনের দরজা ধরে ঝোলাঝুলি করতে থাকে । আপদ গুলো কখন বিদেয় হবে কে জানে ! দেখে মনে হয় ছিঁচকে চোরের দল । পাশের ভদ্রলোক ও ভ্রু কুঁচকে মনে মনে গর্ গর্ করতে থাকেন। 
এরপরই শুরু হয় প্রবল ঝড় বৃষ্টি । বৃষ্টির ঝাপটা তীরের ফলার মতো এসে সারা শরীরে বিঁধতে থাকে । এই তীব্র দহনে শীতল বারিধারা উপভোগ্য , যদিও এখন সেরকম ইচ্ছে নেই, সারারাত জার্নি করতে হবে । সঙ্গে থাকা ব্যাগ দুটো ভিজে চপ্ চপ্ করছে । আমি সীট থেকে উঠে এদিক ওদিক সরতে থাকি । বৃষ্টির সাথে লুকোচুরি খেলা চলে । সে আমায় ধরার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ । অবস্থা দেখে একজন সহৃদয় ব্যক্তি টানা হেঁচড়া করে ট্রেনের দরজা কিছুটা ঠেলে দেয় । কোন দিক থেকে বৃষ্টির ছাঁট ঢুকছে, আমি ভিজে যাচ্ছি, বুঝতে পারি না । বাকি মহিলা দুজন , একজন নাতির সঙ্গে, একজন হাজব্যন্ড এর সঙ্গে হাসিমুখে কোন স্টেশনে নেমে গেছে । উপায় না দেখে বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে, বগির একদম শেষে গিয়ে  দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসি । দুদিকের সীট মিলিয়ে এখানে জনা চারেক। আমার উল্টোদিকের বয়স্ক ভদ্রলোক হাওড়া পর্যন্ত যাবেন । 
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে । স্টেশনে ট্রেন থামতেই বিভিন্ন বয়সী পাঁচ-ছ জন মহিলা উঠলেন। তার পরেই চ্যাংড়া ছেলের দল একেবারে চুপ মেরে গেল , একদম নামা পর্যন্ত তারা শিষ্ট-শান্ত হয়ে রইল। কার্য কারণ আমি কিছুই বুঝলাম না । মনে মনে একটু হাসলাম। 
মুখের হাসি বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না । কয়েকটা স্টেশন পর মহিলা ও ছেলের দল নেমে গেল। গোটা বগিতে আর মোটে চার - পাঁচ জন। কড়্ কড়্ শব্দে বাজ পড়তে লাগল। বৃষ্টির ধারার সুর কখনও উপরে চড়ে কখনও আপন খেয়ালে নীচে নামতে থাকে । দু-একবার এমন হয় হৃৎপিন্ড কেঁপে ওঠে, যেন বগি র কাছেই কোথাও বাজ পড়ল । আমি কানে হাত চেপে বসে আছি । হঠাৎই ঝুপ্ করে কারেন্ট চলে যায় । উৎকন্ঠার ষোল কলা পূর্ণ হয় । বাইরে - ভিতরে ঘুট্ ঘুটে অন্ধকার সঙ্গে প্রবল ঝড় বৃষ্টি ও বিদ্যুতের ফলা । সৃষ্টি ও প্রলয়ে ভারসাম্য আনার জন্য মনে মনে আদি দেবতার চরণে মাথা কুটতে থাকি । যার মাতৃভূমি অশিক্ষার আগুনে জ্বলে মরছে , রুগ্ন দারিদ্র্য ক্লিষ্ট জীবনে অসহায়তার অন্ধকারে ডুকরে কাঁদছে, পাথুরে মাটিতে সরসতার আশায় চাতকের মতো মেঘ খুঁড়ে চলেছে , তাকে অশ্রুমোচনের একফোঁটা সুযোগ দাও! মানুষ যখন পৃথিবীর আলো ও দুচোখে অন্ধকারের সন্ধিক্ষণে এসে উপস্থিত হয় , তখন রিয়ালাইজেশনের  চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছায়। মিনিট পাঁচেক এভাবেই কাটে । একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে দু-তিনবার । কারেন্ট যাওয়া আসা করতে থাকে । এদিকে ঝড় বৃষ্টির কারণে আমার দলের বাকী সদস্যরাও হাওড়া স্টেশনে আটকে আছে। স্যার হাওড়া  থেকে কলকাতা স্টেশন পর্যন্ত বাস ভাড়া করেছেন। উনি বার বার ফোন করতে থাকেন। ফোন ধরার অবস্থায় নেই , কোনোমতে আমার পরিস্থিতি জানাই  , বৃষ্টি থামলে তাদের এগিয়ে যেতে বলি। ছানা-পুনা ও বড়ো ট্রলি ব্যাগ স্যার এর সঙ্গে এগিয়ে যায় । হাজব্যন্ড টিকিট কাউন্টারের সামনে একা অপেক্ষা করে । 
বিরক্তির চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে দিয়ে স্টেশনে ঢোকার আগে ট্রেন প্রায় আধঘন্টা দাঁড়িয়ে যায়। বাইরের কালো অন্ধকারের ভূত আমাকে হাঁ করে গিলতে আসে । অবশেষে বিচিত্র অভিজ্ঞতার ভাগীদার করে ট্রেন ১৩ নং প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে দেয় । ভেজা জামাকাপড় সহ আমার শরীর ও চপ্ চপে ব্যাগ দুটোকে টানতে টানতে কোনমতে টিকিট কাউন্টারের সামনে পৌঁছাই । শঙ্কা হয় পনীরের তরকারি তে জল ঢুকে গেল না তো ! এদিকে হাজব্যন্ড উধাও। সে তখন জনারণ্যে মিশে যাওয়ার আনন্দে মেতেছে। এধার ওধার ঘুরে খুচরো খাবার মুখে তোলার সুযোগ ও পেয়েছে কিছুটা। রাগে আমার গা জ্বলতে থাকে। 
আমরা দুজনেই প্ল্যাটফর্মের বাইরে বেরিয়ে আসি। এত রাত্রেও পিঁপড়ের মতো কাতারে কাতারে মানুষ, জল,কাদা সে এক বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা! আমার শ্বাস নিতেও যেন কষ্ট হচ্ছে । কি হবে না হবে ভেবে গাড়ি আগে থেকে বুকিং করিনি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ কে হাতিয়ার করে ট্যাক্সি ড্রাইভারেরা একেবারে রাজা বাদশা হয়ে বসে আছে। বাধ্য হয়ে বাসের নম্বর হাঁতড়াতে থাকি । আর বেশি সময় নেই, কলকাতা স্টেশন পৌঁছতে হবে ।
বহুকষ্টে একটা বাসে উঠি। চারিদিকে জল জমে গেছে, ট্রাফিক জ্যাম ,বাস ড্রাইভার বেশ খানিক টা সময় নিয়ে আমাদের এধার ওধার মোচড় দিয়ে কলকাতা স্টেশনের কিছুটা আগে মেইন রাস্তার উপর ঢেলে দেয় । প্রথম এলাম এই স্টেশনে । যদিও বেদুইন দের মতো ঘোরা আমাদের অভ্যাস আছে। গোটা পৃথিবী ই কেমন যেন আপন মনে হয় ! জিও নেট,ইউটিউব, গুগল লোকেশন এর রমরমা যখন ছিল না তখনও একেবারে অচেনা জায়গা কনফিডেন্টলি ঘুরেছি। তাই কনফিডেন্টলি এগিয়ে যাই। 
ছেলে-মেয়ে আমাদের দেখতে পেয়েই অক্সিজেন পেয়ে যায় । মনের আনন্দে সমস্ত বাহিনীর সঙ্গে মিলিত হই । তারা আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিল, সকলে মিলে প্ল্যাটফর্মে যাই । ট্রেন দাঁড়িয়ে রয়েছে । সমস্ত দরজা-জানালা বন্ধ , কিছুক্ষণ পরেই খুলে দেবে । সবাই ফুল এনার্জি নিয়ে টগবগ করে ফুটছে। বিভিন্ন বয়সী ছেলে-মেয়ে লোকজন রয়েছে। অনেকে স্টেশনের মেঝেতে পেপার বিছিয়ে বসে খাওয়া দাওয়া শুরু করে দিয়েছে । আমিও মায়ের কর্তব্য একটু পালন করে নিই। নাহ্ পনীরের তরকারি অক্ষত ই আছে । মিডল ও আপার বার্থ এর অধিকারী হয়ে খাওয়া দাওয়ার অসুবিধা হতে পারে । তাই সেরে নিই । উৎসাহী জনতা ধীরে ধীরে ট্রেনের দরজা-জানালা খুলতে শুরু করে দেয় । দু-একজন ছিটকে এধার ওধার চলে গেছে, বাকি সবার সীট একটা বগিতেই।


Post a Comment

0 Comments