জ্বলদর্চি

মেদিনীপুরের কৃষিবিজ্ঞানী ড. রামচন্দ্র মণ্ডল-এর বর্ণময় জীবনের উত্থান-পতনের রোমহর্ষক কাহিনী/উপপর্ব — ১০ /পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী — ৭৫
এগ্রিকালচারাল রেটুনিং

মেদিনীপুরের কৃষিবিজ্ঞানী ড. রামচন্দ্র মণ্ডল-এর বর্ণময় জীবনের উত্থান-পতনের রোমহর্ষক কাহিনী
উপপর্ব — ১০

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা


'রাম, আমি তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে এসেছি' — আগন্তুকের পরনে খদ্দরের জামা কাপড়। চোখে মুখে স্বদেশীয়ানার ভাব স্পষ্ট। নিদ্রাতুর চোখে আবছা আলোয় আগন্তুককে প্রথম দেখে বোঝা না গেলেও এবার স্পষ্ট মনে পড়ল রামের। আগন্তুক আর কেউ নয়, ঝাড়গ্রাম কলেজের তাঁর একসময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাঁর সহপাঠীর আরও বক্তব্য —
'তোমাকে আমি খড়্গপুরের সন্নিকটে বলরামপুর গান্ধী আশ্রম নঈ তালিমীতে নিয়ে যাবো। সেখানে কুটির শিল্পে সাবান, তেল তৈরি, সুতাকাটা, খদ্দরের কাপড় বোনা ছাড়াও কৃষি ব্যবস্থায় জৈবিক পদ্ধতিতে শাকসবজি, উন্নত প্রথায় ধান চাষ হয়। ওই বেসিক ইন্সটিটিউটের কৃষি বিভাগের প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করার প্রস্তাব নিয়ে এসেছি।'
কথা ক'টা বলে একটু থামল সহপাঠী। ইতিমধ্যে ঘরের ভেতরে বসে দুজনের কথাবার্তা চলছিল। বাইরের অন্ধকার আকাশ এখন বেশ পরিষ্কার। দিনের প্রথম আলোয় ঝলমল করছে স্নিগ্ধ পৃথিবী। হাতে সময় খুব অল্প। তারই মধ্যে জলখাবার খেয়ে রাম পুরোপুরি তৈরি। মা বাবার চরণ স্পর্শ করল। তারপর পাড়ি দিল কর্মক্ষেত্রে। সঙ্গী পথ প্রদর্শক সহপাঠী।

এপ্রিল মাস। ১৯৫৭ সাল। আশ্রমে কাজে যোগ দিল রাম। বাইরে গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহ। মধ্যান্নে খর বায়ুর চোটে গরমে হাঁস ফাঁস অবস্থা। অথচ, আশ্রমের ভেতরটা বেশ শান্ত। হই হুল্লোড় নেই। ঝগড়া দ্বন্দ্ব নেই। প্রত্যেকে নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত। এ হেন শান্ত পরিবেশ রামের খুব পছন্দ। আশ্রমে তাঁর থাকার জন্য একটি কুটির বরাদ্দ হল। রুটিন মাফিক কাজ শুরু করল রাম। অল্প কয়েক দিনের মধ্যে আশ্রমের ভাবধারায় একাত্ম হয়ে গেল সে। তাঁর কাজকর্মে উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি ঘটতে শুরু করে ছয় মাসের মধ্যে। এ সময় হঠাৎ ছন্দপতন ঘটে! মাস ছয়েক পরে আশ্রমের বেসিক ইন্সটিটিউটে তাঁর কৃষি সংক্রান্ত কাজকর্মে নেমে আসে বিরতি। ইত্যবসরে তাঁর হাতে একখানা অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পৌঁছয়। আগ্রায় থাকাকালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কৃষি বিভাগের দুটি পদে চাকুরীর বিজ্ঞপ্তি বের হয়েছিল। একটা ছিল এগ্রিকালচারাল এক্সটেনশন অফিসারের (Agricultural Extension Officer বা AEO) পোস্ট। অপরটি রিসার্চ অফিসার। দুটি পদের জন্য আবেদন পত্র জমা দেয় রাম। তারপর ইন্টারভিউয়ের ডাক আসে। ইন্টারভিউয়ের পর সব চুপচাপ। এতকাল কোনো খোঁজ খবর ছিল না। সেও বেমালুম ভুলে গেছে। নঈ তালিমীতে মনপ্রাণ ঢেলে কাজ করে চলেছে। মনের মধ্যে সুপ্ত বাসনা কৃষিতে রিসার্চ করা। গবেষণার দ্বারা উন্নত প্রযুক্তির বীজ আবিষ্কার করা তাঁর লক্ষ্য। উন্নত ধরনের কৃষি পদ্ধতিও তাঁর নিশানায় ছিল। তাঁর সে সব আশায় জল ঢেলে দিয়ে AEO-এর অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পৌঁছে যায় তার হাতে। সেটা সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসের ঘটনা। অগত্যা AEO পদের জন্য চাকুরী জয়েন করে সে। প্রথম পোস্টিং বর্ধমান জেলায় কালনা থানার পাটুলি। নবদ্বীপের কাছাকাছি অপূর্ব সুন্দর জায়গা। 
        
গবেষণালব্ধ উন্নত প্রজাতির বীজ আর উৎকৃষ্ট কৃষি পদ্ধতির সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়ে গ্রাম পঞ্চায়েতে কৃষকদের ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি ঘটাতে রামের জুড়ি মেলা ভার। তাঁর কর্ম তৎপরতায় ব্লকের সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিক সন্তোষ মিত্র দারুণ খুশি। ব্লক স্তরের গুরুত্বপূর্ণ অধিকাংশ কাজের গুরুদায়িত্ব রামের উপর সঁপে দিয়ে তিনি নিশ্চিন্ত মনে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে গল্পে মশগুল থাকেন। রামের হয়েছে মহা জ্বালা! কৃষিতে উন্নত পরিকাঠামোর বড্ড অভাব পাটুলিতে। হাজার একটা সমস্যা। লিস্ট ধরে ধরে সব সমস্যার স্থায়ী সমাধান মেটাতে হবে। প্রথম কাজ দ্রুত পরিকাঠামো তৈরি। সেই পরিকাঠামো রূপায়ণে সঠিক ও চটজলদি পরিকল্পনা গ্রহণ আশু কর্তব্য। সর্বোপরি প্রয়োজন চাষীদের প্রথাগত কৃষি কাজে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করা। তৈরি হল তাঁর নিজের হাতে বানানো উন্নয়ন মুখী খসড়া। শুরু হল অন্যান্য বিভাগের পদস্থ অফিসারদের নিয়ে কৃষকদের মোটিভেট করে তোলা। এ কাজ দিনের বেলা অফিস সময়ে অসম্ভব। প্রথমত, সব অফিসার নিজের নিজের অফিসের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। অফিস সামলে দিনের বেলা সময় বের করা তাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতে হলে সন্ধ্যার সময় টুকু দারুণ উপযোগী। দ্বিতীয়ত, দিনের বেলায় চাষীরাও মাঠে নিজেদের কাজে ব্যস্ত থাকবে। মাঠ থেকে ঘরে ফিরতে ফিরতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে। তাই সন্ধ্যার সময় গ্রামে গ্রামে শুরু হল আলোচনা সভা। সভার মধ্যমণি অবশ্যই রাম। তাঁর তৎপরতায় কৃষকদের সমবেত করে কৃষিতে সার্বিক উন্নয়নের কথা ও প্রশ্নোত্তর পর্বের সূচনা হয়েছিল পাটুলি ব্লকে।

S.E.O., I.D.O., L.D.O., মুখ্য গ্রাম সেবিকা সবাই হাজির সেই গ্রাম্য আলোচনা সভায়। অফিসের কাজের শেষে শুরু হত সভা। A.E.O. রামবাবুর একজন বিশ্বস্ত পিওন ছিলেন কেষ্টবাবু ওরফে কৃষ্ণপ্রসাদ দাস। প্রবীণ। অত্যন্ত সম্মাননীয় মানুষ। স্থানীয় অধিবাসী। সেই সুবাদে এলাকায় গ্রামবাসীদের পরিস্থিতি তার নখদর্পণে। কালেভদ্রে বিডিও উপস্থিত থাকতেন। তিনি কখনও উৎসাহ দিতে কার্পণ্য করতেন না। পাটুলি ব্লকে তখন একটা মাত্র জিপ গাড়ি। বিডিও-র ব্যবহারের জন্য বরাদ্দ। এ হেন জিপটাও, বিডিও-র সম্মতিক্রমে, পরিবহনের জন্য গ্রাম সেবার কাজে লেগে গেল। বিভিন্ন অঞ্চলে থাকত একজন গ্রাম সেবক কিংবা গ্রাম সেবিকা। এলাকা ভিত্তিক তারা সভার স্থান নির্ধারণ করত। স্থান নির্বাচনের পরে গ্রামবাসীদের সভার খবর দেওয়া ছিল গ্রাম সেবক কিংবা গ্রাম সেবিকার কাজ। গোধূলির পড়ন্ত বেলায় অফিসাররা পৌঁছত আলোচনা সভায়। সভা শুরুর প্রাক্কালে S.E.O সুন্দর একখানা গান পরিবেশন করে সভার পরিবেশ জমজমাট করে তুলতেন। এ তো সভা নয়, ঠিক যেন জানা অজানার পাঠশালা। আলোচনার বিষয়বস্তু বিবিধ। গ্রামীণ পরিস্থিতি কেমন? কী কী সমস্যা? সব বিষয় নিয়ে চলত বৈঠকী আড্ডা। শুরু হত প্রশ্নোত্তর পর্ব। চাষীদের কাছ থেকে সমস্যা জানার পর সংশ্লিষ্ট অফিসার তাদের মূল্যবান বক্তব্য পেশ করত। কী করা যেতে পারে তার উপায় বাতলে দিত। সেসময় গ্রামোন্নয়নের জন্য সরকারের বিশেষ ঝোঁক ছিল। সরকারি চাটুকারিতা ছাড়াই বরাদ্দ হত অর্থ। সরাসরি লাভবান হত হাজার হাজার উপভোক্তা গ্রামের মানুষ।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
চাষবাসের ক্ষেত্রে রামের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উন্নত ধরনের কোন বীজ ব্যবহার করলে বেশি লাভবান হবে কৃষক? কৃষিতে কী কী জৈব অজৈব সার ব্যবহার করলে খরচ সাশ্রয় হবে, অথচ মাটির গুনগত মান অটুট থাকবে? কী উপায়ে শষ্যের রোগ কিংবা পোকা দমন করা যায়? সমস্ত বিষয়গুলো পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিতে চেষ্টার কসুর করত না রাম। অফিসারদের এমন সরাসরি জনসংযোগের ফল মিলল হাতেনাতে। চাষীরা লাভবান হতে শুরু করল অল্প দিনের মধ্যে। পাটুলি ব্লকের জনসচেতনতার কথা ছড়িয়ে পড়ল জেলার অন্যান্য অঞ্চলে। চারদিক থেকে ডাক আসতে শুরু করল। প্রায় প্রতিদিনই বারো মাস বসত সভা। বর্ষাকাল বাদে হরেক গ্রাম থেকে রামের ডাক পড়ত। রবিবার ছিল একমাত্র ছুটির দিন। সপ্তাহের শেষে এক চিলতে বিশ্রামের অবকাশ।

(২)
রেলস্টেশনের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট্ট এক নদী। নদী নয়, যেন খাল। পলি জমে জমে নদীর নাব্যতা শূন্যে ঠেকেছে। অথচ একসময় খরস্রোতা নদীর তকমা ছিল। বিশেষত বর্ষাকালে নদীর দুকূল ছাপিয়ে উপচে পড়ত জলরাশি। দুই পাড় উপচেপড়া বন্যার অপরিমিত ঘোলা জলে সংলগ্ন খাল বিল নালা টইটুম্বুর। পাটুলি তখন বন্যার আকার ধারণ করে। পাটুলি খালের পাড় ভেঙে অতিরিক্ত জল ঢুকে পড়ে পাশের ধান জমিতে। ধানক্ষেত জলে ডুবে প্রতি বছর ফসল নষ্ট হয়ে যায়। চাষীদের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। ভাগ্যের এ এক নিদারুণ পরিহাস!
       
সময়টা ছিল ১৯৫৮ সাল। বর্ষার মরশুম। আমন ধান চাষের সময়। সেবার একটানা বৃষ্টির জলে নদী খাল বিল থইথই। নদীতে হু হু করে বাড়ছে জলস্তর। যেকোনও সময় নদীর তীর ছাপিয়ে জল ঢুকে পড়বে সংলগ্ন খালে এবং সেখান থেকে ধানের ক্ষেতে। হাতে সময় বেশি নেই। খবরটা রামের কানে গেল। হন্তদন্ত হয়ে তিনি স্থানীয় আর পার্শ্ববর্তী গ্রামের লোকজনের কাছে কেষ্টবাবু মারফৎ খবর পাঠিয়ে ডাক দিলেন। দলে দলে মানুষ এগিয়ে এল। তাদের হাতে রয়েছে ঝুড়ি কোদাল কাটারি। সবাই কমবেশি বৃষ্টির জলে ভিজে সপসপ করছে। দলের আগে আগে হেঁটে চলেছেন ওদের সকলের প্রিয় রাম বাবু। খালের পাড়ে রয়েছে বিভিন্ন জাতের সরু-মোটা গাছপালা। সেগুলো বেশ ডালপালা ছড়িয়েছে। খাল যেখানে নদীর সঙ্গে মিশেছে, সেখানে খালপাড়ের কিছু গাছপালা কেটে খুঁটি পুঁতে দেওয়া হল। খুঁটিগুলোর সম্মুখে গাছের ডালপালা ফেলে মাটি দিয়ে কৃত্রিম বাঁধ তৈরি করা হল। ফলে খাল দিয়ে জল ঢোকা বন্ধ হয়ে গেল। এ এক বিরাট সাফল্য। সবার মনে সে কী আনন্দ! বিগত বছরগুলো প্রসাশনের তরফে কোনো অফিসার দাঁড়িয়ে থেকে এভাবে জনহিতকর কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েনি। স্বভাবতই সেটাই সবার আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজেদের মধ্যে সেকথা বলতে বলতে সবাই বাড়ি ফিরে গেল। কিন্তু খরস্রোতা নদীর জল তখনও বিপদ সীমার উর্দ্ধে বইতে শুরু করেছে। নদীর পাড় উপচে জল ঢুকে পড়ছে মাঠে। অল্প কিছু ক্ষণের মধ্যে অন্ধকার নামবে। রাতের অন্ধকারে হয়তো জলের গতি রোধ করা সম্ভব হবে না। তাঁর সে কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল। সারা রাত জল ঢুকে ধানের ক্ষেতগুলো সব একেকটা জলাধারে পরিণত হয়েছে। ভোরের আলো ফুটতেই দেখা গেল সর্বত্র জলমগ্ন। সাদা ধূ ধূ করছে মাঠের পর মাঠ। রেলস্টেশনে যাওয়ার রাস্তায় হাঁটু অব্দি জল। প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করে সাধ্যি কার! কিন্তু প্রসাশনিক লেভেলে আগে থেকে ব্যবস্থা নিলে হয়তো এত ক্ষতি এড়ানো যেত! এ রামের দৃঢ় বিশ্বাস। আসলে তাঁর ভেতরে একটা স্বাধীনচেতা মুক্ত মন রয়েছে, যে অন্যের বিপদে দুর্দিনে ঝাঁপিয়ে পড়তে দ্বিধা বোধ করে না। আবার, অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে অনায়াসে। চাটুকারিতা তাঁর ধাতে নেই। একসময় সর্বস্তরের সরকারি অব্যবস্থার বিরুদ্ধে গর্জে উঠল তাঁর কণ্ঠস্বর। উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে মৌখিক নালিশ জানাতে তিনি দ্বিধাহীন। এ হেন প্রতিবাদের অবশ্যম্ভাবী ফল কতটা মারাত্মক হতে পারে? কতখানি বিপদ নেমে আসতে পারে তাঁর চাকুরী জীবনে? প্রসাশনের চোখে চোখ রেখে অন্যায়ের কথা তুলে ধরতে দম লাগে। কিন্তু তারপর? (ক্রমশ...)

তথ্য সূত্র :
• প্রণম্য বৈজ্ঞানিক ড. রামচন্দ্র মণ্ডল মহাশয়
• শ্রী সুদর্শন সেন বিশিষ্ট শিক্ষক ও আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক
• 'মনীষী ড. রামচন্দ্র মণ্ডল' – সম্পাদনা শ্রী জয়দেব মাইতি ও শ্রী সুব্রতকুমার মাঝি

Post a Comment

0 Comments