জ্বলদর্চি

প্রতিবিম্ব /স্বপন কুমার দে

প্রতিবিম্ব

স্বপন কুমার দে

সাত সকালে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে শ্বশুরের ঘরে ঢুকে দেখল, শ্বশুরমশাই তখনও ঘুমোচ্ছেন।ঘড়িতে সাড়ে ছ'টা বাজে।অন্যান্য দিন ভোরে ঘুম থেকে উঠেই প্রাতঃকর্ম সেরে এক কাপ গরম গরম চায়ের জন্য অপেক্ষা করেন। কিন্ত আজ কী হল?
"বাবা,আপনার কি শরীর খারাপ?"
ঘুম ভাঙে সতীশবাবুর। চোখে চশমা নিয়ে চেয়ে দেখেন বড় বৌমা চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে।জানালা দিয়ে সূর্যের আলো ঘরের ভেতর ঢুকে পড়েছে।
"বৌমা, তুমি বরং চা'টা এখন নিয়ে যাও।আমি কাজ সেরে খাওয়ার টেবিলে আসছি।তখন বরং চা'টা একটু গরম করে দেবে।"

বাথরুম সেরে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসতেই পূর্ব নির্দেশ মতো বড় বৌমা গরম চা,বিস্কুট নিয়ে এল।ছোটবৌমা তখনও ঘুম থেকে উঠেনি।একটু দেরিতে ঘুম থেকে ওঠা তার অভ্যাস। এজন্য অবশ্য তাকে কারো কাছে কৈফিয়ত দিতে হয় না।প্রাইভেট সেক্টরে চাকরি করলেও মাসের শেষে মোটা বেতন পায়।তার একটা অংশ সংসারে লাগে। তাছাড়া তাদের কাজের চাপ বেশি থাকায় প্রায়দিনই অফিস থেকে ফিরতে দেরি হয়।

চা খাওয়া শেষ হতেই বাজারের একটা লম্বা ফর্দ আর দু'খানা ব্যাগ শ্বশুরের হাতে গুঁজে দিয়ে দীপা বলল,"বাবা,আজ আমার বাবা,মা এখানে আসবে। বেশ ভালো দেখে কাতলা মাছ আর টাটকা সব্জি নিয়ে আসবেন।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
সতীশবাবু জানেন, টাকাটা কোথা থেকে আসবে?তাই, কথা না বাড়িয়ে ব্যাগগুলো নিয়ে সোজা নিজের ঘরে ঢুকে যান। আলমারি খুলে পেনশনের জমানো টাকা থেকে দু'হাজার টাকা বের করে বাজারে বেরিয়ে পড়েন। বড় বৌমার বাবা-মা আসবেন, তিনি আগে জানতেন না।হয়তো আজও জানতেন না,যদি না তাঁকে বাজারে যেতে হত।এখন সংসারের অনেক কিছুই তিনি জানেন না।তাঁকে জানানো হয় না।আবার তাঁর ব্যাপারেও বাড়ির কেউ খুব একটা খোঁজ রাখে না।যেমন গতকালই ছিল তাঁর জন্মদিন। কিন্ত, কারোরই সে কথা মনে ছিল না।আসলে,মনে করানোর মানুষটাই তো নেই।" মনোরমা যদি আজ বেঁচে থাকতো....।" একটা চেপে রাখা দীর্ঘশ্বাস বুকের পাঁজরগুলো নাড়িয়ে দিয়ে বেরিয়ে আসে।

বাজারে পৌঁছেই প্রথমেই চলে যান মাছ পট্টির দিকে।পাশাপাশি শম্ভু আর অমর লোকাল মাছ নিয়ে বসে।সতীশবাবু এদের নিয়মিত খদ্দের। সামনে আসতেই শম্ভু বলল,"স্যার, একটা বড় দেখে কাতলা দেবো নাকি?"সতীশবাবু সম্মতি দিতেই শম্ভু একটা মাছ ওজন করে দেখল দু'কেজি তিনশো তিরিশ গ্রাম। সেখান থেকে মাছ নিয়ে গেলেন সব্জি বাজারে।ব্যাগ ভর্তি বাজার নিয়ে ন'টা নাগাদ বাড়ি পৌঁছলেন।

বাড়িতে তখন চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা।এখনো রান্না হয়নি শুনে ছোট বৌমা রেগে অগ্নিশর্মা। তাকে দশটায় অফিস পৌঁছাতে হয়।এখন তো তাকে না খেয়েই যেতে হবে।ছোট ছেলেও বৌয়ের পাশে দাঁড়ায়,"বাবা তো একটু সকাল সকাল উঠতে পারে।এতটুকু রেশপনসিবিলিটি যদি থাকে।তাহলে সংসারের জন্য আমরাই বা এতটা ডেডিকেট করবো কেন?"

বড়বৌমা এ সব কথায় কান না দিয়ে শ্বশুরের হাত থেকে বাজারের ব্যাগগুলো নিয়ে কাজের মাসির হাতে দেয়। বলে দেয়, কী কী তরকারি করতে হবে।তার স্বামী আজ অফিস ছুটি নিয়েছে।কতদিন পরে বাবা-মা আসছে,তাই জামাইয়েরও আজ অফিস কামাই।

বুড়োকে নিয়ে এ সংসারে কারো মাথাব্যথা নেই। কাজের মেয়ে গোপালের মা তাঁর জন্য পেঁয়াজ মুড়ি এনে দিলে তাই খেয়ে তিনি নিজের ঘরে গেলেন। বাইরের জামাকাপড় খুলে রেখে ঘরে পরবার পোষাক পরে চেয়ারে বসে খবরের কাগজে চোখ বদলাতে থাকেন।

আজকাল সংসারে তাঁর অবস্থানটা ঠিক কোথায় তা তিনি নিজেও বুঝে উঠতে পারেন না। মূলতঃ এটা ভেবে ভেবেই কাল অনেক রাত পর্যন্ত তাঁর ঘুম হয়নি।বাবার জন্ম তারিখটা তো ছেলে-বৌমাদের অজানা নয়।তাদের মা বেঁচে থাকতে তো বেশ ভালোভাবেই পালন করা হত।সকালে বাড়িতে পুজো,দুপুরে ঘরোয়া রান্না সহযোগে পায়েস খাওয়া,বিকেলে বাবার বন্ধুরা এলে হৈ চৈ।মনোরমার মৃত্যুর পর সব কোথায় গেল?

দুপুরের মেনুটা খুব ভালো,কিন্ত তাঁকে সব কটা পদ দেওয়া হয়নি।সেটা অবশ্য তাঁর শরীরের কথা ভেবেই। খাওয়ার টেবিলে বসে বড় বৌমার বাবার সাথে দু'চারটে কথা হল। অখিলেশবাবু বড় ব্যবসায়ী ।তিন চারটে বড় বড় ব্যবসা। তিন ছেলেই সেগুলো সামলাচ্ছে। দীপা তাঁর বড় মেয়ে ।ছোটর বিয়ে হয়েছে আসানসোলে।কাজের চাপে মেয়েদের বাড়ি খুব একটা যাওয়া হয়না।এবারে মেয়ের আবদারে আর না এসে পারলেন না।কিন্ত সন্ধের আগে তাঁকে ফিরে যেতে হবে।নিখিলেশবাবু সতীশবাবুর শরীরের খোঁজ খবর নিলেন। তারপর মেয়ের রান্না আর আতিথ্যের প্রশংসায় পঞ্চুমুখ হয়ে উঠলেন।

বিকেলে আর একবার চা-জলখাবার খেয়ে সন্ধের আগেই বিদায় নিলেন। ক্লান্ত শরীরে বড় বৌমা ঘোষণা করে দিল, আজ সন্ধ্যায় আর রান্না হবে না।গোপালের মাও শরীর খারাপ বলে বাড়ি চলে গেছে।কাজেই দীপাও আর পারবেনা এতজনের রান্না করতে।দুপুরের বাড়তি যা আছে তাই দিয়ে তাদের চলে যাবে।ছোট ছেলেবৌমাও আজ বাইরে বন্ধুর বাড়িতে খাবে বলে জানা ছিল। কাজেই তাদের তরফেও কোনও আপত্তি নেই।

কিন্ত বৃদ্ধ সতীশবাবু? তিনি কী করবেন? দুপুরের রান্না করা খাবার তাঁর হজম হবে না।কাজেই হয় উপোস নয়তো পেঁয়াজ মুড়ি।তিনি দ্বিতীয়টাকেই বেছে নিলেন।

বুকের ভেতরটা কেমন যেন হাহাকার করে উঠল।"আজ যদি মনোরমা বেঁচে থাকতো....।"রাত্রে বিছানায় শুয়ে শুয়ে অনেকক্ষণ চিন্তা করলেন। জীবনের সাঁইত্রিশটা বছর একসঙ্গে কাটিয়েছেন। কোনোদিন তাঁকে রাতে মুড়ি খেয়ে থাকতে দেননি।গরম ভাত  কিম্বা রুটি করে খাইয়েছেন। এমন অনেক বার হয়েছে যখন মনোরমা খুবই ক্লান্ত বা অসুস্থ তখনও সে ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়নি। আর এখন.....।তাঁর জন্মদিনে কেউ একটা শুভেচ্ছাও জানাল না।বড়লোক আত্মীয়ের কাছেও নিজেকে কেমন যেন ছোট মনে হল। মৃত্যু তো এতটা বেদনার নয়।সে তো নিঃশব্দে আসে।কিন্ত দিনে দিনে এই যে অবহেলা--অবাঞ্ছিত একজন হয়ে বেঁচে থাকা --এটাই তো মৃত্যু যন্ত্রণা।তাহলে আর অপেক্ষা কিসের জন্য?

ঘরের দরজায় ঠক্ ঠক্ শব্দ শুনে দরজা খুললেন।দেখলেন, সাত বছরের ছোট্ট নাতনি রিশা দাঁড়িয়ে আছে।বড় ছেলের মেয়ে। "দাদু,তুমি এখনও ঘুমাও নি? আমি ভাবলাম, তুমি ঘুমিয়ে গেছো।এই নাও তোমার জলের বোতল। তুমি এটা ডাইনিং টেবিলে ফেলে এসেছো দেখেই দিতে এলাম। "

দাদুর দু'চোখ জলে ভরে এল।পরম যত্নে জলের বোতলটি নিয়ে নাতনির দিকে চেয়ে রইলেন।
"কিন্ত দিদিভাই, তুমি যে আমার কাছে এসেছো,তোমার বাবা-মা জানে?"
তখনই ওদিক থেকে চিৎকার, "রিশা!রিশা! কোথায় যায় যে মেয়েটা?"
"দাদু,আসছি"। বলেই দৌড় দেয় রিশা।
দাদু অনেকক্ষণ অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। কী করবেন, বুঝতে পারলেন না। তাঁর স্ত্রীর ছবিটার দিকে চেয়ে রইলেন।খুশির একটা আবেশ বয়ে গেল তাঁর চোখে-মুখে।

Post a Comment

0 Comments