জ্বলদর্চি

সুভাষ মুখোপাধ্যায় // ঈশিতা ভাদুড়ী

স্মৃতি ডট কম ১৭
সুভাষ মুখোপাধ্যায় // ঈশিতা ভাদুড়ী


ফুলগুলো সরিয়ে নাও, / আমার লাগছে। / মালা/ জমে জমে পাহাড় হয়/ ফুল / জমতে জমতে পাথর।/ পাথর সরিয়ে নাও / আমার লাগছে… - বিংশ শতাব্দীর উল্লেখযোগ্য বাঙালি কবি ও গদ্যকার সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে আমি পড়েছি প্রথম ১৯৭৭ বা ১৯৭৮ সালে। 

সেইসময়ে যে দুটির প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল আমার বেড়ে ওঠায় সেই দুটি হলো বালিগঞ্জ ইন্সটিট্যুট লাইব্রেরী আর আইডিয়াল বুক স্টোর, দুটোই গড়িয়াহাটে। বাড়িতে স্থানাভাবের কারণে দিদিমা কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর পুরো বইয়ের ভাণ্ডার বালিগঞ্জ ইন্সটিট্যুট লাইব্রেরীকে দিয়ে দিয়েছিলেন, এবং আজীবন সদস্য ছিলেন সেই লাইব্রেরীর। আমি ওই সদস্যকার্ডে প্রতি একদিন অন্তর বিকেলবেলায় একটি করে বই নিয়ে আসতাম। আমার দিদিমার খুব পড়ার অভ্যেস ছিল। ওই লাইব্রেরীতে বসে বইও পড়া যেতো। আমি সেখানে বসে অনেক কবিতার বই পড়েছি। সেই লাইব্রেরি নতুন দরজা খুলে দিয়েছিল আমার সামনে। আর, আইডিয়াল বুক স্টোরে দাঁড়িয়ে কত যে কবিতার বই পড়েছি ভাবা যায় না। সেই বইয়ের দোকানেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই একে একে বিভিন্ন কবিকে কিন্তু আমি চিনেছিলাম। রক্তের মধ্যে কবিতার শিরশিরানি ওই আইডিয়াল বুক স্টোর থেকেই…
গড়িয়াহাটে আইডিয়াল বুক স্টলে দাঁড়িয়েই আমি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে চিনেছিলাম। তাঁর একের পর এক বই পড়েছি। তাঁকে যখন পড়ছি আমি, তাঁর বহু আগেই তিনি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পেয়ে গেছেন, অ্যাফ্রো এশিয়ান লোটাস পুরস্কার পেয়ে গেছেন। সেই সময় পুরস্কার শব্দটি খুব মহার্ঘ্য ছিল।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মূল লেখা পড়ার আগে তাঁর অনুবাদ আমি প্রথম পড়েছি, নাজিম হিকমতের কবিতা, পাবলো নেরুদার কবিতাগুচ্ছ। পরে তাঁর মূল লেখাগুলি একে একে পাঠ করেছি। কবিতা তাঁর প্রধান সাহিত্যক্ষেত্র হলেও ছড়া, ভ্রমণসাহিত্য, অর্থনীতিমূলক রচনা, বিদেশি গ্রন্থের অনুবাদ, কবিতা সম্পর্কিত আলোচনা, উপন্যাস, জীবনী, শিশু ও কিশোর সাহিত্য সবরকম লেখাতেই যে তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন, খুব দ্রুত বোধগম্য হয়ে গেল আমার।

 তাঁর লেখা সবচেয়ে বেশি আমাকে টেনেছিল এইজন্যে যে সহজেই তার কবিতা পড়া যায়, বোঝা যায় এবং অনুভব করা যায়, তিনি দুর্বোধ্য নন। প্রচলিত ছন্দের বন্ধন ছিন্ন করে নতুন ভাবে তিনি কবিতা লিখেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘লেনিন যেন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বললেন,/ শতাব্দী শেষ হয়ে আসছে—/ একটু পা চালিয়ে, ভাই, একটু পা চালিয়ে…’
তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘পদাতিক’ যে বাংলা কবিতার জগতে নতুন ধারা প্রবর্তন করেছিল, এই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এই ‘পদাতিক’কে নিয়ে বুদ্ধদেব বসু তাঁর 'কবিতা’ পত্রিকায় প্রায় ১৭ পাতা ধরেএকটি আশ্চর্য সমালোচনা লিখেছিলেন। লিখেছিলেন,“দশ বছর আগে বাংলার তরুণতম কবি ছিলাম আমি। কিন্তু ‘ঊর্বশী ও আর্টেমিস’ বেরোনোর পর থেকে সে-সম্মান হলো বিষ্ণু দে-র ভাগ্যে, যতদিন না সমর সেন দেখা দিলেন তাঁর কয়েকটি কবিতা নিয়ে। সম্প্রতি এই ঈর্ষণীয় আসন সমর সেনেরও বেদখল হয়েছে, বাংলার তরুণতম কবি এখন সুভাষ মুখোপাধ্যায়।” বুদ্ধদেব বসু তাঁর প্রবন্ধে প্রশ্ন রাখেন, “এ-কবির ভবিষ্যৎ আমাদের সকলের আশার স্থল। ‘পদাতিক’-এর দুটি দিকই আমি দেখেছি প্রথমে সরল, চড়া গলার কবিতা, ‘গণ’-কবিতা হবার যা দাবী রাখে, অন্যদিকে জটিল আঙ্গিকের সংস্কৃতিবান কবিতা। দু’দিক বজায় রাখা চলবে না, একদিক ছাড়তে হবে। কবি কোন দিক ছাড়বেন?”

সুভাষ মুখোপাধ্যায়-এর কবিতার ভাষা ছিল আড়ম্বরহীন। সেই ভাষাতেই তিনি মানুষের শোষণ মুক্তির জন্য কবিতা লিখে গেছেন। তিনি আশাবাদী ছিলেন, তাই দুঃখ, বেদনা ও অপরিসীম নৈরাশ্যে ভারাক্রান্ত হয়েও তিনি রাতের গভীর বৃন্ত থেকে ছিঁড়ে আনা সকালের প্রত্যাশা করেছেন বারবার। তাই তো তাঁর কলম লিখেছে - ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক / আজ বসন্ত।/ শান-বাঁধানো ফুটপাথে / পাথরে পা ডুবিয়ে এক কাঠখোট্টা গাছ / কচি কচি পাতায় পাঁজর ফাটিয়ে / হাসছে। / ফুল ফুটুক না ফুটুক / আজ বসন্ত। / আলোর চোখে কালো ঠুলি পরিয়ে / তারপর খুলে – / মৃত্যুর কোলে মানুষকে শুইয়ে / দিয়ে / তারপর তুলে – /যে দিনগুলো রাস্তা দিয়ে চলে গেছে /যেন না ফেরে…’
তিনি তরুণদের বই খুব মনোযোগ সহকারে পড়তেন। আমার মনে আছে, ডক্টর নলিন প্যাটেল বাংলা কবিতার ওপর কাজ করছিলেন, বাংলা থেকে গুজরাটিতে অনুবাদ করে একটি সংকলন প্রকাশ করেছিলেন। আমি তখন তত কিছু লিখতাম না, কিন্তু সেই স্বল্প লেখাও সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের দৃষ্টি এড়ায়নি। তিনি ডক্টর প্যাটেলকে আমার নাম দিয়েছিলেন আমার কবিতা সংকলনভুক্ত করার জন্যে।

অল্পস্বল্প লিখছি তখন, সেই সময় একদিন সন্ধেবেলা সাংস্কৃতিক খবর পত্রিকার সম্পাদক কাজল চক্রবর্তী আমাদের বাড়িতে এসে হাজির, বলল ‘চলো সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি যাব’। বলা বাহুল্য তৎক্ষণাৎ এক লাফে বেরিয়ে পড়লাম কাজলের সঙ্গে। ৫বি, শরৎ ব্যানার্জি রোডে ছিল তাঁর বাড়ি, আমাদের বাড়ি থেকে কাছেই। তিনি চৌকিতে বসে ছিলেন, চার দিকে বই ছড়ানো, ঘরের অন্য দিকে বইয়ের তাকে সারি সারি বই। আমরাও তাঁর পাশে চৌকিতে বসেছিলাম। তখন খুব লোডশেডিং হত। যতক্ষণ তাঁর ঘরে ছিলাম, পুরো সময়টাই অন্ধকার। হ্যারিকেনের আলোয় সুপুরুষ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মুখে এমন প্রভা ছড়িয়ে পড়েছিল, আজও আমার মনে আছে। তিনি সেই আলো-অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে নির্মোহ ভাবে বলতে পেরেছিলেন, ‘আমাকে কেউ কবি বলুক/ আমি চাই না।/ কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে/ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত/ যেন আমি হেঁটে যাই।’

জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇




Post a Comment

0 Comments